গল্প - শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত নিয়োগী



মায়া

 

#

" তাতা-আ-আ-আ-ন , তাতান আমার হাতটা ছাড়িস না ,বাবু পড়ে যাবি ৷ ডানদিকে তাকিয়ে দ্যাখ-- কী গভীর খাদ, হাত ছাড়েনা সোনা --বারবার বলছি তো,কথা শোনো ,উফ্ আমি কি পারি তোর সাথে জোরে ছুটতে !! 
আরে --আরে ,শুনছ ,
কি গো ,তুমি কোথায় ?শোনো না ....দ্যাখো.... তাতান আমার হাতটা ছেড়ে দৌড় দিল-- তুমি কোথায় ???? তা...তা...আ...ন৷" 
 
"দিদিভাই ,
কি হল ,দিদিভাই ,জল খাবে? ও দিদিভাই ৷ 
দাদাভাই --তাড়াতাড়ি এ ঘরে এসো না ,দিদিভাই কিসব বলছে দ্যাখো--- ও দিদিভাই চোখ খোলো ,এই তো সবাই আছি আমরা ,তাকাও ৷"  

"ওকে জাগিয়েই বা কি করবে ঝুমি ,ওর জীবনের ছায়াই তো ও ঘুমের ঘোরে দেখছে৷ থাক ,নিজেই ঠিক হয়ে যাবে৷ ডক্টর তো বলেই দিয়েছেন যে ,ট্রমা থেকে বের হতে সময় লাগবে৷ তাতানের চলে যাওয়াটাকেই অন্যভাবে স্বপ্নে দেখছে৷ তোমার দিদিভাইকে জাগিও না৷ তুমি ওঘরে গিয়ে শুয়ে পড় ,কাল  তোমার অফিস আছে , এতদিন তো বিশাখাকে সামলাতে গিয়ে আর অফিসেই যেতে পারনি ৷ যাও ঝুমি , এদিকটা আমি সামলে নেব৷" 

"সত্যি তাতানটা কেন যে এভাবে অকালে চলে গেল ! কত মরনাপন্ন রোগী কাতরাচ্ছে ,মৃত্যু যন্ত্রণায় তিলে তিলে মরছে, তবু তাদের প্রাণ আছে আর ঠাকুর ফুলের মতো তরতাজা ছেলেটাকেই নিজের কাছে টেনে নিলেন !!! ভাবলেই শরীরটা অবশ হয়ে যায় ৷
এত যে ঈশ্বর-ভক্তি দিদিভাইয়ের !! সারাদিন উপোস করে খালি  এ পূজো আর সে পূজো --আমি বারণ করলে বলতো --
"একদিন বুঝবি ঝুমি , স্বামী-সন্তান-পরিবারের  মঙ্গল কামনার চেয়ে আর  বড় কিছু নেই রে৷ "

".......তা কি করলেন তোমার ঠাকুর ? তোমার কোলটাই তো শূন্য করে দিলেন ,এমন পূজোর আমার দরকার নেই ...."  
দুচোখের জল মুছতে মুছতে ঝুমি ছোটনের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল৷ 

ছোটন বলল ,"মাত্র দিন ২০ হল তাতান চলে গেছে ,বৌমণি কী এ জ্বালা এত তাড়াতাড়ি সহজে ভুলতে পারবে  বল তো !সারাটা জীবন এ যন্ত্রণা বয়ে চলতে হবে--- হায় ,ঈশ্বর ,কী নিষ্ঠুর বিচার তোমার ৷" 
 
#২

তিনমাস হল আজ সেই অভিশপ্ত দিনটার ,বাবুয়া 
সন্ধ্যেবেলা ছোটনকে নিয়ে গেল সেখানে --ঠিক তিনমাস আগে দুরন্ত লড়িটা যেখানে পিষে দিয়েছিল তাতানের নরম শরীরটাকে৷ টিউশন থেকে ফেরার পথে ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে যখন বাসে ওঠার জন্য রাস্তা পার হচ্ছিল, তখনই রাক্ষসটা খেয়ে নিল ছেলেটাকে ৷ স্থানীয় লোকজন,দোকানদারেরা ছিটকে যাওয়া ওর ব্যাগ থেকে কিপ্য৷ড মোবাইলটা বের করেই ফোনে ধরল বাবুয়াকে ৷ উফ্,,না ---আর ভাবতে পারছেনা বাবুয়া ৷ ছোটনকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল , কান্নার সাথে বিড়বিড় করে বলল-- "পাপা রে ,আমার সোনা পাপা , আমাকে ছেড়ে চলে গেলি !! ফুটফুটে তোর শরীরটাকে রক্তের পিন্ড বানাল ,রাক্ষসটা ৷তোর কত কষ্ট হল,পাপাকে ডাকলিও না ,একবার৷ আর অন্যসময় একটু হাত কাটলেই দৌড়ে পাপার কাছে ওষুধ লাগাতে আসতিস ৷ সেদিন এলিনা কেন রে তাতান ,বাবা আমার৷" 

"চল রে দাদাভাই ,বৌমণির শরীর ভালো না ,চিন্তা করবে৷ মা-বাপিরও প্রেসার খুব বেড়ে আছে ৷ নিজেকে সামলে নে রে,বৌমণিকে তো দেখতে হবে৷ "

#৩

  ".....ছোটন শোন --- ছোটমাকে ৭ মাসের সাধটা হলে বাপের বাড়িতে রেখে আয়৷বড়মা এখন একটু একটু করে সুস্থ হচ্ছে ,ছোটমা'র সাথেও মাঝে মাঝে দু'একটা কথা বলে ,ওকে ওষুধ খাওয়ার কথাও মনে করায় ,দু চোখ দিয়ে নীরবে ওর খেয়াল রাখে৷ কিন্তু দেড় বছর পার হলেও ,সন্তান হারা মা তো , মাঝে মাঝেই হাউ হাউ করে কাঁদে ,ঠাকুর ঘরে মাথা ঠোকে৷ সান্ত্বনাই বা কী দেব বলতো,কী বোঝাব !! আমি তো পাথর হয়ে আছি ,তোর বাবাও হা হুতাশ করে,সবটা মুখ বুজে সহ্য করি বড়মার কথা ভেবে৷ এখন ছোটমা'র মনটা তো একটু ভালো রাখা দরকার , ও তো বড়মাকে নিজের দিদির  মতোই ভালোবাসে ,তাই বড়মা'র যন্ত্রণাটা ওর পক্ষেও মেনে নেওয়া খুব চাপের রে ,স্পেশালি এমন সময়ে ৷ ওকে এখন একটু এই বাড়ি থেকে দূরে রাখাই ভালো "
       দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছোটনের  ছোট্ট উত্তর ,"হ্যাঁ মা ,সাধটা হলে ঝুমিকে রেখে আসব ও বাড়িতে ,তুমি ওর মা'কে বলে রেখো ৷"

আড়াইমাস পেরিয়ে গেল  নিজের তালে  ....
বুদ্ধ পূর্ণিমার শুভক্ষণে নার্সিংহোম  থেকে ঝুমির ছেলে হওয়ার খবর দিয়ে  বাবুয়া মা'কে ফোনে বলল , "মা আজ আমাদের বাড়িতে আবার উলু দাও , শঙ্খ বাজাও ৷ জানো মা ,বিশাখা আমাদের নতুন সোনাকে কোলে তুলে নিয়েছে ,ওর সাথে কত কথা বলছে আপন মনে ৷ কত দিন পরে ওর মুখে হাসি ফুটেছে মা৷ভাগ্য ভালো তুমি জোর করে ওকে এখানে পাঠিয়েছিলে ৷" 

"ওর তাতানের গন্ধ ,ছোঁয়া পাচ্ছে রে বাবুয়া.....দে ওকে মন খুলে দেখতে দে ,কথা বলতে দে ৷ 
তা ,তিনি কার মতো দেখতে হয়েছেন রে?" 

"অনেকটা বিশাখার মুখের আদল গো মা,
ছোটনটা তো বেজায় খুশি আর ঝুমি ওর দিদিভাইকে দেখেই খুশি৷ 

"হ্যাঁ রে ,ছোটমা ঠিক আছে তো !!
" মা ,শি ইজ পারফেক্টলি ,অলরাইট"৷

চারদিনের মাথায় বাড়ির সামনে গাড়ি এসে থামল৷ কতদিন পরে বোসবাবু হাসিমুখে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আর পাড়ার লোকদের কাছে জোরে জোরে, আনন্দে ছোটনের বাবা হওয়ার খবরটা দিচ্ছেন৷ পাড়ার মানুষদের মনও যেন আজ হাল্কা --স্বস্তির হাসি তাদেরও মুখে ৷ 
গাড়ি থেকে  ঝুমিকে ধরে ছোটন নামাচ্ছে ,বাবুয়া বহুদিন বাদে আজ ড্রাইভ করেছে ৷ঝুমির বাবাও নামলেন সামনের সিট থেকে আর তারপর নতুন অতিথিকে নিয়ে ঝুমির মা৷ সবাই আসছে ওপরে ৷ 

"বড়মা .....,ও বড়মা ,ওরা এসে গেছে ,তুমি এসো ,বরণ করবে৷"
মা'র  ডাকাডাকিতে ঘরে ঢুকে চারিদিকে তাকিয়ে 
বাবুয়া এসে দেখে, বিশাখা ঠাকুর ঘরে অপলকে চেয়ে আছে ঠাকুরের দিকে , ওকে ডাকতেই বলল --
"না গো সবাই ওকে বরণ করে আনুক ,আমি না হয় পরে কোলে নেব----আমি তো শূণ্য৷" 
"আহা ,বিশাখা --আজ চোখের জল ফেলোনা , ঝুমি দেখলে কি ভাববে বলতো !তুমি তো নার্সিংহোমে সেদিন ওকে কোলে নিয়ে কতো খুশি ছিলে তাহলে  আজ এমন করোনা, প্লিজ৷ মনটাকে শক্ত করো৷ "
      "না না এমন বলোনা , আমি তো খুউউউব খুশি গো ,তাই তো ওর পথ চেয়ে ঠাকুর ঘরে বসে অপেক্ষায় ছিলাম ,ওর মঙ্গল কামনা করছিলাম ৷ শুধু ওর শুভকাজে আমি থাকতে চাইনা ,অজান্তে যদি আমার দীর্ঘশ্বাস পড়ে ওর ওপর ,তা আমি চাইনা....... "

ওদের কথা থামার আগেই ঝুমি এসে বলল --
       " দিদিভাই আমি তো ঠাকুর ঘরে পা রাখতে পারব না ,কিন্তু তুমি ওখান থেকে বেরিয়ে এসে আগে তোমার ছেলেটাকে কোলে নাও তো ৷ আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসি ,ওকে দুধ  খাওয়ানোর সময় হয়ে গেছে৷ আর তোমার তো এখন অনেক কাজ ৷ ডিসচার্জের সময় যা যা বলেছে সব বুঝে নিতে হবে তোমায় ৷চোখের জলের আর এন্ট্রি নেই এ বাড়িতে৷ 
আমিও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলাম তোমার ঠাকুরকে---আমাদের তাতানকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য৷ 
তোমার ঠাকুরই জিতে গেছেন গো দিদিভাই .....দেখো তোমার মতো টুলটুলে মুখখানাই পেয়েছে তোমার তাতান ৷ ধরো ,ধরো,ধরো -- এখন তোমার অনেক দায়িত্ব আর আমার বিশ্রাম , হা -হা -হা৷
ওর সব দায়িত্ব কিন্তু তোমার ৷ আমার কিছুদিন পর থেকে শুধু অফিস-বাড়ি-শপিং আর সময় করে তোমার সাথে আড্ডা, এই ছুটিটা তাতানকে নিয়েই দিব্যি কাটবে আমাদের ,কি বল৷"

চোখ বেয়ে আনন্দের বাঁধভাঙা জল গড়িয়ে পড়ল বিশাখার আর বোস বাড়ির সকলের মুখে ফিরে এল স্বস্তির হাসি৷ মা মানেই যে "মায়া"৷

Comments