অণুগল্প - আশিস ধর


ওরা অকৃতজ্ঞ


মানুষ যতদিন বাঁচে তার কির্তি, ভালো ভালো কাজগুলোর আয়ু বোধ হয় ততদিন থাকে। জানি, তর্ক বিতর্ক হবে, অনেকে মানতে চাইবেননা। আমি বড় বড় মনিষীর কথা বলছিনা। আমি আমার পাড়ার পিসি, মাসিদের কথা বলছি। , যারা পাড়ার মানুষের বিপদে আপদে নিস্বার্থে এগিয়ে যায়। অলকনন্দা আবাসন কঙ্কনা পিসিকে এভাবেই সবাই চিনে। চটপটে টকটকে ফর্সা কঙ্কনা পিসি সত্তর বাহাত্তর বয়সেও সবার কাছে আকর্ষনীয়া। বিপদে আপদে সবার প্রথমে প্রিয় কঙ্কনা পিসির কথা মনে পড়ে। কঙ্কনা পিসিও নিজের শত কাজ ফেলে দাড়িয়ে পড়ে পরিবারগুলোর পাশে। কঙ্কনা পিসি অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ারের সুগৃহিনী। ইচ্ছে করলে আরামে আয়েসে দিন কাটাতে পরতো। কোভিটের ভয়ংকর সময়ে কমপ্লেস্কের সবাই বসেছিল দরজায় খিল মেরে। চুপচাপ বসে থাকতে পারেনি কঙ্কনা পিসি। দাড়িয়েছে কোভিডে অসুস্থ রোগাক্রান্ত মানুষগুলোর পাশে। সবাইকে নিয়ে রান্না করে কিছু অসুস্থ মানুষের মুখে জুগিয়েছে অন্ন। একবারও নিজের শরীর নিয়ে, অসুস্থ হার্টের রোগী স্বামীর কথা ভাবেনি। সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছে কঙ্কনা পিসি না থাকলে আবাসনের গোটা বিশেক পরিবারের কোভিডের সময় অবস্থা আরো খারাপ হোত। এহেন সবার প্রিয় কঙ্কনা পিসি বিকেলে পিশেমশায়ের সাথে গিয়েছিল দোকানে। হঠাৎ ওখানেই মুর্ছা, সাথে সাথে পতন। সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক। হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে সব শেষ। কঙ্কনা পিসি কখনও অসুস্থ পিশেমশায়কে একা ছাড়তোনা। কি ভাগ্যের বিড়ম্বনা ! প্রায় পচাশি বছরের হার্টের রোগী পিশেমশাইকে ফেলে চলে গেল মোটামুটি সুস্থ কঙ্কনা পিসি। সুন্দর করে সাজানো দোতলার ফ্ল্যাট অসুস্থ স্বামী পুত্র কন্যা কিছুই পিসিকে ধরে রাখতে পারলোনা! কঙ্কনা পিসির মৃত শরীর রাখা হয়েছে অলকনন্দা আবাসনের কম্যুনিটি হলে। ফুলে ফুলে ঢাকা শরীর। শান্ত ধীর স্থির মুখটা দেখলে মনে হয়, ইচ্ছে করে চোখ বুজে আছে। উপস্থিত সকলে কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে পারছেননা ওদের সকলের প্রিয় কঙ্কনা পিসি চলে গেল না ফেরার দেশে ! কঙ্কনা পিসির ছেলে লন্ডনে কর্মরত, মেয়ে বিবাহিতা কোলকাতায়। কারো কালকে সকালের আগে আসা সম্ভবপর নয়। স্বাভাবিক ভাবে, রাতটা কম্যুনিটি হলে রাখতে হবে মৃতদেহটাকে। ছেলেমেয়ে আসলে নিয়ম কোরে দাহকর্ম সমধা হবে। এখানেই আপত্তি আবাসনের সোসাইটির অধ্যক্ষের। কম্যুনিটি হলে রাতভর মৃতদেহ রাখতে সোসাইটির সবারই অনিহা। আমরা সবাই পিসির উপস্থিত আত্মীয় স্বজন, আবাসনের মানুষজনের ফিসফিস গুজগুজ শুনছি। অবাক হয়ে ভাবছি এরা কি মানুষ ! একটা রাত মূতদেহ রাখতে দিতে এত আপত্তি। একটা কবিতার চারটে লাইন আমার খুব মনে পড়লো- ভাবছো তুমি সবাই আপন/ বড্ড ভালোবাসে/ বিপদ এলে যাচাই করো/ কজন থাকে পাশে। পিশেমশায়কে সোসাইটির অধ্যক্ষ বললেন- “কঙ্কনা পিসি আমাদের সবার জন্য প্রায় বিশ পচিশ বছর যা করেছেন তার জন্য আমরা ওনার কাছে চির ঋনী। ওনাকে শত সহস্র প্রনাম। দয়া করে অন্যভাবে নেবেন না। সকলের মতামত নিয়ে বলছি, কম্যুনিটি হলে কঙ্কনা পিসির শব রাতভোর রাখার অনুমতি আমি দিতে পারছি না। অন্য কোন হাসপাতলের মর্গে শব রাখার ব্যবস্থা না হয় আমি করে দেব। কিন্তু শব এখানে রেখে ভবিষ্যতে সকলের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হোক আমি চাইনা”। -“ হা ভগবান ! কঙ্কনা আজ তার কৃত কর্মের যথোচিত প্রতিদান পেল। এটা কঙ্কনারও আবাসন। অকৃতজ্ঞ মানুষেরা, ওকে এখানে রাতটুকু থাকতে দিল না”। হুহু করে কেঁদে উঠলেন অসুস্থ অসহায় পিশেমশায়। 

Comments

  1. সুব্রত ভট্টাচার্যSeptember 9, 2023 at 7:41 PM

    ভালো বিষয় l ভালো মানুষেরা তবুও অন্যের জন্য কাজ করে যান l দু একটা বানান ভুল চোখে পড়লো l সেগুলো ঠিক হলে আরও ভালো লাগবে l

    ReplyDelete

Post a Comment