ভ্রম
গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় সীতার। ঘুম একবার যদি ভেঙ্গে যায়, আর রক্ষে নেই। ধড়মড় করে উঠে বসে ও। চোখ খুলে চারপাশে তাকিয়ে দেখে। ঘুমের ঘোর কেটে গেলেই মনে পড়ে ও ঘুমিয়ে পড়েছিল।তখন আফশোস আর আফশোস। ইস, ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে ঠিক। পড়তে পড়তে! আর মশা ছেঁকে ধরেছে! ওর পড়ার ঘরের জানালার বাইরেই বিচ্ছিরি ড্রেনটা। দুপুরের দিকে দরজা বন্ধ না করলেই হল! রাজ্যের মশা এসে ঘরে ঢুকে পড়বে! ওম চায় সবাই। মশাও। আহারে! মা হয়ে ও কিনা আরামে ঘুমুচ্ছে, ওদিকে ছেলেটা...! সুভারও বলিহারি! একবার ডেকে দিতে পারেনি সীতাকে? বললেই হত-বউদি, সোনা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে শুইয়ে দাও! কাকে কী বলবে! দুনিয়াটা হয়ে গেছে যক্ষপুরী। মায়া দয়া এসব কি আছে রে সুভা? আবার ওদিকে দেখ, রনজয় কম্পিউটারে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। ও-ই একটা মানুষ! সত্যি বাবা! সারাক্ষণ কম্পি নিয়ে বসে আছে। পারেও। একবার এসে ছেলেটাকে দেখে যেতে পারে! বউ যে একা একা বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল, সেকথা মনেই পড়েনা ভদ্রলোকের।
ভাবতে ভাবতেই তড়িঘড়ি বিছানা ছাড়ে সীতা।প্রায় ছুটেই যায় ছেলের পড়ার ঘরে। বন্ধ দরজায় ধাক্কা দেয়, “ও সোনা, ওঠো বাবা, ঘুমিয়ে পড়েছ বাবা! মশা কামড়াচ্ছে তোমাকে। লক্ষ্মী বাবা, উঠে এসে দরজা খুলে দাও।” বলতে বলতে, হাঁপিয়ে পড়ে সীতা। ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে! ঘাড় গুঁজে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে ঠিক। ইস! সীতা ফোঁপাতে থাকে, “ও সোনা,দরজা খোল।”
রাত দুপুরে হইচই শুনে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল সুভার। ও উঠে এসেছে, “ও বউদি,আঃ ,কী করছো ? আজ ঘুমের ওষুধ খাওনি?”
সুভা জড়িয়ে ধরে সীতাকে, “তুমি কি ভাব? সোনার দিকে আমার লক্ষ্য নেই?” বলতে বলতে সীতাকে টেনে নিয়ে আসে শোবার ঘরে। শুইয়ে দেয় যত্ন করে। গায়ের উপর চাদর টেনে দেয়। মুখে বকবক করে, “সোনা সোনা করেই গেলে। আমি আছি কি করতে?”
“ও খেয়েছিল তো সুভা?”
“হ্যাঁগো হ্যাঁ। খেয়েছে, তারপর ঘুমিয়েছে। আমি চাদর ঢেকে দিয়েছি যেমন দিই। ভোরে উঠবে।পড়তে বসবে। এত ছেলে ছেলে কর কেন?”
সীতা লজ্জিত চোখে তাকায়, “হয়েছে। এবারে যাও।”
দরজা টেনে দিয়ে যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে তাকায় সুভা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এত বড় বাড়িতে দুটোমাত্র প্রাণী থাকে। দিনের বেলাতেই ছমছম করে। রাতে তো কথাই নেই। মেয়ে থাকে বারুইপুরে। কতবার বলেছে, “আমার কাছে থাকো। ওই বুড়ির সেবা করেই কি জীবনটা কাটাবে?” মেয়ে মায়ের জন্য ভাবে। কিন্তু এদিকে যে এক মা তার ছেলের জন্য ভাবে! তাকে কী করে ছেড়ে যাবে সুভা?
সকালে সবজিওলা মনোরঞ্জন এসে হাঁকডাক শুরু করেছে। বড় দেখে কাঁকরোল একপাশে গুছিয়ে রাখছিল সুভা। পাশের বাড়ির অপর্ণা ডাকল,
“সুভা, বউদি কেমন আছে আজ?”
ঠোঁট ওল্টালো সুভা, “একই রকম। ছেলে ছেলে করে পাগল। কথা শোনে না। রাত দুপুরে ছেলের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। কী ব্যাপার? না, ছেলে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে মশা কামড়াচ্ছে…।” সুভা হাসি টেনে আনার ব্যর্থ চেষ্টা করে। চোখ কুঁচকে তাকিয়ে সুভাকে লক্ষ্য করে অপর্না। সুভা কি ভেতরে ভেতরে বিরক্ত?
যদি সুভা কাজ ছেড়ে দেয়, তাহলে কী হবে! অপর্ণা জেনেশুনে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবেনা। পুরো দায় এসে পড়বে ওর ঘাড়ে। একেবারে এক পাঁচিলের এপাশ ওপাশের বাসিন্দা ওরা। এখন অসময়ে হুট বলতেই ‘চিনি না’ বলতে পারবে অপর্ণা?
সুভা বলল, “তুমি এলে তবু কথা টথা বলি। নাহলে ভূতের মত …এতবড় বাড়ি করেছিল কেন কে জানে! ছেলে! হুঃ,একবার পেছন ফিরে চাইলনা যে,সে আবার ছেলে! কত রঙ্গই দেখালে মাগো,পিঠের দেখালে ঠ্যাং!” বকবক করতে করতে চলে যাচ্ছে সুভা,অপর্ণা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সুভা মিথ্যে বলেনি।সত্যি! রনজয়দা হয়তো ভেবেছিল,একদিন ছেলে ছেলের বউ,নাতি-নাতনি নিয়ে জমজমাট হয়ে বাঁচবেন। অথচ রনজয়দার হিসেব কোথায় লেখা হয়ে ছিল,কেউ জানতো না ! ডেঙ্গু জ্বরে মরে গেলেন। সবে রিটায়ার করেছেন তখন।সীতা বউদি নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন। ছেলেটা যদি মাকে সঙ্গ দিত,তাহলে আজ এই অবস্থায় পড়তে হতনা বউদিকে। অপর্ণা ভাবল,আজ বিকেলের দিকে একবার দেখে আসবে বউদিকে।
বিকেলে দুটো টিউশনি সেরে সীতার কাছে যাবে বলে এসেছে অপর্ণা। গেটে বড় বড় দুটো তালা দেখে বেল বাজাল। ঝুল বারান্দা থেকে গলা বাড়িয়ে সুভা ওকে দেখে ইশারায় দাঁড়াতে বলল। চাবির গোছা নিয়ে নেমে আসছে সুভা। ঝন ঝনাত শব্দ হচ্ছে ওর হাঁটার তালে তালে। তালায় চাবি ঢুকিয়ে মোচড় দিতে দিতে ভ্রু তুলল-আর বলোনা ! পাহারা দিয়ে রাখতে হচ্ছে। হুটহাট বেরিয়ে যাবে। কি মুশকিল বল দেখি।
অপর্ণা মুখে কিছু বলেনা। সীতা বউদিকে দেখলে নিজের কথা মনে হয় ওর। বিয়ে করলনা। মা,বাবা নেই। ভাই আলাদা থাকে। তার বউ অপর্ণার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছিল বলে অপর্ণা চলে এসেছিল টিউশনি আর একটা নার্সারি স্কুলের কটা টাকা সম্বল করে। ভবিষ্যত কোথায় গিয়ে থমকে দাঁড়াবে,কে বলতে পারে!
“ভেতরে যাও,আমি তালা মেরে আসছি।” দরজা খুলে অপর্নাকে ঢুকিয়ে দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিতে থাকে সুভা। আধ অন্ধকারে সিঁড়ির ধাপগুলো ভাল দেখা যায়না। সুভা আলোটা জ্বেলে দিতে পারতো !আসলে পয়সার অপচয় করেনা। বুঝদার আছে সুভা।
সীতা বারান্দার গ্রীলে মুখ চেপে দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখছে। পেছনে অপর্ণার উপস্থিতি বুঝতে পারেনি। রাস্তায় কাউকে দেখে চেঁচিয়ে উঠেছে, “এই, অনেকদিন পরে দেখা হল। আমি এখানে বেশি থাকিনা জানো তো? ছেলের কাছে থাকি।ওই দিকে ছেলের বাড়ি। বি-রা-ট বাড়ি করেছে…।” রাস্তায় দাঁড়িয়ে লং স্কার্ট-কুর্তি পরা তরুণী থতমত চোখে সীতাকে দেখছে।
সীতা ওকে প্রথমে চিনতে পারেনি।পরে হেসে, “তুমি কখন এলে? আমি তোমার কাছে যাব ভেবেছিলাম,কিন্তু সুভা দরজায় তালা দিয়ে রেখেছে। ছেলে রাস্তায় বেরিয়ে যাবে। গাড়ি ঘোড়া আছে! ভয় পায় ।” অপর্ণা নানান গল্প করে। সীতা “ও,তাই?” বলে উৎসাহহীন স্বরে বুঝিয়ে দেয় ওর এসব কথা ভাল লাগছেনা।অপর্ণার জেদ চেপে যাচ্ছিল । সীতাকে এই ঘোর থেকে বের করে নিতে ইচ্ছে করছিল ওর। সুভা চা নিয়ে এসেছে। চা খেতে খেতে অপর্ণা বলল, “তোমার ছেলে অর্ক এখন কোথায় আছে?” সীতা চায়ের কাপ নামিয়ে বেশ গুছিয়ে বসল ও, “স্কুল থেকে এই ফিরল।”
“ভুলে গেছ। তোমার ছেলে এখন বিদেশে থাকে। ফোন করে?”
আশ্চর্য চোখে অপর্ণার কথা শুনছে সীতা, “কার কথা বলছিস?”
অপর্ণা জোর দিয়েই কথা বলে, “তোমার ছেলের কথা। এখন সে নেদারল্যান্ডে থাকে। ভাল চাকরি করছে, বিদেশে আছে। আর তোমার হাজব্যান্ড, রনজয়দা, চলে গেছেন স্বর্গে। এসব কথা ভুলে যাচ্ছ কেন?”
ভাষাহীন চোখে তাকাল সীতা, “ জানিস তো,ছেলে ওইদিকে একটা বাড়ি করেছে। আমাদের জন্য আলাদা ঘর, আটাচড বাথরুম ,গাড়ি।” অপর্ণা বসে থেকে সীতার পরিকল্পনা শোনে।
একটা সময় অপর্ণাই উদ্যোগ নিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছিল । ডাক্তার বলেছেন সীতা আলঝাইমার্সের পেশেন্ট। ব্রেণের কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ায় অনেক সময় এটা দেখা যায়। যেমন হ্যালুসিনেশন দেখা । বিভ্রমে বাস করাও এর মধ্যে পড়ে।কখনও বা নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বাড়ি চিনতে পারছেনা, এমনও দেখা যায়। সময়ের যেকোন জায়গায় চলে যেতে পারে এই ধরণের পেশেন্ট। আজ সীতাবউদিকে দেখে অপর্ণার মনে হল খুব ধীরে ধীরে ইরেজার দিয়ে কেউ যেন সীতাবউদির ব্রেণ থেকে স্মৃতিগুলো মুছে দিচ্ছে। পুরোপুরি মোছা হচ্ছেনা বলে খাবলা মেরে কিছু কিছু কথা ধরে ফেলছে বউদি। এরপর? সেদিন যখন এসেছিল,বউদি ছেলের ঘরের বিছানায় বসে গান গাইছিল ঘুম পাড়ানি সুরে-কিসের মাসি, কিসের পিসি, কিসের বৃন্দাবন, এতদিনে জানিলাম মা বড় ধন.ও ও ও…! বিকেল শেষ হয়ে আসা মনখারাপের বিবর্ণ আলোয় ঘরের ভেতরে সীতা বউদিকে অলীক জগতের বাসিন্দা মনে হচ্ছিল। সেই বিবর্ণ আধ অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে গিয়ে অপর্ণার মনে হয় যেন হাজার যুগ ধরে ও এভাবেই নেমে আসছে। শেষপর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌছবে জানেনা। সুভা বলল, “যাবে কী করে? তালা খুলতে হবেনা?” সুভা ঝন ঝন ঝনাত শব্দ তুলে তালা খুলছে। সুভার চাবির গোছা যক্ষপুরীর কথা মনে করিয়ে দিল অপর্ণাকে।
সুভা হাসল, -কী করব বল? দরজা খোলা থাকলেই পালিয়ে যাবে। শিবরাত্রির দিন পাড়ার মন্দিরে নিয়ে গিয়েছি। অনেকক্ষণ ছিলাম। চলে আসার সময় বলে কিনা, “কে তুমি? আমি তোমার সঙ্গে যাবনা।” নেহাত আমাকে সকলে চেনে। নাহলে কি কেলেঙ্কারি হত বল? আরেকদিন চলে গেল এক নম্বর বটতলা। এভাবে কি পারা যায়?” অপর্ণা পা চালিয়ে ঘরে এসে ঢোকে। আলোর সুইচ টিপে আলো জ্বালায়। কেমন যেন ভয় ভয় করে। সীতা বউদি কেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়? একা ঘরে ভাল লাগেনা। নিঃসঙ্গ বোধ করে। ছেলের প্রতি সীতা বউদির যত্ন চোখে পড়ার মতই ছিল। বরুপিসি একদিন বলেই ফেলেছিল, “আদেখলার হইছে পুত, নাম থুইছে যমদূত!” শুনে সীতা বউদি খুব রেগে গিয়েছিল। অথচ দেখ, ছেলে তো মাকে মনে রাখলনা! বিদেশে অতীব সুখে কালযাপন করছে।
সুভা ডাকাডাকি করছিল। সীতা বউদি নাকি সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। ঘন্টা দুই হল। পায়ে চটি গলিয়ে বের হল অপর্ণা। সুভা যেদিকে খুঁজেছে, সেদিক বাদ দিয়ে অন্য দিকে যেতে হবে।রাস্তার লোককে জিজ্ঞেস করে লাভ হবেনা বুঝেও জিজ্ঞেস করেছে। কোথায় যেতে পারে বউদি? ভেবে কূল পাচ্ছিল না অপর্ণা। তখন নিউ গড়িয়ার দিকে যাচ্ছে। দুর্দান্ত ডিজাইনের সব বাড়ি। বিশাল গেটের বাইরে সিকিউরিটি গার্ড চেয়ার পেতে বসে আছে। তাদেরই একজনকে জিজ্ঞেস করেছিল অপর্ণা। জবাব শুনে হতভম্ব। লোকটা একটু ভেবে বলল, “রোগা, লম্বা করে একজন ভদ্রমহিলাকে সে দেখেছে। কথাও বলেছে।”
অপর্ণা সাগ্রহে জানতে চায়, “কী কথা?”
“উনি জানতে চাইলেন, এই বাড়িতে কারা থাকে? আমি জানিনা বলাতে চলে গেলেন।” সিকিউরিটি গার্ড আঙ্গুল তুলে একদিকে দেখাল। অপর্ণা প্রায় ছুটতে শুরু করল। বর্ণনা শুনে সীতা বউদির কথাই মনে হচ্ছে। এদিকে বউদি কেন আসবে, সেকথা ভেবে লাভ নেই। মানুষটাকে খুঁজে পাওয়াই এখন লক্ষ্য। বেশিদূর যেতে হলনা। দূর থেকেই বউদিকে চিনতে পেরেছে অপর্ণা। একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কী বলছে বউদি। কাছাকাছি হতেই কথা শুনতে পেয়েছে অপর্ণা। বাড়ির ঝুলবারান্দায় দাঁড়ানো মহিলাকে বউদি জিজ্ঞেস করছে, “এই বাড়িতে কি আমার ছেলে থাকে? বাড়িটা খুঁজে পাচ্ছিনা!”
অপর্ণা বউদিকে রিকশায় তুলে খুব বকুনি দিয়েছে, “না বলে কয়ে কোথায় চলে যাও?” সীতা বউদি উৎসুক চোখে চারপাশ দেখতে দেখতে যাচ্ছে। যেন কিছুই হয়নি। বাড়ির সামনে সুভা ছিল। বউদিকে বাড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে দিল অপর্ণা। সুভা একমুহূর্ত দেরি করেনি। তিনখানা তালা চটপট ঝুলিয়ে দিল গেটে। বউদি বন্ধ দরজার ভেতর থেকে তালাগুলো টেনে খুলে ফেলার চেষ্টা করছিল,- “খোল না। খুলে দে।” গায়ের জোরে দরজা ভেঙ্গে ফেলতে চাইছিল বউদি। অপর্ণার মনে হল এইভাবে একদিন দরজাটা খুলে ফেলবে বউদি। মোহদ্বার ভেঙে ফেলতে পারবে। ঠিক পারবে।
অপর্নার চোখে কেন যে জল এল!
গল্পের নামকরণ, বিষয়বস্তু সুন্দর l ঝরঝরে লেখা l পড়তে পড়তে পাঠকের আকর্ষণ বাড়তে থাকে l ভালো লাগলো l শুভেচ্ছা l
ReplyDelete