ভ্রমণ - সুব্রত ভট্টাচার্য

 


             

সুন্দরবনের জলে জঙ্গলে

                                


         কলকাতা থেকে  আমরা চলেছি সুন্দরবনের গোদখালীর দিকে।  ওখান থেকে শুরু হবে আমাদের সুন্দরবন ভ্রমণ । পাহাড় এবং সমুদ্র বেশ কবার ঘোরা হয়েছে। সুন্দরবন দেখা হয়নি। বেশ কিছু ছবি দেখে এবং ভ্রমণ কাহিনী পড়ে সুন্দরবনের ওপর আকর্ষণ ধীরে ধীরে বাড়ছিলো।  ভ্রমণের সুবিধা অসুবিধা ইত্যাদি নিয়েও খোঁজ খবর নিচ্ছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমাদের সপরিবারে সুন্দরবন যাওয়া ঠিক হয়ে গেলো নভেম্বরের মাঝামাঝি । কলকাতায় দু দিনের ব্যাক্তিগত কাজের পর  সুন্দরবন রওনা। 


      গাড়ীতে চলেছি আমরা সুন্দরবনের দিকে। ট্র্যাভেল এজেন্সির গাড়ী, আমরা উঠেছি কলকাতা থেকে। কলকাতা পার হয়ে অনেকটা এসেছি। রাস্তাঘাট তেমন ভালো নয়। মাঝে মাঝে ভাঙ্গা, ধুলো উড়ছে।  বারুইপুর , ক্যানিং পার হয়ে  আড়াই ঘন্টায় পৌঁছুলাম গোদখালী। আমাদের গাইড পরিচয় করিয়ে দিল অন্য গাইডের সাথে। এখন থেকে সেই হবে আমাদের সহায়ক কাম গাইড। পুরো তিন দিন সে আমাদের সাথে থাকবে।


        পত্রপত্রিকা , ইন্টারনেট খুঁজে সুন্দরবন সম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। ভারত এবং বাংলাদেশ মিলিয়ে মোট আয়তন ১০,০০০ বর্গ কিমি। ভারতবর্ষে রয়েছে ৪২৬২ বর্গ কিমি , বাকী বাংলাদেশে। ভারতীয় সুন্দরবনে  ১০২ টি ছোটবড় দ্বীপ রয়েছে। তার ভেতর ৫৪ টি  দ্বীপে মানুষ বসবাস করে বাকী ৪৮ টি দ্বীপ  ঘন জঙ্গল। সুন্দরবন অরন্য বিভিন্ন প্রজাতির স্থলচর, জলচর, উভচর, সরীসৃপ এবং পাখীর বাসস্থান। এ অঞ্চলের প্রধান নদীগুলি  বিদ্যাধরী, মাতলা, ঠাকুরন, সপ্তমুখী এবং আরও কয়েকটি।  


      গোদখালীতে পুরোনো জেটি পার হয়ে  গাইডের সাথে আমরা ব্যাগ, সুটকেস নিয়ে একখানা বড় নৌকায় উঠে পড়লাম। সেখানে বিভিন্ন ধরনের মানুষ। গ্রামের সাধারন মানুষ থেকে শুরু করে দেশী এবং বিদেশী পর্যটক অনেক কজন। নৌকোর ধারেই বসবার যায়গা । যথেষ্ট নিরাপদ মনে হলো না। নৌকোর পাটাতনেই বসে পড়লাম। গাইড ছেলেটির বয়স এবং অভিজ্ঞতা কম। সে আমাদের জানালো  নদী পার হলেই গোসাবা দ্বীপ , সেখানেই আমাদের থাকবার ব্যাবস্থা হয়েছে। মিনিট দশেকের মধ্যেই বড় ভটভটি নৌকা আমাদের গোসাবা পৌঁছে দিলো।   


   গোসাবায় নেমে জেটি পার হয়ে রাস্তায় পৌঁছালাম। একখানা বড় অটোরিকশা তৈরী ছিলো আমাদের জন্য। উঠে রওনা হলাম হোটেলের উদ্দেশ্যে। এটাই গোসাবা, আমাদের হোটেল প্রায় দু কিলোমিটার দূরে পাখিরালায়ে। সরু রাস্তা, প্রায় বাড়িতেই পুকুর গাছপালাতে ভরতি। একটু পরেই হোটেলে এসে পৌঁছালাম।


  হোটেলে এসে হাত মুখ ধুয়ে আমরা বিশ্রাম করে নিলাম। মাঝারি মানের হোটেল, আতিথেয়তা ভালো। সামনে পুকুর, হোটেলের সীমানা বরাবর  বেশ কিছু সুপারী, নারকেল গাছ। দুপুর দুটো নাগাদ ডাক আসলো, আমাদের খাবার তৈরী। আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। গাইড আমাদের বলে দিলো , ঠিক সাড়ে তিনটায় আমরা বের হবো।    


    এটার নাম ভিলেজ ট্যুর । আশেপাশের কিছু বিশেষ দেখবার জিনিষ দেখিয়ে দেবে। বিকেল সাড়ে তিনটায় আমরা বের হলাম স্থানীয় কিছু দ্রষ্টব্য স্থান দেখার জন্য। দেখলাম কাঠের তৈরী হেমিল্টন বাংলো এবং বেকন বাংলো। বেকন বাংলো তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুন্দরবনে এসে বেশ কদিন কাটিয়ে গেছেন। সুন্দর একটি  মূর্তি আছে কবিগুরুর, এখানে। বিস্তারিত লেখা আছে প্রস্তর ফলকে। বাংলো দেখতে আসবার পথে গোসাবা বাজার দেখে এলাম। অনেক প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র এখানে পাওয়া যায় ।


    এরপর আমাদের গন্তব্য রাঙ্গাবেলিয়া স্বনির্ভর হস্তশিল্প কেন্দ্র। বেশ বড় জায়গা  দোতলা বাড়ী নিয়ে স্বনির্ভর কেন্দ্র। প্রায় ত্রিশ জন মহিলা বিভিন্ন হস্তশিল্পের কাজ করছেন। এখানে শাড়ী, চাদর, গামছা, চুড়িদার, ব্যাগ ইত্যাদি। একজন কর্মীর  কাছ থেকে জানা গেল , এই সংগঠনটি তৈরী করেন সুন্দরবনের ভীষন জনপ্রিয় মানুষ তুষার কাঞ্জিলাল এবং তার স্ত্রী। ২০২০ সালেই তুষারবাবু প্রয়াত হয়েছেন। তিনি শিক্ষক হিসেবে এখানে যোগদান করেছিলেন। তারপর বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মে জড়িয়ে পরেন। বেশ কিছু মহিলা কর্মী এই সগঠনের সাহায্যে উপার্জনের সূযোগ পেয়েছেন। পাখিরালয় এবং অন্যান্য কয়েকটি জায়গায় সংগঠনের জিনিষপত্র বিক্রীর ব্যবস্থা আছে। সুন্দরবনের বিভিন্ন উন্নয়নে তুষারবাবুর অবদান অসামান্য।


     সন্ধ্যাবেলা আমরা পাখিরালয় বাজার ঘুরে দেখলাম। এখানে পর্যটকদের জন্য অনেক দোকান তৈরী হয়েছে। পাওয়া যাচ্ছে কাপড়ের খেলনা বাঘ, হরিন, কচ্ছপ, কুমীর, পুতুল, চাবির রিং, টুপি, মধু ইত্যাদি। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর স্টলে পাওয়া যাচ্ছে শাড়ী, চুড়িদার, গামছা, ব্যাগ, মধু, আচার, কিছু বই ইত্যাদি। কিছু স্টলে স্থানীয় কিছু গাছের চারা পাওয়া যাচ্ছে। আমরা কয়েকটি জিনিষ কিনে ফেললাম।  

    পরদিন সকালে আমরা নিজেরাই পাখিরলয়ের আশেপাশে ঘুরে দেখে নিলাম। এখানে নদীর পাশেই বাঁধ, বেশ কিছু জেটি তৈরী করা আছে। বাঁধের পাশেই গর্জন এবং আরও কিছু স্থানীয় গাছ। কাদার ভেতরে থাকা লম্বা শিকড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি গর্জন গাছের দৃশ্য চমৎকার।  নদীতে ছোট বড় নৌকা এবং লঞ্চ নোঙ্গর করা আছে। আশেপাশে অনেক হোটেল, রিসোর্ট। 


        দুপুর বারোটা নাগাদ আমরা গাইডের সাথে পৌছে গেলাম গোসাবাতে  আমাদের জন্য রাখা নির্দিষ্ট লঞ্চে। বেশ ক’টি উজ্বল রঙে রঙ করা সুন্দর লঞ্চ। গোদখালীতে আরও কিছু নতুন পর্যটক আমাদের সাথে যোগ দিলেন। দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা হলো লঞ্চে। খেতে খেতেই আমাদের লঞ্চ ছাড়ল নতুন গন্তব্যের দিকে। লঞ্চ থেকে নদীর পার আর গ্রাম সুন্দর দেখা যায়। বিভিন্ন আকৃতির নৌকা নদীর পারে নোঙ্গর করা। পাখিরালয়ের কাছেই নির্জন জায়গায় লঞ্চ দাঁড়িয়ে গেল। এখান থেকে বেশ কিছু পাখি দেখা যায়। নদীর একপাশে গ্রাম অন্যপাশে জঙ্গল। জঙ্গলের কাছাকাছি নদীর পারে বেশ কিছু বাঁদর চোখে পড়লো। জঙ্গলের সীমানা বরাবর জাল লাগানো রয়েছে। অনেক জায়গায় বাঘ খাবারের খোঁজে নদী পার হয়ে লোকালয়ে চলে আসতো। সেজন্যেই এই ব্যবস্থা। 


       এখানে বেশ কিছু পাখী দেখা গেল । কয়েক প্রজাতির  মাছরাঙ্গা, পানকৌড়ি, বক, সারস এসব। নদীর পারে দেখা গেল কাঁকড়া ধরার জন্য পেতে রাখা জাল। এখান থেকেই আমরা সূর্যাস্ত দেখলাম, খুব সুন্দর দৃশ্য। পাখিরালয় জেটিতে আমরা ফিরে আসলাম। সেখান থেকে ফিরে আসলাম আমাদের হোটেলে।


      হোটেলে ফিরে দেখলাম , মাঝখানে সারি সারি চেয়ার পাতা হয়েছে। অতিরিক্ত আলোর ব্যবস্থা হয়েছে। গাইড ছেলেটি জানালো আজ সন্ধ্যায় স্থানীয় শিল্পীদের  দ্বারা পরিবেশিত হবে বেশ কিছু লোকসঙ্গীত এবং নৃত্য।  


       শিল্পীরা সময়মত তৈরী হয়ে নিলেন। তাদের দলে আটজন মহিলা একজন পুরুষ । পুরুষ শিল্পী ঢোল বাজানো শুরু করলেন।মহিলা শিল্পীরা চা বাগানের মেয়েদের মত শাড়ী পরে, কখনও একক কখনও একসাথে বেশ কটি গান এবং নাচ পরিবেশন করলেন। দর্শকেরা হাতে তালি দিয়ে উৎসাহ দিলেন। কয়েকটি গান সুন্দরবনের মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে। কয়েকজন পুরুষ এবং মহিলা দর্শক শেষে নাচেও অংশগ্রহন করলেন। চা পকোড়া পরিবেশন করা হলো। নাচে গানে সন্ধ্যাটা বেশ মজায় কাটলো। অনুষ্ঠান শেষে শিল্পীরা বিদায় নিলেন। এরপরেই রাতের খাবার খেয়ে শুতে যাবার পালা। গাইড জানিয়ে দিলো আগামীকাল ঠিক সকাল সাতটায় আমাদের লঞ্চ যাত্রা ছাড়বে পাখিরালয় জেটি থেকে । সেভাবে তৈরী হয়ে লঞ্চে পৌছুতে হবে। 


     তৃতীয় দিন খুব ভোরে উঠে আমরা তৈরী হয়ে নিলাম। আজ আমাদের জঙ্গল ভ্রমণ । সকাল সাতটায় হোটেল থেকে বেরিয়ে পৌঁছে গেছি লঞ্চে। আমাদের সহযাত্রীরা প্রায় সবাই চলে এসেছেন। আজ আমরা সুটকেস, ব্যাগ ইত্যাদি নিয়ে বের হয়েছি। জঙ্গল ভ্রমন শেষ করে আমরা সোজা পৌছে যাব গোদখালীতে। সেখান থেকে গাড়ীতে পৌঁছুবো কলকাতা। হোটেল থেকে চা খেয়ে বেরিয়েছি। সকালের এবং দুপুরের খাবার দেওয়া হবে লঞ্চেই।


      সকাল সাড়ে সাতটায় আমাদের লঞ্চ ছাড়লো পাখিরালয় জেটি থেকে। নতুন একজন গাইড উঠলেন, তিনি আমাদের সবকিছু বুঝিয়ে দেবেন। ভীষন উত্তেজনা হচ্ছে। সুন্দরবনের ভ্রমন কাহিনী বেশ কজনের কাছে শোনা হয়ে গেছে। ভিডিয়ো দেখেছি অনেক কটা । আর কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা ঢুকে পরবো জঙ্গলের মাঝখানে।


      নদীর ওপারে জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। গাইড জানালেন ওটাই সজনেখালি বন বিভাগের শুরু। দশ মিনিটেই আমরা পৌছে গেলাম  সজনেখালি জেটিতে। একে একে সবাই নেমে পড়ল। সুন্দর প্রবেশদ্বার আমাদের স্বাগত জানালো।  আমরা সজনেখালি বন বিভাগে ঢুকে পড়লাম । বেশ উত্তেজনা হচ্ছে, জঙ্গল ভ্রমন তাহলে শুরু হলো আমাদের।  গাইডের কাছে  পর্যটকদের তালিকা ছিলো। খানিকটা সময় নিয়ে তিনি অনুমতি জোগাড়  করলেন। দুপাশে লোহার জাল, মাঝে পর্যটকেরা। জালের ওপারে জঙ্গল। বনদপ্তরের অফিসের সামনেই একখানা পুকুর। গাইড জানালেন এখানে বিরল প্রজাতির কিছু কচ্ছপ রাখা আছে। তাদের ধীরে ধীরে বংশ বৃদ্ধি হচ্ছে ।

    দুপাশে জালের মাঝখানে রাস্তা দিয়ে আমরা পৌছে গেলাম ওয়াচ টাওয়ারে। সেখানে উঠলে বেশ কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত দেখা যায় জঙ্গলের বিভিন্ন প্রজাতীর গাছ। ওখানে কিছু মিষ্টিজলের জলাশয় তৈরী করা আছে। বন্যপ্রানীরা বিভিন্ন সময়ে জল খেতে আসে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে আমরা ফিরলাম বন বিভাগের মিউজিয়ামে। এখানে সুন্দরবনের মানচিত্র, জীবজন্তু, পাখী, বিভিন্ন ধরনের গাছ, মানুষের জীবিকা ইত্যাদি  সুন্দর ভাবে দেখানো আছে। গাইড অল্প সময়ে খুব সুন্দর ভাবে একটা ধারনা তৈরী করে দিলেন। এরপর মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে আমরা আবার লঞ্চে উঠলাম। ছোট রাস্তার পাশে এখানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো আছে , যাতে পর্যটকেরা এক জায়গায় অনেক ধরনের গাছ দেখতে পারেন।    


     সব পর্যাটকেরা লঞ্চে ওঠার পর লঞ্চ ছাড়লো। এবারে লঞ্চে প্রাতরাশের ব্যবস্থা হলো। লুচি, আলুর দম, চা দিয়ে প্রাতরাশ সারা হলো। জল কেটে তর তর করে লঞ্চ এগিয়ে চলেছে। রেলিঙের পাশে চেয়ারে বসে আমরা জঙ্গলের দৃশ্য উপভোগ করছি। জঙ্গল কোথাও কাছাকাছি আবার কোথাও দূরে চলে যাচ্ছে।  দুপাশে বিভিন্ন ধরনের গাছ – সুন্দরী, গর্জন, কেওড়া, হেঁতাল, কাঁকড়া,বাইন, গোলপাতা, ধুন্ধুল, খোলসে ইত্যাদি। গাইড কিছু গাছ চিনিয়ে দিলেন। গাইড বললেন – ভালো করে  নজর রাখুন। কোন না কোন জন্তুর দেখা মিলে যাবে। একখানা গোসাপের দেখা পাওয়া গেল আর বিভিন্ন ধরনের পাখী – মাছরাঙ্গা , চিল, শঙ্খচিল, বক, সারস, হাড়গিলা, পানকৌড়ি ইত্যাদি । খানিকক্ষন বাদে আমরা এসে পৌছালাম সুধন্যখালি রিজার্ভে।   


     সুন্দর প্রবেশদ্বার, আমরা ঢুকে পড়লাম সুধন্যখালি রিজারভে। এখানেও দুপাশে নেটের ভেতর দিয়ে সিমেন্টের রাস্তা  ওয়াচ টাওয়ার পর্যন্ত চলে গেছে। ওয়াচ টাওয়ারের ওপরে উঠলে অনেক দূর পর্যন্ত জঙ্গল দেখা যায়। অনেকগুলি মিষ্টি জলের পুকুর, তার পারে বড় ঘাসের জঙ্গল। অনেক জীব জন্তু এখানে জল খেতে আসে। জীবজন্তু  দেখার সৌভাগ্য আমাদের হল না। বেশ কিছু পরিযায়ী পাখীর দেখা পেলাম।  


    আবার সুধন্যখালী থেকে আমরা রওনা হলাম পরবর্তী গন্তব্য দোবাংকির দিকে। জল কেটে চলছে লঞ্চ, আমরা রেলিঙের পাশে বসে নজর রাখছি পাশের জঙ্গলে। চারিদিক নিস্তব্ধ, মাঝে মাঝে পাখীর ডাক আর লঞ্চের মানুষজনের কথাবার্তার শব্দ। কোনও জায়গায় এক দুটি পর্যটক সহ চোখে পড়লো।  দু জায়গায় দেখা পাওয়া গেলো তিন চারটি হরিণের দল । এক জায়গায় গাইড হঠাত  লঞ্চ থামাতে বললেন। লঞ্চ থামতেই আমাদের আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন , একখানা মাঝারি আকৃতির কুমীর পারের  কাছে অর্ধেকটা মাথা বের করে বসে আছে। লঞ্চ একটু সময় দাঁড়ালো সেখানে। ছবি তুললেন  অনেকেই। তারপর লঞ্চ আবার  এগিয়ে চললো। কিছুক্ষন পরে আমরা এসে পৌছালাম  দোবাংকি বন বিভাগে।


        দোবাংকি বন দপ্তরও বেশ সুন্দর করে সাজানো। জেটিতে নেমে আমরা এগিয়ে গেলাম ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। কিছুটা এগোতেই এক জায়গায়  বনকর্মীদের বিশ্রামের জায়গা তার পাশে বনবিবির মন্দির। সুন্দরবনের বাসিন্দারা বনবিবিকে জঙ্গলের দেবী বলে বিশ্বাস করেন। তাদের বিশ্বাস বাঘ এবং অন্যান্য বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন এই দেবী। আমরাও বনবিবির মন্দিরে প্রনাম জানালাম। এখানে  বোর্ডে লেখা রয়েছে কিছুদিনের মধ্যে আশেপাশের অঞ্চলে কোন দিন বাঘের দেখা মিলেছে।


       দুপাশের গাছ গাছালি এবং জালের ভেতর দিয়ে আমরা ওয়াচ টাওয়ারে পৌছালাম। সুন্দর ওয়াচ টাওয়ার, দোতালা এবং তিনতলা থেকে অনেক লোক একসাথে জঙ্গল দেখতে পারে। গাইড লঞ্চের কর্মী একটি ছেলেকে দিয়ে কেন্দু গাছের নিচে পরে থাকা কতগুলি ফল নিয়ে আসলেন  এবং পর্যটকদের দেখালেন। এই ফলটি স্বাদে টক এবং বাঁদর এবং হরিণের খুব প্রিয় খাবার।    


      দোবাংকি রিজার্ভের আরও একটি আকর্ষণ হলো গাছ গাছালির মধ্যে দিয়ে প্রায় পাঁচশো মিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভারের মত উঁচু পথ। দুপাশে নেট দেওয়া এই পথের নীচ দিয়ে বিভিন্ন জীবজন্তু যাতায়াত করতে পারে। ওপর দিয়ে দর্শকদের যাবার পথ।  কখনও দর্শকরাও বন্য জীবজন্তু  দেখার সুযোগ পান। উঁচু রাস্তার মাঝে পর্যটকদের বিশ্রাম করার ব্যবস্থা আছে। অনেকেই ছবি তুললেন। এই পথ দিয়েই আমরা ফিরে  আসলাম।     

      

      আমরা সবাই লঞ্চে এসে উঠলাম। দোবাংকি পৌছোনর আগেই আমাদের দুপুরের খাওয়া শেষ হয়েছে। এবার আমাদের ফেরার পালা। আমাদের লঞ্চ ফিরে আসছে গোদখালীর দিকে। দুপাশে ঘন জঙ্গল। সুন্দরী, গর্জন , হোগলা প্রভৃতি গাছ দেখা যাচ্ছে। নদীর পারে বেরিয়ে আছে গাছের শ্বাসমূল। জোয়ারের সময় জল অনেকটা উঁচুতে উঠে আসে আবার ভাটাতে নেমে যায়।  বেশ কিছু পাখী দেখা যাচ্ছে। বাঘ না দেখার আফসোস দু একজন পর্যটকের কাছে থেকে শোনা যাচ্ছে। কোথাও বা তিন চারটে নদী একসাথে মিশেছে। সেখানে প্রায় সমুদ্রের আকার নিয়েছে। 


      অনেকটা পথ চলার পর বেশ কিছু মালবাহী জাহাজ দেখা গেলো। তাদের কোনটায় ভারতের পতাকা, কোনটায় বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। জানা গেলো কলকাতা থেকে বিভিন্ন সামগ্রী, যন্ত্রপাতি নিতে বাংলাদেশের জাহাজগুলো আসে। একবার চা পরিবেশন করা হলো। আমরা সাড়ে ছটা নাগাদ গোদখালী এসে পৌছালাম। 


    লঞ্চে ভ্রমন করার সময় বিভিন্ন জায়গায় লক্ষ্য করলাম নদীতে ভেসে যাওয়া বর্জ্য পদার্থ খুব কম। কর্মীরা পরিত্যক্ত জিনিষপত্র, আবর্জনা , কাপ প্লেট , বোতল ইত্যাদী নদীর জলে ফেলেন না। তারা জমা করে রাখেন নির্দিষ্ট জায়গাতে ফেলবার জন্য। এর জন্য তাদের অনেক ধন্যবাদ প্রাপ্য ।   


      এবারে আমাদের কলকাতা ফেরার পালা। তিনটি পরিবার থেকে গেলো পরদিন আরও কিছু দেখবার জন্য। আমরা তিনটি পরিবার কলকাতা ফেরার জন্য তৈরী হলাম। গাইড, কর্মী এবং সহযাত্রীদের বিদায় জানিয়ে আমরা জেটি পার হয়ে আসলাম। আমাদের জন্য একটি গাড়ী তৈরী ছিলো সেটিতে  উঠে বসলাম। রাত সাড়ে দশটায় আমরা আমাদের কলকাতায় আমাদের হোটেলে ফিরে আসলাম। সঙ্গে রইলো অনেক সুন্দর স্মৃতি।


        বেশ কিছু মানুষের সাথে কথা বলে অনেক নতুন তথ্য জানা গেল। সুন্দরবনের বাসিন্দাদের আর্থিক অবস্থা বেশ দুর্বল। প্রতি বছর মধু সংগ্রহ এবং কাঁকড়া ধরার সময় বাঘের আক্রমনে বেশ কিছু মানুষ মারা যায়। বাঘের আক্রমনে নিহত মানুষগুলির পরিবার ভীষন দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটায়। অতিরিক্ত সুরক্ষা এবং জঙ্গলে বাঘের খাবার পর্যাপ্ত থাকলে বাঘের আক্রমনে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা কমবে।  খাবার জলের সমস্যা আছে। মাটির নীচে যে জল পাওয়া যায় তা নোনা স্বাদের। প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষগুলি বার বার বিপন্ন হয়ে পড়ে। এসবের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা করে রূপায়ন করা দরকার। এ অঞ্চলে মানুষের কাজের সুযোগ তৈরী করা খুব জরুরী।  স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তৈরী করে বিভিন্ন প্রকল্প তৈরী হলে উপার্জন বেশী সংখ্যক মানুষের কাছে পৌছুবে। শিক্ষা, চিকিৎসা , কাজের সুযোগ আরও বেশী তৈরী হওয়া দরকার। তাহলে এই এলাকার মানুষগুলি সুদিন দেখতে পারবে।  


         সুন্দরবন অঞ্চলের পুরোনো জেটিগুলির সংস্কার এবং গোদখালীতে  বিশ্রামাগার এবং বাস স্ট্যান্ড নির্মাণ খুব জরুরী। তাহলে পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়বে।    


     কিভাবে যাবেন ঃ   সুন্দরবন যেতে হলে কলকাতা হয়েই যেতে হবে। অনেক ভালো ভ্রমন সংস্থা আছে। ইন্টেরনেট খুঁজলেই তাদের সাথে যোগাযোগ করা যায়। পরিচিত কেউ ঘুরে এসেছে এমন সংস্থার সাথে ভ্রমনে যাওয়া ভালো। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন বিভাগেরও ভ্রমণের  ব্যবস্থা আছে। যাবার ভালো সময় শীতকাল। বর্ষাকালে অসুবিধা হতে পারে। লঞ্চ থেকে জেটিতে ওঠার এবং নামবার সময় বয়স্ক মানুষের সাবধান থাকা ভালো। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র , মশা তাড়াবার ওষুধ সাথে রাখা উচিত হবে। শুক্র, শনি এবং রবিবারে বেশী মানুষন ভ্রমণে যান।





  • চিত্র - লেখক

Comments