গল্প - অমলকৃষ্ণ রায়

 

চিঠিমেঘের বৃষ্টি

 

সকাল-সন্ধ্যা ধ্যানে বসা সুলোচনার একটা নিত্যদিনের অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। ধ্যানে বসে সকালটা শুরু করলে তার মনে হয়, সারা শরীর, দেহমন সারাদিনের কর্মকাণ্ডের জন্য পূর্ণ শক্তি অর্জন হয়ে প্রস্তুত হয়ে যায়। এরপর নিত্যদিনের কাজকর্ম যখন যা করনীয় সেটা সে সহজেই করে ফেলতে পারবে। ধ্যানাচ্ছন্নতা থেকে এই অপার শক্তি লাভ করার জন্যই সুলোচনা ধ্যানে বসে। কোনও কারণে যদি সে দিনের শুরুতে ধ্যানে বসতে না পারে, তাহলে তার মনে হয় কী যেন একটা গুরত্বপূর্ণ কাজে চরম ফাঁকি দেওয়া হলো। এই ফাঁকি দেওয়ার ফলটা তাকে সারাদিন ধরে পেতেই হবে। তখন নিজের মধ্যে একটা অপরাধবোধ তৈরি হয়, যেকোনও কাজের প্রতি আত্মবিশ্বাস কমে যায়। তখন তার আফসোস হয়, কেন যে সকালবেলা আলসেমি করে ধ্যানটা করা হল না।

বিয়ের আগে সুলোচনা রোজ তার গানের রেওয়াজের ঘরে টাঙানো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাঁধানো ছবিটাকে প্রণাম করে রেওয়াজে বসতো। এটাই ছিল তার দিন শুরুর ধ্যান। বিয়ের পর তার চাকুরেজীবী স্বামী প্রকাশের সংসারে এসে দেখল, প্রকাশ রোজ সকালবেলায় তাদের কূলগুরু তর্কালঙ্কার সাধুবাবার ফটোর সামনে বসে ধ্যান করে। ঘরে কোনও রবীন্দ্রনাথের বাঁধানো ফটো নেই বলে সুলোচনা সেই ফটোর সামনে বসেই ধ্যান করতে শুরু করে। তাতে এক অদ্ভূত কাণ্ড ঘটে যায়। তর্কালঙ্কার সাধুবাবার সামনে বসে চোখ বন্ধ করে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হতেই সাধুবাবার মুখয়বটা পালটে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ হয়ে যায়। তার তখন মনে হয়, মেয়েবেলার রেওয়াজের ঘরের রবীন্দ্রনাথের ফটোর সামনে বসেই সে ধ্যান করছে। ধ্যান শেষ করে সুলোচনা নিত্যদিনের কাজ শুরু করলে সারাটা দিন তার মনটা বেশ প্রশান্তিতে কেটে যায়।

কিছুদিন ধরে ধ্যানে বসে সুলোচনা কবিগুকে একটা বিস্ময়কর অবস্থায় দেখছে। সে লক্ষ করছে, তিনি আপনমনে বসে চিঠি লিখছেন। চিঠিগুলো কাকে লিখছেন, কী বিষয়ে লিখছেন সেটা তার কিছুই চোখে পড়ছে না। তবে চোখ বন্ধ করে তার কলমের ডগায় চোখ রাখলে দেখতে পায় কবিগুরু চিঠি লেখার শুরুতে সবার উপরে ‘ঔঁ’ লিখছেন। তারপর চিঠির ডানদিকের কোণে নিজের বর্তমান অবস্থান লিখছেন— বোলপুর, শান্তিনিকেতন, জোড়াসাঁকো, শিলাইদা, শিলাইদহ, শিলং ইত্যাদি লিখছেন। কখনও বা লিখছেন গৌরীপুর ভবন কালিম্পঙ, আসানটুলি দার্জিলিং। তারপর চিঠির বাঁদিকের কোণে চিঠির প্রাপককে প্রিয়বরেষু, কল্যানীয়াষু লিখে সম্বোধন করছেন। আবার কখনওবা লিখছেন বিনয়সম্ভাষণপূর্বক নিবেদন, কখনও সসম্মান সম্ভাষণমেতৎ, সাদর নমস্কার নিবেদন ইত্যাদি। 

এবার মূল চিঠি যখন লিখতে শুরু করছেন, তখন সেটা আর সুলোচনা দেখতে পারছে না। শুধু দেখতে পায় ধ্যানমগ্নচিত্তে গুরুদেব কলম চালিয়ে যাচ্ছেন। সেসময় তার শারীরিক ভাষায় এমন একটা ভাব ফুটে উঠছে, মনে হয় যেন তিনি তার প্রাপকের সামনে বসেই তার চিঠির বিষয়বস্তু কথনিকা আকারে বলে যাচ্ছেন। মুখভর্তি দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ কবির সেই একান্তে বসে চিঠি লেখাটার মুহূর্তটাকে সুলোচনা তখন মনভরে উপভোগ করতে থাকে। 

ধ্যান ছাড়া সুলোচনার সারাদিনের সংসারের ঘরকন্নার কাজ রয়েছে, রয়েছে তার লেখালেখি। এছাড়া তার অবসরযাপনের জন্য উত্তম সঙ্গী হলো মোবাইল ফোন। অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনটির মাধ্যমে ইণ্টারনেটের কল্যানে সুলোচনা সারা পৃথিবীর সবরকম তথ্য সম্পর্কে সহজেই ধারণা পেয়ে যায়। সেই ধারণার সঙ্গে ধ্যানে বসে গুরুদেবের চিঠি লেখার ব্যাপারটা জুড়ে গেলে তার কাছে ধ্যানের ব্যাপারটা আরেকটা অভিনব মাত্রা পেয়ে যায়। সে তখন কবির চিঠি লেখার ব্যাপারটাকে কম্পিউটার স্ক্রিণের সারাবিশ্বের বিমান চলাচলের গতিবিধির মতো কিলবিল করতে দেখতে পায়। বিমানগুলো যেমন নিজের নিজের আকাশপথ ধরে গন্তব্য স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে, ঠিক সেরকমই চিঠিগুলো যেন ডাকবিভাগের বদান্যতায় প্রাপকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। চিঠিগুলোর প্রেরক থেকে প্রাপকের কাছে পৌঁছনোর পথগুলো সুলোচনার ভাবনার আকাশে একটা হিজিবিজি মেঘের মতো ভিড় করে। সে তখন ভাবে, সেই মেঘ থেকে চিঠির বিষয়বস্তুগুলো বৃষ্টির মতো তার উপর ঝরে পড়ছে। সেই মুসলধারে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়াটাকে সে ধ্যানে বসে দারুণভাবে উপভোগ করে। তার কাছে তখন চিঠির বিষয়বস্তুগুলো প্রেরক এবং প্রাপকের টেলিফোনের আলাপনে পালটে যায়। তার তখন মনে হয়, গুরুদেব যেন ফোনে চিঠি প্রাপকের সঙ্গে কথা বলছেন। সেই কথাগুলো সুলোচনা আড়ি পেতে শুনছে। 

সুলোচনার চিঠির বিষয়বস্তু শুনে মনে হয় চিঠির প্রেরক বিদগ্ধ জ্ঞানতপস্বী বিশ্বকবি তাঁর অনুগামীদের জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাচ্ছেন। সেই জ্ঞানসম্ভার প্রাপকের কাছে পৌঁছনোর পথেই সুলোচনা অপ্রত্যাশিত ভাবে তাতে ভাগ বসিয়ে দিচ্ছে। রেলপথে কিংবা ট্রাকে করে পণ্য পরিবহনের সময় অনেকসময় শোনা যায়, দুষ্ট লোকেরা আদবকায়দা করে মাঝপথে কিছু মালামাল হাতিয়ে নেয়। কিন্তু চিঠির বিষয়বস্তু প্রাপকের কাছে পৌঁছনোর সময় যে তৃতীয় কেউ এভাবে তা চুরি করতে পারে, আড়ি পেতে তার বিষয়বস্তু জেনে নিতে পারে, সে ব্যাপারটা একেবারে অভিনব হলেও সুলোচনার ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই ঘটছে।

সুলোচনা বুঝতে পারে চিঠির মাধ্যমে গুরুদেব কাউকে সাহিত্যজগতে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য সুপরামর্শ দিচ্ছেন— এটা করো, ওটা করো না।  এভাবে করা ঠিক নয়, ওভাবে করো এইসব। প্রকারান্তরে সুলোচনার মনে হয় সেসব পরামর্শ তাকেই দেওয়া হচ্ছে। সেই অমূল্য পরামর্শগুলো তিনি কাকে দিচ্ছেন সেটা বুঝতে পারছে না। সুলোচনার বড় সাধ হলো এসব পরামর্শকে মান্যতা দিয়ে নিজে একদিন বড় সাহিত্যিক হয়ে উঠবে। তাই সাধুবাবার সামনে বসে নিত্যদিনের ধ্যানটা তার একটা নেশায় পরিণত হয়েছে। 

 

                                      (২)

 

অন্যদিনের মতোই ধ্যানে বসামাত্র সুলোচনার মনোজগতে আজ একপশলা বৃষ্টি হয়েছে। কবিগুরুর চিঠিমেঘের বৃষ্টি। সে বৃষ্টিতে ভিজে যেতে যেতে সুলোচনা চিঠির প্রেরক-প্রাপকের কথোপকথনে আড়ি পেতেছে—

‘চিরদিনই আমার মনটা পথিক। এই পথিকবৃত্তিই হয়তো আমার স্বভাব।’

‘এরকম স্বভাব আর ক’জনার হয় বলুন। আপনি ঠিক এভাবেই পথিকবৃত্তি করতে থাকুন। আর আমার মতো কিছু জ্ঞানভিক্ষু মানুষ সেই সুযোগে আপনার জ্ঞানরশ্মিতে নিজেকে আলোকিত করবার সুযোগ গ্রহণ করি।’

‘জানোতো, বাঁশির ভিতর বাতাস বাধা না পেলে ধ্বনি সৃষ্টি হয় না, নদীর স্রোত পাড়ে বাধা পেয়ে আছড়ে না পড়লে যেমন ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হয় না, আমার পথিকবৃত্তিটাও ঠিক তাই। চলার পথে বাধা পাই বলে সে বাধা ধ্বনি হয়ে তোমাদের মতো শ্রোতাদের কানে পৌঁছায়।’

‘আপনি যাকে ধ্বনি বলছেন, আমি তো তাকে সুর বলি।’

‘সুর তো নয়, পথিকের পদধ্বনি আর কী। চলতে চলতে পথ ভুল করি। তারপর নিজের ভুল বুঝতে পেরে পথ বদলাই। সঠিক পথ পাবার পর হয়তো পথের আলোটাই কখনও নিভে যায়। তখন আন্দাজের উপর ভর করে চলতে গিয়ে হোচট খাই। পথের রসদ ফুরিয়ে আসে। অপেক্ষা করি, কখন আলো জ্বলে উঠবে। আমার চলার পথকে আবার দেখতে পাব। সেই সময়টায় নিজেকে স্তব্ধতায় ডুবিয়ে দিই।’ 

‘সেই স্তব্ধতার মাঝে কী খুঁজে পান?’

‘অনেককিছুই। সেখানে অন্ন আছে, আরোগ্য আছে, শান্তি আছে।’

‘সেই শান্তির মাঝে কী পান?’

‘শান্তির মাঝে নিবিষ্ট হতে হতে এক সময় বাইরেকার কুৎসা পারুষ্য পঙ্কিলতা আর নাগাল পায় না। সেই না-য়ের কোঠায় গিয়েই বিশেষ লাভ নেই।’

‘লাভ নেই কেন বলছেন?’

‘নিজের ভিতরে যে রাগান্বেষের চাঞ্চল্য আছে, সেটাকে অতিক্রম করতে পারলে একটি সহজ আনন্দ আসে, সেটা কেবল মুক্তির নয়, সেটা সত্য উপলব্ধির। সেই বিশুদ্ধ প্রীতিতে যে উত্তীর্ণ হতে হবে মন সেটা থেকে থেকে ভুলেই যায়।’

‘ভুলে যাবার কারণ কী বলে আপনার মনে হয়?’

‘কারণ হলো পূর্বসংস্কার সাধনার সংকল্পকে আচ্ছন্ন করে দেয়। তাহলেও এটা নিশ্চিত জানতে পারাতেও শক্তি পাওয়া যায়।’

‘তাহলে কি বুঝব সেই স্তব্ধতা থেকেই শক্তি পাওয়া যায়‘?’

‘এই নিশ্চিত জানাটা হচ্ছে এই যে, অন্তরের স্তব্ধতার সঙ্গে বাইরের চলাকে মেলানো। আর মেলাতে পারাটাই হলো সার্থকতা।’

‘আপনার কথাগুলো যেন আমার মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। কিছুই বুঝতে পারলাম না। এর কি কোনও সহজ বাস্তব উদাহরণ দিতে পারেন?’

‘স্তব্ধবীণার সঙ্গে গতিশীল গানের যেমন সম্মন্ধ।’

‘সেরকম একটা শক্তি আপনার কাছ থেকে পাব বলে আশা করছি।’

‘আমার কাছ থেকে শক্তি পাবে এমন আশা করচ, কিন্তু সেইরকম গুরুর অধিকার তো আমার নয়।’

‘তাহলে কি আমার আশা পূরণ হবে না বলছেন?’

‘আমি তোমার কল্যান কামনা করি, কিন্তু কল্যান বিধান করব এমন ঐশ্চর্য কি আমার আছে?’

সুলোচনা বিস্মিত হয়ে শুনতে থাকে, গুরুদেব তাঁর অক্ষমতা প্রকাশের মাধ্যমে কত মূল্যবান কথাগুলো অনায়াসে বলে যাচ্ছেন। একসময় চিঠিমেঘের বৃষ্টি থেমে যায়। সুলোচনা তখন কথনিকার ঘোর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে।


[ঋণ স্বীকারঃ বিদ্বজ্জনের কাছে লেখা রবীন্দ্রনাথের অগ্রন্থিত চিঠিপত্র--- সম্পাদনা সমীর সেনগুপ্ত।]

Comments