গল্প - নবনীতা সান্যাল

 


তুলির বিয়ে 


দশক নব্বইয়ের এক রবিবার। তুলির বিয়ে। দিনের বেলাতেই সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলো শ‍্যামশ্রী। বিয়ে রোববার ঠিকই। ছুটির দিন। তবে,সোমবার অফিস  আছে। সপ্তাহের শুরু।নতুন চাকরি শ‍্যামার। ছুটির হিসেব এখনই করা মুশকিল। বছরের মাঝে চাকরি।  তাই,নেহাত  ঝামেলা না হলে ছুটি নিতে চায় না শ‍্যামা।একে তো দূরের পথ, ঝড় বৃষ্টির দিন। শ‍্যামা তাই  ভেবে টেবে রবিবার দিনের বেলাই বেছে নিল। আর, উপায় কী?চাকরি পেয়ে শ‍‍্যামার মনের বয়স বেেড়েছে। শুধু বন্ধুরা কেন, বাড়িতেও এ নিয়ে  আলোচনা টিপ্পনি  চলে। সাবধানী হয়েছে শ‍্যামা। মনের কথা মনে জমিয়ে রাখতে শিখেছে। তাই কারও খোঁচার উত্তর সে  দেয় না। মনে মনে হিসেব রাখে, টাকা পয়সার,ছুটির,এমনকি অপমানেরও। অদ্ভুত ব‍্যাপার! হবেও বা। শ‍্যামা একটু ব‍্যতিবস্ত  বাতিকগ্রস্থ গোছের সিরিয়াস সেটাও তো সবাই জানে।

 

যাকগে,রাতেই  ফিরে আসতে হবে--শ‍্যামার  দুপুরের মধ্যে পৌঁছে দেখলো বন্ধুদের কেউই আসেনি।  বা এলেও  বিকেলে আসবে জানিয়ে বাড়ি গেছে। বিয়েবাড়ির ধকল সামলানোর জন্য দুপুরের রেস্ট জরুরি। নইলে সাজ খুলবে না। এসব নিয়ে শ‍্যামার মাথা ব‍্যথা নেই কোনোকালে। তাই বৈশাখের রোদ মাথায় করেই সে উপস্থিত হয়েছে।  তখন  আলাদা ঘর থাকতো না ছোটদের।  গিয়ে দেখলো একাই একটি ঘরে  বসে আছে তুলি।অনেকদিন পর দুইবন্ধু মুখোমুখি। তুলি কী একটু রোগা হয়েছে?  ঘরে ঢুকে শ‍্যামা  ডাকলো--"তুলি!' তুলি জিজ্ঞাসু চোখ তুলে তাকালো। তুলি আঙুল দিয়ে  বিছানায় বসতে ইংগিত  করলো। কনুই পর্যন্ত মেহেদী তখনও আধশুকনো।  শ‍্যামা ওর পাশে বসলে, তুলি ধীরে ধীরে  বললো."আজ থেকে যা, কাল এখান থেকেই চলে যাবি', হবে ন? কী রে?'।শ‍্যামা কিছু না বলে  একটু হাসলো।  মনে হচ্ছিল একটা  ঘোরের মধ্যে আছে তুলি।শ‍্যামা এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল, কাউকে দেখাতে পাচ্ছিল না..." ব‍্যাপারটা কী হঠাৎ  করে ঠিক হলো  তুলি?


 তুলি কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই  একটা হৈ চৈ উঠলো। কলঘর থেকে জল পড়া বন্ধ  হয়ে গেছে। কে যেন এসে খবর দিয়ে গেল হৈ হৈ করতে করতে। এদিকে  হলূদের তত্ত্ব  এসেছে, তাও বলে গেশ। এবারে তুলি বললো,' "আমার   ভয় করছে রে!  সকালেও ওরা এসেছিল।হূমকি দিয়ে গেছে!" শ‍্যামা অবাক   হলো না। এটাই স্বাভাবিক, এটাই হওয়ার ছিল। প্রণবদের দল সহজে ছেড়ে দেবে না এটা সবাই জানতো  --'তুলি -- কতোবার করে তখন  বুঝিয়েছিলাম তোকে! ' মাথানিচু করে  ধীরে ধীরে  তুলি বললো,'ছেলেটা অতোটা খারাপও না জানিস! আসলে, ভালোবাসা পেলে অনেক সময়  বদলে যায় তো মানুষ!" শ‍্যামা   একটু চমকে উঠলো। তবে,এমন কথা তুলি আগেও বলেছে। তাই   শ‍্যামা বিরক্ত হলো। ভাবলো, 'তুলির এই আদিখ‍্যেতা নতুন না। কী যে ভালো, কী যে খারাপ  তাই নিয়ে তুলি দৌদ‍ুল‍্যমান। ওর কী চেঞ্জ হবে না?' --সব ভাবনা ধামা চাপা পড়লো।


এর মধ্যে তুলির বোন ঝুমি এলো। ওর ক্লাস নাইন এবার। তুলির  এই প্রেমপর্বের সারথী ছিল ঝুমি। ঝুমি এসে বেশ জোরে জোরেই বললো-" জলের কলের মুখটা ভেঙে দিয়ে গেছে।মামা এবার জোরে দাবড় দিয়েছে  ওদের-- চলে গেছে এবার।  একদম চলে গেছে"। শ‍্যামা তুলির মুখের দিকে তাকালো। তুলি ভাবলেশহীন।তুলির বড় মামি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলো।-- 'আর আসবে না। বাব্বা, এখন মানে মানে দুপুরের পাঠ তুলে ভবনে যেতে পারলে বাঁচি।সাধে কী জামাইবাবু অত দূরে ভবন নিলো-- তাই ভাবি--!' গালে হত দিয়ে তুলির দিকে ফিরে মামি বললো', কী কান্ড বাঁধিয়েছিলি তুলি! ভাবতেই পারি না! কী গুণ্ডা  ছেলে!' কথাগুলো  বলে দম নেওয়ার জন্য থামল মামি। ঘরে ঢুকলো তুলির হোমরা চোমরা দুই পিসি। ছোটপিসি একটু দোক্তা মুখে ফেলে বললো--'আর আধঘণ্টা, বুইলি, তত্ত্ব এসেই গেছে ও  বাড়ির। একটু হলুদ ছুঁইয়ে গা মাথায় -- চানটা করে ফ‍্যাল্...  বেলাবেলি ভবনে চলে যাবো, বুইলি!' শ‍্যামার মনে  হলো চোখের সামনে ও কোনো থিয়েটার মঞ্চস্থ হতে দেখেছে। দৃশ‍্যের পর দৃশ্য --  চরিত্রের পর চরিত্র -- সংলাপের পর সংলাপ.... শ‍্যামার আর একটুও থাকতে ইচ্ছে করছিল না। হূটহাট কাজ করে অনেকবার বিপদে পরেছে, বিপদে ফেলেছে তুলি-- ভুলভাল লোকের পাল্লায় পড়েছে। কিন্তু, এতো অসহ‍্য লাগে নি ওকে। এতো বিরক্তিকর মনে হয় নি পরিস্থিতি। ছোটপিসি পানের বোঁটায় একটু চুন লাগিয়ে জিভের ডগায় ঠেকিয়ে  শ‍্যামার দিকে ফেরে--' টু -টুমি  ডাবে টো  ভবনে। খেয়ে নাও টাড়াটাড়ি - ঝুমি ,  টুমি  নীচে নিয়ে  যাও ওকে।" শ‍্যামা ইতস্তত করে। হাতঘড়ি  দেখে। দুটো বাজতে চললো। তুলির দিকে তাকায়। তুলি মিনমিন' করে-- এমা, কথাই তো হলোনা!" শ‍্যামা ঝটপট উঠে পড়ে। বলে, কথা  পরে হবে রে, তুই রেডি হয়ে নে। কথা আর পরে হয় না অবশ‍্য। তুলি সত্যিই ব‍্যস্ত  হয়ে পড়ে।


সন্ধ্যার  মধ্যেই ঘরে এসে ব‍্যাগ গোছাতে থাকে শ‍্যামা। মা বলেন, 'ওমা! সে কী! ফিরে  আসলি যে! শাড়ি  পরবি বললি।  ঘুরে ঘুরে জোগাড়  করলি সাজগোজের  কী কী সব--তা কী হলো?  চলে আসলি যে?  তোর সবকিছুতে বাড়াবাড়ি তোর -- কাল সকালে গেলেই কী এমন হতো? এতো টেনশনের কী আছে বাপু! । " শ‍্যামা  কিছু বললো না। মুখও তুললো না।  কেন না জানিনা কান্না পাচ্ছিল ওর।সে কান্না অপমানের নাকি বেদনার --বুঝতে  পারছিল না।


 বছর দুয়েক পরে কলিগের বিয়ের নেমতন্নে গিয়ে  তুলির সঙ্গে দেখা। তুলি বেশ মোটা হয়েছে। অনেক  ফর্সাও। বিয়ের জল গায়ে পড়েছে, তাই বোধহয় - - শোনা কথা মনে মনে আউরালো শ‍্যামা। এখন শ‍্যামারও বিয়ের কথাবার্তা চলছে। এতোদিনে শ‍্যামা কিছুটা গুছিয়ে নিয়েছে। বাড়ির কাছে বদলি হয়ে  অনেকটা সুবিধা হয়েছে এখন। এর মধ্যেই  আবার তুলি। বন্ধুদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, আছেও। তবে, তুলির কথা কেউ জানতো না। খোঁজ নেই ওর।  কেউ বলতে পারতো না। আর, যেচে পরে খোঁজ করতে যাবে তেমন স্বভাব নয় শ‍্যামার।


দেখা হতেই তুলি অবশ্য কলকল করে উঠলো। 'কেমন আছিস? খোঁজ   নেই কারো তোদের? কলেজের বন্ধুরা  এমনই হয়। মনে রাখে না। 'শ‍্যামা  বিপরীত যুক্তি দিয়ে কিছু বললো না।হাসলো।বললো,' ভালো ই আছিস তো!' এর মধ্যে  অঢেল গয়না পরা তুলির কনুই এ কালশিটে দেখেছে শ‍্যামা। তুলি হঠাৎ কেঁদে ফেললো।' হ‍্যাঁ বাইরেটা সবাই দেখে। বড় লোক বাড়ির বৌ।দায়িত্ব কর্তব‍্য আর কাজের চাপে শেষ হয়ে যাচ্ছি। একটা বাচ্চা পেট থাকতেই   নষ্ট হলো--" হূ  হূ করে কাঁদে তুলি। তারপর চোখ মুছে বলে, "এমনিতে খারাপ না জানিস তো। তবে ওর একটু ফিলিংসটা কম।তা থাক, খারাপ  না এমনিতে।" শ‍্যামা ওর কালশিটে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে  বলে.. 'ভালোই তো! "বলতে গিয়েও বলে না অনেক কথা। ভাবে,থাকগে! তুলির পিঠ হাত রেখে বলে', চল্ এগোই। এভাবে  আলাদা হয়ে ভালো দেখাচ্ছে না।"


হাঁটতে হাঁটতেই ওরা দেখে  খানিক দূরে ছাইরঙা স‍্যুট পড়া তুলির বর। ত্তুলি মুখ নামিয়ে হাঁটতে থাকে।  শ‍্যামা দেখে লোকটা  সিগারেট মুখ থেকে নামিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলি উড়িয়ে  দিচ্ছে  বাতাসে।  ওর পাশে কিছূ লোকজন।   তাদের বিশেষ পাত্তাও দিচ্ছে না লোকটা।শীতকাল বলেই ধোঁয়ার রিংগুলো  দেখা যাচ্ছে। উডে যাচ্ছে, মিলিয়ে যাচ্ছে ধোঁয়া । দেখতে দেখতে শ‍্যামার বড়  ধোঁয়াময় মনে হয় পৃথিবীটাকে! অতীত ভবিষ্যৎ সবই বড়  ধূসর। বর্তমানটাই আছে কেবল। শ‍্যামার মনে হয়   বিয়ে, সংসার  এ সবকিছু নিয়ে  তার নতুন করে ভাবা দরকার।  তারপরে  ভাবে, থাক, অযথা এনার্জি নষ্ট! তারচেয়ে  যেমন চলছে চলুক।  যা হবার তা হবেই! সময় কে কবে ধরে বেঁধে রাখতে পেরেছে!

Comments