গল্প - হুমায়ূন কবীর ঢালী


মুরগিছানা কাকছানা


গেন্ডারিয়ার ফরিদাবাদ স্কুলের ঠিক বিপরীত দিকের রাস্তা ধরে কয়েকশ গজ এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে সুমনের শাকসবজির দোকান। এই দোকানের ঠিক উল্টো দিকেই একতা হাউজিং। হাউজিংয়ের শেষ মাথায় এডভোকেট জলিল সাহেবের চারতলা বিল্ডিংয়ের দোতলায় ভাড়া থাকে কাব্যরা। খুব বেশিদিন হয়নি এই বাসায় ওঠেছে। কাব্যদের পাঁচ সদস্যের পরিবার। বাবা—মা, দুই বোন ও কাব্য। কাব্যর শখ পাখি পালন। বাবা গুলশান মাহমুদের বিধিনিষেধের কারণে বাসায় কোনো পাখি আনার তেমন সুযোগ পায় না সে। কিন্তু কাব্যর অনুরোধ আর বায়না আছেই। 

প্লিজ আব্বু, একবার শুধু অনুমতি দাও। জাস্ট একটা টিয়ে পাখির ছানা আনব। 

বনের পাখি খাঁচায় বন্দি করে রাখা আমার পছন্দ নয়। গুলশান মাহমুদের সোজাসাপটা জবাব।

সমস্যা কি? আমি তো টিয়েটাকে বেশি বেশি আদর যত্ন করব। খাবার দেব। কোনোপ্রকার অবহেলা করব না।

না, দরকার নেই। বাবা তার সিদ্ধান্তে অনড়।

তাহলে দুইটা মুরগিছানা কিনে আনব?  

কেন কিনে আনবে?

পুষব। মুরগিছানা তো সবাই পোষে। আমার বন্ধু সায়েম অনেকগুলো মুরগিছানা কিনে এনেছে। ওদের মুরগিছানাগুলো দেখতে খুব সুন্দর। হাতে নিলে খুব ভালো লাগে। আদর করতে ইচ্ছে করে। আমাকেও এনে দাও না আব্বু, প্লিজ?

না, কোনো পাখি—টাখিই পোষা দরকার নেই। এসব হাগুমুতু দিয়ে ঘরদোর নোংরা করে ফেলে। তুমি পরিষ্কার করতে চাও না। তোমার আম্মু বলেছে কাজের বুয়াও এসব পরিষ্কার করতে চায় না। সো, আজাইরা ঝামেলা করার দরকার নেই। পাখিটাখি ছাড়া অন্যকিছুর কথা বলো এনে দেব। 

না, মুরগিছানাই এনে দাও না আব্বু, প্লিজ?

তুমি কিন্তু আমাকে বিরক্ত করছ কাব্য। বলছি তো এসব আজাইরা ভেজাল বাসায় আনা যাবে না। এটাই আমার ফাইনাল সিদ্ধান্ত।

বাবাকে কোনোভাবেই রাজি করাতে না পেরে কাব্যর মন খারাপ হলো। মন খারাপ নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে মোবাইল নিয়ে বসল। মোবাইলে তার প্রিয় গেম ফ্রি ফায়ার পাবজি ওপেন করে তাতে মনযোগ দিলো। 

এদিকে রান্নাঘর থেকে বাবা—ছেলের কথাবার্তা শুনছিরেন মিসেস লাবনী। বাবার সাথে পেরে ওঠতে না পেরে ছেলে ঘরে গিয়ে কী করবে তা তিনি জানেন। তাই রান্নাঘরের কাজ রেখে একটু পরেই কাব্যর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিলেন মিস লাবনী। হাতে মোবাইল দেখেই বুঝতে পারলেন ছেলে গেম খেলছে। এই মুহূর্তে ছেলেকে কিছু বললেন না। চুপচাপ স্বামীর কাছে এলেন। বললেন, টিয়ে পাখি আনার অনুমতি না দাও এক—দুইটা মুরগিছানা তো পোষতেই পারে। মুরগিছানা থাকলে মোবাইলে গেমটাও কম হবে। তুমি কিছু বলো না। কাব্যকে দুটো মুরগিছানা কিনে দেব। 

ঠিক আছে তুমি যা ভালো মনে করো। 

 

#

বিকেলেই পাখির দোকান থেকে ছেলেকে দুটো মুরগিছানা কিনে দিলো। মুরগিছানা পেয়ে কাব্য খুব খুশি। অন্যদিন এই সময় গেম নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও আজ মুরগিছানা নিয়ে ব্যস্ত। ছানার সাথে একটা খাঁচাও নিয়ে এসেছেন মিস লাবনী। 

কাব্য খাঁচার ভেতর মুরগিছানা দুটো ঢুকিয়ে দিলো। দুষ্টুমি করে ছড়া কাটল ছানা দুটোর উদ্দেশে। 

এটা তোদের বাড়ি এটা তোদের ঘর

চটজলদি সালাম কর।

এরপর  বারান্দার উত্তর পাশের লোহার গ্রীলের সাথে খাঁচাটা ঝুলিয়ে রাখল। 

মায়ের কাছ থেকে দুটো ছোট ডিবা এনে একটায় পানি, অন্যটায় খুদ রেখে দিলো ছানা দুটোর খাওয়ার জন্য।

মুরগিছানা দুটো ছিল খুব ক্ষুধার্ত। খাবার পেয়ে কুটকুট করে খুদ খেতে শুরু করল। 

কাব্য মনোযোগ দিয়ে ছানা দুটোর খুদ খাওয়ার দৃশ্য দেখল। কী সুন্দর করে ছানা দুটো খুদ খাচ্ছে! কাব্যর কাছে মনে হলো, পৃথিবীতে এরচে সুন্দর দৃশ্য আর সে কখনো দেখেনি।

#

অনেকদিন হলো মুরগিছানা দুটো কাব্যদের বাসায় এসেছে। নিয়মিত খাবার ও সেবা পাচ্ছে। কাব্য স্কুলে যাওয়ার আগে, স্কুল থেকে ফিরেই ছুটে যায় বারান্দায়। ছানা দুটোর কাছে। ছানা দুটো গত কয়েক দিনে কাব্যকে আপন করে নিয়েছে। ওরা বুঝতে পেরেছে কাব্য ওদের আপনজন। আপনজনই না, ওদের বাবা—মা। যার সেবায় ওরা দিনে দিনে বড় হচ্ছে। ওদের জন্মদাত্রী মা কে ওরা জানে না। শুধু জানে, ডিম থেকে বেরিয়ে প্রথম যেদিন আলো দেখল, সেদিন ওদের চারপাশে দেখতে পেয়েছিল একই বয়সের অসংখ্য ভাইবোন। কিন্তু অসংখ্য ভাইবোনের মাঝে বেশি সময় বাস করার সুযোগ পায়নি। কতগুলো মানুষ এসে ওদের কয়েকজনকে তুলে নিয়ে কয়েকটা খাঁচায় ভরল। এরপর একটা গাড়িতে করে নিয়ে গেল দূরের একটা শহরে, শহরের একটা দোকানে। সেই শহরটার নাম ঢাকা। দোকানটার নাম ককারাল। মুরগির বাচ্চার দোকান। দোকানে এসে ওরা জানতে পেরেছে, যেখানে ওদের জন্ম হয়েছে, ওটা ঢাকার বাইরে অবস্থিত একটা মুরগির ফার্ম। সেই ফার্ম থেকে ঢাকার গেন্ডারিয়া হয়ে কাব্যদের বাসায়।

মুরগিছানাদের কাছে কাব্য খুব ভালো ছেলে। ওদের দুই ছানার দুটো নাম দিয়েছে কাব্য। আদর ও সোহাগ। ওদের খুদা পাওয়ার আগেই কাব্য কী করে যেন বুঝে যায়। ওদের মজার মজার সুষম খাবার দেয় কাব্য। ওদের খাঁচার ময়লা নিয়মিত পরিষ্কার করে। অর্থাৎ কোনো রকমের সমস্যা নেই খাবার—দাবার সেবাযত্নে। 

এতকিছুর পরও আদর সোহাগের মনে শান্তি নেই। কী এক কষ্ট ও ভয় ওদের মনে। এর কারণ, ওদের একদম কাছাকাছি রয়েছে একটি বিদ্যুতের খাম্বা। খাম্বায় আছে একটি কাকের বাসা। সে বাসায় বাস করে দুটো কাক ও তাদের তিনটি ছানা। আদর সোহাগ খাঁচা থেকে কাকছানা তিনটিকে দেখতে পায়। ছানাগুলো বাবা—মায়ের সাথে কতরকম খেলা করে। মা—কাক রোজ ছানাদের খাইয়ে দেয়। মা—কাক দূরে গেলে বাবা—কাক ছানাদের দেখভাল করে। পাহাড়া দেয়। বাবা—কাক দূরে গেল মা—কাক কাছে থাকে। 

কাক ছানাদের দেখে ওদের খুব হিংসে হয়। মনে মনে ভাবে, ওদেরও যদি কাকছানাদের মতো বাবা—মা কাছে থাকত, ওরাও বাবা—মায়ের সাথে আনন্দ করত। খেলা করত। মায়ের মুখ থেকে খাবার খেত। ওদের ভাগ্য এতই খারাপ, বাবা—মায়ের আদরযত্ন দূরে থাক, জন্মের পর বাবা—মাকেই দেখতে পায়নি। 

আর ভয় হলো, কাক দুটো মাঝে মাঝে ওদের খাঁচার কাছে এসে ওদেরকে ঠোকর দিতে চায়। খাঁচার চারপাশের বেড়ার ফাঁক ছোট হওয়ায় ঠোকর দিতে পারে না। তবুও ওদের ভয় হয়, কাক দুটো যদি কখনো খাঁচার শিক ভেঙে ওদের নিয়ে যায়! কাক দুটো খুব চালাক। কাব্য যখন কাছে থাকে কাক দুটো আসে না। কাব্য বাসার বাইরে গেলে কিংবা দূরে থাকলে কাক দুটো কাছে আসে। 

কাকের যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য দুই মুরগিছানা একদিন পরামর্শ করল।

আদর বলল, ভাইয়া কাক দুটো থেকে কিভাবে বাঁচা যায়, একটা বুদ্ধি বের করো না?

সোহাগ বলল, আমরা হলাম পুচকে মুরগিছানা। আমাদের কি আর মানুষের মতো জ্ঞান—বুদ্ধি আছে? আমাদের কথাও তো বুঝবে না কাব্য। আমরা হলাম পাখির জাত। আমাদের জাত ছাড়া অন্যকেউ আমাদের ভাষা বুঝবে না। 

আদর বলল, তাহলে একটা কাজ করলে কেমন হয়, কাক দুটো যখন থাকবে না, আমরা দুই ভাই কাকছানাদের অনুরোধ করব যেন ওদের বাবা—মা আমাদের ভয় না দেখায়। ঠোকর দিতে না আসে।

বুদ্ধিটা খারাপ না। তাহলে ওদের বাবা—মা যখন দূরে চলে যাবে, সেই সুযোগে ওদের সাথে কথা বলব। সোহাগ বলল।

#

 

কিছু সময় পড়েই আদর সোহাগ সুযোগটি পেয়ে গেল। কাকের বাসার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল, কাক দুটো বাসার কাছাকাছি নেই। আদর মাথা উঁচু করে কাকছানাদের ডাক দিলো।

এই যে কাক ভাইয়া, কেমন আছো?

ডাক শুনে তিন কাকছানা মাথা উঁচু করে ওদের দিকে তাকালো। আদর সোহাগ যেদিন থেকে ওদের প্রতিবেশি হয়েছে, সেদিন থেকেই ওদের কৌতুহল মুরগিছানা নিয়ে। 

কাক ছানারা বাবা—মাকেও বলেছে মুরগিছানাদের কথা। সবচে বড় ছানাটা সেদিন মা—বাবাকে বলেছে, মা—বাবা, দেখ দেখ কী সুন্দর দুটি পাখির ছানা! আমাদের মতো কুচকুচে কালো না। সাদা। এগুলোকে কি পাখি বলে?

বাবা বলেছে, ওরা হলো মুরগির বাচ্চা। আমাদের মতো উড়তে পারে না। সবসময় মানুষের ঘরেই থাকে। আর সাদা—কালো বলে কোনো কথা আছে নাকি। সৃষ্টিকর্তা যাকে যেমন করে সৃষ্টি করেছেন, সে তো তেমনই হবে। আমাদের সৌন্দর্য আমাদের মতন। ওদের সৌন্দর্য ওদের মতন। ওরা যতই সুন্দর হোক, ওরা আমাদের খাবার। দেখি সুযোগ পেলে ওদেরকে ধরে নিয়ে আসব। 

বাবার কথায় দ্বিতীয় কাকছানা সাথে সাথে চিৎকার করে উঠেÑ এটা কী বলো বাবা! ওরা আমাদের মতো শিশু। ওদেরকে কেন আমরা খেতে যাবো? 

তৃতীয় ছানাও একই কথা বলে। না, এটা করো না। ওরা নিরীহ পাখি। ওদের ধরে এনো না।

ছানাদের কথায় বাবা কাক কিছু না বলে দূরে চলে গেল। মা—কাককে ছানারা অনুরোধ করে বলে, মা তুমি বাবাকে বলো, মুরগিছানাদের যেন ধরে নিয়ে না আসে। আমরা না খেয়ে থাকলেও ওদের মাংস খাবো না।

ঠিক আছে তোদের বাবাকে বলব। মা কাক ছানাদের অভয় দেয়।

আজ সেই মুরগিছানা ওদের ভাইয়া বলে ডাকছে। ওদের তিন কাকছানার মনে আনন্দ বয়ে গেল। বড়ছানাটা কথার জবার দিলো।

কী খবর তোমাদের? কেমন আছো?

ভালো না ভাইয়া। সোহাগ বলল।

কেন, কোনো সমস্যা? বড়ছানা জানতে চাইল। 

তোমাদের বাবা—মা’র জন্য আমরা সবসময় খুব ভয়ে ভয়ে থাকি। মাঝেমধ্যেই আমাদেরকে ভয় দেখায়। খাঁচার ভেতর ঠেঁাট ঢুকিয়ে আমাদের ধরতে চায়। আদর করুণ গলায় বলল।

ও এই কথা। আমরা জানি বাবা তোমাদের মাঝে মাঝে ডিস্টার্ব করে। বাবাটা একটু এরকমই। মা কখনো তোমাদের ধরবে না। মাকে আমরা বুঝিয়ে বলেছি। আজ বাবাকেও বুঝিয়ে বলব। তোমরা ভয় পেও না। 

ধন্যবাদ ভাইয়া। তোমাদের মঙ্গল হোক। প্রার্থনা করি তোমরা দীর্ঘজীবী হও।

তোমাদের জন্যও শুভ কামনা। তোমরাও ভয় কাটিয়ে ভালোয় ভালোয় বেঁচে থাকো।

Comments