অনুগল্প - জয়িতা সরকার

 


স্বপ্ন বোঝা 




'গেলো রে, গেলো, কাপড়-জামা থেকে ঘুঁটে-খড়ি সব ভিইজ্যা গেলো, তাও এই পোলার কোন হুঁশ নাই, তোরে নিইয়া আর পারি না বাপু',একদিকে হঠাৎ আসা বৃষ্টি আর ঝড়ের দাপটে ঘর-বাড়ি সব উল্টে যাওয়ার উপক্রম, অন্যদিকে মায়ের বকা কিছুতেই খেয়াল নেই মহিনের। দরমার ঘরে এক ছোট্ট জানলার ধারে বসে ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই আউড়ে চলেছে ইতিহাস। ' সব ভিইজ্যা গেলো, বেড়ার ফাঁক দিয়া জল আসতেছে, ওরে মহিন, জাংলাটা বন্ধ কর দেখি, ট্রেরাংকের নিচ থেকে প্লাস্টিক খান বাইর কইরা পশ্চিমের বেড়ার দিকে দে দেখি।' মায়ের চিৎকারে সম্বিৎ ফেরে মহিনের, 'জানালা বন্ধ করলে ঘরে একটুও আলো থাকবে না মা, পড়ব কেমন করে?' মহিনের উত্তর শুনেই, বৃষ্টি ভেজা শীতল বাতাসে যেন আগুন জ্বলে উঠল মায়ের মনে, গলা সপ্তমে তুলে বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে মহিন শুনতে পেল- 'ঘর ভাইস্যা গেলো, আমার পোলা ওহন পণ্ডিত হইতে লাগসে, বেড়ায় প্লাস্টিক লাগা ওহুনি, না হইলে ওই বইয়ের পাতা আর আস্ত থাকব না।' 


মহিন, কুমারপাড়া গ্রামের ভাল ছেলের তকমা পেয়েছে ছোট থেকে। প্রথমে গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে, সেখান থেকে এখন হাইস্কুলের একাদশ শ্রেণীর কলা  বিভাগের ছাত্র সে। বাবা শহরে ভ্যান চালায়, মা ওই একশ দিনের কাজে হঠাৎ কাজ পায়, কাজ পাওয়ার অনিশ্চয়তার মত টাকাও মেলে অনিয়মিত। মহিন স্বপ্ন দেখে একদিন সে বড় অফিসার হবে। ওই  গ্রামের ব্লক অফিসে যে স্যার বসে ঠিক উনার মত। আসলে ব্লক অফিসের অফিসারকে দেখে মহিনের এই স্বপ্ন নয়, বাবার ভ্যানখানা দেখে নিজের মনে বড় অফিসার হওয়ার স্বপ্ন বোনে সে। 


রোজ সন্ধ্যে বেলা বাবা শহর থেকে ফিরে দাওয়ায় বসতেই, ছুটে বাইরে রাখা ভ্যানটাকে একবার প্রদক্ষিণ করে মহিন। তারপর বাবার কাছে জানতে চায় -' আজ তুমি কোনদিকে গিয়েছিলে বাবা?' ছেলের রোজকার এক প্রশ্নের কোন কারণ খুঁজে পায় না, তবুও উত্তর দেয়, ' আজ ওই কাশীনাথ বিদ্যামন্দিরের রাস্তায়, আচ্ছা তুই রোজ এইডা জিগাস কেন বলতো?' বাবার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই মুচকি হেসে ঘরে ঢুকে যায় মহিন। বইয়ের পাতায় চোখ রাখে আর ভাবে- 'ওরা আজকে জানতে পারল, এমন একটা জাদুঘরের কথা, ওখানে গেলেই কেল্লাফতে। একবার ওই জাদুঘরে ঢুকতে পারলেই হয়, আচ্ছা বাবার সঙ্গে একদিন গেলে কেমন হয়?'  বাবাকে কি বলবে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা, ভাবতে ভাবতেই লন্ঠনের আলো নিভে আসে ঘরে। 


নতুন পদ্ধতি, মনে রাখার নতুন কৌশল, এক নিমিষে সঠিক উত্তর এই শব্দগুলোই বারবার ভেসে আসে কানে, স্কুল কামাই করে খানিকটা জোড় করেই বাবার ভ্যানে চেপে শহরে গিয়েছিল মহিন। বাড়ি ফেরার পর থেকে স্বপ্নটা আরও জাঁকিয়ে বসেছে, আর তা বাস্তব করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। স্কুলের মাস্টারমশাই কিংবা দিদিমণিদের কাছে রোজই নতুন নতুন প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয় সে। বাবা ফিরে এলে জানায়, তার ভ্যানে লেখা সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে। স্কুলের গণ্ডিতে পা না রাখা বাবা এসবের কিছুই বোঝেনা, শুধু বোঝে ছেলের স্বপ্নের ভারটা বেশি, পূরণ করতে তাকে আরও কাজ করতে হবে। 


শহরের অলিগলিতে চাকা ঘুরছে মহিনের বাবার, ঘাম ঝড়িয়ে ভেজা হাতে তুলে দিচ্ছে স্বপ্নপূরণের চাবিকাঠি, ওদের স্বপ্ন সফল হলেই ছেলের জন্য মিলবে জাদুঘরের চাবি। ক্লান্ত শরীর, চোখ ডুবে আসছে তবুও প্যাডেল থামছে না। ' অফিসার তোরে হইতেই হবে',  প্যাডেলে পা রাখল মহিন, সংসার যাপনের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে স্কুলের গেটে গেটে অফিসার হওয়ার স্বপ্ন বিলি করছে সে। বড় ব্যানারে মোড়া অফিসার হওয়ার জাদুঘরের বিজ্ঞাপনী ভ্যানের উত্তরাধিকারী হয়ে শহরের রাস্তায় স্বপ্ন বোঝা বইছে মহিন। ঘরে সদ্য ট্রাকে চাপা পড়া ভ্যানচালকের স্ত্রী আর ছোট দুই মেয়ে, বড় ছেলে হিসেবে সংসারের প্যাডেলে গতিমান একমাত্র মহিন। 

Comments