গল্প - দেবাশিস ধর


বেগুনি রংয়ের ঘুড়িটা   

              

                       অন্যদিনের মত যথারীতি আজ দুপুরেও যখন দুটো সিরিয়াল দেখে প্রাক্‌-বৈকালিক নিদ্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আর তখনই শ্বশুরমশাইর ফোনটা এল। আজকালের মধ্যেই আমাকে আসানসোলে একবার যেতে বলছেন, একটা জরুরী বিষয়ে আমার সাথে শলা পরামর্শ করতে চান। শুনেই তো আমার ঘুম উবে গেল, টেনশনে নয় আনন্দে। আমাদের নিজেদের বাড়িতেই আমাকে কেউ কোনদিন সিরিয়াসলি নেয়নি। আমিও ‘হেসেখেলে রঙ্গ করে’ দিন কাটানোর দলে ছিলাম। সাজগোজ, ফ্যাশন ছাড়া  বন্ধুরা বা অন্য কেউ  আর কোন ব্যাপারে কোনদিন আমার পরামর্শ চেয়েছে বলে মনে তো পরেনা। তাই  শ্বশুরমশাইর মত   এমন একজন শিক্ষিত, বড় চাকরি করা মানুষ তার মাত্র ছ’মাস আগে তার পুত্রবধূ হয়ে আসা আমার পরামর্শ চাইছেন  এটা তো রীতিমত আমার কাছে শ্লাঘার বিষয়।    

                    একবার ভাবলাম শ্বশুরমশাইর ফোনের কথাটা ধ্রুবকে তখন তখুনি জানিয়ে দিই। বাবুর গায়ে একটু ছ্যাঁকা লাগুগ- বাবুর মতে তো  ছেলেদের পড়াশোনা আর মেয়েদের পড়াশোনায় নাকি অনেক তফাত। শ্বশুরমশাই যথার্থ বিজ্ঞ মানুষ তাই তিনি তার হাঁটুর বয়সী ছেলের বউয়ের সাথে কোন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ করতে চেয়েছেন। আসলে নারীমুক্তি নয় কথাটা হওয়া উচিত পুরুষমুক্তি- ধ্রুবদের মত পুরুষদের নিজেদের সংকীর্ণ ভাবনাচিন্তার বাঁধন থেকে মুক্তি। ধ্রুবকে আর ফোন করলামনা। অফিস থেকে এলে বলব আর সামনাসামনি ওর রিয়্যাকশন দেখব। দৃশ্যটা কল্পনা করেই আমার চোখে ঘুম চলে এল।           

                    অফিস থেকে ফিরে ধ্রুব কিন্তু বেশ মনোযোগ দিয়েই আমার কথাগুলো শুনল তারপর চায়ে চুমুক দিয়ে বলল- ‘আই অ্যাম প্রাউড অফ ইয়্যু! কিন্তু মা কি তোমাকে  কিছু বলেছেন’?   আমি বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়ি-  ‘কেন বাবার বলাটা বুঝি যথেষ্ট নয়?  তোমাদের বাড়িতে  বাবাকে   মায়ের অ্যাপ্রুভাল নিয়ে  কথা বলতে হয় নাকি’?  ধ্রুব আমার কথার সোজা উত্তর না দিয়ে মুচকি হাসে- ‘ঠিক তা’  নয় আবার তাও বটে। যখন স্কুলে পড়তাম তখন ছুটির দিনে ফুটবল খেলার মাঠ ছেড়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায়ই সন্ধ্যে হয়ে যেত। দুরুদুরু বক্ষে গেট খুলে বাড়িতে ঢোকার মুখে কোন কোন দিন দেখতাম বাবা দাঁড়িয়ে আছেন হাসিমুখে।  আমার জলকাদা মাখা চেহারা দেখে হাসতেন- ‘প্রাণভরে খেলে এলি তাইনা? ভেরী গুড! জীবনে যা করবি এরকম  মনপ্রাণ দিয়ে করবি’।     

                      আমার বুকের ধুকপুকানি কিন্তু বাবার আশ্বাস বাক্যে একটুও কমতনা। ঘরে পা দেওয়ামাত্র মা গালে চড় মারার জন্য হাত তুলতেন- ‘ক’টা বাজে সে খেয়াল আছে’? হঠাৎ পিঠে ধমাধম আরও কয়েকটি চড় পড়ল- সেগুলো অবশ্যই বাবার হাতের। বাবা তার মিনিটখানেক আগের রায় বদলে চিৎকার জুড়েছেন- ‘অসভ্য ছেলে কোথাকার! কাল থেকে দেরী হলে ঐ মাঠেই থাকবি, বাড়িতে নো এন্ট্রি’।  ধ্রুব হাসে- ‘কি বুঝলে’।  যা বুঝলাম বা বুঝে নিতে ধ্রুব ইংগিত করল তা’ মেনে নিতে আমি রাজি নই- ‘ভালোই তো তোমাদের বাড়িতে মাতৃরাজকতন্ত্র চলে। কিন্তু তাই বলে শ্বশুরমশাইয়ের কথার কোন গুরুত্ব থাকবেনা সেটা কি ঠিক’?       

                    ধ্রুব কিছু বলেনা দাঁতে ঠোঁট চেপে হাসি আটকে রাখে। মনে হয় শ্বশুরমশাইকে নিয়ে ওর আরও কোন মজার কথা মনে পরেছে। শুনলে হত কিন্তু শোনা মানে শ্বশুরমশাইর কথার গুরুত্বহানি মেনে নেওয়া। তাহলে তো আমাকে ওর জরুরী তলব পাঠানোর বিষয়টাও গুরুত্ব হারাবে। আমিও তো  উকিলবাড়ির মেয়ে! কোন কথা জোরগলায় সওয়াল করতে হবে আর কোন কথা ‘অশ্বথামা হত ইতি গজ’-র মত অস্ফুটভাবে বলতে হবে তা ভালই জানা আছে।  কথা ঘোরাবার জন্য ধ্রুবকে বলি- ‘বাবা যে আমাকে যাওয়ার জন্য এভাবে বললেন তার কারণটা কি হতে পারে বলে তোমার মনে হয়’?   ধ্রুব মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতেই বলে- ‘তোমাকে যখন বলেছে তখন আমার মনে হয় কোন আইনি ব্যাপার হবে। আফটার অল তুমি উকিলবাড়ির মেয়ে- তোমার  জ্যাঠা আর কাকা সবাই নামকরা অ্যাডভোকেট’।    

                    সে তো বটেই!  ধ্রুব অবশ্যই ঠিক বলেছে। আমার বাপের বাড়ির যে মহল্লায় সেখানে গিয়ে কেউ উকিলবাড়ির খোঁজ করলেই যে কোন লোক দেখিয়ে দেবে। এ’ নিয়ে আমার প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ আছে এবং ধ্রুব সেটা জানে।  কিন্তু আইনি ব্যাপার মানে তো বিরাট এক বিষয়।  আমাদের যৌথবাড়িতে একটা চৌদ্দ বাই পনের ঘরে তো খালি আলমারি ঠাঁসা আইনের বই! ধ্রুবকে আবার বলি- ‘বাবার হঠাৎ কি নিয়ে আইনি পরামর্শের দরকার পড়ল’? ধ্রুব মোবাইল থেকে মাথা তুলে খুব চিন্তান্বিত মুখে বলল- ‘মনে তো হয় ডিভোর্স টিভোর্সের ব্যাপারেই তোমার অ্যাডভাইজ চাইবেন’।

                    সব্বোনাশ! বলে কি?  ‘ডিভোর্স? কার ডিভোর্স’?- আমি আঁতকে উঠি-  ‘আমি কে এসব ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়ার? আমার জ্যাঠা আর কাকা অ্যাডভোকেট কিন্তু বাবা তো সরকারি চাকুরে’। ধ্রুব আমার কথাতেও মাথা নাড়ে- ‘সে তো বটেই’।   আমাকে কি ধ্রুব বোকা বানাল? ডিভোর্স কথাটা শুনেই এতটা রিয়্যাক্ট করা ঠিক হয়নি। ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টায় স্বাভাবিক স্বরে বলি- ‘এই তুমি এসব অলক্ষুণে কথা বললে কেন? পজিটিভ কিছু ভাবতে পারনা’?    

              ‘আমি আর কি বললাম, তুমি প্রশ্ন করলে আমি আমার বিচারবুদ্ধিতে উত্তর দিলাম মাত্র। আর কাকা জ্যাঠা  যার উকিল তার কানে ডিভোর্স শব্দটা অলক্ষুণে ঠেকার কথাতো নয়’- ধ্রুব ফেসবুক ঘেঁটে একটা বিজ্ঞাপন দেখায়- একজন উকিল নিজের ছবি, পরিচয়, যোগাযোগ নম্বর দিয়ে পারিবারিক মামলা জেতাতে তার প্রমাণিত দক্ষতার কথা বড় গলায় জানিয়েছেন। ফোনেও তার সাথে কথা বলা যেতে পারে। 

                 ধ্রুব গলা নীচু করে বলে- ‘এরপর আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স তোমার আমার মনের কথা পড়ে ফেলবে। একবার আমার নামে মনে মনে গালাগাল করেছ কি পরদিন ডিভোর্সের এজেন্ট এসে ঘরের কড়া নাড়বে’।   

                ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে’- আমার বেজায় বিরিক্তি লাগে- ‘এসব যাদের ঝামেলা তারা বুঝুকগে।   বাবা হলেন গে’ আদার ব্যাপারী ওনার তো আর জাহাজের খোঁজের  দরকার নেই। উনি  নিশ্চয়ই অন্য কোন বিষয়ে আমার সাথে কন্সাল্ট করতে চাইছেন। আমি কন্সাল্ট কথাটা একটু জোর দিয়েই বলি।    

                 ‘সে কথা  নিশ্চিতভাবে আমি বলতে পারবনা। অন্য কোন বিষয় হলে বাবা আমাকে একবার নিশ্চয়ই বলতেন’- ধ্রুব কথাগুলো সিরিয়াসলি বলছে বলেও আমার ঠিক বিশ্বাস হয়না।  অভিনয়টা  ধ্রুব খুব ভালই পারে।  কিন্তু ধ্রুব যদি অভিনয় না করে থাকে? ওর কথাগুলো যদি সত্যি হয়! ফ্যাসাদেই পড়া গেল দেখছি! মুখে জোর করে হাসি এনে বললাম- ‘আশ্চর্য লোক তুমি! বাবা এই বাষট্টি বছর বয়সেও কি ডিভোর্সের কথা ভাবতে ’- আমাকে মাঝপথে থামিয়ে ধ্রুব বলে ওঠে- ‘নেলসন ম্যান্ডেলা যখন উইনি ম্যান্ডেলাকে ডিভোর্স করেছিলেন তখন তার বয়স সত্তরের উপর’।       

           ‘কিন্তু তোমার কথা অনুযায়ী বাবা যখন  মাকে ছাড়া চলতেই পারেননা, তখন তো বাবার একা থাকার কথা ভাবতে পারারই কথা নয়’- আমি যুক্তি পেশ করি।       

             ‘একদম ঠিক কথা বলেছ’- ধ্রুব চটপট আমার কথায় সায় দেয়- ‘তবে সমস্যাটা কি জান কথাটা অন্য সবাই  বুঝলেও বাবা হয়ত বোঝেননা। আমাদের স্কুলের একটি ছেলের বাঁ চোখটা যে জন্ম থেকেই খারাপ সেটা সে প্রথম জানতে পারল ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়। এতদিন ও টের পায়নি কারণ ও জেনে এসেছে এক চোখে ও যা দেখে আসছে সবাই নিশ্চয়ই তাই দেখে। তেমনি বাবাও হয়ত তার খামতিটাকে খামতি বলে জানেইনা।  এখন  বাকিটা তোমার হাতে’।  

            ‘আর আমার হাতে!’- আমার গলায় বিরক্তি ঝরে পড়ে- ‘আমি তোমাদের বাড়ি এবার যাবইনা’।  শুনে ধ্রুব হাসে- ‘তুমি না গেলে হয়ত বাবাই এখানে আসবেন তোমার সাথে ‘ক-ন-সা-ল্ট’ করতে।  ধ্রুব কি  কনসাল্ট শব্দটাকে টেনে টেনে উচ্চারণ করে আমাকে  পিঞ্চ করল? ঠিক আছে  পিঞ্চ  করলে করল, আমি এখন গায়ে মাখছিনা।  তবে আমিও সময়মত অ্যায়সা  পিন ফোটাব  যে ধ্রুববাবুর হামবড়াইর বেলুন ফটাস্‌ করে ফাটবে। ধ্রুব আমার মুখে চাপা হাসি দেখে নিজেও হাসে- ‘কি হল তুমি হাসছ যে’?  আমি  সামলে নিয়ে হাসতে হাসতেই বলি- ‘এই ষাট বছর বয়সটা দেখছি বিপজ্জনক’।      

            ‘আসলে বুঝলে   এই ষাট বছরের আশেপাশের বয়সটা পুরুষদের জন্য শুধু শারীরিক নয় মানসিক দিক দিয়েও সমস্যাসংকুল। চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর সারাদিন ঘরে বসে আর কাঁহাতক খবরের কাগজ পড়া যায় বল?  ওদিকে শরীরে মেল হরমোন প্রায় গুডবাই বলছে। একটা হীনমন্যতার ভাব  গ্রাস করে।  এদিকে স্ত্রী ঘরসংসারের কাজে ব্যস্ত- সে নিজের সংসারই হোক বা ছেলের সংসারই হোক। সাহচর্যের অভাবে বয়স্ক মানুষটার স্ত্রীর  উপর ভারী অভিমান হয়, রাগ হয়। স্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য মরিয়া হয়ে কিছু একটা করার ইচ্ছে হয়। যেমনটা তোমার শ্বশুরমশাইরও হয়ে থাকতে পারে’।    

                      মাথাটাই আমার খারাপ হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। ধ্রুবটা দেখছি ভারী ডেঞ্জারাস লোক- ক্রমাগত ভয় দেখিয়েই চলছে। এখনও ধ্রুবর ষাট বছর বয়স হতে একত্রিশ বছর বাকি আছে আর কথা বলছে কিনা একজন সত্তর বছর বয়সী বিশেষজ্ঞের মত। রাগ ওঠে যায় আমার! আসলে পুরুষমানুষদের স্ত্রীদের উপর সারাজীবন দখলদারি চালিয়ে এসে বুড়ো বয়সেও তার সামান্য ব্যত্যয় দেখলেই হুংকার ছাড়তে ইচ্ছে করে। স্ত্রীলোকদের বুঝি এই বয়সে ইস্ট্রোজেন টগবগায়?  যত্তো সব!   

           ‘এই তুমি আমাকে বোকা বানাচ্ছ তাইনা’?- আমি ধ্রুবর হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বলি- ‘স্বীকার কর তুমি আমাকে ভড়কে দিচ্ছিলে তবে মোবাইল ফেরৎ পাবে’।  

               ‘আরে বাবা আমি তোমাকে বোকাও বানাচ্ছিলাম না আর ভড়কেও দিচ্ছিলামনা। এমনকি কোন মিথ্যে তথ্যও দিইনি।  তোমার প্রশ্নগুলো যেমন ছিল আমিও সেভাবেই উত্তরগুলো দিয়ে গেছি। ঠিক ঠিক প্রশ্ন করা দশে দশ পাওয়ার মত উত্তর তৈরী করার চেয়ে কোন অংশে কম কঠিন নয়’- ধ্রুব কথার মাঝে থাবা মেরে ওর মোবাইল নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু চকিতে আমি হাত সরিয়ে নিয়ে বলি- ‘আগে বাবার কাছ থেকে জেনে নাও কেন আমাকে যেতে বলেছেন তারপর তোমার মোবাইল পাবে’।                    

              আমার কথায় ধ্রুব ফিকফিক করে হাসে- ‘এই মোবাইল নিয়ে একটা জোক বলছি শোন।  গুরুর কাছে এক ভক্ত গিয়ে বলছে- ‘মহারাজ, গজব হো গয়া।  কাল রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি আমার বউ পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে আর ওর মুখমন্ডল থেকে জ্যোতি বেরুচ্ছে’!  গুরু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- ‘ওরে মূর্খ! ওটা  কোন জ্যোতি ফোতি নয়!  তোর বউ তোর মোবাইল ছানবীন করছিল’। শুনে হাসতে হাসতে আমার দম বন্ধ হবার জোগাড় আর এই ফাঁকে ধ্রুব ওর মোবাইলটা ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে নিয়ে নিতে চাইলেও আমার কুশলতায়  পারলনা।    

            কিন্তু আমি মোবাইলটা দিয়ে দিলাম। কেন জানিনা পলকে আমার মনে হয়েছিল আমাকে হাসানোর ফাঁকে মোবাইলটা ছিনিয়ে নিতে না পেরে  ধ্রুবর মুখটা কেমন যেন হিংস্র হয়ে গিয়েছিল। আমার মানে একজন মেয়েমানুষের হাত থেকে দু’দু বার চেষ্টা করেও মোবাইলটা ছিনিয়ে নিতে না পারার মত সামান্য ব্যাপারটাকে  ধ্রুব মনে হয় ওর  পুরুষকারের অবমাননাকর পরাজয় বলে  গন্য করেছে। অবশ্য এটা আমার চোখের ভুলও হতে পারে। হতে পারে কি বলছি- ভুলই হয়েছে। ধ্রুব যথেষ্ট শিক্ষিত, মার্জিত মানুষ।     

               ধ্রুব মোবাইলে ওঁর বাবার সাথে কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে দু’একবার চিৎকার করে উঠল। আমি চায়ের কাপপ্লেট হাতে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে সৃজা শব্দটা কয়েকবার শুনলাম। সৃজা আমার বিবাহিতা ননদ যে আমাদের বিয়েতে আসতে পারেনি বা আসেনি। ধ্রুবর মুখে খুব একটা ওর বোন বা ভগ্নিপতির কথা শুনিনি। ভাইবোনের সম্পর্ক যে ভাল নয় সেটা বুঝতে অবশ্য উকিলবাড়ির মেয়ে হওয়ার দরকার নেই। আমাদের বাবা জ্যাঠাদের ভিন্ন হাঁড়ি হলেও সদর্থে যৌথবাড়ি। সব মিলে বিভিন্ন বয়সের গোটা ছয়েক ভাইবোন নিজেদের মধ্যে জ্যাঠতুতো খুড়তুতোর ভেদরেখা মুছে দিয়ে বড় হয়েছি। আর এরা দুটোমাত্র আপন ভাইবোন সেটা পারলনা। আমার ভীষণ খারাপ লাগে।   

            কাপপ্লেটগুলো সিঙ্কে রেখে আমি হাত ধুতে ধুতেই ধ্রুব এসে রান্নাঘরের দরজায় হাসি মুখে দাঁড়াল- ‘বাবার সাথে কথা হল বুঝলে। বাবার ইচ্ছে হয়েছে ওঁর বিষয়সম্পত্তি আমাদের দুই ভাইবোনের মধ্যে ভাগ করে দেন। সেই ব্যাপারেই তোমার সাথে পরামর্শ করতে চান।  আমি কিন্তু পরিষ্কার বলেছি সৃজা নিজে চাকরি করে, ওর বর ভাল কামায় তার উপর মাবাবার একমাত্র সন্তান, বাড়ি আছে, গাড়ি আছে- এর পর সৃজার আর কি চাই?   এখন ম্যাডাম বাকিটা আপনার হাতে’-  ধ্রুব হাসিটা সারা মুখে ছড়িয়ে দেয়।     

               ‘এতো বাবার কথা’- আমি ঠোঁট উল্টে কিন্তু মুখে হাসি ছড়িয়ে বলি- ‘মা এই ব্যাপারে কি বললেন? মা কিছু বলেননি? তাহলে কি করে হবে?’- আমার কথাগুলো শোনামাত্রই ধ্রুবর মুখচোখ কেমন যেন বদলে গেল। একটু আগে মোবাইলটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে না পেরে ধ্রুবর মুখটা ঠিক এমনই হয়েছিল। তাহলে সেবারও আমি ভুল দেখিনি?  

              আমার কিন্তু ধ্রুবর উপর একটুও রাগ হলনা বরং  খুব হাসি পেল। মনে মনেই একটা কার্টুন আঁকলাম।  রাগী পুরুষের মুখ আঁকা একটা লাল-কালো-হলুদ রংয়ের বিরাট  গ্যাসবেলুন আকাশে উড়ে যেতে যেতে হঠাৎ  একটা হাসি মুখের নারীর ছবি আঁকা বেগুনি রংয়ের  ঘুড়ির গোত্তা খেয়ে একদম ফটাস্‌! আমি তো দিব্যি ফটাস্‌ শব্দটা শুনলাম কিন্তু ধ্রুব শুনল কিনা সেটা ওর মুখ দেখে আন্দাজ করার চেষ্টা করি।         

Comments