গল্প - নবনীতা সান‍্যাল

 


শত্তুর 


এক

শোভা গিয়েছিল ক্লাস থ্রির অসুস্থ বাচ্চাটাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। ফিরে এসে তুলসীপাড়া অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ‍্যালয়ের ফোর্থ ক্লাস স্টাফ শোভা,শুনলো হেডমিস্ট্রস চাঁপাদি বলছেন-- "তোর ছেলে এসেছিল শোভা, তুই ছিলি না, তা বললাম বসতে। গেলো গা- -"।'সাইকেল লয়‍্যা  আসছিল নাকি'? আতঙ্কিত শোভা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো। কেউ বলতে পারলো না। কাগজপত্র দেখতে দেখতে মুখ না তুলে হেডমিস্ট্রেস ঠোঁট  উল্টালেন। অজানা ভয়ে কাঁটা হয়ে গেলো শোভার ভেতরটা--

তারপর , রাগ হলো মেয়েদের উপর। একটু খেয়াল রাখতে পারে না ধিঙ্গি মেয়েগুলো।রাগ হলো বয়স্ক শাশুড়ির উপর।  তারপর আস্তে আস্তে মনে পড়তে লাগলো- শাশুড়ি তো তার মেয়ের বাড়ি গেছেন ঝগড়া করে, --ওহো মেয়েগুলো  তো ইস্কুলে! এরপর সব রাগ গিয়ে পড়লো জগবন্ধুর উপর। 'সোয়ামী হিসাবে কুন্ দায়িত্ব সে করেসে?! চিরটাকাল ভালো মানুষ সাইজ্জা গেলো,, কুনকালে কী সামলাইছে?" ভাবলো, পাশের গালামালের দোকানদারকে একটা ফোন করে। তারপর খানিকটা সিঁটিয়ে গিয়ে ভাবলো -'থাউক', থাউক'।  চাাঁপা ম‍্যাডাম মুখ তুলে বললো-" তুই এতো ভাবিস ক‍্যান্?  পোলাপান বড় হইলে হাত পা গজাবে না?" শোভা বললো, 'বড়দি, টিফিনের  পরে বাচ্চাদের খাওয়া শেষ হলি বাড়ি যাওয়া লাগবো আমার।" ঘাড় নেড়ে চাাঁপা বললো,"দেরি করিস না।' শোভা আস্তে আস্তে বললো',না,দেরি হবেনা ।'


 ভেতরে ভেতরে থম মেরে গেলো শোভা। বুকের ভেতরটা এক্কেরে খাাঁখাঁ করে উঠলো। "এখনও দুটা পিরড বাকি'...', হা রে..এতক্ষণ,মনটা ফুরফুরে  ছিল শোভার। কী মায়া যে ওই বাচ্চা পোলাটার। স্কুলে এসেই বমি করে অসুস্থ হয়ে গেলো। শোভা ওকে নিয়ে গেলো ওর বাড়ি । আহা, কী সুন্দর বাড়িখান! সামনে কতো গাছ! তবে, মা খান বড় দুবলা-- রুগ্ন।  এই বাচ্চাটার পরে আরো দুটা বাচ্চা, বৌটা আর পেরে ওঠে না,তাই দূরে ইস্কুলে দিতে পারে নাই।কতকখন গল্প করছিল। বাচ্চার যত্ন করার কথা টথা বলে টলে শোভা ফিরেছিল। ফিরে এসে এখন এই শুনলো, এই! বিজুাটাকে  নিয়ে শোভার চিন্তার আর শেষ নাই। সবসময় চিন্তা ঘাই মেরে ওঠে। মেয়ে দুটাকে নিয়ে কোনো চিন্তা নাই। পড়লেখা করে, ঘরের কাজ করে,.. ঘরেই থাকে। কিন্তু, পোলাটা! শাশুড়ি বিড়বিড়ায় -'পোলা,পোলা  করস্.. এমন পোলা দিমু তোরে গলায় ঠেইক্কা মরস্"। শোভা শোনে শাশুড়ি প্রতিবেশিদের সঙ্গে গল্প করেন.." আমাগো বাড়ির আর কুনো পোলা -মাইয়া এই  বিজয়ের ঢক না...বাপরে বাপ... এক্কেরে পাগল বানাইয়া ফেলাইল ব‍্যাকটিরে"।শুনে শুনে আর সহ‍্য হয় না,শোভা মুখ ঝামটা দেয়'হ, হ জানাই আছে আমার। কে জে কীইইটা জানাই আছে।সক্কাল সক্কাল আমার পোলাটারে গাল দিবার না পারলে আপনের ভাত হজম হইতো কিয়েরে!"


জগবন্ধুর কারখানা থেকে ফিরে সাইকেলটা বেড়ার দিকে ঠেস দিয়ে রাখতে রাখতে বলে-"সাইকেলটার বারো বাজায়‍্যা ছাড়ছে"।মুখ ভেংচে শোভা বলে," আহ্ রে, কত্দিন থাকি তো সাইকেল চায়.. কিনা দিলাই ঝামেলা যায় গিয়া... বাসার থিকা বাজার হাট সবই দূরে ... গোর বেগোরে সাইকেল নাগে না নাকি?একা পোলার দুষ অয়। নিজে কারে কারে দিয়া রাখো সাইকেল তার খুঁজ নাই.."। জগবন্ধু বলে, "হ' ট‍্যাকা তো গাছ ঝাড়া দিলেই আহে... তুমার আহ্লাদে পোলাটা নষ্ট হইতেছে আরও.." ।শোভার গায়ে জ্বালা ধরে। বলে',ঠিকই  আসে, কিন্তুক মনে রাইখ‍্যো,ট‍্যাহা কিন্তু  আমিও আইন‍্যা দিতাসি। ঘরের কাম কইর‍্যা, ব‍্যাকটিরে জুগাড় দিয়া ইস্কুলে গিয়া কাজ কইর‍্যার ফির ঘরে আইসা কাম... তোমরা পাইসো কীইটা আমারে?"

শাশুড়ি বিরজা একটু থামানোর চেষ্টা করেন,' আহ্! তোমারে তো কয় নাই। পোলাটারে শাসন করা লাগবো না?" "-হ্, শাসন! পোলা আমার দুষ্ট সে ব‍্যাকটিই জানে.. তায় মিথ‍্যা দুষ দেন কীয়েরে? আমার পোলা আমি বুঝুম, হ‍্যারে কইলে আমার গায়ে নাগে.."। রাগ করে  জগবন্ধু উঠে পড়ে। বলে,' ধুরওও, বাড়ি ফির‍্যা এতো ঝঞ্চাট আর পুষায় না। এরে সংসার  কয়, না কি কয় ,কও?"গায়ে জামা দিয়ে বের হওয়ার পথে,বড় মেয়ে সোনা এসে দাঁড়ায় -- 'বাবা, চা'। সোনার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ ছলছল করে, বাপের। আহা, বড় লক্ষ্মী মেয়েখান। এক হাত বাড়িয়ে অন্য হাত তার মাথায় হাত দিয়ে বলে,'ইস্কুল নাই আজ?"মেয়ে ঘাড় নাড়ে অর্থাৎ,আছে। হাতের ঘড়িখান দেখে জগবন্ধু বলে, 'যা, যা নয়টা বাজে। দেরি হয়‍্যা যাইবে..."। মেয়ে বলে, "আজকে রেজাল্ট দিবে বাবা।। পাশ করলে একটা সাইকেল  কিনা দিবা আমারে?"-- "আবার সাইকেল?" জগবন্ধু  হাসে।হেসে চা-টা একচুমুকে শেষ করে কাপটা ফিরিয়ে দেয়।মাথা হেলায় - 'দিমু'। তারপর অ‍্যাবাউট টার্ণ করে, কলতলার দিকে যেতে যেতে পরনের শার্টখানা টেনে খুলে ফেলতে থাকে---


  দুই

শীতকাল এসে গেলো। সোনা বড় লক্ষ্মী মেয়ে, "হে,বাপের ঢক হইছে".. তার ঠাকমা বলেন।রূপা আর বিজু পিঠাপিঠি। বছরখানেকের ছোট বড়। সোনার ক্লাস টেন, সামনের বছর  মাধ্যমিক।  সে চুপচাপ, নিজের মতো, সে বাড়ি আছে না নেই -বোঝাই যায় না।স্কুলে ভালো রেজাল্ট দেখে মাস্টাররা ডেকে কথা বলেছেন জগবন্ধুর সঙ্গে। ক'টা টিউশ‍্যন দিতে বলেছেন, বলেছেন,'ইস্কুলে অতজনের মধ্যে বিশেষ নজর দেওয়া সম্ভব না'।বলেছেন,জগবন্ধু যেন দেখে ব‍্যাপারটা। বাড়ি এসে  সেকথা বলতেই,শোভা বললো, ' সব অতেরেক্ত। সব বাড়াবাড়ি,.. মাধ্যমিকের পরে ছেলে খুঁজাও তো নাগবে...  নাকি?"। নারকেলের পাতা থেকে কাটি বের করতে করতে শাশুড়ি বিরজা বললো, ' মেয়েগুলা ভালোই করবো, কিন্তুক ওই পোলাটার পড়ালিখা অইবো না,দেইখো।"--"খপরদার, কয়‍্যা দিলাম, আকথা কইয়েন না-" শোভা ফুঁসে ওঠে। আবার, ঝামেলা বাধে দেখে জগবন্ধু বলে,"ঠিক আসে , ইবার পাশ না করলে কামে ওরে লাগাইয়‍্যা দিমু-" শোভা উশখুশ করে,কী একটা বলত চায়,বলতে পারে না। রাতে শুয়ে শুয়ে স্বামীর ঘনিষ্ঠ হয়ে আসে। জগবন্ধু একটু অবাক হয়। শোভা আবদার করে,"একখান সাইকেল কিন‍্যা দিলে  বিজু পড়বো, হে কথা দিছে-"। জগবন্ধু কোনো উত্তর দেয় না, পাশ ফিরে শোয়।

 ওভার ডিউটি নিল জগবন্ধু। তারপর সপ্তাহ ঘুরলে একদিন নীল রঙের একটা সাইকেল নিয়ে এসে বললো,' এইটা সবার। সবাই  দরকারে নিবা এইটা।"বিজু এসে সাইকেলে হাত বুলায়। বলে,'লেডিস সাইকেল কিনল‍্যা। আমার সাইকেল কী অইলো?"--"সাইকেল অহন একটাই। সবাই ব‍্যবহার করবা।" রাগে ফোঁস ফোঁস করে বিজু-  'নিমুনা।  সাইকেল লাগবো না।লেডিস সাইকেল তো মাইয়াগো। ছিঃ, আমার লজ্জা করে।' জগবন্ধু এসে ঘাড় ধরে তার-"বছর বছর যে ফেল মারস্, তহন লজ্জা করেনা।" ঠাকুমা এসে ত ধরে। ভাগ‍্যািস, শোভা বাড়ি ছিল না। শোভা ফিরে আসলে ধুন্ধুমার বাধে। বিরজা বড়ি দিতে দিতে আপনমনেই বলে,"ভাবখান দেখায়  এমন যেন্, পোলা ছাড়া দুনিয়া আন্ধার।মাইয়াগুলার দিকে খুঁজ নাই-যেন্ ওগুলান  উয়ার  নিজের বাচ্চা না!! কিয়েরে ধরসে উকে...কপাল, কপাল। বুঝবো নেএকদিন।"

 কদিন পরে আর একটা সাইকেল আসে, শোভার লোনের টাকায়।এবং সে বছর পড়ালিখায় মন দেয় বিজয়, এর মধ্যে  মাসখানেকের পার হয় -- তারপর আজকের এইদিন--রেললাইন পার হয়ে, ব্রিজ তারপর ,বাজার পার হয়ে শোভার ইস্কুলে 'পৌঁছাইল  বিজু!'। ভাবলেই বুকটা ছাঁৎ করে ওঠে। নিশ্চয়ই টাকা নিতে এসেছিল। কী এমন দরকার পড়লো যে শোভা বাড়ি পৌঁছানো অবধি অপেক্ষা করা গেল না পোলাটার। বাড়িতে জানলে কুরুক্ষেত্র হবে।অসহ‍্য লাগে, অসহায় লাগে শোভার। পাতলা চটিটার নিচ থেকে গলা  গরম পিচ পায়ে লাগে।ছাতা ভেদ করে রোদ চাঁদি গরম করে। হাঁটতে থাকে শোভা। 


তিন

বাড়ির সামনে এসে ভিড় দ‍্যাখে শোভা। দেখে  মাথায়  হাত দিয়ে মাটিতে বসে আছে জগবন্ধু। আশেপাশের বাড়ির লোক সব জড়ো হয়ে  আছে। দেখে ভয় পায়  শোভা! - "কী হইসে!" পাড়ার চারু বক্সী এগিয়ে  আসে। -- "বৌদি চ‍্যাংরা টাক একটু শাসন করলি পারতেন, আগে  থাকি!" অন্য সময় হলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতো শোভা। দু'চার কথা শোনাত। এখন তার মূখে কথা জোগাল না-- পালকাকা এগিয়ে  এসে বললেন.. "বউমা, কাজটা খুব খারাপ হলো। মান সম্মান সব গেলো জগটার-" বিহ্বল শোভার মুখের সামনে, হাত নেড়ে পাঁচুর মা বলতে লাগলো.." ওই, বিরিজের নিচে থাকি, নেশা করতি গিয়‍্যা ধরা পডসে বিজু, আরও কয়টা পোনা আছিল..নেশাখুরদের ধরতেসে পুলিশ ..।  অহন সবটি পলাইসে, বোজলা!?' পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল শোভার, শাউরি ঠিকই বলতো.".শত্তুর, বাইরে না, ভিতরিই থাকে, পেটের শত্তুর, পেটের শত্তুর"। সোনা রূপা এসে হাত ধরলো, "ভিতরি চলো মা, এহানে আর খাড়ায়ো না। চলো.."। ঘরের  ভেতরে এসে বসে পড়ে শোভা।  হুড়দুড় করে ঘরে আসে জগবন্ধু.." দ‍্যাকলা, কী হইলো, সব তুমার দুষ।সব। তুমার আহ্লাদে পোলাটার এই গতি হইসে। মান সম্মাল সব গেলো আমার, ছিঃ.. ছি ছি। কুনোদিন কেউ ক'বার পাবো কুনো খারাপ কাম করসি আমি? আমাগো গুষ্ঠিতে কেউ নাই এমন.. ট‍্যাহা নাই আমাগো, সনমালটা আছিল.. সব গেলো গা , কী কবে মানসে, ছি, ছি।" অস্থির হয়ে  যেমন এসেছিল সেইভাবেই চলে গেলো লোকটা।

 শোভার মুখটা কঠিন হয়ে গেলো। চোখ মুছে, শক্ত হয়ে সে বসে থাকলো। মনে পড়তে থাকলো  নিরীহ বিধবা মায়ের মেয়ে হয়ে  তাকে  আর তার দিদি পুষ্পকে কী অবহেলাই না সহ‍্য করতে হয়েছে আত্মীয়দের কাছে।  মা  বলতো "পোলা থাকলি কবেই আলাদা ব‍্যবস্থা করবার পারতাম' ---থাকতে হয়েছে পরের বাড়ি , দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই গেছে বহু , কী কষ্ট!কী কষ্ট..!. কতো ধরাধরি,  কতো চেষ্টা করে সে একটা চাকরি  জোগকরতে পেয়েছে।কে সাহায্য করেছে? কেউ না। জগন্ধুও না।কেউ না। তাহলে...। মনে পড়ে গেলো জগবন্ধুর পরিবারের কথাও.. জগবন্ধু বাবা বড় অকালে চলে  গেছে। নাহলে, জগবন্ধুর আজ কারখানাবাবু হওয়ার কথা ছিলোনা। নীরব,নিরীহ,অনুত্তেজিত উচ্চাশাহীন, লোভহীন ভদ্রলোক জগবন্ধু, তাকে ভালোবেসেই তার ঘরে একদিন উঠেছিল শোভা। ভালোবাসা সত্যি ছিল। শোভা কাউকেই ঠকায় নি। কিন্তু, দেখলো সে ঠকে গেছে।  তাদের পরিবেশের পক্ষে একেবারেই  উপযুক্ত নয় জগবন্ধু । 'দুটা কথা সে জুরে কবার পায় না,  বেটাছেল‍্যা... ফুঃ!" তাকে পাড়ার লোক ঠকিয়ে জমি কেড়ে নেয়, বড়লোক আত্মীয়েরা হতছেদ্দা করে, আর সে শুধু  দুঃখ পায় মাথা নাড়ে আর  বলে. 'কাজটা ঠিক করলা না '। এইভাবে দিন চলে না। কাজের কাজ কিচ্ছুই হয় না,লাভের মধ্যে রুখে দাঁড়িয়ে বদনাম কুড়াতে হয়  শোভাকে। ভালো মানুষ, সচ্চরিত্র বলে জগবন্ধু সুনাম পায়, আর তার দজ্জাল, রাগী  বউটাকে মনে মনে ভয় পায় সবাই।

ছেলেটাকে এইভাবে গড়ে তুলতে চায় নি শোভা। চেয়েছিল  নিজের অধিকার  সে যেন বুঝে নিতে পারে। জেদী, দৃঢ়  একরোগা স্বভাবের ছেলেটাকে সে প্রশ্রয় দিয়েছিল - কারণ  জীবন দিয়ে শোভা অনুভব করে , ব‍্যক্তিত্বহীন ভালো মানুষ  হওয়ার চেয়ে চালাক চতুর বজ্জাত 'ব‍্যাটাছেলে'হওয়া ভালো। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়ে শোভা বুঝেছে যে ভালো মানুষের চাইতে বজ্জাত ধড়িবাজ জোর গলায় কথা বলা লোককে  সমাজ মান‍্য করে বেশি। জগবন্ধুকে শোভার কোনোকালে বুদ্ধিমান মনে হয় নি।  তাই চালক চতুর ছেলেটাকে সে তার ভবিষ্যতের আশ্রয় করে তুলতে চেয়েছিল।। তাই, তাকেই সে তোল্লাই দিয়েছে, নিজের ভবিষ্যতের জন্য -- এছাড়া  আর কী  করতো শোভা!!। একা থাকলে এইসব কথা ভাবে। কাউকেই তো বলা যায় না, এসব! কে শুনবে? কে বুঝবে?


চার. 

দিন দশেক বাদে ঘরে ফিরল বিজু। তখন সন্ধ্যাবেলা।  কিছুক্ষণ গোঁজ হয়ে বসে থাকলো, তারপর ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকলো।  শোভা দেখলো। কিছু বললো না। সোনার পরীক্ষা সামনে, রূপা চা আর মুড়ি  দিল তাকে। সে ছুঁয়েও দেখলো না। রাতে শোভা  ঘুমন্ত  পিঠে হাত রাখলো। কিছু বললোনা। কী এক ম‍্যাজিকে  বিজয় পরের দিন থেকে স্বাভাবিক হয়ে গেলো।  জগবন্ধু  আর তার দিকে তাকিয়েও  কথা বলে না। মেয়েদুটো দূরে দূরেই থাকে। শাশুড়িও পারতপক্ষে কথা বলে না।বাড়িতে কেউ  আসে যায় না, খোঁজ নেয় না।অদ্ভুত থমথমে  নীরবতা বিরাজ  করে । শোভার  পক্ষে  অসহনীয় হয়ে  ওঠে। সবাই  যেন একঘরে করে দিয়েছে তাদের...  স্কুলে গিয়ে  সে যেন একটু দম পায়।চাঁপা ম‍্যাডাম বলে, ' কী রে শোভা, তোর ছেলের  খবর কী,মন ঘুরলো?' দম চেপে শোভা মাথা নাড়ে। যার অর্থ ঠিক  বোঝা যায় না।

রাতে শোবার পরে শোভা বলে, ' পোলাটা কেমন য‍্যান  হইতেসে, না"? জগবন্ধু মুখ না ফিরিয়ে বলে, 'ইস্কুলে যায়? , না নাম কাটা গেইসে'? শোভা জানে সে স্কুলে যায় না,তবু বলে যে যায়,সে ইস্কুলে যায়। শোভা গতকাল এই নিয়ে ছেলেটাকে চুপিচুপি অনেক বুঝিয়েছে। ছেলের এক কথা.." পড়ুম না। কাম করুম।" শোভা জানে সাইকেলটা বিক্রি করেছে সে। তবু, জিজ্ঞেস করলে  সে বলে "বন্ধুর বাড়ি  রাখসি।' কেউ প্রশ্ন করে না, কোন্ বন্ধু?কেউ ,বলে না কবে আনবে?।সবাই সব বুঝে‍ যায় নিজে নিজেই।সবাই তাকে হিসাবের বাইরে রাখে। এইটা শোভাকে আরও অস্থির করে। 

সে যে নেশা করে প্রচুর -- ছেলেটাকে দেখে  তার শুকনো চেহারা দেখে সবাই সব বোঝে,আশেপাশের বাড়িগুলোতে, পাড়ায় এ নিয়ে ফিসফাস আলোচনা চলে।  শোভাও বোঝে। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সে।  বুঝে যায় সে হেরে যাচ্ছে, হেরে যাচ্ছে শোভা।  জগবন্ধুর  নার্ভের অসুখ ধরে।  শাশুড়ি মারা যায় । সোনা নার্সিং  ট্রেনিং নিতে চলে যায় শহরে। রূপা গান করে,গান করে সে মেডেল পায়।কলেজে উঠতেই তার সমন্ধ আসে, দেখাদেখি চলে। এভাবেই দিন কাটে-- 

একদিন সন্ধ্যাবেলা রান্নাঘরে  এসে বিজয  ধরে শোভাকে.. ' ট‍্যাহা লাগবো।' শোভা প্রশ্ন না  করলে না সে নিজে নিজেই বলে.. '। "কতো আর,ধরো ওই  বিশ পঁচিশ হাজার-- ব‍্যবসা করুম।'  গম্ভীর গলায় শোভা বলে, "কই থিকা আসপো?" -'ক‍্যান, তুমার পভিডেন্ট ফান্ড আসে না?!"শোভা মাথা নাডে" ' নাই। 'বাপের চিকিৎসা করা লাগতেছে ..আর খরচ..."

 মিথ‍্যা কথা।..." ছেলেটা চেঁচিয়ে  ওঠে, "দিবা না,তাই কও। মেয়েদের দিবা হেই কথা তো?'" শোভার এতোদিনের সহ‍্যের  বাঁধ ভেঙে যেন বাণ ডাকে.. "হ্,দিমু না,দিমু না। ক‍্যান দিমু।কী কাজে লাগতেছস তুই?"--"  তা অইবো না।  দেওয়াই লাগবো। আমি পোলা তুমার।আমার হক আগে। '-"না, দিমু না। ক‍্যান দিমু?, আমার সবার কথাই ভাবোন লাগবো"। চিৎকার করে বিজয় বলে,"দেখমু, না দিয়া ক‍্যামনে পারো। ঘরবাড়ি সব জ্বালায় দিমু আমি"। অগ্নিমূর্তি  ধরে শোভা এবার।অন্ধকারে চোখ জ্বলে ওঠে তার- বলে 'খর্পরদার কইলাম..  অনেক কষ্টের  ঘরবাড়ি আমার। আমি আর সইজ্জো করুম না।" বলে,"  বাইর হ  বাড়ি থিকা যা, চইল‍্যা যা,, ভাগ্  এহান থিক‍্যা...না অইলে পুলিশে খপর দিমু আমি । '

হাতে একটা  পাটকাঠি, তাতে আগুন,--অন্ধকারে .শোভাকে ভয়ংকর  লাগে। সে আবার বলে, "বাইর হ কইলাম।।না  গেলে গা  কিন্তু খপর আছে তোর.. এই বাড়িত আর ঢূকপি না।...যা। বাইর হ। জ্বালা সইজজো করতসি আজ উন্নিশ বছর ধইর‍্যা।।আরনা... বাইর হ কইলাম।"


পিছু হটতে হটতে বিজু  চিৎকার করে '--ঠিক  আসে দেখা যাইবো। কে কারে বাইর করে..'। তারপর বের হয়ে যায় 

 আশে পাশে লোকজন জুটে যায়। কেউ কেউ এসে ধরে শোভাকে। অসুস্থ জগবন্ধু দরজার কাছে এসে হাঁপায়।  জ্বলন্ত পাঠকাঠি উঠোনে ছুঁড়ে ফ‍্যালে শোভা।  হাউমাউ করে কাাঁদে, বলে",প‍্যাটের শত্তুরই, শত্তুর,। শত্তুর শত্তুর...চইল‍্যা যা চইল‍্যা, যা,.. যা.."

Comments