গল্প- অদিতি চট্টোপাধ্যায় গোস্বামী


স্বপ্ন 


গাঁয়ের ছেলে অজিত ছোট্ট বেলা থেকেই অতি  মেধাবী | বরাবরই ক্লাসে ফার্স্ট হয় সে | দুচোখে স্বপ্ন ভরা | বাবা একজন প্রান্তিক চাষা, কিন্তু কোনওকিছুতেই তিনি দমেন না | নিজে টাকার অভাবে বেশিদূর পড়াশোনা করতে না পারলেও চান ছেলে সর্বদা পড়াশোনা করে এগিয়ে যাক | ছেলেকে খালি বলে, তোকে অনেক অনেক বড়ো হয়ে গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে | এরজন্য অন্য কোনদিকে মন না দিয়ে শুধু বইয়ে মুখেই ডুবে থাকতে হবে | কিন্তু বাবার এই কথা শুনে কিছুটা হতাশই হয় অজিত | জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার লক্ষ্য সবাইর  থাকে | তাই বলে পড়াশোনার পাশাপাশি অন্য কিছু করা যাবে না এ কেমনতর নিয়ম | কিছুক্ষণ উদাস বাউল মনে ভাবতে থাকে সে | কারণ সে তো ফুটবল খেলতে বরাবরই ভালোবাসে, বাবার সঙ্গে মাঠে লাঙল দিয়ে জমি চাষ করতেও খুব ভালোবাসে | আর ভালোবাসে গ্রামের মেঠো পথে পথে ঘুরে বেড়াতে | গ্রামের শেষ প্রান্তে নদীর ধারে কিছুক্ষণ আপন মনে গুনগুন করে 'বাড়ে আচ্ছে লাগতে হ্যা' গাইতেও ভালো লাগে | এমনই সব সাতপাঁচ ভাবছিল অজিত, এমন সময় মা খাবার নিয়ে এসে মুখের সামনে হাজির | নে বাবু, আজ সুজির পোলাও বানিয়েছি একটু মুখে দিয়ে নে|


উচ্চ মাধ্যমিকের পর যাদবপুরে চান্স পায় অজিত | এই মহল্লায় বলা চলে অজিতের প্রথম যাদবপুরে যাওয়া | গ্রামের সাদাসিদে ছেলে প্রথম প্রথম কলকাতায় এসে যেন ভ্যাবাচ্যাকা খায় | ট্রাম লাইন ধরে হাঁটবে না গড়িয়াহাটের ফুট ধরে হাঁটবে তা যেন ঠিকই করতে পারে না | এতো বড়ও বড়ও শপিং মল, রাস্তা ঘাটের এতো জ্যাম, মানুষের ভিড়ে অজিত যেন প্রথম প্রথম সব কিছু ঘুলিয়ে ফেলতো | কোথায় গ্রামে রাত ন'টার পর অনেক হাক ডাক করার পর হরেন কাকার খোঁজ মেলে | আর এখানে যেন রাত ন'টাতেই লোকে রাস্তায় বেশি বেরোয় | মন খারাপের বিকাল বেলায় অজিত মেসের আলো নিভিয়ে দিয়ে চোখ মোছে | মনে করতে থাকে গ্রামের শেষ প্রান্তে নদীর তীরে যখন নৌকা গুলু বাঁধা থাকতো তখন বুন্ধ বান্ধব মারফৎ তারা কী বদমাইয়েসি টাই না করতো ! একবার ভরা বর্ষায় একজন ডুবতে বসেছিল | সেদিনও নৌকায় বসে আড্ডা দিচ্ছিল অজিত, মিথিলেশ, আরিফ, শ্রাবণরা | আচমকা আগুন্তকের প্রাণ বাঁচাতে সকলেই প্রায় ঝাঁপিয়ে পরে নদীতে | উদ্ধার হল মাঝ বয়সী এক মহিলার প্রাণ | মেঘ বৃষ্টির লুকোচুরির মাঝেই একমনে এমন অনেক কিছুই ভেবে চলেছে অজিত | বাড়ী ফিরে মার খাওয়া অতঃপর স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে মহিলার আত্মহত্যার তাগিদে নদীতে ঝাঁপ সবই যেন আজ বড্ড বেশি করে মনে পড়ছে অজিতের | 


না অনেকক্ষণ একভাবে এভাবে বিছানায় পরে থেকে গুমড়ানো হল | না এবার চা খেয়ে আসি | এই বলে চা খেতে নেমে গেল অজিত | যাদবপুরে ইলেক্ট্রনিক্স অনার্সের ছাত্র অজিত | দেখতে শুনতেও বরাবরই বেশ ভালো | লম্বা, সুঠাম, গৌরবর্ণ | একই ক্লাসে পড়ে সোমাও | সে পড়াশোনায় অজিতের থেকে কোনও অংশে কিছু কম যায় না | ক্লাসে মেয়েদের মধ্যে সেরা সুন্দরীদের মধ্যে অন্যতম সোমা | ডাক্তার ছত্র ছায়া বাবা মায়ের মধ্যে বড়ও হলেও সোমা কিন্তু বেশ মিশুকে | খুব একটা অহঙ্কার তার শরীরে ফুটে উঠে না | ক্লাসের অন্যান্য সকলের মতো অজিতের সঙ্গেও বেশ ভালো বুন্ধত্বও গড়ে উঠে সোমার | কাছাকাছি আসতে আসতে কোন অজান্তে মন দেওয়া নেওয়া হয়ে যায় তা যেন বুঝতেও পারে না অজিত-সোমা | পড়াশোনার পালা শেষে দুজনেই মনের মতো চাকরিতে জয়েন করে | অজিত কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট নিয়ে বাবা-মা কে নিয়ে আসে | কিন্তু বাবা মায়ের মন পরে থাকে সেই গ্রামের রাঙা মাটির দিকে | দুই বাড়ির তরফ থেকে কথা বার্তা পাকা হয়, দেখতে দেখতে শুভদিনে বিয়েও হয়ে যায় | কিন্তু বিয়ের পর থেকে কোথাও যেন বাবা মায়ের আর অজিতের ফ্ল্যাটে আসতে ভালো লাগে না | শুধু নাতি নাতনির টানে ছুটে আসে | বৌমা পরের মেয়ে কাজের ফাঁকে যথাযথই যত্ন আত্তির করে, অনেকসময় আবার বেজার বিরক্তিও হয় | কিন্তু নিজের ছেলেটা আজ যেন বড্ডো বেশি পর হয়ে গিয়েছে হয়তো কাজের চাপে | সংসারের চাপে | বাবা-মা খেয়েছো কিনা, বা তোমাদের এখানে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো ! এই জিজ্ঞাস্সাটুকুও করার ফুরসুৎ নেই | আজকাল প্রায়ই অফিস থেকে ফিরতে রাত হয় অজিতের | তখন বাড়ি শুদ্ধ সবাই ঘুমিয়ে কাদা | ডিনার টেবিলে খাবার ঢাকা দেওয়া থাকে | সকালে কলে ব্যস্ত থাকার কারণে আজকাল ভালো করে কথা হয়ে উঠে না কারোর সঙ্গে | গিন্নি অনেকদিন তো হল, চলো এবার গ্রামে ফিরি | হা চল, কালই বাবুকে বলে চলে যাবো | না গ্রামের সোদা গন্ধের মাটি থেকে উঠে আসা অজিত জীবনে আজ খুবই সাকসেস | দুচোখে স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম থেকে এসে কলকাতা শহরে ফ্ল্যাট, গাড়ি বৌ বাচ্চা সবই আজ হয়েছে তার | মফঃস্বলের ছেলেরাও যে পারে তা করে দেখিয়েছে অজিত | আর পিছনে পরে রয়েছে গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ, মা-বাবা আর নদীর ধার | নৌকা, ছেলে বেলার সঙ্গী সাথীরা যারা আজ দেশে বিদেশে ছড়িয়ে রয়েছে | পরে রয়েছে খেলার মাঠ, প্রিয় চপের দোকান, মাচানের ওপর বুন্ধদের সঙ্গে আড্ডা, গ্রামের কোন মেয়েটা বিয়ে হয়ে ছেড়ে চলে গেল, আরও কত শত ক্র্যাশ | শেষ মেশ সেই লাইব্রেরি, যেখানে প্রতি সন্ধ্যায় রবীন্দ্র-নুজরুল, সুভাষ বোস, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দের বাণী পড়ানো হত |

Comments