প্রবন্ধ - জিতেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য

 


ভিক্টোরিয়া( এ বি এন শীল) কলেজের    প্রাক্তনী কলাগুরু বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা 

             

কলাগুরু বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা ছিলেন অসমের একজন বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, অভিনেতা, চিত্রকর এবং চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত পরিচালক। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও তিনিও সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন।একজন বিপ্লবী হিসেবেও তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ঢাকায় ১৯০৯ সনের ৩১ জানুয়ারী বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল গোপাল চন্দ্র মুসাহারী। বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা বোড়ো জনগোষ্ঠীর মধ্যে জন্ম গ্রহণ করলেও এক রাভা পরিবারে লালিত পালিত হয়েছিলেন বলে পরবর্তী সময়ে তিনি রাভা উপাধি গ্রহণ ও ব্যবহার করেছিলেন। সেনা বাহিনীর উচ্চ পদস্থ আধিকারিক তাঁর পিতা  গোপাল চন্দ্র  মুসাহারীকে ব্রিটিশ সরকার রায়বাহাদুর উপাধি দিয়েছিল।সংস্কৃতি অনুরাগী গোপাল চন্দ্র মুসাহারী তেজপুরের বান রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।


বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা সেনা বিভাগের বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি তেজপুরে এক আত্মীয়ের গৃহে কিছু দিন বসবাস করেন। ১৯২৬ সনে তিনি তেজপুর সরকারি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন।এরপর তিনি কোচবিহারে এসে কিছু দিন ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যয়ন করেন।পরবর্তীতে রংপুর কলেজে পড়াকালীন অবস্থায় তিনি মাধবচন্দ্র বেজবরুয়া পরিচালিত বাহী মুখপত্রের চিত্রলেখা(অঙ্কন) বিভাগ পরিচালনা করেছিলেন ও আবাহন মুখপত্র সম্পাদনাও করেছিলেন। ১৯৩৫ সনে তিনি জ্যোতিপ্রসাদ আগরয়ালার চলচ্চিত্র জয়মতীতে নৃত্য পরিচালনায় সহযোগিতা করেন।১৯৪৫ সনে বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা বিপ্লবী কমিউনিস্ট দলের সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪৬ সনে তিনি সিরাজ ছায়াছবির কাজে কলকাতা যাওয়ার পথে কমিউনিস্ট দলের নেতা সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে পরিচিত হন ও ঐ দলের একজন সক্রিয় সদস্য হন।১৯৪৮ সনে কমিউনিস্ট দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে তিনি ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সন পর্যন্ত আত্মগোপন করে পলাতক অবস্থায় ছিলেন। ১৯৫২ সনে গোয়ালপাড়ার ঘিলাগুড়ি অঞ্চল থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে ও এক বৎসরের জন্য তাঁকে  কারাবাস দেওয়া হয়।


১৯৫৫ সনে বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা ভারতীয় কমিউনিস্ট দলে যোগদান করেছিলেন ও ১৯৫৭ সনে বরপেটা সমষ্টির প্রার্থী রূপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। নির্বাচনে বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা পরাজিত হয়েছিলেন। ১৯৬২ সনের ভারত-চীন যুদ্ধে তাঁকে চীনাপন্থী রূপে বিবেচিত করে ৯ মাস কারা দণ্ড দেওয়া হয়।১৯৬৭ সনে তিনি তেজপুর বিধানসভার নির্দলীয় প্রার্থীরূপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়লাভ করেছিলেন। ১৯৬৮ সনে তিনি কোকরাঝার সমষ্টি থেকে লোকসভার নির্দলীয় প্রার্থী রূপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হয়েছিলেন।


বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা ১৯৩৭ সনের ২৪ নভেম্বর যোরহাটের সুগায়িকা প্রিয়বালা বরুয়াকে বিবাহ করেছিলেন। বিবাহের কিছুদিন পর জ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রিয়বালা দেবীর মৃত্যু হয়েছিল।পত্নী বিয়োগের পর তিনি নিরুপমা দেবীর সান্নিধ্যে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি নিরুপমা দেবীকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহ করেন নাই। ১৯৫১ সনে বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা নলবাড়ীর বেলশরের নবীনচন্দ্র মেধীর কন্যা কনকলতা দেবীকে বিবাহ করেন। তিনি দু'টি পুত্র সন্তান পৃথ্বীরাজ রাভা ও হেমরাজ রাভার জন্ম দেন। ১৯৬২ সনে কনকলতা দেবীর মৃত্যুর পর বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা গোসাইগাও অঞ্চলের অন্তর্গত বিন্নাখাটা গ্রামের মোহিনীবালা বসুমতারীকে বিবাহ করেন। মোহিনীবালা দেবী একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন।পুত্র সন্তানের নাম মেন্ডেলা রাভা। কন্যা সন্তান জন্মের পরে মোহিনীবালা দেবী ইহলোক ত্যাগ করেন।


বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত তাঁর তাণ্ডব নৃত্যে মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন উপাচার্য ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন বিষ্ণুপ্রসাদ রাভাকে কলাগুরু উপাধি দিয়েছিলেন।এই উপাধিতে তিনি অসমবাসীর হৃদয়ে আজও জাগরূক হয়ে রয়েছেন। 


বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা অসমীয়া সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখার  সাথে জড়িত ছিলেন। সংগীত, অভিনয়, চিত্রকলা ও নৃত্য ছাড়াও তিনি সংগীত ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর রচিত গানকে       বিষ্ণুরাভা সঙ্গীত বলা হয়। তিনি নাটক ও চলচ্চিত্রেও অভিনয় করতেন। প্রথম অসমীয়া চলচ্চিত্র জয়মতী নির্মানের সময় তিনি জ্যোতিপ্রসাদ আগরয়ালাকে নৃত্য পরিচালনায় সাহায্য করেছিলেন। তিনি এরা বাটর সুর, প্রতিধ্বনি ও সিরাজ ইত্যাদি চলচ্চিত্রে দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। ফনী শর্মার সঙ্গে যুগ্মভাবে পরিচালনা করেন অসমীয়া চলচ্চিত্র সিরাজ।সিরাজ  সফল চলচ্চিত্রের মর্যাদা পেয়েছিল।


১৯৬৯ সনের ২০ জুন বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বিষ্ণুপ্রসাদ রাভার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ২০ জুন তারিখ অসমে রাভা দিবস রূপে পালন করা হয়। তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ভারত সরকার ২০০৯ সনে একটি বিশেষ ডাক টিকিট চালু করেছিলেন। বিষ্ণুপ্রসাদ রাভার সৌজন্যে অসম সরকার বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা পুরস্কার প্রবর্তন করেছে। অসমের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অসামান্য অবদানের জন্য প্রতি বছর এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। 


বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা স্মৃতি উদ্যান ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ভৈরবী মন্দিরের পাশে অবস্থিত। বিষ্ণুপ্রসাদ রাভার স্মৃতিকল্পে তাঁর পুত্র হেমরাজ রাভা এই উদ্যানের কাজ আরম্ভ করেছিলেন। পরে অবশ্য এই উদ্যান নির্মাণের ভার অসম সরকার বহন করেছিলে। এই উদ্যানের ভিতর বিষ্ণুপ্রসাদ রাভার সমাধি অবস্থিত। বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা শুধু অসম নয়, সমগ্র ভারতে এক উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত।

Comments