গদ্য- সুব্রত ভট্টাচার্য



কবি স্মরণ – ঘরে, বাইরে


  

    একটা মানুষ, তাকে ঘিরেই বেঁচে থাকে একটা জাতি।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছোটবেলায় রচনা বই থেকেই আকর্ষণের শুরু। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আকর্ষন আরও বেড়েছে। কবিগুরুর সাথে যোগ আমাদের শৈশব থেকে শুরু করে কৈশোর, যৌবন পার করে বার্ধক্য পর্যন্ত। প্রতিটি ঋতুতে তার সৃষ্টির কথা মনে করিয়ে দেয়। তার সঙ্গীতেই আমরা আনন্দ ভাগ করে নিই, আবার দুঃখ বিষাদের সময় আমাদের শক্তি যোগায়। পরিবারের মানুষ এবং প্রিয়জনেরা তাকে ঘিরেই এক হয়ে যেতে পারি কোনও অনুষ্ঠানে। 


    এখনও বাঙালি বাড়িতেই থাকতে হবে তার একখানা ছবি। বৈশাখ মাস আসলেই শোনা যায় রবীন্দ্র জয়ন্তীর প্রস্তুতি। ছোট বড়, মাঝারী কত রবীন্দ্র জয়ন্তী যে দেখেছি বাড়ীতে, স্কুলে, পাড়ার ক্লাবে, সরকারী আর বেসরকারী অনুষ্ঠানে। এখনও শহরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের গান বা নাচের দৃশ্য দেখে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে।  



  চাকুরীসূত্রে বেশ কিছু বছর অসমে ছিলাম। অসমে বিভিন্ন ভাষা ভাষী মানুষের বাস। বছরের বিভিন্ন সময়ে তাদের উৎসব অনুষ্ঠান। সব সম্প্রদায়ের মানুষই এই উৎসব গুলি উপভোগ করেন। দক্ষিণ অসমের বরাক উপত্যকায় বাংলাভাষী মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ। শিলচর, করিমগঞ্জ, বদরপুর ইত্যাদি অঞ্চলে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালিত হয় বাংলার মতই। 


   ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাংলা ভাষী মানুষের সংখ্যা কম। যেসব এলাকায় বাংলাভাষী মানুষ রয়েছেন, সেখানে ছোট মাঝারী বা একটু বড় করেই পালিত হয় রবীন্দ্র জয়ন্তী। অন্যান্য ভাষাভাষী অনেক মানুষও অংশগ্রহন করেন।  


   গুয়াহাটি শহরে পাণ্ডু, মালিগাও, ভাস্কর নগর, কালাপাহাড়, ওদাল বাক্রা  ইত্যাদি অঞ্চলে অনেক বাংলাভাষী মানুষ বাস করেন। সেখানে কবিগুরুকে স্মরণ করে সপ্তাহব্যপী অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। বর্তমানে ইংরেজী মাধ্যমে পড়ার সুবাদে ছোটদের উৎসবের উপর আকর্ষণ কমেছে। তবুও কিছু অভিভাবকের উৎসাহে নিজস্ব সংস্কৃতি ধরে রাখার চেষ্ঠা চলছে।


    অসমের বিভিন্ন জেলা এবং মহকুমা শহর যেমন বঙ্গাইগাও, কোকরাঝার, ধুবরী, তেজপুর, ঢেকিয়াজুলি, নগাও, লামডিং, তিনসুকিয়া, ডিব্রুগড়, ডিগবয়  ইত্যাদি শহরে বাংলাভাষীরা রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করেন। অন্য ভাষার কিছু মানুষও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। 


    বর্তমানে শহরে তৈরী হয়েছে বেশ বড় বড় আবাসন। সেখানে বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ বাস করেন। অনেক বড় আবাসনেই বিভিন্ন উৎসব আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হয়। যেমন বিহু, উরুকা, রবীন্দ্র জয়ন্তী, ঈদ, বড়দিন ইত্যাদি। সব ভাষাভাষীর মানুষ এই সব অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। এভাবে রবীন্দ্রনাথও পৌঁছে যান সাধারণ মানুষের মধ্যে।  


      অনেক অসমীয়া কবি, সাহিত্যিক ভীষণ রবীন্দ্র অনুরাগী। রবীন্দ্র সাহিত্যের অনেক কিছুই তাদের পড়া। গুয়াহাটির বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী প্রয়াত দিলীপ শর্মা খুব ভালো রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন। অসমীয়া অনুবাদে তার ভরাট কন্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত – পুরানো সেই দিনের কথা, এ  মনিহার আমায় নাহি সাজে, হে নুতন দেখা দিক আরবার...  অনেক বার শোনার সৌভাগ্য হয়েছে।  


     গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক প্রয়াত সুভাষ দে স্থানীয় ছেলেমেয়েদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর অনুষ্ঠান নিয়মিত করতেন। অনেক শিল্পী তিনি তৈরী করেছিলেন। পত্র পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি তিনি করতেন। তার অকাল মৃত্যুতে বাংলা সাংস্কৃতিক জগতের ভীষণ ক্ষতি হয়েছে। তার প্রতিষ্ঠিত স্কুল ‘আনন্দধারা’ পাণ্ডুতে কম সংখ্যক ছাত্রছাত্রী নিয়ে এখনও চলছে। 

   

    সারা বছর বাংলাভাষীরা রাজ্যে, রাজ্যের বাইরে অথবা দেশের  বাইরে নিজেদের কাজকর্ম নিয়ে ব্যাস্ত থাকেন। বৈশাখ মাস আসলেই রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে তাদের অস্তিত্ব ফিরে পাবার চেষ্টা করেন। ধুলো ঝেরে নামানো হয় হারমনিয়াম, রবীন্দ্রনাথের বই। শুরু হয় একক, সমবেত সঙ্গীত, আবৃত্তির আয়োজন। কখনও বা গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্যর আয়োজনও। এ সব অনুষ্ঠান থেকে ছোটরাও জানতে পারে তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়।  


     প্রতিবেশী দেশ ‘বাংলাদেশ’ যা কবির স্বদেশও বটে, সেখানেও মহা উৎসাহে পালন হয় রবীন্দ্র জয়ন্তী। ভারতবর্ষের বাইরে আমেরিকা, লন্ডনে  ভারতীয় এবং বাংলাদেশের অনেক বাঙ্গালীর বাস। এ সময় তাদের ভেদাভেদ ঘুচে যায়। তারা সকলেই বাঙালী। একসাথে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনের দৃশ্য ছড়িয়ে যায় বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে।


    অসমে এবছর সরকারী উদ্যোগে কেন্দ্রীয় ভাবে পালিত হলো রবীন্দ্র  জয়ন্তী। বিভিন্ন শহরে ছোটদের এবং বড়দের প্রতিযোগিতা হলো। অনেক মানুষ উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে অংশগ্রহন করেন। অনুষ্ঠান সুশৃঙ্খল ভাবে শেষ হয় গুয়াহাটি, প্রাগজ্যোতি আই টি এ কমপ্লেক্সে।  অনেক ধন্যবাদ প্রাপ্য রাজ্য সরকার এবং আয়োজকদের। 


   কলকাতা মহানগরীর লোকাল ট্রেনের নিত্যযাত্রীরা সম্প্রতি উদযাপন করলেন একটি ব্যাতিক্রমি ও অভিনব ধরনের রবীন্দ্র জয়ন্তী অনুষ্ঠান। শহরতলীর সকাল ন টার হাবরা শিয়ালদহ লোকালে যাত্রীরা গত  ২৫শে বৈশাখ  ট্রেনের কামরাতেই পালন করলেন রবীন্দ্র জয়ন্তী। এমন অনুষ্ঠান নাকি তাঁরা করে চলেছেন গত ছ- সাত বছর ধরে। নিত্যযাত্রীরা ট্রেনের কামরা সাজিয়ে গুছিয়ে কচি কাচাদের নিয়ে নাচে, গানে কবিগুরুকে স্মরণ কলেন। এভাবেই বেঁচে থাকুন কবিগুরু মানুষের মনে।  



ছবি : ইন্টারনেট l

Comments

  1. অতি সুন্দর এই লেখাটি পড়ে আমি নিজেও অবাক হয়ে গেলাম। প্রায় দীর্ঘ চার দশক চাকরিসূত্রে অসমে বাস করেও আমার এত কিছু জানা ছিলনা। লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ। তার আরো অনেক লেখা পড়ার আশা রাখি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ দাদা l ভালো থাকবেন l

      Delete

Post a Comment