গল্প - সোমা গুপ্ত


ভালবাসা যে হারায় নাগো


"পথিক ও পথিক দাঁড়াও একটু। কথা শোন আমার। তুমি যে তখন কথা দিলে সারাটা রাস্তা তুমি থাকবে আমার সাথে। ভয় হচ্ছে ত আমার।  একটু দাঁড়াও পথিক।"

পথিক থেমে দাঁড়ায়। চারিদিক দেখেন। সবুজে ভরা রাস্তা। দুপাশে গাছ। মধ্যে রাস্তা।  যেন স্বপ্ন দেখছে। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে পথিক ভাবল একি জ্বালা রে বাবা। মেয়েটার চোখে একরাশ মায়া। বলেছিল ঠিকই মেয়েটাকে তোমায় ছেড়ে এগিয়ে যাবোনা আমি। কিছুক্ষণ পরে মনে হলো আর জড়িয়ে পড়ব না মায়ার বন্ধনে। তাই ত মেয়েটাকে রেখে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু মেয়েটার গলার স্বরে কি আকুতি। দাঁড়িয়ে গেল পথিক। এই মেয়ে তোর নাম কিরে? একা কোথায় যাস তুই?"

" আমার নাম? আমার যে কোন নাম নেই এই মুহূর্তে।  আমি যে  ভালবাসার কাঙালি।  আমি খুঁজছি  একটা খোলস। খুঁজছি একটা পরিবার। খুঁজছি অনেকটা ভালোবাসা। জানো পথিক তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। দেখেই মনে হয়েছে যেন কত দিনের চেনা তুমি।" 

" বাবা কি সুন্দর কথা বলিস রে তুই। জানিস আমিও খুব ভালোবাসতাম আমার পরিবার কে। সব সময় চেষ্টা করতাম সবাই কে ভালো  রাখার। দূরে থাকতাম বাড়ি থেকে অর্থ উপার্জনের জন্য। বুঝতে পারতাম না আমাকে সবাই এটিএম ভাবত কিন্তু রক্ত মাংসের মনযুক্ত মানুষ ভাবতো  নারে। যখন তখন যে কেউ ফোন করে জানান দিত টাকা লাগবে টাকা পাঠাও। কেউ একবারের জন্য জিজ্ঞেস করত না কিংবা বলতো না হ্যাঁরে অসুবিধা  হবে না তো? কিংবা ঠিক আছে ম্যানেজ করে নেব। বউ, ছেলে বলতো বটে একটু রাশ টানো। তুমি কি পয়সা রোজগারের যন্ত্র? আমরা যে প্রবাসে ভাড়া বাড়িতে কত কষ্ট করে, অন্যের মুখঝামটা খেয়ে থাকি সেটা ত কেউ দেখতে আসেন না। বউ বলতো আমরা দুজন শেষ কবে কোথায় বেড়াতে গেছি? তোমার পরিবার তোমার সাথে আমার বিয়ে দিয়েছে তারা তাদের ছেলের উপর কতটা দায়িত্ববান তা শোকল্ড সমাজের কাছে প্রমাণ করার জন্য আর আমার পরিবার বিয়ে দিয়েছিল ঘাড় থেকে বোঝা নামানোর জন্য। কথাগুলো শুনে খুব রাগ হতো রে।  খুব মেজাজ দেখাতাম তখন কিন্তু আস্তে ধীরে বুঝতে পারি বৌটা ঠিক কথাই বলছে রে। সবই বুঝতে পারতাম কিন্তু অশান্তির জন্য কিছু বলতাম না। পরশুদিন আর পারলাম না। ধকল নিতে পারলাম না আর। কারখানায় অজ্ঞান হয়ে গেলাম। বাড়িতে খবর দেওয়া হলো।  হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো কিন্তু প্রাণ টা বেরিয়ে গেল। পারলাম নারে আর লড়তে।  খুব কষ্ট হচ্ছে জানিস।  মা দূর্গা আসছেন কয়েকদিন পরে।  সবাই নতুন জামা কাপড় পরবে আর আমার ছেলেটা, বৌটা কাঁদছে রে। বাবা, মা ওদের কাছে আসতে চাইছে না। শুধু ফোন করে খবর নিচ্ছে কত টাকা পাবো। টাকাগুলো  ভাইকে দেবার চেষ্টা করছে রে। ভাবছি আজ বৌকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলবো দেবে না আমার একটা টাকাও কাউকে। শুধু ওরা টাকা নিয়ে গেছে আমার থেকে। কিভাবে কষ্ট করে লোকের বাড়িতে দিন কাটিয়েছি তা তো দেখতে আসেনি। যত্ন করে টাকা রেখে দিও এবং ভুলেও ঐ বাড়িতে যাবে না। ছেলেকে বলো কাজ খুজতে এবং তুমি যেমন কাজ করতে সেটাই করো। এই মেয়ে জানিস দুনিয়াটা বড় স্বার্থপর। " এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো কমল অর্থাৎ পথিক। কমলের বাড়ি বর্ধমানের একগ্রামে। সে  ছিল বাড়ির বড় ছেলে। বাবা ছিলেন কাঠমিস্ত্রি।  কমল যখন বারো ক্লাসে পড়ত তখন  হঠাৎ বাবা অসুস্থ হয়ে যান।  সুতরাং  বড় ছেলে হিসাবে সংসারের দায়িত্ব এসে পরে তার উপর। পাড়ার এক দাদা কলকাতায় এক লোহা কারখানায় তাকে কাজটা করে দেয়। মনের জোরে কর্মরত অবস্থায় পড়াশোনা করে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছিল সে। ঐযে মানুষ ভাবে যারা বাড়ির বাইরে থাকে, নিউক্লিয়ার পরিবার তারা নাকি ভীষণ  সুখে থাকে এবং তার উপর তারা স্বামী স্ত্রী যদি দুই জনে রোজগার করে তাহলে ত সোনায় সোহাগা। তাদের কে হয় এটিএম নয়ত বা সোনার ডিম দেওয়া হাঁস ভাবেন। বাইরে থাকার খরচ কেমন,  দুজনের রোজগার  কেমন তা বিচার করে না। শুনতে হয় ভালোই ত আছিস। তা এই যে মেয়ে তোর কথা বল কিছু।" থামল কমল।

" এবার তোর কথা বল"। কমল মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে।

"জানো পথিক এক নদীর তীরে একটা ছোট্ট কুড়ে ঘরে ছিল আমার বাস। পলাশপুর ছিল গ্রামের নাম। মা, বাবা, ভাই আর আমায় নিয়ে ছিল ছোট্ট সুখের সংসার।  বাড়ির উঠানে  মা তৈরী করেছিলেন ছোট্ট ফুলের বাগান। হরেক রকম ফুল হতো। কত পাখি আসত বাগানে, রঙ্গীন প্রজাপতি  ফুলের উপর বসত। জানো পথিক আমার ভাইটা খুব মজা পেত এইসব দেখতে। আমি কিন্তু পড়াশোনা তে ভাল ছিলাম। বাবা লোকের জমিতে চাষ করতেন। ভালোভাবেই চলছিল সবকিছু। বারো ক্লাসে ভর্তি হোলাম শহরে। ঐযে বলে নাগো ডানা গজানো। গজিয়ে গেল ডানা। জানো পথিক মায়েরা মনে হয় জাদুকরী।  কিছু না বললেও অনেক কথা বুজতে পারেন। একদিন রাতে শোবার সময় মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন পিছু দিকে একবারের জন্য না দেখে অনেক উপরে ভেসে গিয়ে সেখান থেকে মাটিতে পরলে হয় কোমর ভেঙ্গে যায় নয়ত বা মাটিতে পরলে কেউ পা দিয়ে চেপে দিলে ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়।  আমার কেন এটা নেই, ঐরকম  পোষাক কেন নেই, কেন আমরা হোটেলে খেতে যাই না এইসব নিয়ে বাড়িতে অশান্তি শুরু করি। বাবা বলেছিলেন মারে আমাদের যে ওদের মত পয়সা নেই। তবুও যতদূর পারবো তোদের দুজনকে পড়াশোনা করাবো। যখন চাকরী করবি তখন সব মনের ইচ্ছা পূরণ করিস। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন রাতে। ছোট ভাইটা বলেছিল দিদিরে বাবা, মা কিন্তু আমাদের খুব ভালোবাসেন। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ভর্তি হই কলেজে। প্রেম প্রনয় শুরু হয়। তবে ছেলেটা ছিল খুব ভালো।  খুব ভালোবাসত।  কত যে স্বপ্ন দেখেছিলাম দুজনে। হঠাৎ  সে প্রায়ই কলেজ কামাই করে। একবার একসপ্তাহ পরে বন্ধুদের সাথে যাই তার বাড়ি। ডেকে পাঠিয়েছিল গো আমায়। গিয়ে দেখি রাজীব আমার প্রেমিক ভীষণ অসুস্থ।  তার নাকি হার্টের কি সমস্যা। আমার দিকে তাকিয়ে অনুরোধ করেছিল তাকে ভুলে যেতে। যখন অসুখ ধরা পরে তখন যে অনেক দেরী হয়ে গেছে। উওর দিয়েছিলাম অপেক্ষা করবো।  সাতদিন পরেই সব শেষ হয়ে গেল। খুব কষ্ট হচ্ছিল গো পথিক। একদিন রাতে আর পারলাম  না। মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুতেই মা বললেন মনের কষ্টটা আমার সাথে ভাগ করে নে মানু। অঝোরে চোখের জল ফেলেছিলাম শুধু। কোন শব্দ বের হইনি মুখ থেকে। শরীর টা হাল্কা হয়ে যায়। শুধু শুনতে পাই মায়ের করুন আর্তনাদ মানুরে চলে যাস নারে এইভাবে। এরপর চোখ খুলে দেখি এখানে এসে গেছি। প্রেমিকের ভালবাসা, বাবা মা ভাইয়ের ভালবাসা হারিয়ে খুব কষ্ট হচ্ছিল গো পথিক।"  

" এই মেয়ে শুধু কাঁদলেই হবে রে? চ খুঁজি তোর প্রেমিক কে।" 

"পথিক এই কথাটা ত মাথায় আসেনি।  চল দেখি কোথায় খুঁজে পাই তাকে। পথিক তুমি দেখতে পাচ্ছ ঐ ছোট্ট কুঠি টা? আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম এই রকম কুঠির।"

দুজনে এগিয়ে এসে দেখে এক সুপুরুষ  বাগানে গান গাইছে মিলন হবে কত দিনে আমার মনের মানুষের সনে। 

" পূর্ণিমার রাতে স্নিগ্ধ মায়াবী আলোয় ছিল তোমার হাতের উপর আমার হাত। দেখেছিলাম  কত স্বপ্ন। সব স্বপ্ন  কি থেকে যাবে স্বপ্ন? ওপারে আমাদের মিলন হয়নি ত কি হয়েছে এপারে ত হতে পারে আমাদের মিলন তাই না সখা? আমি যে ভালবাসার কাঙ্গালিনী। "

"তুমি এসেছ প্রিয়া( মেয়েটির ভালো নাম।)? আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল যে একা এখানে। দেখ আমার নতুন বাসা। ঠিক এইরকম ভাবেই বাসাটা সাজানোর স্বপ্ন দেখেছিলাম না আমরা? তবে আজ থেকে এটা আমাদের বাসা। আচ্ছা উনি কে?"

প্রিয়া বলে " নতুন জায়গায় এসে   পথ হারিয়ে ফেলি। উনিই আমার পথের সাহারা  হন। উনিও নতুন।"

মিলন হয় দুই প্রেমিক প্রেমিকার। তৈরী হয় এক ভালবাসার কুঠি। না হয় অন্য জগতে। কমল কে ওরা রেখে দেয়। কমল পায় এক নতুন সংসার।  যেখানে কেউ তাকে পয়সা রোজগারের মেশিন মনে করে না। অবশ্য কমল স্বপ্নে তার স্ত্রীকে দেখা দিয়ে তার মনের কথা জানায়।

একটা ইট, কাঠ, পাথরের খাঁচা ঘরে পরিণত হয় সেই ঘরে থাকা প্রত্যেকটা মানুষের ভালোবাসা দিয়ে ।  ভালোবাসা না থাকলে তা হয় কয়েদ খানা। ছড়িয়ে পরুক চারিদিকে ভালোবাসার স্তুতি। চলো বলি সবাই জয় ভালোবাসার জয়।

Comments