বই কথা - সুবীর সরকার


আলোচনা:নতুন বই

চাদর ও বৈতরণী: আশ্চর্য এক মনকেমনের দহ


রিমি দে।বাংলা কবিতার পাঠকদের কাছে একটি সুপরিচিত নাম।রিমি নয়ের দশকে লিখতে এসেছেন আমাদের বাংলা কবিতা।এত বছরের ধারাবাহিক জার্নি তাকে কবিতার সাধক করে তুলেছে। রিমি দের প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছিল ২০০১ সালে। মেঘবন্দি।তারপর একে একে নিয়মিত তার বই প্রকাশ পেয়ে এসেছে। কবিতার পাশাপাশি অনুগল্পের বই রয়েছে তার। করেছেন একটি প্রবন্ধের সংকলন সম্পাদনার কাজ।
কবি রিমি দে দীর্ঘ সময় ধরে সম্পাদনা করে আসছেন "পদ্য" পত্রিকা। এই পত্রিকা ইতিমধ্যে তার জস্ব পরিসর অর্জন করে ফেলেছে।
শিলিগুড়ি শহরে রিমি গড়ে তুলেছেন "আড্ডাগলি",শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে যেখানে নিয়মিত মেধা মনন চর্চা ও বিনিময় হয়।
আসলে কবি রিমি দে কেবল একজন গুরুত্বপূর্ন কবিই নন।রিমি দে একজন বহুমাত্রিক ব্যাক্তিত্ব।
নানা রকমের স্বপ্ন আর কাজ নিয়ে তিনি বেঁচে থাকছেন।চলমান থাকছেন।
২.
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে রিমি দের নুতন বই।"চাদর ও বৈতরণী"।
প্রকাশক:শহরতলি প্রকাশনী।
নান্দনিক প্রচ্ছদ এঁকেছেন আমার প্রিয় এক তরুণ কবি সুপ্রসন্ন কুন্ডু।
বইটি দুটি পর্বে সাজানো।
প্রথম পর্ব "চাদর" ৩২ টি কবিতা দিয়ে সাজানো।
দ্বিতীয় পর্ব "বৈতরণী" একটি কাব্যনাট্য।বাবা ও মেয়ের কথাবার্তায় এক নুতনের বিনির্মাণ।
৩.
মেঘবন্দি(২০০১) থেকে চাদর ও বৈতরণী(২০২৩)_২২ বছর ধরে প্রকাশিত রিমি দের বইগুলো।
আর সবচেয়ে বড় কথা প্রতিটি বই প্রকাশের পর পরের বইতে রিমি দে কিন্তু পুরোন থেকে সরে এসেছেন নুতনের দিকে।এবং রিমির এক সচেতন বিস্তার তার মগ্নতাকেই এস্টাব্লিস করে।
৪.
রিমি দে শব্দের ম্যাজিক দিয়ে আস্ত এক মনকেমনের
দাহ ও দহ লিখলেন।সাবলীল প্রয়োগ, উপমা,প্রতীক দিয়ে ব্যক্তিজীবনের সুরতাললয় প্রলয়ের জায়মান বিস্তারের ভেতর পাঠককে নিয়ে যান রিমি।
পুতুল,বেড়াল,বাবা,অরুনেশ,ছায়া দি, নীরা মামী,গলিপথ_সব যেন মস্ত এক চাদরের নিচে ঢাকা পড়ে যায়।রিমি দে তার পাঠকদের সন্ন্যাস খুঁটে নেবার তন্ত্র মন্ত্র শোনাতে থাকেন।
রিমি দে লেখেন_
১.
সন্ধের পর দেখি ফ্ল্যাটটিতে লিফট নেই
আর
টুপি পড়া লোকটি আমার বউয়ের সঙ্গে হেসে গল্প করছে!
২.
আমি নিজের নদী নিজেই খেয়ে ফেললাম
৩.
আলমারীর ভেতর থেকে
ম্যাও ম্যাও শব্দ আসে
অথচ আমার কোন পোষ্য নেই
৪.
তারপর যে যার মতো সন্ন্যাস খুঁটে খাই
৫.
পথ ছোঁয়া অপরাধ নয়
অলিপথ গলিপথ নালীপথ খালিপথ
৬.
সংসার লিখতে লিখতে এঁটেল মাটি
৭.
মানুষের নাম লোভ!
৮.
হালুম শব্দে কেঁপে উঠি স্বপ্নের ভিতর
রিমির কবিতার ভুবনজোত জুড়ে অদ্ভুত ডিলিরিয়াম।কুয়াশাটানেল। ঘোর।আর ক্রমাগত আত্মগত হয়ে উঠতে থাকবার আন্তরিক জার্নি।
৫.
বইটির দ্বিতীয় পর্ব "বৈতরণী" একটি কাব্যনাট্য।
বড় মেয়ে ঝুম্না তার বাবার সাথে কথা বলছে।
সেখানে বোন উম্না,মা,গুহ কাকু,নদী,চা বাগান,কুলি লাইন আরো কত কিছু আসছে।
কন্যাকে তাড়া করছে বাল্য স্মৃতি।
বাবা।বাবার পিটুনি।বকুনি।স্নেহ।মমতা।
বড় হয়ে উঠতে থাকা কন্যার বাবাকে বহুমাত্রিকতা
দিয়ে দেখা।দেখতে থাকা।
বাবা এখানে আবহমান এক উচ্চারণের মত আমাদের ভেতর সংক্রমণ ছড়াতে থাকে।আমরা অন্যমনস্ক হতে হতে পড়ে ফেলি_
"আমি প্রস্তুত হচ্ছি
আরো একটি ধূপকাঠির জন্য
আমার কোন পায়চারি নেই
কোন হাওয়া নেই
শুধু স্মৃতি আছে
যা আবছা বিস্মৃতিও হতে পারে
যেখানে হর্ষ বা বেদনা কোনোটাই নেই
আমার বাচ্চারা খেলে
আমি জল নাড়াই
কোন ফাঁকে ওরা বড় হয়
যন্ত্রণার কথা বুকে লেগে থাকে"
খুব নিবিড়ভাবে ডুবে যেতে হয় রিমির কবিতার
জোতজমিতে।
বাবা মা মেয়ে স্বপ্ন প্রেম আর নিজেকে খুঁড়তে খুঁড়তে
এক জন্ম আত্নপীড়নl লিখছেন রিমি দে।
বাবার বয়ানে রিমি উচ্চারণ করেন_
"আমি তোকে চিনি
পার্থিব আমি
আর এই আমি এক নেই আর!"
আসলে রিমি দে তার বাবাকে হারিয়েছেন ২০২০ এ।
তারপর থেকে রিমিকে তার বাবার শূন্যতা প্রবল সম্মোহিত করে রেখেছে।
তার স্বাক্ষর তার "বাবা ও ভ্রমণ"(প্রকাশক:কবিতা আশ্রম) বইটিতে আমরা দেখেছি।
বাবা পার্থিব জগৎ থেকে চলে গেছেন এটা মেনে নিতে পারছেন না রিমি।
তিনি বাবাকে দেখতে পারছেন বৈতরণীর অপর প্রান্তে।
কন্যা কান্নার সুরে বলছেন_
"আর দেখতে পাবো না তোমায়!
আর কথা হবে না কোনোদিন!
বসন্তের স্বপ্নের ভেতর
পাখিডাক হুহু করে বাবা
জানি তুমি আমায় শুনতে পাচ্ছ
আমি তোমাকে"
এই শব্দশেল,এই আকুতি প্রবল ছুঁয়ে যায় আমাদের।
নিজে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে আমাদেরকেও
খুব ভিজিয়ে দিতে থাকেন রিমি দে।
এখানেই তো তিনি কবি হিসেবে তার জাত চিনিয়ে দেন।
"শহরতলি"খুব যত্ন করে বইটি প্রকাশ করেছে।
খুব চাইছি,বইটি পাঠকপ্রিয় হোক।
৬.
রিমি দে আর আমি একই দশকে লিখতে এসেছি।
আমরা অনেক ঘাত প্রতিঘাত ঝড় বৃষ্টি পেরিয়ে আজও ভালো বন্ধু।
কবি রিমি দের জন্য শুভেচ্ছা ও আন্তরিক শ্রদ্ধা রইলো। সে আগামীতে অনেক কাজ করুক।

Comments

  1. সুব্রত ভট্টাচার্যSeptember 8, 2023 at 8:26 PM

    খুব সুন্দর আলোচনা l ভালো লাগলো l

    ReplyDelete

Post a Comment