গল্প - দিবাকর পুরকায়স্থ


বাংলা, বাঙ্গালী এবং ডিটেনশন ক্যাম্প


[এই গল্পের পটভূমি যেহেতু আসামের কাছাড়, করিমগঞ্জ জেলা নিয়ে বিস্তৃত, তাই কথপোকথনে স্থানীয় সিলেট অঞ্চলের ভাষা ব্যবহঋত হয়েছে]


ইজাজ উদ্দিন ভালো করে সামনে বসা মেয়েটির দিকে তাকালেন। কাঁদতে কাঁদতে মুখ চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে বছর পঁচিশের মেয়েটা। কান্নার দমকে পিঠ মাঝে মাঝে কাঁপছে। নিজের রিভলভিং চেয়ারে বসে মেয়েটির অল্প সামলে নেবার অপেক্ষা করছেন ইজাজ উদ্দিন।

ইজাজ উদ্দিন শিলচর শহরের বার এসোসিয়েশনের নামকরা এডভোকেট। সারা শিলচরের সবাই একবাক্যে চেনে ইজাজ সাহেবকে । নিজের বাড়ীর প্রথম ঘরটাতেই ওনার চেম্বার, যেখানে এখন উনি বসে আছেন । দেয়াল জুড়ে তিনদিক আলমারি। বলাই বাহুল্য আলমারি গুলো আইনের মোটা মোটা কেতাবে ঠাসা। 

প্রতীক্ষার এক সময় অন্ত হয় । মেয়েটি নিজেকে সামলে নি চোখ মুছে সোজা তাকায় । পোড়া খাওয়া উকিল ইজাজ উদ্দিন সোজাসুজি প্রসঙ্গে না গিয়ে প্রশ্ন উত্তর শুরু করলেন যাতে মেয়েটির নার্ভাসনেস কেটে যায়।

"তুমার নাম কিতা গো মাই?" উনি আঞ্চলিক ভাষায় কথোপকথন শুরু করলেন।

"আইজ্ঞা নীলুফার। নীলুফার রহমান।" মেয়েটি চোখ মুছে জবাব দেয়।

"কইতনে আইছো ?" দ্বিতীয় প্রশ্ন ইজাজ সাহেবের।

"বদরপুর।" মেয়েটির সংক্ষিপ্ত জবাব।

"অখন কও দেখি কিতা অইছে তুমার ।" এবার সরাসরি পয়েন্টে আসেন দুঁদে উকিল।

"আমার মা'রে শিলচর পুলিশে ধরিয়া লইয়া আইছে কাইল রাইত। কয় মা বুলে অবৈধ বিদেশী,মানে বাংলাদেশী।" মেয়েটির চোখ আবার ছলছল ।

বিশিষ্ট উকিলের বুঝে নিতে মুহূর্ত লাগে না যে সমস্যা কি । এই ছবি আজকাল আসামের ঘরে ঘরে, বিশেষত ভাষাভিত্তিক সংখ্যালঘুদের। তিনি তাড়াতাড়ি রাইটিং প্যাড আর কলম খুলে চোখে চশমা এঁটে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন মেয়েকে " তুমার মা'র নাম কও।"

"আইজ্ঞা সইনধ্যারাণী পাল।" 

উকিল বাবু প্যাডে লিখলেন সন্ধ্যারাণী পাল । তারপর জিজ্ঞেস করলেন অবধারিত পরবর্তী প্রশ্ন।

"তুমার বাবা রহমান আর মা হিন্দু?"

"আইজ্ঞা অয়। আব্বুর দরজির দুকান আর মা অউ ইস্কুলঅ কিতা যে কয়, মিড ডে মিল, ওতার ভাত রান্নার কাম করইন।"

"অখন কও কাইল কুন সময় পুলিশ গেছিল ঘরঅ। আর কতায় কতায় আইজ্ঞা কওয়া বাদ দেও।" 

"জী,বিহানকু মা ইস্কুলঅ গেছইন দশটার সময়। আমরার দুইজনর মাধানর ভাত তরকারী রানধিয়া থইয়া গেছইন, রোজ যেলাখান যাইন। আমি আমার পড়া শেষ করিয়া স্নান করিয়া আইছি খালি। আববুও দুকান লাগাইয়া স্নান খাওয়া করতে ঘরঅ আইছইন, আর দরজাত বাড়ি। কে আইলঅ চিন্তা করিয়া উড়কা খুলিয়া দেখি পুলিশ।কোর্টর কাগজ দেখাইয়া জিগাইলো মা'র নাম দিয়া যে কে তাইন। আববু স্নান করাত আছলা।আমার পুলিশ দেখিয়া ডর ডর করের। ডরাইয়া কইলাম যে আমার মা।কেনে কিতা অইছে? তে তারা কইলা মা'রে ডাকঅ। কোর্টর সমন আছে এরেস্ট করিয়া লইয়া যাইবার, তুমার মা বাংলাদেশী। হুনিয়া আমার শরীল কাপা আরম্ভ অইলো। আমি কুনোমন্তে কইলাম যে আমার মামার বাড়ী রূপসীবাড়ি। মা বাংলাদেশী অইলা কেমনে ? পুলিশে কয়, অত মাত মাতার সময় নাই, কাগজপত্র লইয়া কোর্টঅ দেখাইয়ো। আমরা সরকারী নির্দেশ পালন করতে আইছি। আমি কইলাম যে মা তো অখন ইস্কুলঅ।"  নীলুফার নামের মেয়েটা ঢোক গেলার জন্য থামল ।

"পানি খাও, খাইয়া আস্তে আস্তে কও"  ইজাজ উদ্দিন টেবিলের কোণে ডাকা নিজের জল ভর্তি গ্লাস এগিয়ে দিলেন ওর দিকে । নীলুফার ঢকঢক করে গ্লাসের জল শেষ করে ফের শুরু করে ।

"তে পুলিশর বাবুরা জিগাইলা কুন ইস্কুল। আমি নাম কইলাম আর ইবায় আব্বু স্নান শেষ করিয়া আইছইন। হকল কথা হুনিয়া তো আব্বু কাঁপতে কাঁপতে পড়িয়া ফিট । আমি কুনবায় জাইতাম? আব্বুর মুখো চোউখো পানি আনিয়া ছিটাইতে ছিটাইতে পুলিশ দুয়োজন হাওয়া। আধাঘন্টা বাদে ইস্কুলর পিয়ন মিনহাজ দৌড়াইয়া আইয়া খবর দিল যে মা'রে পুলিশে ইস্কুল থাকি এরেস্ট করিয়া জীপঅ করিয়া শিলচর লইয়া গেছে গিয়া।"

নীলুফারের চোখ আবার ছলছল করছে।

ইজাজ উদ্দিন তাকে অভয় দিয়ে বলেন " ভয় নাই মা, ভয় নাই। আমরা কোর্ট থাকি তুমার মার জামিনের ব্যবস্থা করমু। তারপরে কিতা অইলো কও।"

নীলুফার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে "বিয়ালে ইস্কুল আর পাড়ার হক্কল মুরব্বী আইলা আমরার বাড়ী । হক্কলেউ কইলা আফনার নাম। শিলচর আইয়া আফনার লগে লগ করতে । তে, আব্বুর তো লেখাপড়া নাই, এরলাগি আমি আইছি। আফনে যেভাবে অউক মা'রে ছুটানির লাগি কিচ্ছু একটা করইন। পয়সা আমরা খরচ করমু।" 

                                                                       

                               ******

মেজিস্ট্রেট কোর্টে এসেই ইজাজ উদ্দিন দুঃসংবাদ পেলেন। গতকাল দুপুরেই শিলচর পুলিশ সন্ধ্যারাণী পালকে কোর্টে তুলে ভারতীয় বিদেশী অধিনিয়ম ১৯৪৬ এর ধারা ৩(২)সি অনুসারে এবং আসাম সরকারের উপর ন্যস্ত ধারা ২৫৮(১) অনুসারে ডিটেনশন ক্যাম্পে স্থানান্তরিত করার অধিকার দাবী করে । মহামান্য আদালত সন্ধ্যারাণী পালের নিকট ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণের কোনো প্রমাণপত্র না থাকায় তাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে স্থানান্তর করার নির্দেশ দেন এবং অবিলম্বে আসাম পুলিশ সেই নির্দেশ কার্যকরী করে। আদালত অবশ্য এই নির্দেশও দিয়েছেন যে অভিযুক্ত সন্ধ্যারাণীর নিকটাত্মীয় কেউ যদি সঠিক প্রমাণপত্র আদালতে পেশ করতে পারেন তবে আদালত পরবর্তী নির্দেশ দিয়ে তাকে মুক্তি দেবে । সন্ধ্যারাণীর নিকটাত্মীয় তারসঙ্গে দেখা করতে অবশ্য পারবেন, তবে সরকারী নিয়ম মেনে ।

এই নির্দেশের কপি কোর্ট থেকে বের করে নীলুফারকে বুঝিয়ে বলার সাথে সাথে ও হাউহাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে । ওর কান্নাকাটি এত জোরে জোরে হচ্ছিল যে কোর্টে উপস্থিত অনেকেই তার দিকে তাকাতে বাধ্য হচ্ছিল। ইজাজ উদ্দিন উকিল তাড়াতাড়ি ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিজের গাড়ীতে ওঠালেন । আজ ওনার অন্যান্য মামলার কাজ জুনিয়রদের বুঝিয়ে দিয়ে গাড়ী স্টার্ট করেন।পরবর্তী গন্তব্য ডিটেনশন ক্যাম্প,শিলচর ।

                                                                     

                               *******

শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্প শিলচর মূল জেলের একটা অংশ বিশেষ। ডিটেনশন ক্যাম্প বলতে যা বোঝায় তার হলো কোনো ব্যাক্তি অবৈধভাবে এদেশে এসে বাস করছেন আর ভিসার সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাবার পরও কোনো বিদেশী যদি অবৈধভাবে এদেশে বসবাস করছেন এবং কোনো ব্যাক্তি যদি সন্দেহজনক ভাবে অবৈধ বিদেশী বলে চিহ্নিত হন তারাই ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকেন । এখানে শিলচর শহরে আলাদা কোনো ডিটেনশন ক্যাম্প নেই এবং শিলচর সদর জেলের একটা অংশ ডিটেনশন ক্যাম্প হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে ।

আমাদের গল্পের বিশিষ্ট উকিল ইজাজ উদ্দিন তার গাড়ী শিলচর জেলের বহির্ভাগে সাইড করলেন । তারপর নীলুফারকে উত্তেজিত না হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় নামতে বলে নিজেও নামলেন । গাড়ি লক করে জেলের গেটের প্রহরারত সান্ত্রীকে তাদের আসার উদ্দেশ্য জানালে সান্ত্রী তার কালো কোট দেখে তার পরিচয় বুঝে নেয় এবং গেট খুলে জেলার সাহেবের অফিস ঘরের দিক নির্দেশনা দেয়। 

জেলার শ্রী জগদীশ গগৈ ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকায় মানুষ হয়েছেন এবং কর্মসূত্রে এই বরাকের অববাহিকায় শিলচরে আছেন ।বাংলা ভাষা মোটামুটি রপ্ত করেছেন।সন্ধ্যারাণী পালের নাম বলার সাথে সাথে বুঝে নিলেন ।

"কালকে বিকেলে আসা মহিলা তো ?" উনি নিশ্চিত, তবুও নিয়মমাফিক প্রশ্ন।

উকিল সাহেব মাথা নাড়লেন সম্মতিসূচক। গগৈ একজন সিপাহী ডেকে ওদের ডিটেনশন ক্যাম্পের দিকে নিয়ে যেতে বললেন। ওনারা দুজন উঠে সিপাহীটিকে অনুসরণ করলেন । কিন্তু কি দেখলেন ? 

"ইয়া আল্লাহ!" ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে এই শব্দ বেরিয়ে এল ইজাজ উদ্দিনের মুখ দিয়ে ।

বায়ে বাঁক নিয়ে একটা প্রশস্ত পথ ধরতে প্রথমেই একটা ঝাঁঝালো গন্ধ এসে নাকে লাগলো । তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে চাপা দিলেন উনি । যন্ত্রচালিতের মতো নীলুফার ও নিজের সালোয়ারের ওড়না দিয়ে নাক ঢাকলো। দীর্ঘ দিন ধরে কোথাও প্রস্রাব করে ঠিকমত জল না দিলে যে ঝাঁঝালো এ্যমোনিয়ার গন্ধ লাগে, এ সেই গন্ধ। তারপর দেখলেন এক বড় চৌবাচ্চার ধারে স্তূপ করে কাপড় কাচা হচ্ছে। দেখেই বোঝা যায় এগুলো বন্দীদের কাপড়। কাচা কাপড়ের সাবান জলের ফেনা কলের পাড়ের নালা উপছে পড়ে সামনের উঠানের মত খালি জায়গা ভেসে যাচ্ছে। সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। ওধারে দুজন সেপাই খইনি টিপতে টিপতে নিজেদের পারিবারিক গল্প করছে।

বারান্দা পার হয়ে উল্টো দিকে সারি সারি কয়েদখানা। প্রত্যেক কয়েদখানায় লোহার শিকের গায়ে মুখ ঠেকিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন অগুনতি কয়েদী । এক এক কক্ষে পনেরো জনের কম নয়।

হতবাক ইজাজ উদ্দিন জিজ্ঞেস করেন " এরা হক্কল সন্দেহভাজন বিদেশী নি রেবা?"

"না না স্যার। ইনো হক্কল মিকচার।" সেপাই জবাব দেয়।

"মিক্সচার মানে কিতা ?" এবার নীলুফার পেছন থেকে শুধায় ।

সিপাইটি একবার পেছনে তাকিয়ে দেখল নীলুফারের দিকে । তারপর জবাব দেয় "মানে হক্কল আছইন,চুর ছ্যাচছড়,ডাকাইত আর বাংলাদেশী,সব মিক্সচার।" সেপাই খইনি রঞ্জিত কালো দাত কেলিয়ে হাসলো একবার।

"কিতা কও ইতা? এরা হক্কলর খাওয়া দাওয়া, পেচ্ছাপ, পায়খানা কিতা একখানো নি ? " এবার বিস্ময়ের পালা উকিল সাহেবের ।

"স্যার , কিতা করবা ? জাগা বাসা অত মানুর কেমনে অইতঅ ? সরকারে তো টেকা দেইন না আবার আলাদা বিল্ডিং ও দেইন না।" গার্ডের যুক্তি অকাট্য। উত্তর পেয়ে সন্তুষ্ট হলেন না ইজাজ উদ্দিন। ততক্ষণে ওরা একটা কয়েদখানার সামনে পৌঁছে গেছেন যেখানে অগ্রবর্তী সেপাই থেমে বলল " অনঅ রাখা অইছে কাইল আনা বেটি ওগুরে ।" 

"ভদ্র ভাষায় কথা কইন। বেটি অগু কিতা ? আমার মা তাইন ।" নীলুফার কর্কশ স্বরে ধমকে ওঠে ।ওর চোখে আগুন।সিপাই কোনো কথা না বলে মিইয়ে যায়। 

ভেতরের অবস্থা ভয়াবহ। এক লোহার গ্রীলের ভেতরে মোটামুটি ১৫'x১০' একটা ঘর।  প্রায় দেড় মানুষ উঁচুতে একটা ছোট জানালা হাওয়া বাতাস আসার জন্য । ভেতরে কুড়ি জন মানুষ। বেশীর ভাগ হিন্দু মহিলা হাতের শাঁখা পলা দেখে চেনা যায় । দু চার জন বিধবা ও আছেন । ঘরের ভেতরে ভীষন অপরিষ্কার এবং ভ্যাপসা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।মহিলারা সকাল থেকে গ্রীলের শিকে নাক মুখ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কিসের আশায় কে জানে । নীলুফারের মা সন্ধ্যারাণীকে দেখা গেল এক কোনে অন্ধকার এক নোংরা বিবর্ণ মশারীর পাশে বসে আছেন আনমনে । নোংরা আবর্জনা দেখে নীলুফারের বমি পাওয়ার অবস্থা। ওর মা দিনরাত ঘরদোর পরিষ্কার রাখার জন্য কত পরিশ্রম করে, আর আজ এই নোংরার মাঝে …..আর ভাবতে পারে না ।

" আ…ম….মু……" নীলুফারের গলা দিয়ে বেরোনো আওয়াজ হাহারবের মতো শোনায়।

সন্ধ্যা রাণী চমকে উঠে তাকান বাইরের দিকে ।তারপর মেয়েকে দেখে বোবা দৃষ্টি মেলে গ্রীলের কাছে ঝটিতি এগিয়ে আসেন। " তুই ইখানো আইছছ কেনে? তোর আব্বু কৈ ?" চাপা গলায় জিজ্ঞাসা। পাশের কালো কোট পরিহিত পুরুষকে প্রথমে খেয়াল করেন না।

"আব্বু আইছইন না। হক্কল আইলে কেমনে চলবঅ। আব্বু খুব চিন্তাত আছইন। এরে হুনো, তানরে আমরার উকিল ঠিক করছি। শিলচর শহরর বড় উকিল। আমরা খুব শিগগির তুমারে ছাড়াইয়া নিমু। চিন্তা করিও না । আগে কও খাইছ কিতা ?" নীলুফার কথা বলছিল আর তার দুচোখ জলে ভেসে যাচ্ছে।

মেয়ের কথার সোজাসুজি জবাব না দিয়ে সন্ধ্যারাণী উল্টো প্রশ্ন করেন " উকিলর খরচ আইব কই থাকি?"

ইজাজ উদ্দিন এবার মা মেয়ের কথোপকথনের মাঝে ঢোকার সুযোগ নিলেন  তিনি সন্ধ্যারাণীকে একটা নমস্কার দিয়ে বলেন " ইতা আফনার চিন্তা করতে লাগত নায়। আইচ্ছা ইখানো যত আছইন হক্কল কিতা সন্দেহভাজন বিদেশী নি?" 

"না,না" সন্ধ্যারাণী এবার মাথার ঘোমটা আর একটু টেনে বলেন " মাঝ রাইত দুই বেটিরে ঢুকাইছে, এরা বুলে বাসা চুরিত ধরা পড়ছইন। হউ কুণাত বই রইছইন দুয়োটা। এছাড়া হউ বুড়ি খুঁটির কান্দাত" বলে আঙ্গুল তুলে দেখান ডানদিকে, তারপর বলেন ," খুন করছে হুনলাম, তিন বছর থাকি আছে । অখনো কোর্টর রায় অইছে না। হারা রাইত ঘুম নাই। কেচর মেচর লাগিয়া আছে । কুনোটায় কান্দে,কুনোটায় চেঁচায়, কি পাপ যে করছি ! ঠাকুর !" বলে মাথায় জোড়হাত ঠেকান মহিলা।

দুঁদে উকিল ইজাজ সাহেব কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি একখানা ওকালতনামা কোটের পকেট থেকে বের করে কলম খুলে সন্ধ্যা রাণীর দিকে বাড়িয়ে বলেন " আফনে আগে নীচে আফনার নাম লেখিয়া দেইনি, এরপরে মাইয়ার লগে মাত কথা চালাইন।"

"ইখান কিতার কাগজ ?" মহিলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকান মেয়ের দিকে।

"আম্মু, ইখান অইলো তুমার অইয়া তাইন যে কোর্টঅ লাড়াই করবা তার লাগি তুমার অনুমতি লাগব।তুমি নাম লেখিয়া দেও, বাকী যেতা লেখার, তাইন লেখবা।" 

মেয়ে নীলুফারের অভয় পেয়ে বন্দী গোটা গোটা অক্ষরে তার চতুর্থ শ্রেণীর বিদ্যা জাহির করে ওকালতনামার নীচে নাম লিখে দিলেন। ইজাজ উদ্দিন একটু পরে গিয়ে সিপাহীর হাতে হাত মেলান। হাত বদল হয়ে কিছু একটা নিয়ে সিপাহী পকেটে চালান করলেন, যদিও আমরা তা কি জানি না। মুখে উনি সিপাহী কে বললেন " মা বেটি রে একটুক মাততে দেও, আমি ততক্ষণে জেলার সাহেবর ঘর যাইয়ার। মাত শেষ পাইলে বেটীরে আমার কাছে লইয়া আও।" 

সিপাই লম্বা সেলাম করল উকিল সাহেবকে আর মাথা নাড়ল। ইজাজ উদ্দিন লম্বা বারান্দা ধরে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে এগিয়ে গেলেন।

                                  *****

জেল সুপার জগদীশ গগৈর উল্টো দিকে চেয়ারে জাঁকিয়ে বসেছেন ইজাজ উদ্দিন। এসেই একগাদা প্রশ্ন পেশ করেছেন সুপারের সামনে তার সদুত্তর দিতে গগৈকে হিমসিম খেতে হচ্ছে। ইজাজ প্রথমেই জেলখানার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে প্রশ্ন করে বলেন " মানলাম আপনি সরকারি টাকা পয়সা ঠিক মত পাননা বলে সমস্ত বন্দীদের এক জায়গায় রেখেছেন, কিন্তু কম্পাউন্ড পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে টেকা লাগে নি?"

জগদীশ গগৈ নিরুত্তর। ভাবছেন আজ কার মুখ দেখে উঠেছেন ঘুম থেকে যে এই উকিলের সামনে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে।

"আপনি সন্দেহভাজন বিদেশী আর খুনী আসামীকে এক সেলে রাখতে পারেন কি?" ইজাজ উদ্দিন আবার জিজ্ঞেস করেন ।

"কি করব, সরকারকে আলাদা ওয়ার্ড মানে এনেক্স বিল্ডিং করার জন্য চিঠি দিয়েছে আমি, কিন্ত জানে তো সরকারী কাম কাজ , এখনো রিপ্লাই পায়নি।" জগদীশ তার মত বাংলায় জবাব দেবার চেষ্টা করেন ।

"দেখেন, আমরা কিন্তু হিউম্যান রাইটস কমিশনকে জানাব । মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে এখানে । ন্যাশনেল হিউম্যান রাইটস কমিশনের মেম্বাররা এই জেল পরিদর্শন করে রিপোর্টে দিলে আপনার সরকারের ঘুম ভাঙ্গবে।" ইজাজ উদ্দিন জানিয়ে দিলেন রাগত ভাবে ।

                                                       ******

এদিকে মা'র সাথে সুখদুঃখের কথার চেয়ে বেশী কান্নাকাটি করে একসময় চোখ মুছে নীলুফার মাকে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সঙ্গী সিপাই কে জিজ্ঞেস করে "উকিল সাহেব কৈ গেলা?"

"তাইন জেলার সাহেবর ঘরঅ গেছইন।আফনার শেষ অইলে নিয়া যাইতে কইয়া গেছইন।" সিপাহী জানান দিলেন ।

“তে চলইন তাঅইলে।" নীলুফার একবার পেছনে তাকিয়ে ক্রন্দনরত মাকে দেখে নিয়ে পা বাড়ায়। বারান্দা দিয়ে যেতে হঠাৎ এক সেলের ভেতর থেকে কানে এল উদাত্ত আবৃত্তি। কৌতুহলী হয়ে থেমে গিয়ে তাকালো সেলের ভেতর । পুরুষ বন্দীদের সেল । কোঁকড়ানো কালো চুল, মুখভর্তি দাড়ি উজ্জ্বল দুচোখ এক যুবক । আবৃত্তি করে যাচ্ছেন আপন মনে । নীলুফার দাঁড়িয়ে শুনতে থাকে ।


কাল রাতে মৃত্যু এসে আমার পালঙ্কে শুযেছিল

ভোট কম্বল জড়িয়ে গায়ে,

কবরের বাতাসে শিউলি উড়ছিল - -

কফিন গুলো ভেসে উঠেছিল দামাল হাওয়ায়

আর আমার মশারি ফুলে উঠেছিল যেন পোয়াতি মেয়ের পেট

অথবা মাছের কানকোর মত।

বাতাসে ভীষণ এক যন্ত্রনার গন্ধ,

অনেকটা পাশাপাশি সার সার শুয়োরের খোয়াডের বিষ্ঠা

অথবা আসাম পুলিশের বগলের ঘাম

এই নিয়ে শুয়ে আছি, রোজকার ভাতঘুমে।

কারা যেন বলেছিল মৃত্যু এক বিরামহীন ঘুম

এক বিরামহীন ঘুম।


মন্ত্র মুগ্ধের মতো নীলুফার এগিয়ে যায় সেলের গ্রীলের সামনে । ওকে দেখে থেমে গিয়ে তাকায় যুবক ওর দিকে । " থামলা কেনে ? খুব সুন্দর ।" নীলুফার বলে । তারপর জিজ্ঞেস করল " আফনার কি চার্জ?"

ম্লান হাসল যুবক ।ও জবাব দেবার আগেই সঙ্গের সিপাই তাড়া লাগিয়ে বলল " চলইন, দেরী করলে উকিল সাহেবে গুসা করবা, চলইন, ইনো সব অবৈধ বিদেশী।" 

নীলুফার আর একবার তাকায় পূর্ণ দৃষ্টিতে ঐ যুবকের চোখের দিকে । তারপর হাঁটতে থাকে । গন্তব্য জেল সুপারের রুম।

জেল সুপারের রুমে নীলুফার ঢোকার সাথে সাথে ইজাজ উদ্দিন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ওকে উদ্দেশ্য করে বললেন "চল মাই গো, অখন হা্রা কাম আছে আমরার ।" 

নীলুফার ওনার করার জবাব না দিয়ে জেলার জগদীশ গগৈর দিকে উষ্মার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে " এইভাবে যে আপনারা বন্দীদের রাখছেন, পরিবেশ, খাওয়াদাওয়ার মান, সব বন্দীদের একত্রে রেখেছেন, এতে   মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় না ? ভারতীয় সংবিধানের ধারা ১৪, ১৯, ২১ এইগুলা সম্বন্ধে ধারণা আছে আফনার?"

জগদীশ কি জবাব দেবেন এই অগ্নিদৃষ্টির সামনে । আমতা আমতা করে বলেন " দিদি, আমি সরকারী কর্মচারী মাত্র।"

"আপনি পিশাচের কর্মচারী।" নীলুফার ত্বরিৎ জবাব দেয়।

                           

                                   *****

ইজাজ উদ্দিন ফিরে এসেই তার জুনিয়র বিভূতি ভট্টাচার্যকে ডেকে পাঠালেন । বিভূতি আসলে নীলুফার দেখল ওর বয়সী বা অল্প বড় হবে এক যুবক। ইজাজ উদ্দিন বিষয়ের গুরুত্ব বুঝিয়ে ওকে বললেন " তুমি নীলুফাররে লইয়া অকনু  তাইর মামার বাড়ী রওয়ানা দেও। তাইর মামার বাড়ী রুপসীবাড়ী আর তারা হিন্দু। এর লাগি তুমি যাওয়া ভালা। তারা সাহস পাইব মাত কথা কইতে। মামার বা নানার ভোটার কার্ড আছে কিনা, অথবা মাটির দাগ নম্বর ইত্যাদি লইয়া তুমি সাব রেজিস্ট্রার অফিস যাও। লাগলে করিমগঞ্জ যাইতে লাগব। মুঠর উফরে কাগজ না থাকলে তাইর মা'রে ছাড়াইয়া আনা যাইত নায়। তুমি দেরী না করিয়া তাইরে লইয়া রওয়ানা দেও।" 

তারপর নীলুফার কে বললেন "দেখ মাই,কাগজ পত্র কিতা পাও নানার বাড়ী দেখ।সব লইয়া কাইল না অইলে পরশু আও।দেরী করা যাইত নায়। ট্রাইব্যুনাল না অইলে গৌহাটী হাইকোর্ট যাইতে লাগবো । দৌড়াও তাড়াতাড়ি।"

কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল বিভূতির দুপেয়ে স্কুটারের পেছনে চেপে নীলুফার চলেছে রূপসীবাড়ী ওর দাদুর বাড়ীতে । গ্রামের বাড়ী, এক চিলতে পুকুর, পাশে অল্পসল্প চাষ আবাদের জমি । রেল লাইন চলে গেছে বাড়ীর পাশ দিয়ে করিমগঞ্জ হয়ে সূদুর ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা অব্দি। শিলচর করিমগঞ্জ রোড ধরে ওরা এক ঘন্টার কম সময়ে পৌছে গেল রূপসীবাড়ী। পিচ রোড ছেড়ে স্কুটার নামল ডান দিকের মাটির চলা পথে। আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে নানার বাড়ী পৌছে নীলুফার হাঁক দিল "বড়মামা! ও বড়মামা!"

নীলুফারের দাদুভাই ধীরেন চন্দ্র পালের বড় ছেলে ওর বড়মামা বীরেন দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে একটু বিশ্রামের তোড়জোড় করছিলেন । এমন সময় নীলুর গলার আওয়াজ পেয়ে একটু চমকালেন। আসলে বদরপুরের গতকালের ঘটনা ইচ্ছে করে প্রথমে ওদের জানানো হয়নি অযথা চিন্তা করবেন বলে । তাই বীরেন চট করে দোর খুলে নীলুফারকে এই ভর দুপুরে এক অচেনা মানুষের সাথে দেখে যার পর নাই চমৎকৃত হয়ে জিজ্ঞেস করেন "আরে নীলু মা ! তুই অখন অউ ভর দুপুরঅ ? সব খবর ঠিক আছে তো ?"

ইতিমধ্যে বড়মামী, মামাতো ভাই নরেন এসে পড়েছে ভেতর থেকে। মামীকে দেখেই নীলুফার হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে ।সবাই অপ্রস্তুত হয়ে পাশে দাঁড়ানো লোকটার দিকে তাকান।

বিভূতি নিজের পরিচয় দিয়ে সংক্ষেপে বীরেন পালকে সব ঘটনা খুলে বললেন। সঙ্গে সঙ্গে কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল তারস্বরে । অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠাণ্ডা করে বীরেন কে ওদের আসার মূল উদ্দেশ্য জানালেন বিভূতি উকিল।

সব শুনে বীরেন দিলেন এমন এক খবর যাতে অসুবিধা আরো বেড়ে গেল । ওনার বক্তব্য অনুযায়ী ২০১১ সালের বন্যায় ওনাদের বাড়ীর প্রভূত ক্ষতি হয় । তখন প্রয়োজনীয় অনেক নথিপত্র জলে ভিজে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। তবুও উনি একঘন্টা টাক খোঁজাখুঁজি করে নিজের অসহায় অবস্থার কথা জানালেন ।

তরুণ উকিল নিমিষে সব বুঝে ওদেরকে আস্বস্ত করে বলেন " কোনো সমস্যা নাই । আফনার বাড়ী কার নামে কইন , আমি বদরপুর সাব রেজিস্ট্রার অফিস থাকি ডুপ্লিকেট বার করি লাইমু। আইচ্ছা, মাসিমার জন্ম কোন জাগাত হইছিল?"

"মাসিমা মানে ?" বীরেন পাল্টা জানতে চান।

"মানে তান মা। যার লাগি আমরা আইছি।" বলে নীলুফার কে দেখায় বিভূতি উকিল।

"ও , সন্ধ্যা! সন্ধ্যার জন্ম তো বাড়ীত । নীরদাসুন্দরী, মানে নীরদা ধাইএর হাতঅ জন্ম হইলো। আমিও তখন খুব ছোট, ১০/১২ বছর বয়স আমার,কতকাল আগর কথা ।" একটু চিন্তা করে বলেন " ৮৭ বাংলা , হ্যাঁ ৮৭ বাংলাত তাইর জন্ম ।"

"নীরদা সুন্দরীরে পাওয়া যাইব নি ? " বিভূতি জিজ্ঞেস করেন।

"নীরদা তো অখন একবারে বুড়ি। ৮০ র উপরে বয়স । চলতা ফিরতা পারইন না।" 

"অইব,কাইল আমরা একখান কাগজ ও জন্ম বৃত্তান্ত লেখিয়া লইয়া আইমু।আফনে আমরারে লইয়া তান বাড়ীতে গিয়া কষ্ট করিয়া তান সই লইয়া দিবা। আফনার  ভইনরে ছাড়াইতে এ ছাড়া উপায় নাই, বুঝছইন?" বিভূতি বোঝাতে চেষ্টা করেন।

বীরেন জানতে চান " ওউ কাগজ ইখান পুলিশরে দিলেউ সন্ধ্যারে ছাড়িদিব নি?"

"পুলিশরে দিলে অইত নায়। অখন আর পুলিশের লগে কাম নাই। অখন ট্রাইব্যুনাল আর না অইলে কোর্ট। হাইকোর্টঅ আপিল করতে লাগবঅ ।ইতা পারা ঝামেলার কাম, তুমি হক্কলতা বুধ পাইতায় নায় বড়মামা।" নীলুফার ওর মামাকে বোঝায়।

ইতিমধ্যে দুই মামী হাজির । ছোটমামী বললেন " কাম কাজ তো হারি দিন করবায়। অখন হাত পাও ধইয়া ভাত দুইটা খা আগে । বিহানকু কিতা খাইছছ?"

বড়মামী বিভূতিকেও অনুরোধ করেন দুমুঠো ভাত খেয়ে রওয়ানা দিতে। কিন্তু নীলুফার আপত্তি করে বলে " মামীরা, অখন সময় বেঠিক।খাওয়া আগে পরে অইব। আগে মা'রে আনার ব্যবস্থা করতে লাগব। অখন খাওয়ার কথা বাদ দেও।"

মামী দুইজন বলেন " কিতা কছ নীলু ?কোনোদিন ইনতনে না খাইয়া গেছছ নি?" নীলুফার মুখ কালো‌ করে  বলল “অয় অয় মামী, খাইছি, কিন্তু ইবার অত সময় নাই।এক কাম করো, উকিল বাবুরে খাওয়াইলে খাওয়াই দেও। তারপর হঠাৎ বিভূতির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করে “কিতা উকিলবাবু, ভাত চাইট্টা খাইবা নি”?

বিভূতি উকিল নির্বাক হয়ে ওদের কথোপকথন শুনছিল এতক্ষণ।এখন দুহাত দিয়ে মানা করে তাড়াতাড়ি স্কুটারে স্টার্ট দেয়।এখান‌ থেকে এখন পালাতে পারলে বাঁচে।

                                       ******

বদরপুর এস ডি ও অফিসের গেটের‌ পাশে স্কুটার রাখলো বিভূতি। নীলুফার নামলো পেছন থেকে। দুজনে ভেতরের লম্বা বারান্দা দিয়ে এগোতে লাগলো।বিভূতি বললো “আপনে অনঅ এট্টু বেঞ্চঅ বই থাকইন। আমি এফিডেভিট রেডি করি লইয়া আই। এরপরে আবার আফনার মামার বাড়ী যাইতে লাগবঅ”।

“কিতার এফিডেভিট’? নীলুফার জানতে চায়।

“আফনার মা’র জন্মর প্রমাণপত্র।ধাই বেটির সই লইতে লাগব গিয়া, তারপরে কোর্টর সীল পড়লে কাগজ পাক্কা অইব”।

নীলুফার হেসে বলে “ আফনে করিয়া লইয়া আইন, আমি আছি,ইটা আমার‌ নিজর জাগা, কোনো সমস্যা নাই”। বলে ও‌ বাইরের দিকে এগোয়।

বিকালের মধ্যেই নীরদা সুন্দরী নামের বুড়ি ধাই এর  বাড়ীতে গিয়ে তার সই সংগ্রহ করা হয়ে গেল।বাকি রইল মাটির দলিলের কপি বের করা সাব রেজিস্ট্রার অফিস থেকে। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার ফলে কাজটা পরের দিনের জন্য তোলা রইলো।বদরপুর ফেরার আগে বড়মামা নীলুফারের হাত ধরে

বলেছেন‌ যে খবর কি হয় না হয় জানাতে । “জানছতো মাই, ঈশ্বরে জানইন,  আমার অবস্থা। কোনো সাহায্য তোরে করবার কুনো উপায় নাই ।গোসা করিছ না,কাইল শিলচর গিয়া কিতা অয় না অয় জানাইছ।মন বড় উচাটন‌ বইন ইগুর লাগিয়া”। 

নীলুফার মামাকে আশ্বস্ত করে‌ ফিরে আসে। বিভূতি উকিল বদরপুর তার কোনো আত্মীয়ের বাড়ি চলে গেলেন সকাল দশটায় সাব রেজিস্ট্রার অফিসে আসতে বলে। সঙ্গে কিছু টাকা নিয়ে আসতে বলেন, খরচের জন্য।নীলুফার এসব বোঝে, ইশারাই যথেষ্ট। পরদিন‌ যথাসময়ে সাব রেজিস্ট্রার অফিসে আসে নিজের কষ্টে জমানো টাকা থেকে দুহাজার টাকা যা যখের ধনের মত সে আগলে রেখেছে এতদিন আজ মা’র জন্য  খরচ করবে ও।

হাজার টাকার বিনিময়ে এক ঘন্টার মধ্যেই মাটির দলিলের কপি পাওয়া গেল।মাটি স্বর্গত বাপ ধীরেন সালের নামেই আছে।

এখন এগুলো নিয়ে শিলচর যাবার জন্য তৈরী হলো ওরা।বিভূতি ইতিমধ্যে ফোন করে ইজাজ সাহেবকে ওদের কাজ সম্বন্ধে অবহিত করলেন। কিন্তু সিনিয়র আরেক ফ্যাকড়া তুললেন। সন্ধ্যারাণীর ভোটার কার্ড সঙ্গে নিয়ে যেতে বললেন।

এবার নীলুফার ফ্যাসাদে পড়ল।মায়ের ভোটার কার্ড কোথাও‌ খুজে পায় না। অবশেষে ভোটার কার্ড ছাড়াই ওরা শিলচর রওয়ানা দিল ।এবার অবশ্য ওর আব্বু দিলদার রহমানকে আর রাখা গেল‌না।উনি স্ত্রীর অবস্থা দেখার জন্য শিলচর যাবেনই।অগত্যা বিভূতিকে একা পাঠিয়ে নীলুফার বাপকে নিয়ে শিলচরের বাসে উঠলো।

                                         ******

শিলচর ইজাজ উদ্দিন উকিলের অফিসে এসে বসে বাপ আর মেয়ে । দুটো সমস্যা এখন‌ তাদের সামনে। দিলদার রহমানের বলা মতো‌, ওদের কোনো‌ ভোটার কার্ড তৈরী করা হয়নি, তবে ভোটার লিস্টে নাম আছে। সম্ভবতঃ গ্রাম অঞ্চলের সব এখনো ভোটার কার্ডের আওতায় আসেনি। দ্বিতীয়ত সন্ধ্যা রাণীর সাথে এখন দেখা করা সম্ভব হবে না। জেল কর্তৃপক্ষ বিকেল ৩টার আগে দেখা করতে দেন না কোনো আত্মীয় স্বজনদের। শুধু ইজাজ উকিল হিসেবে যখন‌ ইচ্ছা যেতে পারেন‌ জেলের ভেতর মক্কেলের সাথে দেখা করতে, কিন্তু বাকিরা পারবেন না। অগত্যা আজকের পুরো দিন অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই। ইজাজ উদ্দিন এদিকে বিভূতিকে পুনরায় পাঠিয়েছেন‌, এবার করিমগঞ্জ জেলা সদরে।ইলেকশন‌ দপ্তরে গিয়ে‌ যেভাবেই হোক সন্ধ্যারাণীর ভোটার লিস্টের সার্টিফাইড কপি নিয়ে আসতে হবে। তবেই তারাপুর ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে হবে। এগুলো কাজ আজ শেষ না হলে কাল‌ ফিরবে। আসার সময় বদরপুর থেকে নীলুফারকে নিয়ে আসবে।

নির্দেশ দিয়ে ইজাজ উদ্দিন নীলুফারকে উদ্দেশ্য করে বললেন যে উনাকে এখন কোর্টে যেতে হবে।ওরা বরং দুটোর পর আসুক।

সোজাসুজি চলে যেতে বলা। এরপর তো আর বসা যায় না।বাপ মেয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে প্রেমতলা, সেন্ট্রাল রোড অঞ্চলে কিছুক্ষণ ঘুরে তারপর একটা রিক্সা নিয়ে মধুরবন্ধ রওয়ানা দিল নীলুফারের এক দূর সম্পর্কের খালার বাড়ি।

ওখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে রিক্সা নিয়ে যখন‌ ইজাজ উদ্দিন সাহেবের বাড়ী পৌঁছালো তখন‌ ঘড়িতে ২ টো পঁচিশ। ইজাজ ওদের বসতে বলে হাতের কাজ সারলেন । দু তিনটে ফোন‌ করলেন তারপর ওদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন‌।

জেলের ভিতর নীলুফার দ্বিতীয় বার আসলো কিন্তু ওর বাপ দিলদার রহমানের প্রথম বার।লম্বা বারান্দার শেষ‌ ভাগে সন্ধ্যারাণীর সেলে পৌঁছানোর পরই কান্নাকাটি শুরু হলো স্বাভাবিকভাবে।সন্ধ্যারাণী শোহরকে দেখেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন।দিলদারের চোখেও জল। নীলুফারে ওদেরকে একান্তে রেখে একটু দুরে দাঁড়ায়। ইজাজ উদ্দিন এরমধ্যেই সন্ধ্যারাণীর সাথে জরুরী কথা সেরে নিয়ে জেলারের ঘরের দিকে হাঁটা শুরু করেন।নীলুফার নিঃশব্দে ওনাকে ফলো করে।

জেলার গগৈ ওকে দেখে একটু হাসার চেষ্টা করে বলেন‌ “ কি দিদি, মার সঙ্গে দেখা হলো?”

নীলুফার ওনার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো এক কঠিন প্রশ্ন করে যার জবাব দেবার শক্তি জগদীশ গগৈর নেই ।

“আচ্ছা স্যার, আপনি তো গগৈ,আহোম। আমরা পড়েছি যে আহোমরা পাটকাই পাহাড় পার করে বার্মা থেকে আসামে এসেছিলেন বহুকাল আগে। তাহলে আপনি কেন‌ বিদেশী চিহ্নিত হন না?আপনারা ভাষা গ্রহণ করেছেন বলে আসামী আর আমরা কতকাল আগে এসেও আমাদের ভাষা বাংলা রেখেছি বলে আমরা বিদেশী, আসামী না?”

জগদীশ গগৈ জানেন এদৎ অঞ্চলে অনেকেই অসমীয়দের আসামী বলে থাকেন, আসামের অধিবাসী বলে। তাই নীলুফারের প্রশ্ন বুঝেও এই প্রশ্নের জবাব দিতে সমর্থ হন না।

            ****** 

বিভূতি ভটচায অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে করিমগঞ্জ ইলেকশান অফিস থেকে সন্ধ্যারাণীর ভোটার লিস্টে থাকা নাম এবং ধীরেন সালের ১৯৬৬ সালের ভোটার লিস্টে থাকা নামের সার্টিফাইড কপি নিয়ে আসার পর ইজাজ উদ্দিন তারাপুর ফরেনার ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা স্বত্ত্বেও কোনো লাভ হলো না । ওই অফিসের এক অফিসার এফিডেভিট করা জন্মের সার্টিফিকেট গ্রহণ করতে রাজী নন। ওনার অফিসে নীলুফার অনেক বার ইজাজ সাহেবের সাথে হাঁটাহাঁটি করে এটুকু জানলো যে এভাবে এফিডেভিট করা প্রমাণ অনেকেই নিয়ে আসতে পারে, প্রকৃত তথ্যের সত্যতা সম্বন্ধে উনি সন্দিহান।এবার নীলুফার আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না । ও অফিসার নীরদ‌বরণ করকে প্রশ্ন করে বসে “স্যার আপনার মা কিতা জীবিত নি?”

অফিসার অবাক হয়ে মাথা নাড়লে ও দ্বিতীয় প্রশ্ন করে “ তান আনুমানিক বয়স ৬০ এর উপরে নিশ্চয় অইব?” 

এবারও নীরদবাবু ইতিবাচক জবাব দিলে নীলুফার বলে বসে “ঘরো গিয়া আফনার মার জন্মবৃত্তান্ত জিগাইবা   আইজ।তান জন্ম সঠিক অইলে আফনার বৃত্তান্ত ও প্রমাণিত”।

ইজাজ উদ্দিন হাত নেড়ে ওকে থামাতে চাইলেন, কিন্তু মুখের বুলি তার আগেই বেরিয়ে গেছে। অফিসার নীরদবাবু রাগে লাল হয়ে জানতে চান এ এই মহিলাটি কে।ইজাজ উদ্দিন অনেক কষ্টে ওনাকে ঠাণ্ডা করে নীলুফারকে ধমকে চুপ করতে বলেন‌ এবং ওকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন‌ ট্রাইব্যুনাল অফিস থেকে ।

কিন্তু ওদের কেসের কোনো‌ সুরাহা হয় না দিনের পর দিন, মাসের পর মাস; ধর্ণা দেয়াই সার হয়।একসময় ট্রাইব্যুনাল ওদের আপীল রিজেক্ট করে দেয়। সন্ধ্যারাণীর বিনা বিচারে জেলের মেয়াদ বেড়ে যায়।

ইতিমধ্যে ইজাজ উদ্দিন মানবাধিকার কমিশনে এপ্রিল করেছেন‌ শিলচর জেলের এই অমানবিক এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কথা জানিয়ে।এতে দেরিতে হলেও কিছুটা কাজ হয়েছে। কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর নির্দেশে জয়রাম রমেশ এই জেল পরিদর্শন করে রিপোর্ট দেন সংসদে।আসাম মানবাধিকার কমিশনের দল সভাপতি ভাইপেইএর‌ নেতৃত্বে জেলা পরিদর্শন করে ওদের রিপোর্টে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

এতে অবস্থার সামান্য হেরফের হলেও সন্ধ্যারাণীদের‌ ভাগ‌্যের পরিবর্তন হয় না।

ইজাজ উদ্দিন নীলুফারকে বলেন যে ওদের এবার গৌহাটি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হতে হবে, এ ছাড়া আর উপায় নাই। কিন্তু গরীব নীলুফাররা হাইকোর্টৈ লড়াই করার টাকা আজও যোগাড় করে উঠতে পারে নি।

নীলুফাররা কয়েকদিন পর পর জেলের ভেতরে আটকে থাকা মাকে দেখতে যায়,আশার স্তোক শুনিয়ে আসে।

আজ ফেব্রুয়ারী মাসের একুশ তারিখ। আজ সকালে ও মেয়ে এসেছে মাকে দেখতে।পুরুষদের সেলের অন্ধকার থেকে শুনতে পায় কে যেন‌ উদাত্ত স্বরে আবৃত্তি করছে। আরে এতো সেই উজ্জ্বল চোখের‌ কালো কোঁকড়ানো চুলের অচেনা যুবক।ও গাইছে:

 মোদের গরব, মোদের আশা

আ-মরি বাংলা ভাষা।

মোদের গরব, মোদের আশা

আ-মরি বাংলা ভাষা।


মাগো তোমার কোলে,

মাগো তোমার কোলে, তোমার বোলে 

কতই শান্তি ভালোবাসা।

আ-মরি বাংলা ভাষা

মোদের গরব, মোদের আশা

আ-মরি বাংলা ভাষা।


কি যাদু বাংলা গানে, 

কি যাদু বাংলা গানে

গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে.... 

গেয়ে গান নাচে বাউল, 

গেয়ে গান নাচে বাউল

গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।

আ-মরি বাংলা ভাষা

মোদের গরব, মোদের আশা

আ-মরি বাংলা ভাষা।

শুনতে শুনতে নীলুফারের দুচোখে জল এসে যায়। এই বাংলা ভাষার গর্বে আজ সে মাথা উঁচু করে কথা বলে। এই ভাষার জন্যে আজ ওর মা অনন্তকাল ধরে জেলে বন্দী সন্দেহভাজন বিদেশী হিসাবে।প্রত্যেক দিন ফিরে আসার সময় পেছন ফিরে দেখে ওর মা সন্ধ্যা রাণী লোহার গরাদে নাক লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন‌ মুক্তির আশায়।এক একুশে ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে যায়, আসে উনিশে মে।আবার ঘুরে আসে একুশে ফেব্রুয়ারি, আবার উনিশে মে। বাঙ্গালী সন্ধ্যারাণীর মুক্তি হয় না।বাংলাভাষী সন্ধ্যা রাণীরা আজও দিন গুনছে মুক্তির।তবে একটা আশার কথা এই লড়াই যুগ্ম লড়াই। এ লড়াই নীলুফার আর সন্ধ্যা রাণীর, এ লড়াই ইজাজউদ্দিন আর সন্ধ্যারাণীর।

এ লড়াই হিন্দু আর মুসলিমের মিলিত লড়াই।এ লড়াই জিততেই হবে । কিন্তু সে কবে গো, কবে?

Comments