গল্প - অদিতি সরকার


ভাইরাস

 
 
এদের এই সোসাইটির গেটের সিকিউরিটির লোকটা একটু ত্যাঁদড় গোছের। কোম্পানির কার্ডটা দেখানো সত্বেও কিছুতেই মানতে চাইছে না। অথচ অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েই এসেছে রক্তিম।
"সেলসপার্সনদের অ্যালাউ করতে মানা আছে আমাদের।"
"আরে আর কতবার বলব আমি সেলসপার্সন নই? আপনাদের সোসাইটির প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা হয়েছে, আজকে ডেট দিয়েছেন উনি দেখা করার। আপনি ফোন লাগান তো, ফোন লাগান।" একটু সুর চড়ায় রক্তিম। এই কন্ট্র্যাক্টটার ওপর তার অনেক কিছু ডিপেন্ড করছে। ফসকালে মালিক চামড়া তুলে নেবে।
"যখনতখন ফোন করতে মানা আছে।" লোকটা কান চুলকোতে চুলকোতে অন্য দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়।
"তাই নাকি? আচ্ছা তাহলে আমিই করছি। সেই সঙ্গে আপনার নামে কমপ্লেনটাও করে দেব নাহয়। জেনুইন লোককে হ্যারাস করছেন বলে।" পকেট থেকে ফোন বার করে রক্তিম।
"আরে আরে, কী করছেন কি দাদা?" এবার উর্দিধারী সত্যি চমকায়। কান থেকে হাত নেমে গেছে তার। 
"ঠিকই তো করছি। তখন থেকে আপনি আমার সঙ্গে যেটা করছেন সেটাকে হ্যারাস করা ছাড়া আর কী বলে? বলছি মিস্টার হাজরার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, উনি নিজে ডেকেছেন, আপনি মানছেনই না।" রক্তিম চোয়াল শক্ত করে।
"সরি দাদা, সরি। বোঝেনই তো। আমারও তো ডিউটির ব্যাপার। উলটোপালটা কত লোক আসে, একটু বাজিয়ে না নিলে হয়? তাতে এই রোগের সময়। দিনকাল ভালো নয় না দাদা? কার থেকে কী ভাইরাস মাইরাস চলে আসবে, পুরো সোসাইটিতে রোগ ঢুকে যাবে দাদা। চোট তো আমারই ঘাড়ে পড়বে না তারপর? নিন, ঢুকে পড়ুন দেখি চট করে। ওইখানে দেখুন ওই যে স্যানিটাইজ়ারের বোতল রাখা আছে, দুটো হাতে লাগিয়ে নিন ভালো করে। তারপর এখানে সই করুন। এই রেজিস্টারে। আসুন দাদা।" গেটটা ফাঁক করে ধরে লোকটা।
"কত করে কিনছেন এই স্যানিটাইজার আপনারা?" নীলচে তরল আঙুলের ফাঁকে ঘষতে ঘষতে জিজ্ঞাসা করে রক্তিম।
"সে তো ম্যানেজিং কমিটি জানে দাদা।" লোকটা সামান্য অবাক চোখে তাকায় রক্তিমের দিকে।
"থোকে কেনেন না খুচরো?"
"খুচরোই বোধহয়। তবে শুনছিলাম দুচারটে কোম্পানির সঙ্গে নাকি কথা চলছে থোক সাপ্লাইয়ের জন্য। আমরা সিকিউরিটির লোক দাদা, অত খবর বলতে পারব না। কেন বলুন তো?"
"নাহ্ এমনি। খুচরোয় তো অনেক খরচা পড়ে যায় নিশ্চয়ই, তাই ভাবছিলাম।" আর বেশি কিছু বলে না রক্তিম। কী কন্ট্র্যাক্ট ধরতে আজ তার এখানে আসা সেটা একে বলার কোনওই দরকার নেই। "মিস্টার হাজরার ফ্ল্যাটটা কোনদিকে একটু দেখিয়ে দেবেন?"

 
বিকাশ কাগজখানা নিয়ে সবে জুত করে বালিশে ঠেস দিয়ে বসেছে কি বসেনি, খনখন করে কলিং বেল বেজে উঠল৷ কপালটা কুঁচকে গেল বিকাশের। এখন আবার কে এল৷ কাগজওলা, দুধওলা সবাই তো যে যার মাল সাপ্লাই দিয়ে চলে গেছে৷ কাজের মাসিও রাতের বাসনপত্র মেজে দিয়ে চলে গেছে, সে আসবে আবার এগারোটার সময়৷ আর তো কারো এখন আসার নেই৷ এখন কলিং বেল মানে হয় অনলাইন কেনাকাটার ডেলিভারি, নয় কোন অনাহূত অপ্রত্যাশিত অতিথি৷ ডেলিভারির কোনও নোটিফিকেশন যখন আসেনি, অতএব ওই দ্বিতীয়টিই হবে। এই সকাল সাড়ে আটটায় কার আবার কী দরকার পড়ল রে ভাই বিকাশের সঙ্গে৷ তাও এই করোনাকালে।
নাঃ, এরা শনি-রোববারগুলোকেও ছাড়বে না৷ সারা সপ্তাহ গাধার খাটনি খাটার পরে কার ভালো লাগে এসব ফালতু ঝামেলা৷ আজকে মনে মনে ইচ্ছে ছিল বীথিকে পটিয়ে অনেক দিন পরে বেশ জমিয়ে লুচি আলুভাজা দিয়ে একখানা রেয়াজি ব্রেকফাস্ট সাঁটানোর, সে স্বপ্ন বোধহয় গোল্লায়ই গেল৷ 
ওই আবার কলিং বেল বাজে৷ এত অধৈর্য কেন রে বাবা৷ কানে কালা তো নই কেউ, একবার বাজালেও শুনতে পাব, দশবার বাজালেও শুনতে পাব৷ বীথিই বা কোথায় গেল এই সাতসকালে৷ বাথরুমে ঢুকেছে নির্ঘাত৷ গজগজ করতে করতে হাতের কাগজখানা নামিয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠে বিকাশ৷
দরজা খুলতেই যাদের মুখোমুখি হতে হল তাতে সকালটা মনে হল আরওই তেতো হয়ে গেল৷ থুতনিতে মাস্ক ঝুলিয়ে সস্ত্রীক সুরঞ্জন বিশ্বাস৷ চার নম্বর ব্লকে থাকে৷ ছোট বড় সব ব্যাপারে কর্তা গিন্নি মাথা গলিয়েই আছে৷ ঘোঁট পাকাতে ওস্তাদ৷ যত দুর্গন্ধ এদের নাকেই সবার আগে ঢোকে৷ আজ আবার কী নিয়ে গণ্ডগোল পাকাতে উদয় হয়েছে কে জানে৷ বিরক্তিকর৷
বিরক্তিটা অবশ্য চেহারায় ফুটতে দিল না বিকাশ৷ মুখে একটা প্রায় নিখুঁত অভ্যর্থনার হাসি ঝুলিয়ে দু”হাত জোড় করল৷ 
“আরে আরে, কী সৌভাগ্য, কার মুখ দেখে উঠেছি আজ৷ সক্কালবেলা একেবারে যুগলমূর্তি আমার বাড়ির দরজায়৷ সুপ্রভাত, সুপ্রভাত। আসুন আসুন, ভেতরে আসুন৷ বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? আসুন  ম্যাডাম৷”
বিকাশের এত সহাস্য সবিনয় অভ্যর্থনার উত্তরে সুরঞ্জন বিশ্বাস প্রবল ভ্রূকুটি করে তার দিকে তাকাল৷ 
“এটা কী রকম হচ্ছে দাদা? আপনি সোসাইটির সেক্রেটারি, আপনার নাকের ডগায় এসব আজেবাজে কাণ্ড চলছে আর আপনি কোনো স্টেপই নিচ্ছেন না৷”
“কী ব্যাপারে বলুন তো? আমি তো ঠিক...”
বিকাশ কথা শেষ করতে পারে না৷ তার আগেই কণা বিশ্বাসের গলা উচ্চগ্রামে বেজে ওঠে৷ মহিলার দেহ যে পরিমাণে মোটা, গলার আওয়াজ ঠিক সেই পরিমাণে তীক্ষ্ণ৷ 
“ওই ছেলেমেয়ে দুটো যা শুরু করেছে, আর তো সহ্য করা যায় না৷ আপনাকে তো আগেও বলেছিলাম, আপনি কোনো গুরুত্বই দিলেন না৷”
ওফ্, আবার সেই এক গল্প৷ 
সাত নম্বর ব্লকের ছ তলায় দুটো ছেলেমেয়ে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে৷ এই মাস আষ্টেক হল৷ প্রথমে জানা যায়নি, পরে আবিষ্কার হয়েছে যে তারা বিবাহিত স্বামীস্ত্রী নয়৷ ব্যস, সকলের মাথায় হাত এবং গেল গেল রব৷ এক্ষুনি ওদের এই সোসাইটি থেকে তাড়াতে হবে৷ এসব অনৈতিক কারবার আর যেখানে চলে চলুক, এই নীলাঞ্জনায় চলতে দেওয়া যাবে না৷
বিকাশকে এর আগেও অনেকেই বলেছে ব্যাপারটা, বিকাশ বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি৷ নিজের ঘরে বন্ধ দরজার আড়ালে যে যা করছে করুক না, অন্য লোকের কোনও ক্ষতি না হলেই হল, মোটামুটি এই তার থিয়োরি৷
ওরা অবশ্য কোনও রকম লুকোচুরি করেনি৷ ফ্ল্যাট ভাড়া ছেলেটির নামে হলেও দরজার সামনে নামফলকে দুজনের নামই ছিল৷ চয়ন কোনার, সুবর্ণা তরফদার৷ তা সে তো আজকাল অনেকেই বিয়ের পরেও বাবার পদবি ছাড়ে না৷ কেউ ওটাকে অত গভীরে গিয়ে ভাবেনি৷
দুজনেই ওরা কাজ করে৷ যেমনটি আজকাল ঘরে ঘরেই৷ বাচ্চাও আছে একটি। তার পরেও নীলাঞ্জনার সব উৎসবে অনুষ্ঠানে ওরা যোগ দেয়৷ দূরদর্শনে যেমন বলে, উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে৷ 
গত রবীন্দ্রজয়ন্তীতে সুবর্ণা সোসাইটির বাচ্চাদের দিয়ে খুব সুন্দর নাচ করিয়েছিল৷ নিজেও নেচেছিল ভানুসিংহের পদাবলীর সঙ্গে৷ সকলে একবাক্যে ধন্য ধন্য করতে বাধ্য হয়েছিল৷
গোলমালটা হল ওখানেই৷ 
টাওয়ার চারের রিংকুর মা সুবর্ণার নাচ দেখে মুগ্ধ হয়ে পরের দিনই ওদের ফ্ল্যাটে হানা দেন৷ প্রশংসা বাহানা মাত্র, আসল উদ্দেশ্য যদি রিংকুর জন্য নাচের টিচার হিসেবে সুবর্ণাকে ম্যানেজ করা যায়। তা সেখানেই নাকি গপ্পে গপ্পে যেই বলেছেন ‘তোমাদের কত্তাগিন্নিকে বেশ মানায়’, অমনি কী কাণ্ড। সুবর্ণা নাকি হেসেই লুটোপুটি। 
“কে কত্তা, আণ্টি?
রিংকুর মা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও হাল ছাড়েননি। 
“কেন, চয়ন?”
“ও আন্টি, ও কত্তা টত্তা হতে যাবে কেন? ও তো আমার বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু, অনেকদিনের।”
"অ্যাঁ? আর তোমাদের ছেলে?" 
"তোজো? ও তো আমাদেরই ছেলে আন্টি, আমিই ওর মা। ওর বায়োলজিক্যাল মা ছিলেন একজন অবশ্যই, চয়নের স্ত্রী। তিনি পপির জন্মের পরেই মারা যান আসলে।" নির্লজ্জের মতো হেসে হেসে বলেছে সুবর্ণা।
রিংকুর মা স্বাভাবিকভাবেই এর পরে আর ওই পাপের ডেরায় বেশিক্ষণ থাকেননি। কিন্তু ওদের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়েই খবরটি অতি দ্রুতবেগে গোটা নীলাঞ্জনাতে ছড়িয়ে দিতেও ছাড়েননি। সেই থেকে আগুন জ্বলছে নীলাঞ্জনার ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে। বিকাশের বাড়িতেও আজ সক্কালবেলা সেই আগুনেরই ফুলকি ছিটকে এসেছে।
“কেন ম্যাডাম, আবার কী হল?”
“হল মানে৷ জেনেশুনে ন্যাকা সাজছেন নাকি! হতে আর বাকিটা কী আছে বলুন তো। জানেন, সেদিন ডক্টর চক্রবর্তীর বাড়ি যাব বলে সাত নম্বরে গেছি, ওমা দেখি লিফ্টে হাত ধরাধরি করে উঠছে দুটোতে, অ্যাত্তো বেহায়া৷ আমিও যে একটা গুরুজন মানুষ ওই লিফ্টের ভেতরে আছি, সে যেন কোনও কেয়ারই নেই৷ আবার নামার সময় একমুখ হেসে বাই বাই করে গেল৷ লজ্জাও করে না৷” কণা বিশ্বাস সজোরে দুহাতে স্যানিটাইজ়ার ঘষতে ঘষতে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন। 
বিকাশের কান মাথাও ঝাঁঝাঁ করছিল। মুখের ওপর এরকম ভাষা শুনতে সে অভ্যস্ত নয় আদৌ। মহিলা অবশ্য ভ্রূক্ষেপও করেন না।
“না দাদা, এ জিনিস চলতে দেওয়া যায় না৷ ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে, তাদের সামনে এ সব কী এগজাম্পল সেট হচ্ছে বলুন তো৷” সুরঞ্জন বিশ্বাস তোম্বা মুখখানাকে আরও গম্ভীর করে ফেলে৷ “আপনি একটা কিছু কংক্রিট স্টেপ নিন এবার৷ এসব ব্যাপার সেক্রেটারি না দেখলে কে দেখবে৷”
উফ্, সেক্রেটারি মানে যে এ হেন বাঁশ আগে জানলে কে হাড়িকাঠে মাথা দিতে যেত৷ অবশ্য বিকাশই কী আর সাধ করে গিয়েছিল৷
এই হাউজিংটায় বাঙালির তুলনায় উত্তর ভারতীয়দের সংখ্যা একটু বেশি৷ আগের কমিটিতে তাদের দু একজন বেশ সরব সদস্য ছিল৷ এটাতেই বাঙালি গোষ্ঠীর একটু আপত্তি৷ কিংবা হয়তো ভয়৷ কোনঠাসা হয়ে পড়ার ভয়৷
বর্তমান প্রেসিডেণ্ট, সুখেন্দু হাজরা, নিজেকে প্রো-বাঙালি বলতে ভালবাসেন৷ “আরে মশাই, বাঙালি বাঙালির জন্য না করলে করবে কে?” এই বাক্যটি তাঁর মুখে হামেশাই শুনতে পাওয়া যায়৷
ভদ্রলোক কলকাতার কাছাকাছি একটি আধাসরকারি কলেজে পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক ছিলেন৷ বর্তমানে সেবানিবৃত্ত হয়ে এই নীলাঞ্জনায় বাসা বেঁধেছেন৷ অবশ্য কলেজের সেবা থেকে নিবৃত্ত হলেও পকেটের সেবা বন্ধ করেননি৷ এখানেও মাদুর পাতা চালু করে দিয়েছেন৷ ব্যাচে ব্যাচে দলে দলে ডিগ্রিসাগর পাড়ি দিতে উৎসুক নোটভিক্ষুদের আনাগোনা লেগেই আছে৷ এখন অবশ্য করোনার দরুন বাড়িতে পড়ানো বন্ধ, তবে অনলাইন ক্লাস রমরমিয়ে চলছে। পাঞ্জাবির রঙ পরিস্থিতি বুঝে পালটে পালটে যায়। আগে ছিল লাল, তারপর বেশ কিছুদিন সবুজের সমারোহ পেরিয়ে আজকাল গেরুয়ার দিকে ঘেঁষছে৷ ভারতীয় তথা বাঙালি সংস্কৃতির একনিষ্ঠ ধ্বজাধারী৷
লাস্ট ম্যানেজিং কমিটির মেয়াদ ফুরোবার দিন যত কাছে আসে, হাজরা মশাইয়ের ক্যাম্পেনিংও তত জোরদার হয়ে উঠতে থাকে৷ 
“কমিটিতে ঠিক ঠিক জায়গায় আমাদের লোক না থাকলে শেষটায় দেখবেন দুর্গাপুজোর জায়গায় নবরাত্রি হচ্ছে, ধুনুচি নাচের জায়গায় ডান্ডিয়া, আলপনার বদলে রঙ্গোলি।” 
সুখেন্দু হাজরার আশঙ্কায় সায় দেবার লোকের অভাব হয়নি৷
“অন্তত মেন পোস্টগুলোতে আমাদের লোক যে করেই হোক ঢোকাতে হবে, বুঝেছেন তো? সেক্রেটারি, ট্রেজারার৷ এগুলো ওরা ধরে নিলে মুশকিল।”
প্রেসিডেণ্ট যে সুখেন্দুই হচ্ছেন এটা জানাই ছিল৷ বিকাশকে যে টেনে দলে ঢোকাবেন সেটা একেবারেই আন্দাজ করা যায়নি৷ বেচারা প্রচুর গাঁইগুঁই করেছিল। “আমাকে কেন টানছেন এসবের মধ্যে৷ আমি সাতে পাঁচে থাকি না, আমায় ছেড়ে দিন স্যর৷ আমার দ্বারা হবে না।”
“আরে সেই জন্যেই তো তোমার সেক্রেটারি হওয়া দরকার৷ সবাই জানে তুমি নিরপেক্ষ, টোটালি অনেস্ট৷ তোমার এগেনস্টে কেউ ক্যাণ্ডিডেটই দেবে না, দেখে নিও।” 
সুখেন্দু হাজরার কনফিডেন্সের জোরেই হোক বা অন্য যে কারণেই হোক, সত্যি সত্যিই বিকাশ আনকনটেস্টেড জিতে গেল৷ এবং ক্রমে ক্রমে বুঝতে শুরু করল সুখেন্দুর কথায় রাজি হয়ে কী মারাত্মক ভুলটা সে করে ফেলেছে৷ নীলাঞ্জনার কোনো সমস্যা,কোনো কাজের ব্যাপারেই সুখেন্দুকে পাওয়া যাচ্ছে না। খুব কুশলীভাবে তিনি বলটা ঠেলে দিচ্ছেন বিকাশের দিকে। ফলে এখন বিকাশের অবস্থা সেই সব ব্যাটাকে ছেড়ে বেঁড়ে ব্যাটাকে ধর গোছের। আজকের উৎপাতটাও সেই চলমান প্রবাহেরই একটা অংশ।
“ঠিক কী করতে বলছেন বলুন তো বিশ্বাসদা।” বিকাশ বিরক্তি চেপে প্রশ্ন করে।
“আরে তাড়ান,তাড়ান। এখান থেকে তাড়ান ও দুটোকে।” সুরঞ্জন উত্তর দেওয়ার আগেই কণা আবার ঝনঝনিয়ে ওঠেন।
“কিন্তু ও ভাবে কি কাউকে তাড়ানো যায়  ম্যাডাম? লিগ্যালি সব ডকুমেণ্ট দেখিয়ে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে, কোনো মাসের পেমেন্টে ডিফল্টও করে না, দুম করে তাড়াব বললেই তাড়ানো যায়? একটা কংক্রিট গ্রাউন্ড লাগবে তো।”
“এটা গ্রাউন্ড নয়? দুটো ধেড়ে ধেড়ে আনম্যারেড ছেলেমেয়ে দিনের পর দিন একসঙ্গে থাকছে সবার চোখের ওপর, এই বেলেল্লাপনাটা আমাদের কালচারের সাথে ম্যাচ করে?”
“কিন্তু ভাড়া নেওয়ার শর্তে কি লেখা ছিল যে অবিবাহিত ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বাড়ি ভাড়া নিতে পারবে না? আমাদের নীলাঞ্জনার রুলসেও তো তা নেই।” বিকাশ নিজের সাহসে নিজেই অবাক হয়ে যায়।
“আপনারাও কি বিলেত থেকে এসেছিলেন নাকি মশায়?” সুরঞ্জন বিশ্বাসের গলার স্বরে ব্যঙ্গ চাপা থাকে না। “এ সব তো একটু খেয়াল রাখতে হয় সোসাইটির রুলস বানানোর সময়। না থাকলে রাখতে হবে। বেশ, তাহলে একটা মিটিং ডাকুন। স্পেশাল মিটিং। রুলস অ্যামেন্ড করতেই হবে। আর ইমিডিয়েটলি এদের তাড়াতে পারুন না পারুন, অন্তত কষে একটা কড়কানি তো দিন। বুঝুক অন্তত যে এসব বেলেল্লাপনা যেখানেই চলুক, এখানে চলবে না। এটা বিলেত আমেরিকা পায়নি যে যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবে। হুঁঃ, লিভ টুগেদার। পরিবারের শিক্ষারও বলিহারি। একবার ভেবে দেখেছেন, এই নোংরামির মধ্যে বড় হতে হতে ওই বাচ্চাটাই বা কী শিখছে?”
বিকাশের ফোনটা ঠিক এই সময়ে বেজে উঠে তাকে উত্তর দেওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেয়। স্ক্রিনে সুখেন্দু হাজরার নম্বর।

 
“হাজারটা টাকা লাগবে যে।
সুখেন্দু নিবিষ্ট হয়ে ক্রসওয়ার্ড করছিলেন, আচমকা এরকম ভূমিকাহীন দাবিতে চমকে উঠলেন একেবারে। কাগজ থেকে চোখ তুলতেই অমিতার বাড়ানো হাতটাই সর্বাগ্রে নজরে এল।
“দুদিন আগেই তো পুরো সপ্তাহের বাজার হল। আবার এক্ষুনি টাকা কিসের?"
“মণি ওর বন্ধুদের রাতে খেতে বলেছে যে কাল। একটু ভালো চালটাল আনতে লাগবে না? চিকেন, আইসক্রিম। ওরা তো মাছ ভালোবাসে না।"
সুখেন্দুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে গেল। 
“তা সে সব তোমার সাধের মণিই এনে দিক না। রিটায়ার্ড বাবার ওপরে বসে ফুটানি কেন?" 
“বললেই দেবে। সে তো আর বাপের মত কঞ্জুস নয়। সারা জীবন শুধু টেনে চালাও আর টেনে চালাও। একদিনও শুনলাম না, অমিতা, একটু হাত খুলে খরচ করো।"
 “টেনে চালিয়েছ বলেই এখন আরামে থাকতে পারছ, বুঝলে? এই এত বড় ফ্ল্যাট, দিনে রাতে ঠাণ্ডা মেশিন, এসব এই শর্মার  দৌলতেই হয়েছে। তোমার বাবা যৌতুকে দেননি।"
“সক্কাল সক্কাল বাবা তুলো না তো। যত ইতর স্বভাব। কিছু বললেই খিচখিচ। কথা বাড়াতে ভালো লাগছে না আমার। টাকাটা লাগবে, দাও।"
“পারব না। পেনশনের টাকা তোমায় মাসের গোড়াতেই দিয়ে দিয়েছি। আজ উনত্রিশ তারিখে হুট বলতে হাজার টাকা বের করে দিতে পারব না। তোমার তহবিলে যা আছে তাই দিয়ে হলে হবে, নইলে নবাবজাদাকে বলো তার বন্ধুবান্ধবের আপ্যায়নের ব্যবস্থা সে যেন নিজেই করে। কর্তা গিন্নি দুজনেই কামায় তো মন্দ না। আর এই প্যান্ডেমিকের মধ্যে এসবের দরকারটাই বা কী? একবার বাড়িতে ওই রোগ ঢুকলে আর সামলানো যাবে?"
সে ভয়টা অমিতারও যে ছিল না তা নয়, তবুও সুখেন্দুর সামনে প্রেস্টিজ বজায় রাখতে ভেতরের ছমছমানি জোর করে চাপা দিয়ে গলা উঁচু করলেন।
“আচ্ছা অন্য সবার বেলায় তো এমন করো না, আমি দুটো পয়সা চাইলেই তোমার কী হয়?"
“তোমার কি কোনও কিছু আটকে থেকেছে কখনও টাকার অভাবে, নাকি দরকারি জিনিসে মানা করেছি  কোনওদিন? বাজে খরচের টাকা আমি দিই না, দেব না।"
অমিতা দাঁড়িয়েই রইলেন তবু কিছুক্ষণ। সুখেন্দু তাঁকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আবার ক্রসওয়ার্ডে মন দিলেন। ভেতরে ভেতরে চিড়বিড় করছিলেন যদিও। অন্য কারো কাছে টাকা চাইতে অমিতার যেন লজ্জায় মাথা কাটা যায়, এক সুখেন্দু ছাড়া। বাড়িতে রোজগেরে ছেলে রয়েছে, ছেলের বউ রয়েছে, তাদের কাছে চাও না। এই পেনশনভোগী বুড়োটার কাছেই কেন।
আর ছেলেরও বলিহারি। তোর বন্ধু, তোর আনন্দ, ব্যবস্থা তুই কর। তা নয়, টাকা দেবে বুড়ো বাপ, রেঁধে মরবে মা, তোরা শুধু হোহো হিহি। অবশ্য একবার করোনা ধরলে আর মা-বাবা কেউই টিঁকবে না। তিনদিনের শ্বাসকষ্ট, তারপর খালাস। কর কতো ফূর্তি করবি কর।
ক্রসওয়ার্ড থামিয়ে আবার অমিতার দিকে সটান তাকালেন সুখেন্দু।
"আচ্ছা তুমিই বা অমন গায়ে পড়ে ওদের জন্য অত করতে যাও কেন বলতে পারো? ওরা কি তোমায় বলে কেউ এলে-টেলে ভালোমন্দ রান্না করতে?"
"না তা অবশ্য বলে না।" অমিতার গলায় সামান্য অস্বস্তির আভাস।
"তবে? কেন করো আগ বাড়িয়ে? হয়তো ওরা অন্যরকম কিছু খেতে চায়, অন্যভাবে বন্ধুদের নিয়ে সময় কাটাতে চায়। তোমার উৎসাহ দেখে কিছু বলতে পারে না। আমাদের বয়স হয়েছে অমিতা, আমরা জেনারেশন পাস্ট। ওদের সঙ্গে আমাদের মানায় না। বোঝার চেষ্টা করো।"
"তাহলে সারাটা দিন কী নিয়ে কাটাব তুমিই বলে দাও। তুমি তো হয় টিভি নয় কাগজ নয় ফোনে সারাদিন খুটুরখাটুর করে যাও, আমি কী করব বলতে পারো? রান্নাবান্নাও যদি ছেড়ে দিই?" 
অমিতা আর শান্ত থাকতে পারেন না। "দশটা মাস একভাবে ঘরে বন্দী। কারো বাড়ি যাওয়া নেই, আসা নেই, দুটো সুখদুঃখের কথা যে বলব সে উপায় নেই। লকডাউন উঠে গেলেই বা কী, ভয়ে ভয়ে এতগুলো দিন কাটিয়ে এখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাজারদোকানটুকু অবধি করার সাহস পাই না। ঘণ্টায় ঘণ্টায় হাত ধুতে ধুতে আর ওই ছাতার লোশন মাখতে মাখতে ছালচামড়া উঠে গেল, তবু ভয় যায় না। মণি তো অন্তত অ্যাদ্দিন পরে বন্ধুবান্ধবকে বাড়িতে ডাকার সাহসটুকু দেখিয়েছে।" 
সুখেন্দুর মুখে চট করে জবাব জোগায় না। ক্রসওয়ার্ডের ছকটাই মুখের সামনে তুলে ধরেন আবার।
"দেবে না তাহলে টাকা?" সামান্যক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অমিতা প্রশ্ন করেন।
"না, দেব না। তোমার পেয়ারের পুত্রবধূ রিনিদেবীকে বলো অনলাইনে আনিয়ে নিতে। নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করতে শিখুক এবার। বেহায়ার মতো রাস্তায়ঘাটে ঘুরে ঘুরে প্রেম করতে পেরেছে যখন, সংসারটাও চালাতে পারা উচিত।" 
"আচ্ছা কী সব আজেবাজে বলছ বলো তো? মুখে আটকায় না একটু। মেয়েটা তোমার নিজের ছেলের বউ, সেটাও কি মনে থাকে না তোমার?" অমিতা ফুঁসেই ওঠেন এবার একটু।
"ছেলের বউ তো কী? মাথা বিকিয়ে দিয়েছি নাকি? তাও যদি বাপের বাড়ি থেকে দু কুচি সোনাদানাও সঙ্গে আনত। ওই তো ফ্যামিলির ছিরি, এদিক টানলে ওদিক খুলে যায়। মণির শ্বশুরবাড়ির কথা আত্মীয়স্বজনের কাছে বলতেও লজ্জা হয় আমার।"
অমিতা আর বিরক্তি চাপতে পারছিলেন না।
"এত পড়াশোনা জানা, এত শিক্ষিত পরিবার, এত যোগ্য মেয়েতেও তোমার মন উঠল না, শুধু পয়সার অভাবটাই চোখে পড়ল? কী গো তুমি?"
"রাখো রাখো। সকাল সকাল ফালতু বকে মাথা ধরিয়ে দিলে। যাও তো সামনে থেকে, যাও। টাকা ফাকা হবে না। আর হ্যাঁ, তোমার উচ্চশিক্ষিতা বউমাকে বলে দিও যা কিছু আনাবে সব যেন আগে ভালো করে স্যানিটাইজড করে তার পর ঘরে তোলে। আর ওই যারা আসবে ফোকটে গিলতে তাদেরও হাত টাত ভালো করে পরিষ্কার করিয়ে তবে যেন ঢোকায় বাড়িতে।" সুখেন্দু কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বলেন।
"স্যানিটাইজ়ারের বোতল লাগবে একটা।" অমিতা বলতে বাধ্য হন।
"আবার? এই না সেদিন কেনা হল? করো কী ওগুলো নিয়ে? জলের মতো খাও নাকি?" 
"খেতে যাব কেন? সব সময়ে ডাক্তাররা বলছে শুনছ না? টিভিতে, পেপারে। ওই তো নাকি এই হতচ্ছাড়া ভাইরাস আটকানোর একমাত্র উপায়। চার চারটে লোক বাড়িতে, তার ওপর দুটো কাজের লোক। খরচা হবে না? নাকি শুধু চোখের সামনে ভর্তি বোতল সাজিয়ে রাখলেই রোগ সেরে যাবে? অনেক অদ্ভুত লোক দেখেছি সত্যি, তোমার মতো আর দ্বিতীয়টি দেখলাম না এ জীবনে।" 
তীব্র অসন্তোষ নিয়ে ঘর ছাড়েন অমিতা। মেয়েছেলের অসন্তোষে সুখেন্দুর অবশ্য কিচ্ছু আসে যায় না।
সাইডটেবিলে রাখা ফোনটা বেজে উঠল এই সময়েই।


ঘুম থেকে উঠেই রোজ এত তাড়াহুড়ো লাগে, এক এক দিন সুবর্ণার নিজেকে পাগল পাগল মনে হয়৷ সংসার যে কী বিষম বস্তু আগে জানলে বোধহয় ও পথে পা-ই মাড়াত না৷ চয়নের সঙ্গে প্রেম করার সময় তো আর বোঝা যায়নি যে সে একেবারে আদি অকৃত্রিম ভারতীয় পুরুষের কভার মডেল৷ একমাত্র চাকরিটি ছাড়া দুনিয়ার অন্য কোনও কাজ তার দ্বারা হবে না৷ এক গ্লাস জল খেতে গেলেও তার বনিকে ডাকতে হয়৷ 
এমন বাবার ছেলেও যে একখানি রত্ন হবে তাতে আর সন্দেহ কোথায়৷ তিনি তো আর এক অবতার৷ সুবর্ণার সকাল আরম্ভই হয় ছেলের নিদ্রাভঙ্গ পর্ব দিয়ে৷ চয়ন অবশ্য তখন বালিশ আঁকড়ানো ধোপার পুঁটুলি৷ সে মা ছেলের নিত্যদিনের দক্ষযজ্ঞের খবর রাখে না, রাখতে চায়ও না৷ ও সব সুবর্ণার ডিপার্টমেণ্ট৷ তার চেয়ে আধঘণ্টা এক্সট্রা ঘুমের প্রতি তার অনেক বেশি আকর্ষণ৷ সুতরাং নিরুপায় সুবর্ণা প্রাণপণে লড়ে যায়৷ 
ওদিকে তোজোকে স্কুলে পাঠানোই এক মহাযুদ্ধ প্রায়৷ নাইনথ স্ট্যান্ডার্ডের ছেলে হলে কী হবে, এই এক বছর বাড়ি থেকে অনলাইনে পড়াশোনা করে করে তার স্কুল যাওয়ার অভ্যেসটাই চলে গেছে। নতুন করে অভ্যেস আবার তৈরি হতে হতে বোধহয় স্কুলের পাটই শেষ হয়ে যাবে। সাড়ে সাতটায় তোজোর বাস আসে৷ সাড়ে পাঁচটা থেকে কুম্ভকর্ণের পকেট সংস্করণকে জাগানোর প্রচেষ্টা চালু হয়৷ প্রথমে বাবা বাছা দিয়ে শুরু করে শেষটায় ঘেঁটি ধরে টেনে হিঁচড়ে বিছানা থেকে নামানো৷ ঠেলেঠুলে বাথরুমে ঢোকালেও শান্তি নেই, তোজো টয়লেটে বসে বসেও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে৷ পেছনে লেগে না থাকলে এত বড় ছেলেকে তৈরি করাই যায় না৷ সে পাট চুকলো তো খাওয়ানো নিয়ে দক্ষযজ্ঞ শুরু হল৷ সে যে কী এক কাণ্ড নিজের চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না৷ কলার নাম শুনলে ছেলের বমি আসে, দুধ খেতে গেলে হেঁচকি টেচকি তুলে একাকার কাণ্ড, মাখনে গন্ধ লাগে, কত রকম যে তার প্যাখনা৷ কখনো চোখ পাকিয়ে কখনো ষাট সোনা করে কোনোরকমে ছেলের পেটে ব্রেকফাস্ট চালান করতে হয়৷ তারই মধ্যে ফাঁক বার করে টিফিনও তৈরি করতে হয়৷ একই টিফিন রোজ দিলে আবার বাবুর গাল ফোলে৷ কোনওদিন পরোটা আচার তো কোনও দিন হালুয়া পুরি৷ সে সব তৈরি করে প্যাক করে তোজোর ব্যাকপ্যাকে ঢোকানোটাও মায়েরই ডিউটির মধ্যে পড়ে৷ 
“ও রে জলের বোতলটা নিলি না তো, ওই দ্যাখ ক্লাস ডায়রিটা তো টেবিলেই পড়ে রইল, মাস্ক পর মাস্ক পর...", ইত্যাদি ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিকও সঙ্গে সঙ্গে চলতেই থাকে৷
ছেলে বাসে চড়লেন তো এবারে বাবার পালা৷ প্রথমে জল৷ তার পর এক কাপ চা৷ তারপরে আরও এক কাপ চা৷ খবরের কাগজ এলে শান্তি৷ বাবু এইবার কাগজ বগলে বাথরুমে ঢুকবেন৷ 
বাপ ছেলের পেছন পেছন এই শাটল সার্ভিস করতে করতে আটটা বেজেই যায়৷ তার পরে শুরু হয় আসল রান্নাবান্নার পালা৷ অন্য দিন এর মধ্যে গৌরীর মা এসে রাতের বাসনগুলো মেজে ফেলে৷ আজ আবার তারও দেখা নেই৷ সাতটা চল্লিশ হয়ে গেছে, এখনও যখন আসেনি তার মানে আজ আর তিনি আসছেন না৷ চমৎকার৷ এরা কামাই করার কথা কখনও আগে থেকে বলেও যায় না৷ অথচ মাইনে কাটলেই মুখ হাঁড়ি আর গায়ে জ্বালা ধরানো বচন৷ অথচ পুরো লকডাউন পিরিয়ডে একটা টাকাও কাটা হয়নি কিন্তু।
আচ্ছা আগে জানাতে কী অসুবিধে হয়? তাহলে রাতেই বাসনগুলো মেজে রাখা যেত৷ কোনদিকে যে এখন যায় সুবর্ণা৷ চয়ন সকালে যতই টোস্ট ডিম কি দুধ কর্নফ্লেক্স খেয়ে যাক, দুপুরে তার দু মুঠো মাছ ভাত না হলে চলে না৷ চলছে না আজকাল। লকডাউন পিরিয়ডে বাড়ি থেকে কাজ করার সাইড এফেক্ট। অতএব সাড়ে নটার মধ্যে সুবর্ণাকে পুরো দিনের রান্না নামিয়ে ফেলতে হয়৷ সুন্দর একটা বেতের ঝাঁপি মতন আছে সুবর্ণার, তাতে মাপ মত খোপ খোপ করা৷ সেই খোপে খোপে চার থাকের টিফিন ক্যারিয়ার, জলের বোতল, কাঁটা চামচ, ন্যাপকিন থেকে নিয়ে স্যানিটাইজ়ারের শিশিটি পর্যন্ত সুবর্ণা গুছিয়ে গুছিয়ে ভরে দেয়৷ আজ আবার সিংক ভর্তি এঁটো বাসন ডাঁই হয়ে পড়ে আছে, আগে সেগুলোকে তুলে তবে তো রান্নায় হাত লাগানো৷ সুবর্ণা কাঁধের ওপর এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলোকে তুলে মাথার ওপরে ঝুঁটি করে একটা৷ দরজার পেছনের হুক থেকে এপ্রনটা নিয়ে কোমরে বাঁধে৷ গৌরীর মার বিশ্বাসঘাতকতার কথা পরে ভাবা যাবে, এখন সম্মুখে সমরাঙ্গন৷ 
যত দরকারি কাগজপত্রের কথা চয়নের ঠিক অফিসে বেরোবার আগেই মনে পড়ে৷ 
“বনি আমার ইনসিওরেন্সের ফাইলটা কোথায়, বনি অমুক কাগজটা কোথায় রেখেছিস, বনি বনি বনি...", মাথা খারাপ করে দেয় একেবারে৷ 
“এগুলো তো কাল রাতেও বলা যেত, এখন ভাত নামাব না ডালে ফোড়ন দেব না ফাইল খুঁজতে যাব?” 
এ সব কথা অবশ্য মনে মনেই বলে সুবর্ণা, জোরে বললে পরিষ্কার আকাশে অপ্রত্যাশিত ভাবে প্রবল দুর্যোগের সম্ভাবনা৷ এমনিতেই আজকাল কিছুদিন ধরে হাওয়া গরম যাচ্ছে। রিংকুর মাকে সব কথা ওইভাবে বলে দেওয়াটা একেবারেই পছন্দ হয়নি চয়নের। তার জের ভালোভাবেই সামলাতে হচ্ছে সুবর্ণাকে। এর ওপর আবার সকাল সকাল কে বাবা ঝামেলা পাকাতে ভালোবাসে? অতএব গ্যাস সিম করে ভেজা হাত ঝাড়নে মুছতে মুছতে সুবর্ণা কোনও দিন ফাইল খোঁজে, কোনও দিন ওষুধের প্রেসক্রিপশন, কোনওদিন হয়তো অন্য আরও কিছু, যেটা তক্ষুণি না পাওয়া গেলে কিছুতেই চলবে না৷ 
“আমার আসলে দুটো বেবি, একটা খুদে আর একটা ধেড়ে”, সুবর্ণা নিত্যই নিজেকে বলে থাকে৷
আজ পাওয়া যাচ্ছে না একটা খাম৷
“আরে ওই তো ব্রাউন রঙের লম্বা মতন খামটা, সেদিন আনলাম না হাতে করে? কোথায় যে রাখলাম৷ তোর এই গোছানোর জ্বালায় না আমার সব দরকারি জিনিস মিসপ্লেসড হয়ে যায়৷”
সুবর্ণা যথারীতি কোনো উত্তর দেয় না৷ চুপ করেই মোটামুটি সম্ভাব্য জায়গাগুলো খুঁজতে থাকে৷
“ওখানে নেই৷ ওগুলো আমি আগেই দেখেছি, নেই ওখানে৷ তাহলে আর তোকে ডাকলাম কেন?” চয়নের গজগজ চলতেই থাকে৷ “তোর তো ওয়ার্ক ফ্রম হোম। সারা দিন তো বাড়িতেই থাকিস, কোথায় কী আছে তাও একটু দেখে রাখতে পারিস না?” 
মাঝে মাঝে সুবর্ণার মনে হয় এই এক সংলাপ বোধহয় প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চলে আসছে৷ আদিম পুরুষও বোধহয় শিকার করে এসে তার নারীটিকে বলত, ”সারাদিন গুহায় বসে বসে কী যে করো, আমার মুগুরটাও খুঁজে রাখতে পারোনি৷"
ওদিকে রান্নাঘরে আঁচে চড়িয়ে আসা কুকার সিটির পর সিটি দিয়ে ডাকাডাকি করছে৷ খাম খোঁজা ছেড়ে সুবর্ণা ডাল নামাতে দৌড়য়৷ চয়নের জিনিস চয়নই খুঁজে বার করুক আজ৷
খুঁজে অবশ্য পাওয়া গেল না৷ 
“সময় করে দেখিস তো একটু ভালো করে, খুব দরকারি কিছু কাগজ ছিল খামটায়”, বেরোতে বেরোতে বলে গেছে চয়ন৷ “ব্রাউন রঙের প্লেন লম্বা খাম, নাম টাম কিছু লেখা নেই।”
অতএব আজ সুবর্ণার প্রোজেক্ট চুলোয় গেলেও, ডেডলাইন মাথায় উঠলেও, তাকে সারাদিন বাড়ি ওলোট আর পালট করতে হবে। করতেই হবে। আর তো কোনও উপায় নেই তার, কোনও যাওয়ার জায়গা নেই। চয়ন বেঞ্জামিন কোনারের পেছন পেছন হাঁটার সিদ্ধান্ত যেদিন থেকে নিয়েছে সে, সেদিন থেকেই তো তার সব রাস্তা, সব দরজা বন্ধ হতে হতে এই ঘরটুকুর মধ্যে এসে থেমেছে।
তাই খাম খোঁজে সুবর্ণা, ফাইল খোঁজে, ওষুধের প্যাকেট খোঁজে। নিজেকে খোঁজে না আর কক্ষনো। 


"বীথি, আমি একটু বেরোচ্ছি।" বার্মুডার ওপরেই ফুলপ্যান্ট গলিয়ে নেয় বিকাশ। পাতলা হয়ে আসা চুলে দুটো চিরুনির টান।
"কোথায় চললে এখন আবার?" বেডরুমের দরজায় এসে দাঁড়ায় বীথি।
"ওই সুখেন্দু হাজরার ফ্ল্যাটে। ডাকছে। দরকার আছে।"
"এখন?" বীথি একটু অবাকই হয়।
"হুঁ। বলছিলাম না তোমাকে সেদিন। সোসাইটি থেকে বাল্ক স্যানিটাইজারের অর্ডার দেওয়া হবে? তারই সাপ্লায়ার এসেছে। কন্ট্র্যাক্ট ফিক্স করতে হবে। যাই। মাহেশ্বরীও আসছে।" মুখটা রুমাল দিয়ে একবার মুছে নেয় বিকাশ। তেলতেল করছিল।
"মাহেশ্বরী মানে ওই টাওয়ার সিক্সের মারওয়াড়ি ভদ্রলোক তো? তোমাদের ট্রেজ়ারার?"
"হ্যাঁ, ও-ই। দরাদরির ব্যাপারে এক্সপার্ট। ওকে ছাড়া এসব হবে না।" 
"সস্তায় করিয়ে দেবে বুঝি?" 
"দেখি কততে কী দেয়। আমাদের ক বোতল লাগে বলো তো মাসে?"
"ওই তো, এক লিটার মতো।"
"আচ্ছা, দেখছি যদি আমাদেরটা ফ্রিতে ম্যানেজ করা যায়।"
"দেবে?" বীথির গলায় আগ্রহ টের পাওয়া যায় স্পষ্ট।
"দেখিই না।" বিকাশ পায়ে চটি গলাতে গলাতে হাসে।
"আচ্ছা শোনো না, ওই বিশ্বাসরা কেন এসেছিল গো?" 
"আরে সেই সুবর্ণা কেস। ছাড়ো তো। আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। লোকের বেডরুমে উঁকি দিই গিয়ে।" দরজার বাইরে পা বাড়িয়েও থেমে যায় বিকাশ।
"মেয়েটা কিন্তু সত্যি ভালো।" 
"ভালো হোক আর মন্দ, মেজরিটি এগেনস্টে গেলে ফ্ল্যাট ছেড়ে উঠে যেতেই হবে। হাওয়া যা বুঝছি, বেশিদিন টিঁকবে না ওরা নীলাঞ্জনায়। ও নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই। চুপচাপ থাকো, বেশি মেশামিশি করতে যেও না। তোমার একটু সফট কর্নার আছে ওদের ওপর, জানি।" 
"তুমি কিছুই বলবে না ওদের হয়ে? নাহয় বিয়েই করেনি, তাতে কী হল? আজকাল তো কতই হয় এরকম।"
"সে হয় আমিও জানি। কিন্তু এখানে সবাই মানবে না। আমি মরতে গলা বাড়াব কেন হাড়িকাঠে? দেখি আর কটা দিন। সোসাইটিতে আমি ছাড়াও তো ডিসিশন মেকার্স আছে। ফাইনালি যেদিকে হাওয়া দেখব, সেদিকেই ইয়েস বলে দেব। তারপর উঠে যাওয়ার নোটিশ দিক কি ধাক্কা দিয়ে তাড়াক সে কমিটির ব্যাপার। যাকগে, দরজাটা দিয়ে দাও, বুঝলে। আসছি আমি ঘুরে।" বিকাশ বেরিয়ে যায়।


বাংলাটা গৌতম মাহেশ্বরী অনেক বাঙালির থেকেই ভালো বলে। তিনপুরুষের কলকাত্তাইয়া সে, নিজের বাড়িতে আমিষ ছোঁয় না, বাইরে গেলে সবরকমই চলে।
"ঠিক করে বলুন মিস্টার দাস, কতটা ডিসকাউন্ট দিতে পারবেন। আপনাকে তো বললাম, আমাদের শুধু স্যানিটাইজ়ারেরই মোটামুটি থাউজ়্যান্ড এমেল হিসেব ফাইভ হান্ড্রেড বটলস লাগবে, পার মান্থ। নীলাঞ্জনায় এখন প্রায় এইটি পার্সেন্ট অকুপ্যান্সি, আয়্যাম শিওর সব ফ্ল্যাট থেকেই অর্ডার হবে। এবার আপনি বলুন।" 
গৌতম মাহেশ্বরী সোফায় পিঠ এলিয়ে দেয়। প্রায় আধঘণ্টা ধরে এই দর কষাকষি চলছে রক্তিমের সঙ্গে তার। 
"আপনাকে তো প্রথমেই বললাম স্যার, কোম্পানি টোয়েন্টি পার্সেন্ট ম্যাক্স দিতে পারে। আমার হাতে কিছ্ছু নেই।"
"আছে আছে, ইচ্ছে করলেই পারবেন।" মাহেশ্বরীর নরম সুরের পেছনের ইস্পাতটা রক্তিমের কান এড়ায় না। 
"ওহো, সফট ড্রিংকটা গরম হয়ে যাচ্ছে যে। খান, খান, খেয়ে নিন। শরীর ঠাণ্ডা হবে, মাথাও পরিষ্কার হবে।" 
"না স্যার, সত্যি পারব না।" কোল্ড ড্রিংকের গ্লাস হাতে তুলেও নামিয়ে রাখে রক্তিম।
"তাহলে তো আমরাও পারব না মিস্টার দাস। ভেবে দেখুন। এত বড় অর্ডার, ছেড়ে দেবেন? একটু কমপ্রোমাইজ করলে কিন্তু আখেরে আপনাদেরই লাভ। ভেবে দেখুন, এখনই তো বিজ়নেসের সময় মিস্টার দাস, ভাইরাস রোজ বাড়ছে, রোজ ছড়াচ্ছে। যত ছড়াবে তত আপনার কোম্পানিও বেশি বেশি মাল সেল করতে পারবে। কুড়ির জায়গায় তিরিশ দিলে ঠকবেন না মিস্টার দাস।"
"আমি বরং আমার বসকে একটা ফোন করে দেখি স্যার। আমি নিজে থেকে সত্যি এর বেশি দিতে পারব না।" এসিতে বসেও রক্তিমের কপালে হালকা ঘাম ফুটে উঠছিল। তার মালিক এমনিতেই তিলে খচ্চর লোক। এত বড় অর্ডার হাতছাড়া হয়ে গেলে তাকে ছেড়ে কথা বলবে না সে।
"হ্যাঁ হ্যাঁ, করুন করুন। ফোন করে কথা বলে নিন। বলুন রোগ যে ভাবে ছড়াচ্ছে, প্রত্যেক মাসে প্রচুর স্যানিটাইজা়র লাগবে আমাদের, একটু ডিসকাউন্ট রেটটা না বাড়ালে আমাদেরও তো মুশকিল। এ ভাইরাস তো সহজে যাবার নয়, সব্বার ঘরে ঘরে ঢুকে আছে। টোয়েন্টিফোর ইনটু সেভেন স্যানিটাইজ করতে হবে। সব সারফেস।" মাহেশ্বরী যেমন এলিয়ে বসে ছিল সেভাবেই বসে বসে বলে।
"আর হ্যাঁ, পারলে ওর সঙ্গে হ্যান্ড ওয়াশের অর্ডারটাও অ্যাড করে দিন। এতগুলো ফ্ল্যাট, এত এত লোক, এত এত ভাইরাস, নেহাত কম সেল হবে না ভাই। আপনার বস বিজ়নেস করতে এসেছেন, লাভ লোকসান ঠিকই বুঝবেন। দেখুন, দেখুন। কতটা কম করতে পারেন দেখুন।"
হালকা চোখ টেপে মাহেশ্বরী সুখেন্দু হাজরার দিকে।
বিকাশ এতক্ষণ চুপ করে এদের দড়ি টানাটানি দেখছিল। এবার সে কথা বলে।
"না হয় কাগজে কলমে কুড়িই দেখাবেন। এক্সট্রা দশ পার্সেন্ট আরামসে অ্যাডজাস্ট হয়ে যাবে।  ফিউচার অর্ডার কিন্তু তাহলে আপনার গ্যারান্টিড। আমরা অন্য কোনো সাপ্লায়ারের সঙ্গে কথাই বলব না আর। বলুন এটা বসকে আপনার। তিনজন আছি আমরা। হয়ে যাবে দশ পার্সেন্ট অ্যাডজাস্ট। আর হ্যাঁ, আমাদের তিনজনকেই স্যানিটাইজ়ারের বটলগুলো ফ্রি দেবেন অফ কোর্স। আপনাকে কন্ট্রাক্টটা পাইয়ে দেওয়ার দরুন একটা মিনিমাম থ্যাংকস, বোঝেন তো? লং টার্ম কন্ট্র্যাক্ট। যতদিন ভাইরাস, ততদিন আপনার কোম্পানি, ততদিন আপনার বোনাস, ইনক্রিমেন্ট, ইনসেন্টিভ।" হালকা একটা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখে বিকাশ।
"ঠিকই। তাতে আমরা প্রায় সকলেই সিনিয়র সিটিজ়েন, ভেরি ভেরি ভালনারেবল। যা দিনকাল, স্যানিটাইজ়ার ছাড়া বাঁচাই যাবে না। কী বলেন, মাহেশ্বরী সাহেব? ঠিক বলেছি কী না?" টেনে টেনে হাসতে থাকেন সুখেন্দু। 
এসির কনকনে হাওয়ায় জীবাণুনাশকের কড়া গন্ধ ঘুরপাক খায় ঘরের ভেতর। ভাইরাস মরে কি? কে জানে।

Comments