
গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা: মেধা ও অনুভূতি
'বন্ধ দরজার সামনে রোজ রাতে দাঁড়ায় তিনজন
সমস্ত বাড়িটা ঘুমে, অন্ধকার নামে
কার্নিসে চোঁয়ায় বৃষ্টি বটচারা দুরন্ত বাতাস
নিথর কপাটে হাত, রোজ রাতে তারা তিনবোন।
দেওয়ালে অস্পষ্ট নোনা, কোণে কোণে কাঁপে উর্নাজাল
একটি বিষণ্ণ ছোটো সেতার জানলার পাশে পড়ে
পাথরের মেঝে থেকে জল পায়ে জলছাপ রেখে
গিয়েছে সময় সরে এখানে ঘড়ির কাঁটা থেকে। ’
‘জলে হস্মিন্ সন্নিধিং কুরু’ কাব্যগ্রন্থের ( আনন্দ পাবলিশার্স ১৯৯৯ এর জানুয়ারি) ‘ শ্রীচরণেষু দিদি ’
কবিতার প্রথম দুটি স্তবক দিয়ে যার প্রসঙ্গে আলোচনায় আসতে চাইছি তিনি বাংলা সাহিত্যে কবিতার জগতে এক বিস্ময়। কবির নাম গীতা চট্টোপাধ্যায়। সমসাময়িকদের কারও সঙ্গে তুলনা না করেও বলা যায়, তিনি ষাটের দশকের এক উজ্জ্বল দীপশিখা। মেধা ও অনুভূতির এমন অগ্নিসংযোগ সত্যিই বিরল। ভাবালুতা আর প্রগলভতাই যে শেষ কথা নয় এবং মস্তিষ্ককোষই যে কবিতার মূলশক্তি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কবি গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা।
কবি ও প্রাবন্ধিক উত্তম দাশ কবি গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘ বিচিত্র মিথে, পুরাণে, বাংলার লোক- সংস্কৃতিতে গীতা অনুভব করেন এক চলমান জীবন স্রোতকে। অভিজ্ঞতা ও পঠনজাত উপলব্ধি তাঁর কবিতার অবলম্বন। বিচিত্র বিষয়ে ছড়িয়ে নিজেকে উপলব্ধি করতে চাইলেও ছন্দে তন্নিষ্ঠ ঈষৎ ভারী বাক্যবন্ধে হারিয়ে যাওয়া বঙ্গসংস্কৃতি ও প্রকৃতি তাঁর কবিতায় জীবনানন্দীয় বিষণ্ণতার ছায়াপাত ঘটায়।’ কবি মনীন্দ্র গুপ্ত মনে করতেন - বাংলাদেশের পুরাণ, পুথি, কিংবদন্তিতে ছড়ানো বাঙ্গালিজীবনের বিচিত্র তথ্য সমস্ত দূরপ্রসার আবহ নিয়ে গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কল্পনায় যেন প্রাণ ফিরে পায়। কবিপ্রত্নবিদের মতো তিনি সেই সব ছেঁড়া, হারানো, ঝাপসা দিনগুলোকে তাঁর কল্পনা ও বিদ্যা – মনীষায় জোড়া দিয়ে নিয়ে পুনর্গঠিত করেন।
কবি গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় প্রাচীন থেকে প্রাচীনতর দিন তাদের গোধূলিবিষণ্ণ সৌরভ নিয়ে পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। অদ্ভুতভাবে ফুটে ওঠে সেই সময়ের নীরব চলমানতা। উড়ন্ত পাখিটির রেখাহীন শূন্যপথের মতন সর্বদা অ স্পষ্টভাবে ধরা থাকে এই অতি – সাম্প্রতিক কালের সঙ্গে সেই হারানো কালের যোগাযোগ, আসা – যাওয়া।‘ বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে বঙ্গ ইতিহাস' এর ‘ জন্ম ’ কবিতার কথা মনে পড়ে যায়। যেখানে তিনি বলছেন,
‘আর তুই পুতুল খেলবি?’
কপালে দিলেন লাল দাগা।
‘আর তুই চৌকাঠ ছাড়াবি ?’
হাতে দেন রাঙারুলি শাঁখা।
‘ ঘাটে গিয়ে দেরি হবে তোর ?’
দু’পায়ে আলতার শক্ত ডোর ।
বেদনা আরম্ভ তারপরে
অন্ধকার শিল্পের ভেতরে।’
১৯৪১ এর ৬ আগস্ট তারিখে জন্ম কবি গীতা চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর এবং প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিলো ভাগবত ও বাংলা সাহিত্য। সেই গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা চর্চা চিরকালেই চলেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। একমাত্র জগদীশ ভত্তাচার্যের ’কবি ও কবিতা’ ছাড়া অন্য কোনও পত্র পত্রিকায় তাঁর লেখা তেমন দেখেন নি কেউই। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ‘গৌরীচাঁপা নদ, চন্দরা’ (১৯৭৩ )। বইটির শেষ পাতায় বিদগধ কবি ও সমালোচক জগদীশ ভট্টাচার্য লিখেছিলে, ‘উনিশশো পঁয়ষট্টি সনের বিভিন্ন সময়ে লেখা তিনগুচ্ছ সনেট – অষ্টাদশীর সংকলন। পেত্রার্কান্ সনেট অষ্টক ও ষটকবন্ধে বিশিষ্ট মিলবিন্যাসে নবজন্মোত্তর য়ুরোপের অপূর্ব কলাকৃতি হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। গীতা চট্টোপাধ্যায়ের সনেট – অষ্টাদশী অষ্টক ও দশক বন্ধে পুনরাবর্ত মিলবন্ধনে অনুপ্রাসিত। বাংলা কাব্যসাহিত্যে এই অভিনব কলাকৃতির উদ্ভাবন অভিনন্দনযোগ্য।’ যা থেকে আমরা ধরে নিতে পারি যে গীতা চট্টোপাধ্যায় একজন পরিনত মনের বিদুষী মানুষ এবং ভাবুক কবি। ‘সপ্ত দিবানিশি কলকাতা’ , ‘বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে বঙ্গ ইতিহাস’ , এবং ‘জলেহস্মিন্ সন্নিধং কুরু ’ তাঁর অন্যান্য কবিতার বইগুলির নাম। তাঁর গদ্যের বইটির নাম ‘এক অক্ষৌহিনী বৃষ্টিরেখা'।
ষাটের দশকেই কবি গীতা চট্টোপাধ্যায়ের লেখালেখির সূত্রপাত। অন্যান্য দশকের মতো ষাটের দশকের কবিতারও বৈচিত্র্য অনেক। পঠন পাঠন ও মননের দিকে উন্মুখ সেই ধারাটিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে তাঁর কবিতা। জীবনের দেখাশোনা কিংবা পড়াশোনা থেকে আহৃত অভিজ্ঞতা আর অন্বেষণ নিয়েই গড়ে উঠেছে তাঁর কবিতা। যা মুখ্যত বিষয় নির্ভর। সেই বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তাঁর বহুমুখিনতার অন্ত নেই - যেখানে কোথাও কোথাও তাঁর মৌলিকত্ব চমকে দেওয়ার মতো। কবিতাগুচ্ছ কিংবা সিরিজ রচনায় তাঁর প্রবণতাটি সহজাত মনে হয়। 'পাণিনির সঙ্গে শব্দবিতর্ক', ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথামালা, বাংলার ব্রতকথা, তং হি দুর্গা, ধ্বনি ইত্যাদি নিয়ে যেমন লিখেছেন তেমনি অনায়াসে লিখেছেন বিশ্ব নারীবর্ষ ১৯৭৫, আর কলকাতা নয় , বার্থডে পার্টি কিংবা ও ব্লাড গ্রুপের কিডনি, শেকসপিয়র সরণি ইত্যাদি।
তাঁর কবিতায় প্রাচীন কালের বাংলা এবং তার আবহ কিংবা মানুষকে জলজ্যান্তভাবে উঠে আসতে দেখি। দেখি ইতিহাস, পুরাণ, কিংবদন্তি ছড়ানো বাঙালি জীবনের বর্ণনা। এই প্রসঙ্গে তাঁর ‘বাংলার বর’ কবিতার কিছুটা তুলে ধরছি –
‘কলাগাছ উলুটানা ছায়াপথে লগ্ন – শেষাবধি
বিজন কোকিল – ডাকা রমনীর পাড়ে এসেছো যে ,
তারি তো তরঙ্গধ্বনি অখিল গুন্ঠনবতী চোখ!
সমস্ত হলুদ নিয়ে পৃথিবীর গায়ে – হলুদের বনে আলো
তোমার দৃষ্টির আগে পরপার গোধূলি কাঁপালো ।’
ঠিক এভাবেই ‘কর্তার ঘোড়া দেখে রাসসুন্দরী’ কবিতাটিতে অষ্টাদশ শতকের এক বাঙালি রমনীর সরলতা, মায়াবী মন, সেকেলে মেয়েলি সংস্কার এক অপূর্ব মাধুর্য নিয়ে প্রাণ পেয়েছে। তবে সমসাময়িক কালও বাদ যায়নি তাঁর লেখার নজর থেকে। 'আজ রাতে কেউ থাকবে না’ কবিতায় উঠে আসে এক জটিল ও আত্মপরায়ণ জীবনের ছবি। ‘গভীর নাড়ির সঙ্গে লবনাক্ত নল যোগ করে সেবিকা উদ্বিগ্ন মুখ আজ রাত কাটে কি কাটে না ,
আপনাদের মধ্যে যে হোক একজন থেকে যান।
যাদের সবার জন্যে কত রাত জেগে কেটে গেছে
তাঁর জন্যে শেষবার আজ রাতে কেউ থাকবে না।’
কবি গীতা চট্টোপাধ্যায়ের ‘জলে হস্মিন্ সন্নিধিং কুরু' বইটিতে পাই এক বিদুষী মানুষকে। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত ছয় বছর সময়কালে রচিত কবিতাগুলিতে তাঁর সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে পাণ্ডিত্যের পরিচয় আছে। তবে তাঁর কবিতায় তৎসম শব্দের ভিড় যেমন আছে তেমনি চলতি শব্দেরও অভাব নেই। এই প্রসঙ্গে ‘চড়’ কবিতাটির উল্লেখ করা যায়।
‘মাস মিডিয়ার হাতে হাত রেখে চলি বরাবর।
নাগরিক – মফস্বলী কবি সম্মেলনে ছুটোছুটি
সংকলনে সংকলনে অন্তর্গত রক্তের ভিতর
অর্থ –কীর্তি –স্বচ্ছলতা', এক বছরের শ্রেষ্ঠে' দুটি।
এবার তাহলে গাল বাড়িয়েছো, বিপন্ন বিস্ময়; এখানেও মকদ্দমা, তালুকজারি, সম্পত্তি বিষয়?
প্রতিমার সামনে আর চড় মারবে সাধ্য আছে কারো
নির্নিবেক বাংলাদেশে গাল বাড়িয়েছি, কই মারো?’
অক্ষরবৃত্তে পোক্ত হাতে লেখা হালকা রসের এই কবিতার মধ্যে শ্লেষ আছে, আত্মকরুণার রেশও আছে। এই সময়ের তিক্ততা, ক্ষোভ ইত্যাদিও তাঁর কবিতায় ঠাঁই করে নিয়েছে। তুলে ধরছি তাঁর 'পর্ননব – দাহ'
‘এখানে আসছেন কেন, স্থপতি বা ঠিকদারে যান
সবজান্তা সাংবাদিক, ষড়যন্ত্রী শিক্ষক প্রবরে
যা দেবী সর্বঘুষেষু রাষ্ট্রনীতিবিদের কাছে যা
এ লাশের নাম জানতে মোমিনপুরের লাশঘরে।’
কবি গীতা চট্টোপাধ্যায় কী কখনও কোনও কবিতাতেই নিজের কথা বলেন নি! নিজের সুখ – দুঃখ, উচ্ছ্বাস ভাবনা, তার আত্মজীবন কী আড়ালেই থেকে গেছে! লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা কবি সম্পর্কে এমন একটি ধারণা হয়তো স্বাভাবিক। তবে একজন শিল্পীর পক্ষে সত্যিই কী এই ধারাবাহিক নৈর্ব্যক্তিকতা সম্ভব! উত্তর অবশ্যই কবির কবিতাতেই খুঁজে পেয়েছি। তুলে ধরছি তারই কিছু দৃষ্টান্ত –
‘কান বিঁধিয়ে প্রথম পরা নিমকাঠিটি দিয়ে যাবো
সোনার ছোটো মাকড়ি দুটি দিন ও রাত্রি দিয়ে যাবো
দিদি কাঠের খেলনা দিলো, গোলাপপিসী কাশীর প্যাঁড়া
গোপাল দোলে যে মঠ খাবে ফুটকড়াই আর লুঠবাতাসা
বিষ্ণু পটচিত্র ঘিরে সারা সকাল চন্দনে ওঁ
পুণ্যিপুকুর গোকাল গোরুর শিঙ্ য়ে সিঁদুর হলুদকোঁটা
ন্যাওটা বোনের হাত ধরে ঝিম দুপুর জুড়ে বারান্দারই
অলীক বাড়ি ঘুরে ঘুরে নেমত্তন্ন পুতুলভোজে ’
'উত্তরাধিকার' কবিতার এই অংশে উত্তর কলকাতার রক্ষণশীল সচ্ছল বনেদি বাড়ির যে মেয়েটির বালিকাবেলার স্মৃতি ফুটে উঠতে দেখি সেখানে কবির ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতাই লেখা হয়েছে বলে আমার ধারণা। আবার পুরনো দিনের গ্রামবাংলার সুদাসী বৈষ্ণবীর হরিচন্দনের মতো স্নিগ্ধ প্রেম – আকুতির অন্তরালে যে মেয়েটি রয়েছেন তিনি কি কবি নিজেই নন? এই কবিতাটি পড়তে গিয়ে পাঠক হিসেবে এই প্রশ্নই আমার মনে এসেছিলো। তুলে ধরছি সেই পাঠের অংশ –
‘সুদাসী বৈষ্ণবী তার সারা গায়ে মেখেছিল হরিচন্দনের মতো প্রেম
শরীর ছিল না তার কতক্ষণ, কতক্ষণ গন্ধই শরীর,
মৃগনাভি হরিণের বিভোরতা উপত্যকা – দেশের বাগানে
নীল গন্ধরেখা ধরে পদে পদে ফিরে আসা নাভিতে নির্জন
সেও এক অসম্ভব অভিসার জ্যোৎস্না পথে রাসস্থ মণ্ডলে।’
‘ জলেহস্মিন সন্নিধিং কুরু’ কবিতার বইটির বেশ কিছু কবিতায় তাঁর ব্যক্তিগত শোক গহন ও কাতর ছায়া ফেলেছে।
‘শ্রীচরণেষু , দিদি ’ কবিতার অংশটি, এইরকম –
‘ আষাঢ়ের ভিজে মাটি তবু দাগ চাকার পড়ে না
টেবিলে হাতের ছাপ হাতে করে নেয়নি, যখন
চলে গেছে এমনি গেছে, দুটি হাত শুধু খালি করে,
মা ডেকেছে, বহুদূর থেকে যেন আবছা কানে শোনা।’
দিদির অন্তিম যাত্রা কিংবা মায়ের মৃত্যুতে কবি গীতা চট্টোপাধ্যায়ের শোকের গভীরতা পাথককে বিচলিত করে । তাঁর ‘ মাতৃশ্রাদ্ধ ’ কবিতার দুটি লাইন – ‘ মা নেই, তা লোহা পরে ছন্নছাড়া ভবঘুরে বেশে
ঘুরে ফিরছি কালাশৌচ মহাগুরু – নিপাত স্বদেশে ।’
কবি গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় সহজেই ধরা পড়ে তাঁর সমকালীন পাশ্চাত্য সাহিত্যে পাণ্ডিত্যের গভীরতা। যার শিকড় প্রোথিত রয়েছে ভারতীয় সনাতন ঐতিহ্যে। উপনিষদ, পুরাণ, ব্রতকথায় ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর কবিতার ভিত্তি। অথচ তাঁর এই পাণ্ডিত্যের গভীরতা কখনই কবিতাকে সংকুচিত করেনি বরং প্রসারিত করেছে। রক্ষণশীল অভিজাত পরিবারে বেড়ে ওঠা এক নারী হয়েও তিনি কিন্তু নারীবাদী কবি নন বরং তাঁর কবিতায় নারী পুরুষের উর্ধ্বে এক মেধাবী মানবিক সত্ত্বা বিচ্ছুরিত হয়েছে। সত্যিকারের বৈদগ্ধ্য ছাড়া এমন কবিতা লেখক হওয়া কখনোই সম্ভব নয়। বৈদগ্ধ্য আর নিষ্ঠাই কবি গীতা চট্টোপাধ্যায়ের অন্যতম প্রধান চরিত্রগুণ। ধর্মও।
Comments
Post a Comment