অনুবাদ কবিতা - সুস্মিতা কৌশিকী


জন ডান :  প্রেমের কবিতার সন্ত - কবি  

                               
বিক্ষত সময় আর যাপনের লাভা নি:সরণের  মধ্যে বসেও  গোধূলিসন্ধ্যার আরতি যে রহস্যময় সংকেতে আমাদের  কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে, যে  ভাষ্য আমাদের হৃদয়ের স্বচ্ছতোয়াকে  বয়ে যেতে দেয় শত বিকশিত ধারায়,  প্রবঞ্চনা আর বেদনার কালিদহে আপন স‌ওগাত ও সপ্তডিঙা মধুকর ডুবে গেলেও, যে মুঠোভর্তি অনুভূতির জন্য  হৃদয় চিরউন্মুখ হয়ে থাকে --      তা  নির্ভার, শাশ্বত,  অনির্বাণ  প্রেমের ধারায় অবগাহনের আকুলতা  ছাড়া আর কি! তাই তো প্রেম সাহিত্যে, শিল্পে, কলায়  চিরকালীন প্রশস্ত  উপজিব্য। প্রেম যখন শত জোনাকি হয়ে আলো ছড়ায় কবিতার পংক্তিতে তখন কি তা কেবল কবির‌ মনকেই উদ্বেলিত করে, নাকি  আমাদের‌ অন্তরলোকও তার অংশীদার --- এ প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজন নেই। অনুভবী মন মাত্রই তা আলগোছে জেনে যায়। তাই প্রেমের মতো প্রেমের কবিতাও  অন্তর্দীপক।

ইংরেজি সাহিত্যে প্রেমের কবিতার আলোচনায় যাঁদের এড়িয়ে একেবারেই সম্ভব নয় তাঁরা হলেন মেটাফিজিক্যাল পোয়েটস। সপ্তদশ শতকে ইংলন্ডের একদল কবি-- নতুন পরীক্ষামূলক কাব্যচর্চাই যাদের লক্ষ্য। 

সেই মেটাফিজিক্যাল বা অধিবিদ্যামূলক কবিতা রচয়িতাদের একেবারে পুরভাগে সে। লেখাপড়ায় তুখোড় তরুণটি প্রোটেস্ট্যান্ট রানী এলিজাবেথের পায়ের কাছে হাঁটুগেঁড়ে বসবে না বলেই ঠিক করেছে। মনে প্রাণে গোঁড়া ক্যাথলিক পিতা-মাতার কাছ থেকে পেয়েছে আধ্যাত্মবাদের পরম আশ্রয়। তাই অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেও সে পাবে না প্রথাগত ডিগ্রী। থোড়াই পরোয়া। সে ভাসতে ভাসতে চলে যাবে আইন পড়তে জগৎবিখ্যাত আইনবিদ্যার নিকেতন লিঙ্কন'স ইন এ। 

আইন পাস করে  লন্ডনের বিশিষ্ট বিচারক ও অভিজাত ব্যক্তি ইগারটন সাহেবের সহকারী হিসেবে কাজ করতে করতে তরুণটি ইগারটনদের এক আত্মীয় জর্জ মুরের কন্যা অ্যানি মুরের প্রেমে পড়বে। ১৬০১ সালের ডিসেম্বর নাগাদ, অ্যানির সাথে বিয়েটাও সেরে ফেলবে, বলা বাহুল্য, তা হবে গোপনেই। কারণ কন্যাপক্ষ এ বিয়েতে রাজি হবে না কিছুতেই। কিন্তু কতদিন আর সত্য গোপনীয়তায় মুড়ে রাখা যায় ? 
জানাজানি হতেই কেরিয়ারের ইতি, এবং সশরীরে স্থান হবে শ্রীঘরে।

বয়স মাত্র ত্রিশ। ঘরে সদ্য পরিণীতা স্ত্রী, কবি  কারাবাসে। পরবর্তী বেশ কিছু বছর দুর্দশা যেন কিছুতেই ছেড়ে যেতে চায় না তাকে। কিন্তু তারই মধ্যে চলতে থাকে কবিতা - চর্চা। অন্তিম - এলিজাবেথীয়দের আবেগ সর্বস্ব জোলো রোমান্টিকতা থেকে উদ্ধার করে, স্মার্ট প্রেজেন্টেশনে ইংরেজি কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে এক ভিন্ন ধারার জন্ম দেবে তার ভাবময় কলম। বস্তুগত পৃথিবীর উর্ধ্বে তার কবিতা এক অনন্য আধ্যাত্মিক দর্শনকে তুলে ধরবে, যে কাজে প্রধান আয়ুধ হিসেবে ব্যবহৃত হবে (conceit) কনসিট-- সুদূর বিস্তৃত কাল্পনিক উপমা। এছাড়া তাঁর কবিতার আকস্মিক আড়ম্বও চমকে দেয় পাঠককে।  

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যাঁর কবিতায় আপ্লুত ছিলেন।  তিনি কবি জন ডান। ১৫৭২ (ইং) সালের ২২শে জানুয়ারী লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন পিতা জন ডান (বাবা ও ছেলের একই নাম) ও মা এলিজাবেথ হেইউডের ছয় সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সন্তান হিসেবে। মাত্র চার বছর বয়সে পিতৃবিয়োগের মধ্য দিয়ে  সেই যে দুর্ভাগ্যের সূচনা হয়, পরবর্তীতে নিজের একের পর এক সন্তান হারানোর মধ্যেও যেন তা সঞ্চারিত হতে থাকে। অবস্থা এমনও হয় যে নিজের সন্তানকে সমাধিস্থ করবার মতো অর্থসংগতিও তাঁর নেই।

ইং১৬১৫ সাল নাগাদ কিছু কালের জন্য সৌভাগ্যের রৌদ্রজ্জ্বল দিন উজ্জীবিত করে তোলে কবির জীবনকে। তিনি রাজযাজক নিযুক্ত হন। ডক্টর অব ডিভাইনিটি ডিগ্রীও পান কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিন্তু এই সুখের কালও ছিল হেমন্তবেলার রোদ্দুরের মতো। স্ত্রী অ্যানির সঙ্গে ঘটলো চির বিচ্ছেদ। মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে গেল কবির জীবনের মস্ত আনন্দপ্রদীপ। সেটা ১৬১৭ সাল। পরের অবশিষ্ট জীবনটুকু তিনি নিভৃত কাব্যচর্চায় কাটিয়ে ১৬৩১ সালের ৩১ শে মার্চ মহাপ্রস্থানের পথিক হলেন।
 
লিখেছেন একাধিক প্রবন্ধ, ধর্মীয় কবিতা এবং অসাধারণ কিছু প্রেমের কবিতা। প্রেমের প্রতি অগাধ আস্থা, রূপ ও সৌন্দর্য্যের প্রতি আকাঙ্খা এবং গভীর শিল্পবোধ তাঁর প্রেমের কবিতাকে এমন এক অনন্যতা দান করেছে যে কবিতাপ্রেমিরা আজও তাঁকে 'পোয়েট অব লাভ' বলে সানন্দে স্বীকার করে নেন।

Good Morrow ( অনু : সুপ্রভাত ) আর Canonization ( অনু : সিদ্ধাবস্থা )  কবিতা দুটি ডানের কবিতার সংকলন ' Songs and Sonnet' -এ প্রকাশিত হয় ১৬৩৩ খ্রি:, কবির মৃত্যুর পর।

স্বীকার : Canonization কবিতার প্রথম পংক্তিটি অনুবাদ করে রবিঠাকুর তাঁর 'শেষের কবিতা' নামক উপন্যাসে ব্যবহার করেছিলেন। আমার অনুবাদে কবিগুরুর  অনুবাদকৃত সেই পংক্তিটিই রেখে দিলাম চিরন্তন মানবপ্রেমিক কবির প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলী হিসেবে।



১. সুপ্রভাত 

অবাক বিস্ময়, বলছি সত্যাসত্য, কী যে তুমি আমি!
তখনও কি ভালোবাসতুম? হইনি কি তখনও ক্লান্ত?
আস্বাদন করেছি গ্রাম্য মৌতাত, ছেলেমানুষী যত,
অথবা ছিলেম ঘুমিয়ে, সে ঘুমের দেশে--যেখানে সাতটি তরুণ ঘুমন্ত?
হয়তো ছিল তেমনই  কিছু, কিন্তু সকল আনন্দ- কল্পনা
যে কোন সুন্দর আমি কেন দেখিনা
যা পেয়েছি বা করেছি যাচনা, তোমার স্বপ্ন বিনা কিছু না।

এখন তোমার আমার জাগ্রত অন্তরকে জানাই সুপ্রভাত 
 নেই ভয়ের লেশমাত্র সেইখানে
ভালোবাসার জন্য, ভালোবাসার অন্যসকল দৃশ্য নিয়ন্ত্রিত 
একটি ছোট গৃহকোণ রচে সবখানে
সমুদ্র সন্ধানী খুঁজুক নতুন পৃথিবী সর্বত্র
মানচিত্র আঁকুক নতুন দেশ যত্রতত্র
আমাদের থাক একটাই পৃথিবী, প্রত্যেকের এক ও একত্র।

আমার মুখখানি তোমার আঁখিতে, তোমার আমার চোখেতে দ্রষ্ট
দুটি সরল হৃদয় মুখচ্ছবিতে প্রতীয়মান
সেখানে কি খুঁজে পাবো সুন্দরতর দুটো গোলার্ধ স্পষ্ট
তীক্ষ্ণ উত্তরহীন, নয় পশ্চিম ক্ষীয়মান?
যা কিছু নি:শেষ হয়, মেলেনি সঠিক ভাবে
যদি মিলে যায় দুটি প্রাণ, তুমি ও আমিতে
প্রেম অবিকল, কারো নয় ক্ষীণতর, কেউ পারে না মরে যেতে।


২. সিদ্ধাবস্থা
'দোহাই তোদের, এতটুকু চুপ কর, ভালোবাসি বারে দে অবসর'
নয়তো করো তিরস্কার আমার অবশ‌ অঙ্গ, বেতো শরীর অসাড়
পাঁচটি শুভ্র কেশে, বিদ্রুপে ভরিয়ে তোলো ভগ্নভাগ্য অনড়
ঘটুক তোমার ধনবৃদ্ধি, মনে শিল্পময় ঋদ্ধি
সঠিক পথে হও চালিত, সঠিক স্থানেতে হও সম্মানিত
দু'চোখ ভরে দেখো রাজকীর্তি, শোভন শোভিত
হও ধ্যানস্থ আসল কিংবা মোহরিত মুখে তার
যা খুশি তুমি করতে পারো দর
 দাও  আমাকে ভালোবাসার নিখিল পরিসর।


হায় হায় ! কে পেল আঘাত আমার ভালোবাসায়?
আমার দীর্ঘশ্বাসে ডুবল কার বানিজ্যতরীদল
কে বলে গো আমার অশ্রু প্লাবিত করে তার উঠোনতল?
কোন বসন্ত হলো প্রতিহত আমার সর্দিকাশে
কখন বা সে উষ্ণতা শিয়ায় শিরায় তাপে
বাড়িয়ে দিলো মারির খরচ কখন কোন ধাপে?
সেনারা খেলুক যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, উকিল খুঁজুক মামলাবাজ মেলা
ঝগড়াঝাঁটি চলছে যেমন চলুক অবলীলায়
আমরা শুধু ভাসি ভালোবাসার ভেলায়।

যেমন খুশি ডাকতে পারো, ভালোবেসেই হলাম  এমনতর
বলো তাকে এক, আমায় অন্য একটি মাছি
আমরা মোমের মতো জ্বলি, নি:শেষ হই জীবন বাজি রেখে
আমরা হলাম ঈগল এবং ঘুঘু পাখির মতো
ফিনিক্স ধাঁধায় যুগিয়ে দিলাম নতুন করে অর্থ
দুয়ে মিলে এক সত্তায় জীবন পরমার্থ
তাই যেখানে উভয় সত্তা হয়ে একাকার এমন প্রশমিত 
মরে গিয়ে রূপকথার পাখির মতো জাগি
প্রমান করি ভালোবাসার রহস্যময় ভাগই।

যদি না পারি বাঁচতে ভালোবেসে, মরে যেতে পারি নিশ্চিতে
যদি না হই উপযুক্ত শবাধার বা সমাধিতে
স্থান করে নেবে আমাদের রূপকথা কবিতার অমোঘ পংক্তিতে
যদি বা কোন কাহিনীতে অপাংক্তেয় হই
সনেটের অপরূপ ঘরে দু'জন জেগে রই
কারুকার্যময় ভস্মাধারও শেষে
অধেক- একর- জোড়া কবরখানি মহৎ ভস্মে মেশে
আর আমাদের  স্তবগাথা গাইবে আদিগন্ত
আমরা হলাম ভালোবাসার সফল সিদ্ধসন্ত।

 আর এভাবে আমাদের করো আবাহন  : "তোমরা,
মহতী ভালোবাসা করলো যাদের একে অপরের তপস্যলোক;
তোমরা যাদের কাছে ভালোবাসাই ছিল শান্তি, আজ যত অশান্ত হোক
তোমরা যারা সঙ্কুচিত করো সকল বিশ্বলোক অন্তর  তার এবং তোমরা আয়না ধরো  একে অপরের চোখের তারার স্বচ্ছপটে
(এমন করে আয়না বানাও, বানাও অন্বেষণ)
যেন তারা গ্রামে গ্রামে, শহরে নগরে, রাজ দরবারে করে সংক্ষেপিততান
তোমাদের সেই ভালোবাসার হয় প্রতিমান।।
চিত্র - শ্রীহরি

Comments

  1. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  2. খুব সুন্দর হয়েছে। এরকম আরও সুন্দর সুন্দর নতুন প্রেমের কবিতা পড়তে আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করুন।

    ReplyDelete
  3. ‌লেখা এবং অনুবাদ দু‌টোই অত‌্যন্ত কা‌ব্যিক ও চিত্তাকর্ষক। অ‌ভিবাদন হে অনুবা‌দিকা।

    ReplyDelete

Post a Comment