বই কথা - সাম্য রাইয়ান

 



মায়াবী বাদ্যকর সুবীর সরকার


কথাসাহিত্যিক শওকত আলী উত্তরবঙ্গে গ্রামীণ এক কৃষককে মাটিতে কান পেতে বীজ গজানোর ধ্বনি শুনতে দেখেছিলেন। আর কবি সুবীর সরকার, যিনি এক মায়াবী বাদ্যকর, বাঙলার পথে-প্রান্তরে ঘুরে হেমন্তকালীন ভূমিতে কান পেতে শুনছেন, “মধ্যরাতের সঙ্গম শেষ হলে হেমন্তের মাঠে বেজে ওঠে সা রে গা মা৷”

(বিবাহ)


পিকাসো বলেছিলেন, সব মহৎ শিল্পকলাই সংগীত হয়ে উঠতে চায়। অর্থাৎ, তিনি শিল্পকলার শাখাগুলোর মধ্যে সংগীতকে শীর্ষস্থান দিয়েছিলেন। এরকম উপলব্ধিও পাই যে, শিল্পের উত্তরণ সংগীতে উপনীত হওয়ার মধ্য দিয়েই ঘটে। অর্থাৎ শিল্পযাত্রায় সংগীত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে৷ ফলে কবিজীবনে সুরের প্রভাব আলাদা করে উল্লেখ বাহুল্য৷ কবি সুরের হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো পাখি৷ এই সুর উপলব্ধি করতে হয়; আবিষ্কার করতে হয় প্রকৃতি ও জীবনের ভেতর থেকে৷ এই সত্যই রচনা করেছেন কবি—

“বাদ্য লিখি৷ বাজনা লিখি৷ ম্যাজিকের মধ্য থেকে

উঠে আসে শিস৷ নির্জন প্রান্তরে একা একা জ্বলে ওঠে উনুন৷”

(গান)


আমাদের জীবনের প্রতিক্ষেত্রে সুরের প্রভাব সুনিবিড়, অবিশ্ছেদ্য৷ সুরের প্রভাবে আগুন জ্বলে, বৃষ্টি নামে, ব্যক্তির চিত্তশুদ্ধি ঘটে, অসুস্থ স্নায়ুর ওপর ক্রিয়া করে সুস্থতা আনে। খরার সময় বৃষ্টির গান তো আমাদের লোকায়ত জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটি অনুষঙ্গ। সামগানে সাতটি স্বরের যে ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, তার অর্থ হলো সুরের সাহায্যে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন।


“সব চিহ্ন মুছে যায়৷ শ্মশান পাহারায় পুরোন ছাতা৷

হাতঘরিহীন হাতে রোদ পড়লে

হাডুডু ভুলে যাওয়া মাঠে বিকেল নামে৷”

(ডুব)


কবি তো বাদ্যকর, বাজিয়ে চলেছেন জীবন— অপার সৌন্দর্য! কিন্তু হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা না, সত্যদ্রষ্টা৷ এতটাই সত্য— দৃশ্যমান সত্যের উপরে যার অবস্থান, নিঃসন্দেহে গভীরেও৷ তিনি লিখেন যেন আত্মপরিচয় কিংবা সেই মানুষ যাকে তিনি কল্পনায় লালন করেন আত্মপ্রতিভূরূপে—

“আসলে তো বাদ্যকর৷

লম্বা ও চওড়া মানুষ৷

প্রেরিত বাক্য প্রত্যাখ্যান করে দুপুর

আমাদের যাপনে অন্তত কিছু গান জমুক”

(বাদ্যকরের জার্নাল)


এই যাপনজুড়ে অন্য কিছুই নয়, কিচ্ছু না, শুধু গান! কবি উপলব্ধি করেন আমাদের এলিয়েনেশন, অনেকের সাথে থেকেও একা হয়ে যাওয়ার দৃশ্য এবং তার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা সেই নিয়ন্ত্রকের চেহারা৷ ফলে তিনি লিখেন, “কী ভীষণ ব্যক্তিগত হয়ে উঠছে আমাদের জীবন!”


সুবীর সরকার তাই ছুটে চলেন বাঙলার পথে-প্রান্তরে; ভারতের, বাঙলাদেশের৷ তার এ পথ চলাতেই আনন্দ! চলতে চলতে জড়িয়ে পড়েন বাঙলার ধুলোবালিপথে, নানা অনুষঙ্গে৷ কোনকিছুই তার নজর এড়ায় না৷ একজন ব্যক্তি কত সামান্য বস্তুর সাথে জড়িয়ে যায় জীবনপ্রবাহে, যা কবির হাতে অসামান্য হয়ে ওঠে, মর্যাদা পায় লাইটার, হাতকুঠার, এরকম আরো কত কী!

“এই যে জীবন যা যুক্ত হয়ে যাচ্ছে হাতকুঠারের সঙ্গে

এই যে জীবন যা আসলে বহন করে লাইটার

চাপা হাসিকে সূত্র ধরে একটা ফুলবাগান খুঁজে নিতে থাকি” (সূত্র)


সুবীর সরকার নয়ের দশকের গুরুত্বপূর্ণ নাম৷ কবি উত্তরের লোকজীবনের সাথে জড়িয়ে আছেন তীব্রভাবে। জন্ম জানুয়ারি ১৯৭০, কোচবিহার শহরে। ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা। ১৯৮৭ থেকে লেখালিখি শুরু। কবিতার পাশাপাশি ভূমিলগ্ন জনমানুষের যাপন নিয়ে নিয়মিত গদ্যও লেখেন৷ রয়েছে কয়েকটি গদ্যের বইও।


জঙ্গল-জনপদ বারবার তাকে টানে অবিচ্ছেদ্য ভঙ্গিতে৷ প্রকৃতিতে মিশে যান কবি৷ লিখেন—

“কিনে নিচ্ছি জল জঙ্গল জনপদ।

মানচিত্রের গায়ে হেলান দেয় ম্লান আলো

আমরা ফুরিয়ে যাই।

আর চারপাশে কথা ওড়ে।” (জীবন)


কখনো এরকম অনুভূতিও ফুটে ওঠে তার লেখায়, 

“নদী দেখে ভয় পাই। এদিকে অন্ধ কুকুর স্নান সারছে।

আলো কমে আসলে জঙ্গল ক্রমে ভয়ার্ত হয়ে ওঠে” (দুপুর)


মানুষের অধিক অন্যান্য প্রাণী কতোটা প্রকৃতিবর্তী তা ফুটে উঠেছে ‘দুপুর’ কবিতায়৷ ‘বাদ্যকরের জার্নাল’ বইয়ে অনেকগুলো পংক্তি আমাকে বিস্মত করেছে৷ কয়েকটি উল্লেখ করছি:


১৷ “গ্রাম ও গ্রামার ঘেরা নদী৷” (গ্রামার)

২৷ “আমি লিখি, ডানা ভাঙার ইতিহাস৷” (হাসপাতাল)

৩৷ “কান্না আসলে বিশ্রামাগার

খুব একা হয়ে যাওয়া মানুষেরা এটা জানেন৷” (গল্প)

সুবীর সরকার এক মায়াবী বাদ্যকর; মাটিবর্তী মানুষের গল্প ছড়িয়ে আছে যার কথায়, কবিতায়৷ ‘বাদ্যকরের জার্নাল’ এমনই এক কাব্য, যা পাঠককে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখতে সক্ষম৷

Comments