দেশীয়
রাজ্য কোচবিহারের মহারানীওরাজমাতা ইন্দিরা
দেবী
(জন্ম :- ১৮৯২ - মৃত্যু :- ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ)
তৎকালীন কোচবিহার রাজ্যের মহারাণী ইন্দিরা দেবীর জন্ম ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ফেব্রুয়ারি আরব সাগরের তীরে রাজন্য শাসিত বরোদার রাজকন্যা রূপে| বরোদার মহারাজা তৃতীয় সয়াজিরাও গায়কোয়াড় এবং মহারাণী চিমনাবাঈয়ের একমাত্র মেয়ে, এই ইন্দিরা রাজে| দাদাদের সঙ্গে শৈশব কেটেছিল বিলাসিতা আর প্রাচুর্যে, বরোদার বিলাসবহুল লক্ষ্মীবিলাস রাজপ্রাসাদে |
রাজকন্যা ইন্দিরা রাজের খুব অল্প বয়সেই বিয়ে ঠিক হয় ভারতের বিখ্যাত গোয়ালিয়রের মহারাজা মাধোরাও সিন্ধিয়ার সঙ্গে| সেই সময় ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের দিল্লি দরবার পর্বে ঘটে গেল এক অঘটন| কিশোরী রাজকন্যা ইন্দিরার সঙ্গে পরিচয় হয় আরেক দেশীয় রাজ্য কোচবিহারের তত্কালীন মহারাজকুমার জিতেন্দ্র নারায়ণের সঙ্গে।
উনিশ বছরের সুন্দরী রাজকন্যা ইন্দিরা তরুন মহারাজকুমার জিতেন্দ্র নারায়ণের প্রেমে ভেসে গেলেন এতটাই, নিজে চিঠি লিখে গোয়ালিয়রের মহারাজার সঙ্গে তাঁর বিয়ে ভেঙে দিলেন।
পরবর্তীকালে এর ফল হলো মারাত্মক। তাঁর বিয়ের উপর অনেকটাই নির্ভর করেছিল বরোদা-গোয়ালিয়র রাজবংশের কূটনৈতিক সম্পর্ক। তাছাড়া জিতেন্দ্র নারায়ণ ছিলেন কোচবিহারের মেজো রাজকুমার| ফলে তাঁর রাজা হওয়ার সম্ভাবনাও ছিলো ক্ষীণ।
আশ্চর্যজনক ভাবে, এই বিয়ে ভাঙায় মহারাজা মাধোরাও সিন্ধিয়া কিন্তু নিজের ভদ্রতা ধরে রেখেছিলেন। তিনি ভাবী স্ত্রীর চিঠি পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। স্পষ্ট করে লেখা ছিল, তাঁকে বিয়ের ইচ্ছে নেই ইন্দিরার। পড়ে মহারাজা সয়াজি রাওকে তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন মহারাজা মাধো রাও| লিখেছিলেন "What does the princess mean by her letter?"। নিচে স্বাক্ষর করেছিলেন 'Your son' বলে।
ভাবী জামাতার তারবার্তা থেকে রাজকন্যা ইন্দিরার বাবা-মা জেনেছিলেন তাঁদের মেয়ে বিয়ে ভেঙে দিয়েছে! বরোদার রাজা-রাণী কোনওদিন সুঃস্বপ্নেও ভাবতেও পারেননি মেয়ের কাছে এত অপমানিত হবেন। কিন্তু কোনও কিছুতেই টলানো যায়নি রাজকন্যা ইন্দিরাকে।
বরোদার রাজপরিবারে সবার অমতে রাজকুমারী ইন্দিরা বিয়ে করেছিলেন কোচবিহারের মহারাজকুমার জিতেন্দ্র নারায়ণকে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে, লন্ডনের এক হোটেলে। মহারাজকুমার জিতেন্দ্রনারায়ণের মা কোচবিহারের রাজমাতা সুনীতি দেবী ছিলেন তৎকালীন ভারতের ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা ও সমাজ সংস্কারক বিখ্যাত কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা|
ঘটনাক্রমে, এই বিয়ের কদিন পরে অসুস্থ হয়ে লন্ডনে প্রয়াত হন মহারাজকুমার জিতেন্দ্র নারায়ণের দাদা ও তৎকালীন কোচবিহার রাজ্যের মহারাজা রাজরাজেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুরের। কোচ রাজবংশের নিয়ম অনুযায়ী রাজ্যের পরবর্তী মহারাজা হন জিতেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুর |
কিন্তু
অল্পবয়সী সুদর্শন এই মহারাজা জিতেন্দ্র
নারায়ণ ভূপবাহাদুর নিমোনিয়া অসুখে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩৬ তম জন্মদিনেই
প্রয়াত হন লন্ডনে ১৯২২
খ্রিস্টাব্দে। মহারাণী ইন্দিরা দেবী তখন পাঁচ সন্তানের জননী।
তিনি কিন্তু ভেঙে পড়েননি, অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে হাল ধরেছিলেন জীবন এবং রাজকার্যে। যতদিন না ছেলে মেয়েরা সাবালক হচ্ছে, মহারাণী ইন্দিরা দেবী পরিচালনা করেছিলেন কোচবিহার রাজ্যের রাজ্যপাট| তৎকালীন বিখ্যাত জুতা নির্মাতা 'Salvatore Ferragamo' এর কাছে কোচবিহারের মহারাণী ইন্দিরা দেবী ১০০ জোড়া জুতার অর্ডার দেন, যেগুলি সজ্জিত থাকতো হীরা দ্বারা।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দে মহারাণী ইন্দিরা দেবীর জ্যেষ্ঠ সন্তান মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুর অভিষিক্ত হন কোচবিহারের রাজার পদে। এরপর দীর্ঘদিন লন্ডন এবং ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় কাটিয়েছিলেন রাজমাতা ইন্দিরা দেবী। পরে ফিরে এসেছিলেন ভারতে । শেষ কিছু বছর কাটিয়েছিলেন বম্বেতে, সেখানেই প্রয়াত হন ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে |
মহারাণী ও রাজমাতা ইন্দিরা দেবীর পাঁচ সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন মহারাজকুমার ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণ, তাঁর স্ত্রী ছিলেন পিঠাপুরমের রাজকন্যা কমলা দেবী। মহারাণী ও রাজমাতা ইন্দিরা দেবীর বড় মেয়ে রাজকন্যা ইলা দেবীর বিয়ে হয়েছিল ত্রিপুরার রাজকুমার রমেন্দ্রকিশোর দেববর্মার সাথে। তাঁর পুত্র হলেন কুমার ভরত দেববর্মা ও পুত্রবধূই হলেন বর্তমান বাংলা অভিনেত্রী ও প্রাক্তন সাংসদ মুনমুন সেন। মেজো মেয়ে ছিলেন রাজকন্যা গায়ত্রী দেবী, পরবর্তী জয়পুরের মহারাণী ও রাজমাতা এবং রাজনৈতিক স্বতন্ত্র দলের হয়ে লোকসভার বিরোধী নেত্রী। ছোট রাজকন্যা মেনকা দেবীর বিয়ে হয়েছিল মধ্যভারতের দেওয়াস জুনিয়র রাজপরিবারে |
সোনার
চামচ মুখে নিয়ে জন্ম হলেও আজীবন শোকের তাপে দগ্ধ হয়েছিলেন মহারাণী ও রাজমাতা ইন্দিরা
দেবী| অল্প বয়সে স্বামীর পাশাপাশি অকালে হারিয়েছিলেন দুই সন্তানকেও। তাঁর জীবদ্দশাতেই
মৃত্যু হয় রাজকন্যা ইলাদেবীর
ও পুত্র মহারাজকুমার ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণের।
বলা হয়, এমন দৃঢ়চেতা মায়ের জন্যই জয়পুরের রাজমাতা গায়ত্রী দেবী ঋজু মানসিকতার অধিকারিণী হয়েছিলেন| ফ্যাশনদুরস্ত হওয়ার পাঠও পেয়েছিলেন মায়ের কাছ থেকেই |
ডঃ নৃপেন্দ্রনাথ পালের "ইতিকথায় কোচবিহার"
অরুণকুমার শীলশর্মার " কোচবিহার রাজবাড়ির অন্দরমহলের "
এছাড়াও বিভিন্ন পত্র - পত্রিকা থেকে।
Comments
Post a Comment