বই কথা - সম্রাট সরকার




চিরায়ত মৈশাল




খুব সম্প্রতি হাতে এল কবি সুবীর সরকারের দুটি কবিতার বই। প্রথমটি হিলকার্ট রোডের মাস্তান (প্রকাশক – বান্ধবনগর) ও দ্বিতীয়টি মহড়াকক্ষ (প্রকাশক – নেটফড়িং)।


দুটি বইতেই সেই পুরনো সুবীরের – আজ থেকে কুড়ি বছর আগের সুবীরের ঝলক পেয়েছি। তবে একেবারেই হুবহু এক নয়। আগেকার পেলবতা আর ফিরবার নয়। তবুও সেই তরুন সুবীরের কবিতাভাষা গত দশ বছরে যে আপাত-রুক্ষতা ও সুতীক্ষ্ণতার দিকে বাঁক নিয়েছিল সেই পোড়খাওয়া কলমের ধারালো শ্লেষাত্মক উচ্চারণ অনেকটা শান্ত আর জমাটবদ্ধ। এই দুটি বইয়ের কবিতা উত্তরের প্রতি তার চিরায়ত ভালোবাসার, উত্তরের বিবিধ চিহ্ন-সূচককে ঘিরে তার চিরপরিচিত মগ্নতা অত্যন্ত মায়াময় ভাবে বহন করেছে।



প্রথমে আসি ‘হিলকার্ট রোডের মাস্তান’-এর কথায়। সাকুল্যে তেরোটি কবিতায় সাজানো বইটিকে কবিতা পুস্তিকা বলা যেতে পারে। প্রথম কবিতাটির নামই ‘হিলকার্ট রোডের মাস্তান’। এবং ‘মহড়াকক্ষ’-এরও প্রথম কবিতাটি কাব্যগ্রন্থের শিরোনামে নামাঙ্কিত। খুব মজার কথা এই যে, আমার জানা মতে এই দুটি বই সুবীরের প্রথম যেখানে সূচনা-কবিতার শিরোনাম কাব্যগ্রন্থের নাম হয়ে উঠেছে। আপনারা হয়ত খেয়াল করেছেন একাধিক কব্যগ্রন্থে সুবীর তাঁর শেষ কবিতাটির শিরোনামকে বেছে নিয়েছে কাব্যগ্রন্থের নাম হিসেবে। এখানে একটু ব্যতিক্রম। 


এবার প্রশ্ন কোন কবিতার শিরোনাম কবি নির্বাচন করবেন কাব্যগ্রন্থের নাম হিসেবে, বা আদৌ করবেন কিনা – নিশ্চিতভাবে সেই নির্বাচন কবির নিজস্ব অভিপ্রায় - এ আর এমন কি বড় ব্যাপার। কিন্তু এটা স্বীকার করে নেওয়া ভালো -  পাঠক বিশেষ ভাবে খেয়াল করেন সেই কবিতাটিকে যে কবিতাটির শিরোনাম কাব্যগ্রন্থের শিরোনামে উন্নিত। সেই কবিতাটিই কি বহন করছে সমগ্র কাব্যগ্রন্থের মূল ভাবনাবিন্দু? এই চিন্তা এসে যায়। আজকাল যেখানে প্রারম্ভেই বিভাব কবিতার চল একেবারেই উঠে গেছে। আর সুবীর তো কোনদিন বিভাব কবিতা লেখেনি বইয়ের শুরুতে। সেখানে উল্লিখিত কবিতাটিকে যদি বইয়ের এক্কেবারে শুরুতেই পেয়ে যান, পাঠকের চিন্তার একটা অভিমুখ প্রথমেই নির্মাণ হয়ে যাওয়ার প্রবনতা তৈরি হয়। সুবীরের ক্ষেত্রে এটা অভিনব তো বটেই।  


তবে ‘হিলকার্ট রোডের মাস্তান’-এর প্রথম কবিতাটি নির্দিষ্ট কোন ভাবনাপ্রবাহের সূচনামুখ তৈরি না করলেও শৈলীপ্রবাহ তৈরি করে দেয়। মনে পড়ে যায় আজ থেকে দুদশকেরও বেশি আগে লেখা ওর একটি কবিতার কথা। ‘ক্যাপ্‌টেন অথবা জাহাজডুবির গল্প’-এর কথা (কাব্যগ্রন্থ  - ‘সাদা ঘোড়া ও লোকপুরাণের কবিতা’)। জাহাজডুবির পর উপকূলবর্তী এক গ্রামে এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো ক্যাপ্টেনের কথা। তিনি অবশেষে ফিরে যান আবার সমুদ্রে, জাহাজে। সেখানেও সেই ক্যাপ্টেনের মধ্যে সে নিজেকে খুঁজে বেড়িয়েছিল। এখানেও হিলকার্ট রোডের সেই মাস্তান আদপে স্বয়ং কবিকেই বহন করে। ‘তাচ্ছিল্য আর বিদ্রুপ’কে মিশিয়ে শুরু হয় আত্মনির্মাণ। মাস্তান গরিমা। 


কাব্যগ্রন্থে একাধিকবার এসেছে ‘কাঠের বন্দুক’ প্রসঙ্গ। ‘খোঁপার কাঁটা’ যদি হয় সুবীরের প্রেমের প্রতীক, আসক্তির প্রতীক, যৌনতার প্রতীক তবে ‘কাঠের বন্দুক’ অবশ্যই তার উত্তরযাপনের, আবহমানের প্রতীক। উত্তরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সে প্রাচীন জমিদার-জোতদারদের কুঠিতে ঘুরে বেড়িয়েছে। দেওয়ালে দেখেছে ‘কাঠের বন্দুক’। ধ্রুপদী বন্দুক তাকে নিয়ে যায় শিকারের অনুষঙ্গে। মায়াময় ঘোরের মধ্যে পড়ে যায় সুবীর। বহুকাল আগের পদুমোহন বরাইকের কথা ফিরিয়ে নিয়ে আসে কবিতায়।  


পাঠক নিশ্চই খেয়াল করবেন কবিতাগুলোয় দাঁড়ি ছাড়া অন্য যতিচিহ্ন তেমন নেই। খুব কম রয়েছে বিষ্ময়বোধক চিহ্ন। আর অন্য কোনো যতিচিহ্ন অনুপস্থিত। বিবৃতিধর্মিতার ইঙ্গিত আরো বেশি মাত্রায় ঢুকে পড়েছে এই পর্যায়ের কবিতায়।


একটিই কবিতা আছে উত্তরবঙ্গে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া এক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তাছাড়া বাকি সব কবিতা পড়ন্ত বিকেলে নরম আলোর মত। যে আলো এখন নির্জনে গা এলিয়ে শুয়ে থাকে উত্তরের নদীবক্ষে। যে বিকেল বয়ে যায় খোঁপা ও খোঁপার কাঁটার দিকে অপলক শান্ত তাকিয়ে। সুবীর তার বিক্ষত হৃদয় নিয়ে প্রবেশ করে মহড়াকক্ষে। ‘নতুন এক ইনিংস’ শুরু হয়।   


‘মহড়াকক্ষ’ সাজানো তেরোটি কবিতা দিয়ে। যদিও ‘মহড়াকক্ষ’ একটু আগে প্রকাশিত। ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে। ‘টাইটেল সঙ’ শিরোনামের কবিতাটি দুটি বইয়েই মুদ্রিত। পঙক্তির বিভাজন কিছুটা আলাদা। ‘মহড়াকক্ষ’ শিরোনামে দুটি আলাদা কবিতা আছে বই দুটিতে। 


আমি এগেও লিখেছি সুবীরের সমশিরোনাম্নী বহু কবিতা আছে। অন্য কবিদের তুলনায় অনেক বেশি। অথচ খুব স্বাভাবিক লাগে আমার কাছে। সেই স্বাভাবিকতা এই দুটি বই পড়ার পরে আরো গভীর ভাবে প্রবেশ করেছে আমার পাঠক মনে। এই পর্যায়ের সুবীর পুরোপুরি দৃশকল্প নির্ভর পঙক্তি রচনা করে চলেছে। ওর দৃশ্যকল্পের দৈর্ঘ্য আগের থেকেও হ্রাস পেয়েছে - বস্তুত অনু-দৃশ্যে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি বাক্যবন্ধের পরিসর খুব স্বল্প এবং তারই মধ্যে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নির্মাণ করেছে সেই সব অনু-দৃশ্য। একাধিক অনু-দৃশ্য জুড়ে তৈরি হয়েছে কবিতার অবয়ব। সেই সব অনু-দৃশ্যের মিলিত রেশ প্রাণ সঞ্চার করছে সে অবয়বে। সেই সব অনু-দৃশ্যের উপাদান, কুশীলব হল উত্তরের আবহমান, সুবীরের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সিক্ত হৃদয়। সমস্ত কবিতাগুলো যেন একটাই কবিতা। সাম্প্রতীক যেন একটাই কবিতা লিখে চলেছে সুবীর।   

Comments