সমস্ত বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল জুড়ে নিয়মিত চলছে কবিতাচর্চা। কবিতা নিয়ে প্রবল স্বপ্ন দেখা। বাংলা কবিতা লেখা হচ্ছে প্রান্তে প্রান্তে। অন্তর্জাল এবং মুদ্রিত পত্রিকার মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে পাঠকের কাছে। সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যেও কিছু ভালো আর সৎ কবিতার মুখোমুখি দাড়াতে পারছি আমরা। কত প্রানবন্ত নুতন কলম নুতন কবিতা লিখছেন। পাঠক হিসেবে আমি সমৃদ্ধ হচ্ছি। আমাদের এই উত্তর জনপদ জুড়েও অনেক তরুণতম কবি খুব নিবিড়তা নিয়ে লিখে চলেছেন বাংলা কবিতা।
তেমনই কিছু কবিকে নিয়েই এই লেখা লিখছেন
কবি সুবীর সরকার। আজ চতুর্দশ কিস্তি।
১.
ছেঁড়া তারে ভিজে যায়
অগোছালো সকালগুলো
চিলেকোঠায় রং মাখে
গোধূলি আলাপ ।
দগ্ধ শ্রাবণের আঙিনায়
রাশভারি মেঘজুড়ে
ক্লান্তিহীন অপেক্ষায়
পূরবী সুরে ব্যস্ত বসন্ত বিলাপ ।
নির্ভার স্বপ্নের কথারা
দুদ্দার জলছুট
সময়ের পাতা ভরে
বিশুদ্ধ কার্বন
শহরের রোদেলা রাতে
অতলান্ত পথ বেয়ে
ধোঁয়া ওঠা পেয়ালায়
এক চুমুক সমর্পণ ।
২.
নিরুদ্দেশের তালিকা অনেক লম্বা
চেনা ঘরদোর, চেনাশোনা আপনপর;
ঝুলবারান্দা পেড়িয়ে লম্বা চাতাল
স্কুলগাড়ির ভিড়ে একরাশ হাসির সকাল,
পোড়া কাঠামোর বুকচিরে এক ছাইচাপা দীর্ঘশ্বাস
কঙ্কালসার শহরময় সুর শুধু সাইরেন !
আত্মরক্ষায় মিশে যায় বিচ্ছেদ,
কার্ফু ঘেরা দিনে রাজহাঁসের মিছিলে
ঝরে-পড়া একবুক শুভ্র আশায়
আমাদের উত্তরণ হোক সিদ্ধার্থের পথে...
৩.
আঁকাবাঁকা চলনে হোক
কিংবা সরলরৈখিক আকারে
সুদীর্ঘ অতীত হতে বহমানতা
ক্রমাগত নতুনত্বের সন্ধানে
অন্বেষণ শুধু অন্বেষণ
অব্যাহত এক লড়াইয়ের গল্প।
সুনিপুণ কৌশলে শিল্পী করে যায় কর্ম
অস্ত্র হাতে সৈনিক চাপায় বর্ম ,
পর্যায়ক্রমিক উত্থান পতন অবশ্যম্ভাবী ।
তবুত্ত কিছু দ্বন্দ্ব
অভন্ত্যরীন লাভাস্রোতে
অনবরত আড়ালে আবডালে
ময়দান অবধি যায় না পৌছে
চলে অন্তহীন সমান্তরালে
রামধনু রঙ মাখে রোদ্দুর
আমার পাড়া তোমার পাড়া
পার হয়ে শীত পাড়ি দেয়
সাত সমুদ্দুর।
ছিল তাড়া খুব তাড়াতাড়ি
অজানার সফরে শুধু তুমি আজ
সময়ে জমেছে স্মৃতির পলি
পিছে পড়ে আছে ভাঙা বালিয়াড়ি ।
দিগন্তের প্রান্তে খেয়া
দূরে সরে যাচ্ছে নদী পাহাড়
তুমিহীন তোমাতেই
অনেকটা পাওয়া ।
তোমার গল্পে আজ তারাদের সাতকাহন
মিলে যাব জানি একদিন
বিরতিতে এভাবেই চলমান
শব্দের প্রিয় অবগাহন।
৪.
দিন এসেছে বদলের
অভ্যাস পাল্টে স্বাভাবিক নতুনত্ব
অবারিত দ্বারে পুরোনো যাতায়াতে
বহাল হয়েছে নতুন শর্ত।
জানাশোনা বেশভূষা হয় অজানা
বর্ম দিয়েছে ঢেকে
ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলে
বার্তালাপ দূর থেকে।
চলমান জীবন্ত বসুধাকে
“অতিমারী করোনা” করেছিল কব্জা ।
নিরলস সৈন্যদলের অক্লান্ত শ্রম
অবশেষে উড়িয়েছে জয়ধ্বজা।
“লকডাউন” টু“আনলক”
আবার ফিরছে ধরিত্রী কোলাহলে
সংক্রমণের ভয়াল থাবা
আটকে গেছে হাত সাফাইয়ের জালে!
রুজিরুটি সন্ধানে
হয়ে পরবাসী নিজভূমে
পথ অফুরান সড়ক রেলে
হারিয়েছে বহুচোখ চিরঘুমে।
তালাবদ্ধ ক্লাসঘরে
ধূলিমলিন বেঞ্চি
আগাছায় পড়েছে ঢাকা
ফুলেদের সতরঞ্চি।
বিপর্যয়ের তস্ত্র হানায়
কণ্টকিত পথে
আমাদের যান যাবে এগিয়ে
প্রতিনিয়ত নতুন শপথে।
৫.
গল্পের ছবি আর ছবির গল্প কখনও বেরঙিন
আবার কখনও রঙ মাখে অল্প।
ঢেউ-এর গভীরে জমে যাওয়া
ছোটোবেলা যখন ফসিলস
গুটিয়ে আনা বিনিসুতোয়
কয় কদম আব্বুলিস।
পলেস্তারা খসে সাতমহলার
হাড়-জিরজিরে কাঠামোর’পরে
মেঘেদের আনাগোনা অকপট
হিসেবের ধার বাকি জমা রাখে অহর্নিশ ,
শ্রাবণধারায় তখন বসন্তদিন
আর বাকিটুকু বকশিস ।
৬.
বিশ্ব জুড়ে উঠেছে রব
মরণদোলায় মুহূর্মুহূ বাড়ছে শব
একের থেকে দুই- তিনে বিষ মিশছে নিঃশ্বাসে,
মুখের আড়াল মুখ খুঁজছে মুখ ঢেকেছে মুখোশে।
যতই হোক ঘরের শিকল নয়কো এটা বন্দীযাপন
হাজার বছর থাকুক বেঁচে সবার প্রিয়জন
জীবন পথে জীবন বোধে লড়ছে যারা অহর্নিশ
ঋণের বোঝা ভীষণ ভারী তবুও জানাই লক্ষ কুর্নিশ।
মানের বড়াই করছ বড় ফেরেনি যে এখনো হুঁশ
জোরের সাথে বেড়াও বলে তোমরাই মানুষ !
সর্বনাশের বাড়ছে প্রহর বাজছে বিপদ ঘন্টা
“করোনা” আর নয়তো একা দোসর হয়েছে “হান্টা”।
প্রতি ফোঁটায় বাড়ছে বংশ রক্তবীজের
সাবধানতা মানলে তবেই আটকে যাবে ক্ষতি নিজের।
শান দিয়েছে অস্ত্রে চুপিসারে আক্রমণ
একান্তরের দিন এসেছে ভিড়ের মাঝে সংক্রমণ ।
উড়ছে শকুন আকাশ ধারে নিচের ভাগার শুধুই শূন্য
চিন্তার ভাঁজ কপাল জুড়ে কাল কিভাবে জুটবে অন্ন ?
যতই দেখাক দম্ভ দাপট করুক শত আস্ফালন
বিজ্ঞানের “সুদর্শন”এ হবেই তার সমাপন।
চাষার মতো আশার বুনন কাটবে যবে দুঃস্বপ্নের রাত
আবার তোমায় জানাবো প্রভাত হাতে রেখে হাত।
৭
আমাদের আয়নায় রোজ
চাঁদ ভেঙেচুরে যায়
বাদাবন বালুচর ডোবায়
লবনাক্ত স্রোতে আর শিরার ধারাস্নান
গুন গুন করে জমা হয় দোষের গুনীতক!
তবুও পৃথিবীর কোল জুড়ে স্বপ্নেরা আজও
রাজপথে মিছিল নামায়
সীমানার দিকচিহ্নে নির্ভার বসন্ত ফুল
সুভাষিত কুহুতানে লেখা রবে মুখরিত ইতিহাস
গোলাপি-নীলের ব্যাবধান মুছে গিয়ে হাতে হাত বারোমাস।
৮.
বাসন্তী গৈরিকের সমারোহে
কয় টুকরো সবুজের
আশ্চর্য রঙমিলান্তি!
রবিবাসরীয় আলাপনের ভিড়ে
অস্থি মজ্জা পার হয়ে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে
পৌঁছে যায় এক অলিখিত বার্তা
আঁচল জুড়ে হলুদের ছোপে মা এর গন্ধ
দুই বাটি ভাতঘুম হোক না উদ্বৃত্ত, ক্ষতি কি?
আমার রাতজাগা প্রহরে এই তো সম্বল
যেই ঘ্রাণটুকু লেগে রইল ধরলা পাড়ের বাতাসে।
সম্মানিত পাঠক,উপরের এই ৮ টি কবিতা বারবার পাঠ করেছি আমি।এবং প্রতিটি পাঠ আমাকে এক নুতন পাঠক হিসেবে রূপান্তরিত করেছে।
কবিতা কি!
আমরা কবিতা থেকে কি পাই!
এসবের কোন যথার্থ উত্তর তো আদতে নেই!
এটুকুই বলতে পারি কবিতা আমাদের জীবনের গল্পগুলিই আসলে বারবার শোনায়।শোনাতেই থাকে।
এই কবিতাগুলি লিখেছেন তরুণ প্রজন্মের কবি শতাব্দী সাহা।
কুচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ মহকুমার সীমান্ত কেন্দ্র চেংড়াবান্ধায় শতাব্দীর জন্ম যাপন বসবাস।
এখান থেকেই সে বাংলা কবিতা নিয়ে অনর্গল স্বপ্ন দেখেছে।দেখেই যাচ্ছে।
এবং শতাব্দী কবিতায় ডুবে যাচ্ছে। নিমজ্জিত হচ্ছে।
শতাব্দীর কবিতার এক অদ্ভুত সুর,মেজাজ,স্বতন্ত্রতা যা তাকে আগামীতে অসম্ভব এক ধারালো কবি হিসেবে তুলে ধরবে হয়তো বা!
দেশ কাল সময় প্রেম আবেগ ব্যর্থতা জীবনমায়া_কি তীব্র হয়ে ছড়িয়ে পরে কবির কাব্য ভুবনের আনাচে কানাচে।
শতাব্দীর কবিতা জুড়ে এক অদ্ভুত রহস্যের কুয়াশা।
সে অনেক পরিণত।
তার ভেতরের চোখ অসম্ভব ধারালো।
নিজের যত্ন নিতে পারলে শতাব্দী আমাদের আগামীর উজ্জ্বল মুখ হবে নিশ্চিতই।
Comments
Post a Comment