গল্প - সুব্রত ভট্টাচার্য


               

দূরত্ব


        মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার পর প্রায় পনরো দিন পার হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে  বেশীরভাগ ছাত্রই তাদের মার্কসীট এবং ক্যারেকটার  সার্টিফিকেট নিয়ে গেছে স্কুল থেকে। শুধুমাত্র তিনখানা ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট  রয়ে গেছে স্কুলে।


      দয়াময় সরকার উচ্চতর বিদ্যালয়ে এবারে বেশ খুশীর হাওয়া। গত বছরের চেয়ে রেজাল্ট এবারে অনেকটা ভালো হয়েছে। মাধ্যমিকে দুটো সেকশান মিলিয়ে আশি জন ছাত্র এবারে পরীক্ষা দিয়েছিলো। প্রথম বিভাগে পাশ করেছে চল্লিশ জন। স্টার মার্কস পেয়েছে ছয় জন ছাত্র।  মাত্র দুজন ছাত্র ফেল করেছে। ছাত্র , শিক্ষক এবং অভিভাবক মহলে বেশ খুশীর হাওয়া। অভিভাবকরা স্কুলের হেডমাস্টার মশায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।


         স্কুলের হেডক্লার্ক  অবনীবাবু সার্টিফিকেট  গুলো মিলিয়ে দেখছিলেন  রেজিস্টারের সাথে। একটু পরেই স্কুলের অফিস রুমে এসে পৌঁছুল  স্কুলের ছাত্র অসীম রায়। অসীম এ বছরেই মাধ্যমিক পাশ করেছে স্কুল থেকে। প্রথম বিভাগে ভালো নম্বর নিয়ে ও পাশ করেছে। অসীমেরও ক্যারেক্টার সারটিফিকেট নেওয়া হয়নি। 


          অফিস রুমে ঢুকে অবনীবাবুকে অসীম বলল --- গুড মর্নিং স্যার, কেমন আছেন ? আমার ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট টা নেওয়া হয়নি। সেটাই নিতে আসলাম । 


          মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হবার পরদিন হেডস্যার অবনীবাবুকে ডেকে দুজন ছাত্রের নাম বলেছিলেন। যেন তাদের  ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দেবার আগে হেডস্যারের সাথে আলোচনা করা হয়। 

            অবনীবাবু অসীমকে বসতে বলে রেজিস্টার নিয়ে হেডস্যারের সাথে দেখা করতে গেলেন। হেডস্যার রেজিস্টার দেখে অবনীবাবুকে বললেন ছাত্রটিকে  কিছুক্ষন অপেক্ষা করার জন্য। সময় হলে তিনি ডেকে নেবেন। 


     এমন একটা পরিস্থিতিই  অসীম চিন্তা  করেছিলো  এবং সেজন্যই কদিন দেরী করে আসা । একটা ঝড়ের পূর্বাভাষ পেল অসীম। অসীম অফিস রুমেই অপেক্ষায় রইলো ।  


       দয়াময় সরকার উচ্চতর বিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা এখন আটশো। অতীতে স্কুলের বিশেষ সুনাম ছিল না। যারা পড়তে আসতো তারা বেশিরভাগই আশে পাশের অঞ্চলের ছাত্র। বাড়ীতে তাদের পড়াশোনার গুরুত্ব তেমন নয়। পরীক্ষার ফলও তেমন ভালো হতো না । কিছু ছাত্র মাধ্যমিক পর্যন্ত পৌঁছুতে পারতো না ।প্রতি ক্লাসেই কিছু ছাত্র ছিলো ভীষন উশৃঙ্খল। শিক্ষকেরা ছাত্রদের ভেতর শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করতেন । কিন্তু সব সময় যে সফল হতেন বলা যায় না। অপমানের ভয়ে কিছুটা এগিয়ে তাদের থেমে পড়তে হতো। 


     জগন্নাথ বোস প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেবার পর স্কুলের বেশ পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। ক্লাসগুলো নিয়মিত হচ্ছে । কেউ অনুপস্থিত  থাকলে তিনি ডেকে খবর নিচ্ছেন। শিক্ষক এবং ছাত্রদের অসুবিধাগুলি তিনি দেখছেন।  সরকারি দফতরের সাথে যোগাযোগ  করে স্কুলভবনের অনেক জায়গায় সংস্কার করা   হয়েছে। পুরোনো আসবাব পাল্টিয়ে অনেক আসবাব নতুন হয়েছে। খাবার জল, নতুন টয়লেট, লাইব্রেরীর উন্নতি হয়েছে। স্কুল ছেড়ে যাওয়া ছেলেদের সংখ্যা কমেছে। নিয়মানুবর্তিতা বেড়েছে।  


            জগন্নাথবাবু স্কুলে কঠোর অনুশাসন চালু করেছেন । কারোও বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তিনি ক্লাস টিচার সমেত ছাত্রটিকে ডেকে আনেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন। 


           এক বছর আগে ক্লাস টেনের চার জন ছাত্রকে বেশ কড়া শাস্তি দিয়েছিলেন হেডস্যার । তারা স্কুলের পাশেই এক বাড়ী থেকে না বলে  অনেক আম পেড়ে নিয়ে এসেছিলো। তারপর সে বাড়ীর মালিক স্কুলে অভিযোগ জানায়।  তাদের দলে ছিলো অসীম এবং আরোও তিন জন। অভিভাবকদের ডেকে  নিয়ে এসেছিলেন স্কুলে। 


      মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হবার কয়েকদিন পর হঠাত রাতে হেড স্যারের বাড়ীতে চার পাঁচ খানা ঢিল পড়ল। ব্যাপারটায় আতংকিত হলো অনেকেই। হেডস্যার বাইরে এসে আলো নিয়ে দেখবার চেষ্টা করলেন । কিন্তু কাউকেই দেখা গেল না । পরদিন সকালে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে , হেডস্যার বাড়ীর সামনেই  দেখতে পেলেন দুই ছাত্রকে। অসীম আর অশোক, তারা দুজনেই এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। এদের দুজনকেই এক বছর আগে কঠিন শাস্তি দিয়েছিলেন। হেডস্যারের মুখোমুখি হতেই দ্রুত সাইকেল চালিয়ে চলে গেলো অসীম আর অশোক।  


          হেডস্যারের একটু সন্দেহ হলো, তবে কি কাল রাতের ঢিল মারার কান্ডটি ঘটিয়েছে অসীম  আর অশোক ? সেজন্য ভোর বেলা দেখতে বেরিয়েছে গতকালের ঘটনার ফলাফল কি?  অন্য ছাত্রদের দিয়ে স্যার খবর দিয়েছিলেন অসীম  আর অশোক কে স্কুলে  দেখা করতে। কিন্তু তারা কেউ দেখা করতে আসেনি । 


         কিছুক্ষন অফিস রুমে অপেক্ষা করার পর অসীমের ডাক আসলো হেডস্যারের রুম থেকে। অসীম দুরু দুরু বক্ষে হেডস্যারের চেম্বারে প্রবেশ করলো। স্যার মাথা নীচু করে কিছু কাজ করছিলেন। মাথা তুলে দেখে  অপেক্ষা করতে বললেন। অসীমের দিকে চাইতেই অসীম বলল --- স্যার ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট নিতে এসেছিলাম। হেডস্যার বললেন --- নিশ্চয়ই পাবি। তোর যেমন ক্যারেক্টার তেমনই সার্টিফিকেট পাবি। অসীমের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেলো। অনেক রকম দুর্ভাবনা তাকে চেপে  ধরলো।  


    হেডস্যার বলতে লাগলেন --- বুঝলি যেদিন আমার বাড়িতে চারটা ঢিল পড়ল, মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলো । এত বছর শিক্ষকতা করার এই কি পুরস্কার? আমরা এত ছাত্র তৈরী করি। আমরা চাই আমাদের ছাত্ররা জীবনে সফল হোক  তার সাথে ভালো মানুষ হোক। খুব চিন্তা করলাম একজন শিক্ষকের বাড়িতে কে ঢিল ছুড়তে পারে। 


        তোদের নাম সেদিন আমি ভাবতে পারিনি। কিন্তু পরদিন সকালে তোদের আমার বাড়ির সামনে দেখে এবং দ্রুত সাইকেল চালিয়ে চলে যেতে দেখে সন্দেহ হয়। পরে এর পেছনের কারনগুলো চিন্তা করে সন্দেহ আরোও দৃঢ় হয়। 

   

        অসীম মাথা নীচু করে সব শুনে যাচ্ছিল । উত্তর দেবার কিছুই খুঁজে পাচ্ছিল না। ব্যাপারটা অসীম আর অশোক উত্তেজনার মুহূর্তে করে ফেলেছিলো।  দুষ্কর্ম করার পর অসীম আর অশোকের অনুশোচনা হয়েছিলো। কিন্তু স্যারের কাছে গিয়ে স্বীকার করার মতো সাহস তাদের হয়নি। ওরাও ভেবেছিলো সময়ের সাথে সাথে স্যারও ভুলে যাবেন। 


    স্যার বললেন – আমরা যে তোদের শাসন করি , সেটা কি তোদের খারাপের জন্য ?  নীরবতা ভেঙ্গে অসীম বলল --- স্যার , ভীষন অন্যায় হয়ে গেছে । এবারের মত ক্ষমা করে দিন। 

         স্যার কিছুক্ষন চুপ করে থাকলেন , তারপর বলতে শুরু করলেন ---ভুলটা কি সত্যিই বুঝতে পেরেছিস?  আমরা চাই তোরা জীবনে যেন বড় হতে পারিস, মানুষ হতে পারিস। অসীম স্যারের পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করার চেষ্টা করল, কিন্তু পা পর্যন্ত পৌঁছুতে পারল না। আবার সামনে এসে দাঁড়ালো। স্যার চুপ করে খানিকক্ষণ বসে থাকলেন।  স্যারকে দেখে বোঝা গেল না তিনি অসীমের ব্যাপারটা নিয়ে কি ঠিক করলেন।  স্যার ফাইল খুলে আরোও দু একটা কাজ করলেন। একটু পরে মনে হলো তিনি খানিকটা শান্ত হয়েছেন। বললেন – তাহলে বুঝতে পেরেছিস, যে তোদের ভুল হয়েছিলো। 


          মাথার ওপর টেবিল ফ্যানটা ঘুরে চলেছে। অসীম দাঁড়িয়ে হেডস্যারের টেবিলের সামনে। স্যার  টেবিলের ওপর রাখা গ্লাস থেকে এক গ্লাস জল খেলেন। ফাইল খুলে অসীমের সার্টিফিকেট বের করলেন। সেখানে নাম, রোল নাম্বার ইত্যাদি সব লেখা আছে। নীচে লিখে দিলেন—  হিস পারফরমেন্স ইন দি স্কুল ওয়াজ ভেরী গুড। আই উইস হিজ সাকসেস ইন লাইফ। লিখে সই করে স্ট্যাম্প লাগিয়ে দিলেন। কাজ শেষ হতেই স্যার অবনীবাবুকে ডেকে সবকিছু দিয়ে দিলেন। 

        

         অসীম এখন অবনীবাবুর অফিস থেকে সার্টিফিকেট  নিয়ে বাড়ী যাবে। এ সপ্তাহেই সে পরবর্তী ক্লাসে ভর্তির ফর্ম ফিল আপ করবে। অনুশোচনা এখন তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।  অসীম যখন অফিস রুম থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে বের হচ্ছে তখন তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। স্কুলের গেট পেরিয়ে অসীম রাস্তায় পা দিয়েছে । স্কুলের সাথে তার দূরত্ব ক্রমশঃ বেড়ে যাচ্ছে।  রুমাল দিয়ে একবার সে  চোখ মুখ  মুছে নিল। তার দুচোখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে জলের ধারা। 

Comments

  1. ভালো লেগেছে। আরো গল্প আশা করছি। -আশিস ধর।

    ReplyDelete
  2. সুব্রত ভট্টাচার্যMarch 24, 2023 at 8:42 PM

    ধন্যবাদ দাদা l ভালো থাকবেন l

    ReplyDelete
  3. ভালো লাগলো।

    ReplyDelete

Post a Comment