গল্প - শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত নিয়োগী



"জয়া"



চুলের মুঠি ধরে এক ধাক্কায় জয়াকে বিছানায় ফেলল মানিক ,চড় থাপ্পড়ের সাথে ক'টা কাঁচা খিস্তি করে হুমকি দিল পরের দিন ফিরিয়ে দিলে জয়ার সর্বনাশ করে ছাড়বে ৷ 
সর্বনাশ !! হায়রে আর নতুন কী সর্বনাশ হবে ওর !!করোনা অকালে অভয়ের  প্রাণ কেড়ে নেওয়ার পর মানিকবাবু তিলে তিলে জয়া আর ওর ১০ মাসের মেয়েটার জীবনটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু করেছে৷ 
      বৌদিমণি সেদিন  ইস্কুলের একটা কাজে একটু সকালে বের হল --তখনও কাজ শেষ হয়নি জয়ার ৷ হঠাৎ করে রান্নাঘরে ঢুকে জাপটে ধরে ঝড়ের বেগে বলল --"খবরদার টু শব্দ করবিনা ৷ শোন,আজ থেকে মাঝে মাঝে তোর বাড়িতে ঢুকব রাত করে ,আমাকে খুশী করাও তোর কাজ --মাইনেটাও বাড়বে আর খুশী করার বকশিশও পাবি ৷  যদি কথাটা না মানিস ,কাজও খোয়াবি আর বদনামও কুড়োবি , তোর যে কোনো বাড়িতে কাজ পাওয়া বন্ধ  করে দেব আমি৷ কি রে ? কি করবি ? বিশ্রী একটা  হেসে বলল "দুধের শিশুটাকে নিয়ে বাঁচবি না কি ওটাকেও বলি দিবি ভেবে দেখ ৷" 
মুহূর্তে চোখে অন্ধকার দেখল জয়া --এ কী সর্বনাশ হল তার ,একে তো স্বামী হারা , বাড়ি ফেরার পথে ভাবল ,শেষ করে দেবে নিজেকে --তাছাড়া আর কোনো উপায় নেই ৷ কিন্তু বাড়িতে ঢুকেই মেয়েটার দিকে চোখ পড়তেই কান্নায় ভেঙে পড়ল জয়া৷ পাশের বাড়ির ৮ বছরের পূজাকে বলল - "বাড়ি যা রে মা" --কোলে তুলে নিল নিজের মেয়েটাকে ,আদর করে কান্না জড়ানো চোখে একরত্তি মেয়েটার নিষ্পাপ মুখের দিকে চেয়ে নিজের মনেই বলল--বাপমরা মেয়ে তুই , অভাগী, তোকে বাঁচিয়ে রাখতে তোর মা সব করবে সোনা , নিজেকে নষ্ট করতেও পিছপা হবে না৷ তোকে যে মানুষ করতেই হবে -- কাজটা গেলে তোকে নিয়ে মরতে হবে যে ৷ নিজে মরি মরি ,তোকে তো খাওয়াতে হবে , বাঁচাতেই হবে" --আর সেই রাত থেকে ই একটা নরপশুর লালসাকে মেটানোর  কাজ শুরু হল জয়ার ৷ 
আজ পশুটা হুমকি দিয়ে তীরবেগে ঘর ছেড়ে রাতের অন্ধকারে মিশে যাবার পর ,যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে নিজের  দুর্দশার কথা মনে করে জয়া --আজ শরীরটা বেশ খারাপ  তাই রাজি হয়নি ,তাতেই এভাবে অত্যাচার করে গেল বাবু ৷
  বাবু --মানিক বাবু --
সমাজের কাছে ,বৌদিমনির কাছে কত ভালো মানুষ৷অথচ মুখোশের আড়ালে তার হিংস্র ,কদর্য রূপটা শুধু জয়াই চেনে ৷বৌদিমনির জন্য মাঝে মাঝে কষ্ট হয় ৷ ঘুমন্ত বাচ্চাটার দিকে চোখ পড়তেই ভাবে --"কাল কী করবে !তলপেটটা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে ,কাল তো শয়তানটা ছেড়ে দেবেনা" ---আরও যেন যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায় আর ভয়ে শিউরে ওঠে ৷ চোখটা লেগে এসেছিল কখন 
যেন ---হঠাৎ  একটা ধাক্কায় ধড়পড় করে উঠে পড়ে৷ 
এ কী হল? কে বলে গেল !!! এ কী সত্যিই !!! ভোরের আলো ফুটবে এবারে ---আজ পঞ্চমী  ,কাল মায়ের বোধন আর মা এসেই ধরা দিলেন স্বপ্নে !!! এও কী সম্ভব !!! 
মা যে বললেন ঐ অসুর বিনাশ হবে তোর হাতেই ,আর ভোররাতে মেয়েটাকে কাঁখে করে এ ঘর, এ গ্রাম ছেড়ে বাসে চেপে নবগ্রামে চলে যা-- দেখ গিয়ে ওখানে কত মেয়ে ,বৌ কাপড়ের কারখানায় কাজ করে নিজের পরিবার চালায় ,তুইও পারবি ,যা চলে যা ৷ যাবার সময় তোর ঘরের একমুঠো মাটি পাড়ার মন্ডপে লেপে যাস ,তবেই আমার বোধন হবে ,পূজা সার্থক হবে"----
চিৎকার করে কেঁদে ওঠে জয়া ,অভয়ের ছবিটাকে বুকে জড়িয়ে বলে "পারব মা ,পারব৷ পারতে আমাকে হবেই ,ঐ অসুরটাকে বধ করবই ,অভয়া শক্তি বলপ্রদায়িনী মা গো, তোমার শক্তিতে বলীয়ান আমি ,নতুন জীবন শুরু করব আবার ৷ মেয়েটাকে মানুষের মতো মানুষ করব"৷ 
ষষ্ঠীর দিন ঢাক বাজে পাড়ার মন্ডপে ,
এদিকে মায়ের বোধন ---বাসে চেপে জয়া তখন প্রায় পৌঁছে গেছে নবগ্রামে ৷ গত রাতে ঐ নররূপী অসুরটাকে বিনাশের পর আজ বহুদিন বাদে স্বস্তির শ্বাস নিতে পেরে জয়া যেন আজ সাক্ষাত দুর্গতিনাশিনী ,
মহিষাসুরমর্দিনী ৷

Comments