গল্প - ব্রততী সেন দাস



অলীক দুনিয়া

 

-ঠোঁট দুটো শুকিয়ে মামরি উঠেছে,গাল ফেটেছে।চুল উস্কোখুস্কো,কী অবস্থা!যত্ন টত্ন নিস না নিজের,বৈরাগ্য নাকি?

অনন্যা কোন উত্তর না দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল, আনমনে।

সুনন্দ ওর দিকে চেয়ে হাসল- মাইরি বলছি অনু তোকে কেমন মাতাজির মত লাগছে।মাতা নিরানন্দময়ী!

অনন্যা কোন জবাব না দিয়ে বলল- ওই ছাতিমগাছটা দেখ!

সুনন্দ কফি শপের কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে বাইরে তাকালো,

-হুঁ,দেখলাম।

-ওর নীচে একটা ভিখিরিকে দেখছিস?

-হুঁ

-আমি ওই ভিখিরিটার মত…রিক্ত,নিঃস্ব!

-হা হা হা.... খুব বাংলা সিরিয়াল দেখছিস বুঝি ,ওই রাবিশ সিরিয়ালের নায়িকাদের মত কথা বলছিস যে খুব!...তোর মত গোছানো সুখী

মানুষ ক'জন আছে রে? পরিপাটি সংসার,সারাদিন কোন কাজকম্ম নেই,শুধু লেজ নাড়ালে এইই হয়!কত জন্ম ঘরের কাজ করিসনা বল

তো?

অনন্যা রাগল না বরং উদাসচোখে সুনন্দর দিকে চেয়ে রইল।সুনন্দও দু পলক গভীর চাহনিতে বাল্যসখীর দিকে চাইল।

অনন্যার অপূর্ব সুন্দর চোখ,টিকলো নাক আর কবির বর্ণিত পদ্মফুলের মত ঠোঁট।মধুরঙা ত্বক,গালে শীতের লালিমা,মাথার

উস্কোখুস্কো অবিন্যস্ত চুলের মধ্যে দু একটি রূপোলি ঝিলিক আর অযত্ন বেশভূষায়ও এক অনন্য সৌন্দর্য ঝরে পড়ছে।এই মেয়েটি

সব সময় অনাবিল সুন্দর কারণ ওর মধ্যে কোন কৃত্রিমতা নেই,কোথাও আত্মসচেতনতা নেই,উদাসীন আর অন্যমনস্কতায় বিভোর

হয়ে থাকে ।ও জানেই না কপালের ওপর কুচো চুল দুললে বা অগোছালো করে শাড়ি পড়লে ওকে কতটা আকর্ষণীয় লাগে।শাড়ির সঙ্গে

ব্লাউজেরর ম্যাচিং নেই বা কান গলায় সামান্যতম অলঙ্কারটুকুও অনেকসময় থাকে না।শুধু নাকের হিরেটুকু যখন ঝলসে ওঠে তখন

এক দর্পিতা রমণী মনে হয়। সুনন্দ অনন্যার এই রূপেই আজীবন মোহিত।অনন্যা যেন ওর কাছে বনের অযত্নে ফোঁটা কোন নাম-না-

জানা বন্য কুসুম যাকে ছিঁড়ে নিয়ে এসে ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখলে মানায় না,সবুজ পাতার ঝোপের আড়াল থেকে খুঁজে নিতে হয়।ভাললাগা

আর ভালবাসাকে বন্ধুত্বের সুত্রে গেঁথে দুজনে পা মিলিয়ে চলেছে আকৈশোর।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অনন্যা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল

-ওরকম মনে হয় বাবু...ঈশ্বরের দুনিয়ায় সব কিছুর সাইড এফেক্ট রয়েছে রে, পাওয়ার... না- পাওয়ারও।তোরা বুঝবি না।

-অ্যাই,তুই কি প্রেমে পড়েছিস? তোর ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডদের কী খবর?অনুরাগীদের? সুনন্দ হেসে বলল

অনেকক্ষণ ভেবে অনন্যা মুখ খুলল-ভার্চুয়াল আর রিয়েল বলে কিছু হয় না... মেন উইল অলওয়েজ বি মেন।

-এই রে,লেঙ্গি খেয়েছিস মনে হচ্ছে?

-না চিনছি!এই ভার্চুয়াল দুনিয়া একটা মজার জায়গা জানিস সুনন্দ.... এখানে যা কিছু হয় ধরাছোঁয়ার বাইরে,আচ্ছা বল তো আজকের

দিনে দাঁড়িয়ে একজন পরিণত মানুষ কত ঘন্টা নেট-দুনিয়ায় প্রদক্ষিণ করি? অন্তত পক্ষে আট-দশ ঘন্টা তো বটেই,প্রতিদিন আমরা

নানা ভাবে হাজার মানুষের সঙ্গে ইন্টার‍্যাক্ট করি,কিন্তু এই অদেখা মানুষগুলোকে কি আমরা জানতে পারি,চিনতে পারি ? তারা

আসলে কী ভাবছে আর কেমন ভাবে ভাবছে আমরা আন্দাজ করে নিই আর সেটাই যে যার নিজের মত করে করি,তাই তো?সত্যিকারের

মনের গতি বোঝা কি অতই সহজ?

-সে তো হবেই।

-বাস্তব জগতে আমরা এক একজনকে চিনতে হিমসিম খেয়ে যাই।যার সঙ্গে দিন-রাত এক ছাদের নীচে বাস করছি তাকে চিনতে এক

জীবনও কম পরে যায় আর এই ইল্যুউশনারি ওয়ার্ল্ড,বাপ রে!

- হু…ভাবতে হবে।


2


-পরতে পরতে মুখোশ…একটা খুলবি,আর একটা আড়াল করবে।তবে হ্যাঁ ,রিয়েল জগৎ তোকে আসল রূপটা দেখাবেই,আজ নয়তো কাল

কিন্তু ভার্চুয়াল জগৎ তোকে একটা ইল্যুশনের মধ্যে ফেলে দিতে পারে।

- বাব্বা! তুই তো অনেক রিসার্চ করেছিস এসব নিয়ে!চালিয়ে যা গুরু বলে সুনন্দ একটু হাল্কা করে দিতে চাইল পরিবেশটাকে।

ওরা দুজনে একটা ক্যাফেতে বসা,সামনে দুটো ধুমায়িত কফি মাগ আর কুকিস।

-এই যে তুই আমার সামনে বসে আমাকে তখন থেকে নানা টিকা টিপ্পনি দিচ্ছিস আমি তোকে চিনি আর জানি বলে আমার অসুবিধে হচ্ছে

না।কিন্তু ভার্চুয়াল দুনিয়ায় এরাই হয়ত আমার তালে তাল দিয়ে এমন কিছু মন্তব্য করত যে আমি ভাবতাম সহমর্মী একজন

কেউ।আমি আর একটু কাছে এগিয়ে যেতাম,আরো কাছে.... আরো কাছে!

-এগোবি কেন? এগোবি না.... এটা একটা মানুষের তৈরি মেকি দুনিয়া... বুঝতে হবে।বাস্তবে আমাদের যতটা মুখোশ পড়তে হয়,এখানে

প্রোটেকশন ডাবল করে নিতে হয়।করোনাকালের মাস্কের মত,সঙ্গে স্যানিটাইজার আর গ্লাভস ভুলিস না।

-কিন্তু মানুষ তো কিছুর ওপর নির্ভর করতে চায় সুনন্দ! কতটা ফাঁকা জায়গা মনের মধ্যে।যৌথ পরিবার ভেঙেছে,ভোগ আর চাহিদা

সম্পর্কগুলোর মধ্যে ঘুণপোকা হয়ে ঢুকে গেছে- বন্ধুত্ব,প্রেম,দাম্পত্য, পরিবার সব খোলনলচে খুলে উলঙ্গ হয়ে পড়ছে দিন

দিন।কম্পিউটার আর মোবাইল হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমাদের বৈতরণীর তরী।স্যুইচ অন-অফ করলে সম্পর্ক জোড়া লাগছে,সম্পর্ক ভেঙে

যাচ্ছে।এ মুহূর্তে আবেগপ্রবণ মানুষ যাবে কোথায়? কার ওপর নির্ভর করবে,কাকে মনের কথা ভাগ করে দেবে আর কাকেই বা আপন

ভাববে?একাকীত্ব যে এক দূরারোগ্য অসুখ,ঘুণ পোকার মত তিলে তিলে শেষ করে দেয়।সবাই তো আর ধীমানের মত নিক্তি মেপে

আবেগ বিলোয় না বা তোর মত নিজের মনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে পারে না!

এবার সুনন্দকে একটু চিন্তান্বিত দেখাল।বুঝল অনন্যা সত্যিই কোন মনোকষ্টে পড়েছে নইলে এতক্ষণে হাল্কা হাসির ছররা

তুলত।সুনন্দ জীবনের কঠিন মোড় গুলোয় যখন দিশেহারা হয়েছে তখনই অনন্যা বারেবারে পরম সুহৃদের মত ওর হাত ধরে টেনে

তুলেছে,ভেসে হারিয়ে যেতে দেয়নি।ধীমানও জানে ওদের দুজনের বন্ধুত্ব কতটা গাঢ়।আগে ধীমানের মনের কোণায় একটু আধটু জ্বালা

ধরত, এখন আর কিছু বলে না।অবশ্য বলার সময়ই বা কই? ধীমান সব সময় দৌড়চ্ছে।আজ এদেশের হিল্লি দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর, পুনে

তো কাল ইউ এস,ইউ কে,অস্ট্রলিয়া,ইতালি,চীন, জাপান কোথায় নয়।একমাত্র ছেলে তকাই কানপুর আই আই টিতে এম টেক

করছে।অনন্যা একটা পাবলিশিং কম্পানিতে প্রুফ রিডিং এর কাজ করে।এ ছাড়া নিজের একটা হোম ডেকর বুটিক আছে।দুইই ওকে

ব্যস্ত রাখে।সারাদিন খাটাখাটনি করে কিন্তু সন্ধে বেলা নিঝুম পুরীতে ঢুকলেই ওর ডিপ্রেশন শুরু হয়।একটা ভয় ওকে দুপাশ থেকে

জড়িয়ে ধরে।রাতে ও তিনতলায় স্টাডিতে কাজ করে,খুব রাত হলে ওখানেই ডিভানে শুয়ে পড়ে।ঘুম আসতে না চাইলে কোন কোনদিন দু/

তিন পেগ হুইস্কি নীট নিয়ে ফেলে।তাও যদি ঘুম না আসে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে সিলিঙের দিকে।অতীত-বর্তমানের টুকরো টুকরো

দিয়ে কোলাজ তৈরি করে তাতে ডুব দেয়।

-ইউ নো অনু,আই থিঙ্ক ইউ নিড সেক্স!

অনন্যা আবার সেই লুক দিল, গভীর রহস্যময় এক চাহনি।অস্ফুটে বলল- আই নিড আদর।এমন এক আদর যা রোমকূপের গভীরে তুফান

তুলবে,শিরদাঁড়া বেয়ে উথলে উঠবে শিরশিরে এক রোমাঞ্চ!প্লাবিত করবে এমন এক উষ্ণতায় যাকে মুঠো করে ধরা যায় না,উড়িয়ে দিতে

হয় বাতাসে।দূর নক্ষত্রবীথিতে শালিকের পায়ের চিহ্ণ রেখে যাবে!

সুনন্দ বুঝল বাল্যসখীর বেদনা।হাতের ওপর হাত রেখে বলল-আমি আছি তো রে!

অনন্যা অন্য হাতটা দিয়ে ওর আঙুলটা জড়িয়ে নিয়ে বলল- হাতের ওপর হাত রাখা সহজ নয়/ সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়/এ কথা

খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে/সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়।

………………………………………………………………………

সুনন্দ,অনন্যা আর ধীমান কলেজের একই ইয়ারের স্টুডেন্ট ছিল,সাবজেক্ট আলাদা আলাদা। সুনন্দ আর অনন্যারা পাশাপাশি পাড়ায়

থাকত,ওদের বন্ধুত্বআশৈশব।পরে কলেজে উঠে ওরা তিনজন আর রাত্রি এই চারজনের গভীর বন্ধুত্ব ছিল।কলেজ পাশ করার পর

রাত্রি আর পড়াশোনায় এগোয়নি, ভাল চাকুরে ছেলে দেখে বিয়ে করে এখন নিউ জার্সিতে সেটল করেছে।অনন্যার প্রতি ধীমান আর

সুনন্দ দুজনেই আকৃষ্ট ছিল কিন্তু অনন্যার ভাললাগা,ভালবাসাটা একটু অন্য রকম ছিল।সুনন্দের প্রতি ওর ভাল লাগাটা ছিল

বন্ধুত্ব....চোখ বুজে অন্ধ বন্ধুত্ব ,একটি মেয়ের জীবনের যত রকমের কথা অন্য কারুর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া সম্ভব অনন্যা সে

সবটাই সুনন্দের সঙ্গে করে থাকত।সেই কৈশোর বেলা থেকেই।পাড়ার কোন ছেলে পেছনে লাগছে,কার প্রতি ওর ভাল লাগা,অঙ্ক পারা

না পারা,জয়েন্টে না বসার ডিসিশন সবটাই অনন্যা সুনন্দকে না বলে শান্তি পেত না,এমনকি রজঃস্বলা হওয়ার পর সে যে বড় হয়ে

গেছে সে কথাটাও জানাতে দ্বিধা করেনি সে।সে এক আশ্চর্য মানসিক নির্ভরতা। কিন্তু ধীমানের প্রেম,যৌনতায় আর দায়িত্ববোধের

প্রতি অন্য রকম আকর্ষণে আকৃষ্ট ছিল অনন্যা।তাই কলেজ শেষে বরমাল্য দিল ওরই গলায়।সুনন্দ দুঃখ পেয়েছিল কিন্তু ভেঙে

পড়েনি।জানত যে বন্ধুত্ব থাকবেই তাই মন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি কেননা অনন্যার প্রতি ওর আকর্ষণ প্রেমের অধিক কিছু ছিল

হয়ত।


3


এর বেশ কিছু বছর বাদে সুনন্দ অফিস কলিগ স্বপ্না শ্রীবাস্তবকে বিয়ে করে মুম্বাইতে চলে যায়। ধীরে ধীরে কলকাতা,অনন্যার

স্মৃতির সাথে আপোষ করে নিজের জীবনে থিতু হচ্ছিল ও। কিন্তু স্বপ্না ছিল হাউই বাজির মত,আকাশে উড়তে চায়,এক মিনার থেকে

অন্য মিনার ছুঁতে চায়।একদিন স্বপ্নাও ওকে ছেড়ে চলে গেল জীবনটা লন্ডভন্ড করে দিয়ে। হয়ত সুনন্দ আরব সাগরের জলে হাবুডুবু

খেতে খেতে কোন অতলে তলিয়ে যেত যদি না আবার অনন্যার সঙ্গে যোগাযোগ হতো ।পরে আবার কলকাতায় ফিরে আসে কিন্তু আর

বিয়ে করেনি।স্বপ্না নাকি অনন্যা?কার শূন্য জায়গায় পূর্ণ করবে ও, নিজেই ঠিক করতে পারে না !

অনন্যা মোবাইল বার করে একটা ছবি বার করে দেখাল সুনন্দকে- দেখ!

একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় এক যুবকের ছবি,বছর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের।

-বাঃ বেশ তো!কে ছেলেটি?

-ওর নাম শিলাদ্রি সেন,ফেসবুকে আমার বন্ধুবৃত্তের একজন।লেখালেখি করে।আমি প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত সেই সূত্রে ও আমায়

ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠায়,আমি এক্সেপ্ট করি।তারপর আর কী,যা হয়।সব সময় শিলাদ্রি আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত।প্রথমে

ফেসবুকে,তারপর মেসেঞ্জার,হোয়াটসঅ্যাপ, ফোন ইত্যাদিতে... সারাদিনে অনবরত।আমার অকুণ্ঠ অনুরাগী হয়ে উঠল।সারাক্ষণ নানা

বিষয়ে বকবক।থামানোই যেত না!

-তোর ভাল লাগত নিশ্চয়ই

-মন্দ লাগত না।তখন সদ্য সদ্য তকাই বেরিয়ে গেছে,সারাদিন একা একা কাটানো।বাড়ি এসেও একাকীত্ব যেন গিলে খেতে আসত আর

ঠিক তখনই শিলাদ্রি পিং করত! আমি যেন কোথাও তার অপেক্ষাতেই থাকতাম, তড়িঘড়ি বসে যেতাম। কথার পিঠে কথা চলতে

থাকত।ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে।কথায় কথায় দেখতাম আমার মন খারাপটা কোথায় উধাও হয়ে যেত।

-ধীমান কিছু বলত না?

-দূর... ওর সময় কোথায়? বাড়িতেই তো থাকে না।থাকলেও আমাকে নিয়ে ওর মাথা ঘামানো সময় নেই।দরকারের জিনিসটা হাতের কাছে

পেয়ে গেলেই ওর কাজ চলে.....শোন না,এই শিলাদ্রি দীর্ঘ এক -দেড় বছর আমায় এমন ভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখছিল যে আমি

কেমন এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলাম।যদি কোন কাজে আমি বা ও একে ওপরকে সময় দিতে না পারতাম তাহলে কেমন একটা মান

অভিমানের পালা শুরু হয়ে যেত।অথচ আমরা কেউই কাউকে দেখিনি কিন্তু !শিলাদ্রি কতটুকু,আমার থেকে অনেকটাই ছোট।সুতরাং

একটা অনাবিল বন্ধুত্ব ছাড়া আর কী সম্ভব? কিন্তু আমি সোজা রাস্তা চলতে চাইলেও দেখতাম ওর চলন কখনও কখনও আঁকা

কখনও বাঁকা হচ্ছে।আমার বিরক্ত লাগত,রাগ করতাম কিন্তু একা থাকার মুহূর্তে ওকে আবার অগ্রাহ্যও করতে পারতাম না!

-তোর শিলাদ্রি কেস বেশ জমে উঠেছি দেখছি।

- না, জমে ওঠেনি।তাহলে এই দেখ।

সুনন্দ মোবাইলটা হাতে নিয়ে চমকে উঠল।একজন নিরাবরণ নারী! না না ,এ তো অনন্যা! উর্দ্ধাঙ্গ সম্পূর্ণ নিরাবরণ।সুনন্দ

বিস্ফারিত চোখে চাইল ওর দিকে- তুই ওর সঙ্গে সাইবারসেক্স করতিস?

অনন্যা আতঙ্কে আর ঘৃণায় মুখ বিকৃতি করে হিসহিস করে বলল-তুই কি বলছিস জানিস,পাগল হয়েছিস ! পরশু রাত্রে শিলাদ্রি এই

ছবিটি পাঠিয়েছে আমায়।সুপার ইম্পোজ করেছে আমার মুখ এই নিরাবরণ শরীরের ওপর। বলেছে এর চাইতেও হট ছবি নাকি আছে ওর

কাছে।ও যা চায় তা না দিলে ও এগুলো ভাইরাল করে দেবে!

-হুঁ...ব্ল্যাক মেল?ও কী চায়?

-ও আমার সঙ্গে সেক্স করতে চায়!

-মাই গড!

অনন্যা চোখের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুকণা রুমাল দিয়ে মুছে নিল।কিন্তু কালিমা দূর হল না।

-আর আমি রাজি না হলে এই উপহার আমায় সে দেবে।দীর্ঘ এক-দেড় বছরের যোগাযোগ যাকে ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডশিপ বলে তার এই হল

পরিণাম।

সুনন্দ আর একবার ছেলেটির ছবির ওপর চোখ বোলালো... রীতিমত সুদর্শন,ছেলেমানুষী মাখানো মুখ,নিষ্পাপ চাহনি,নারীচিত্ত

বিমোহনকারী হাসি।কিন্তু একটু ভেবে দেখলে এই আকর্ষণকারী সারল্য হল ওর মূল অস্ত্র।এইগুলো সম্পর্কে ও এতটাই

ওয়াকিবহাল ও আত্মবিশ্বাসী যে অনায়াসে যে কোন চিত্তকে ঘায়েল করতে পারে।আর এ ক্ষেত্রে ও টার্গেট করে বয়সে একটু বড়

রমণীদের কারণ তারা এমন একটা বয়সে পৌঁছে যায় যখন নিঃসঙ্গতা অবধারিত ।সমবয়স্ক হলে মুশকিল কেননা ও নিজেই কোথাও

জড়িয়ে গেলে মুশকিল।সুনন্দ বাল্যসখীর মূঢ়তাকে কী আর বলবে কিন্তু এই প্রবঞ্চকের প্রতি এক দুঃসহনীয় আক্রোশ জেগে উঠল।


4


-এসব ছবি যদি ধীমান বা তকাইয়ের চোখে পড়ে কী সর্বনাশ হবে ভাবতে পারিস।আমি তো তকাইয়ের কাছে চিরদিনের জন্য ছোট হয়ে

যাব।একাকীত্ব ঘোচাতে গিয়ে নিজের সম্মানের জমি হারাতে বসছি।

সংসারের প্রতি ধীমানের ঔদাসীন্যের কারণেই যে অনন্যা এমন মারাত্মক বিষাদাক্রান্ত সেটা সুনন্দ বহু বছর আগেই টের

পেয়েছিল,আজ অনন্যাকে এক বন্ধ্যাভূমিতে আছড়ে ফেলেছে বোঝা যাচ্ছে।আগে দু একবার এই বিষয়টা উপস্থাপিত করতে গিয়ে

দেখেছে ধীমান কেমন যেন এড়িয়ে যাচ্ছে। একদিন দুজনে মদের গ্লাস হাতে নিয়ে বসেছিল।ধীমান কোন কারণে ডিস্টার্বড ছিল,তাই

পানও অতিরিক্ত করছিল।সেদিন অনন্যাদের কথা উঠতে ধীমান বলেছিল- এটা আমাদের পার্সোনাল ব্যাপার সুনন্দ,আমাদেরটা

আমাদেরই বুঝতে দে? বাইরের কেউ এখানে মাতব্বরি করুক আমি চাই না।আর আমাদের সংসার সরকারি এতিমখানা নয় যে যে সে এসে লাঠি ঘোরাবে।

কিন্তু তার মানে ওর অনন্যাকে যে ইচ্ছে মাড়িয়ে চলে যাবে সুনন্দ সেটুকুও হতে দেবে না।মোবাইল বার করে কারো সঙ্গে কথা সেরে

নিল।অনন্যাকে বলল- আমি শুভ্রাংশুর সঙ্গে কথা বললাম,কাল আমি একবার যাব ওর কাছে।শুভ্রাংশু চ্যাটার্জি আমার মামার বাড়ির

পাড়ার বন্ধু।কলকাতা পুলিশে আছে,লালবাজার সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্টে পোস্টেড।শোন,তুই শিলাদ্রি না কি বাঞ্চোতটার সাথে

এখন আর কম্যুউনিকেট করবি না কিন্তু ফেসবুক ডিয়াক্টিভেটও করিস না।আর যে যে কমেন্টউলো করেছে তার সব স্ক্রিন শট নিয়ে

রাখবি,বুঝলি? আমি দেখছি কী করা যায়,সাইবার ব্ল্যাকমেলিং! ওকে জেলের ঘানি যদি না টানাতে পারি আমিও শালা সুনন্দ স্যানাল

নই! আজ রাত্রেই তুই ধীমানের সঙ্গে কথা বলে নিস।যদি কিছু উল্টোপাল্টা বলে বা ঝামেলা পাকায় তাহলে আসরে আমাকেই নামতে

হবে।অনন্যা পরদিন সুনন্দের সঙ্গে গিয়ে লোকাল থানায় একটা জিডি করে এলো।শুভ্রাংশুর পরামর্শে স্কাইপ এডভাইসও নিতে লাগল।

পুলিশ ডিপার্টমেন্ট সমস্ত ডিটেলস যোগাড় করে তদন্তে নেমে পড়ল।

*******************************************************

ঠিক দেড় মাসের মাথায় সুনন্দ অনন্যার সঙ্গে দেখা করল।মাঝখানে অবশ্য অনন্যাকে বার কয়েক লালবাজার ডাক পাঠিয়েছিল

তদন্তের স্বার্থে,অনন্যার সঙ্গে ধীমানও গেছিল কয়েকবার। না,ধীমান সব শুনে কোন বিরূপ মন্তব্য করেনি। সুনন্দ বলল-শুয়োরের

বাচ্চাটা ধরা পড়েছে! ভদ্দরলোকের ছেলে,শুনলাম ওর বাবা মা দুজনেই নামী ডাক্তার।অঢেল পয়সা।ছেলের দিকে নজর দিতে পারে

না,তাই বোধ হয় পয়সা ঢেলে ঢেকে রাখে।আর বড়লোকের বখাটে ছেলে পড়াশোনা ডকে তুলে দিয়ে মদ,মাদকসেবা আর আঁতলামো করে।

কবিতা চর্চার নামে মাগীবাজি করে আর এখন দামী ফোন হাতে নিয়ে নারী শিকার করে বেড়াচ্ছে।ওর ফোনে পঁয়তাল্লিশ থেকে ষাট-

পয়ষট্টির বহু মহিলার এরকম আপত্তিকর ছবি পাওয়া গেছে! এক্কেবারে পার্ভার্টেড!

অনন্যা লজ্জায় কুণ্ঠায় মাথা নীচু করে বসে রইল।সুনন্দর মায়া হল দেখে।অনন্যা মুখ তুলে কিছু বলতে গেলেই একটা আঙুল দিয়ে ওর

ঠোঁটের ওপর রেখে সুনন্দ বারণ করল-উঁহু... অনু... আর নয়,এবার আমি বলব,তুই শুনবি। নিজেকে নিয়ে কখনও ভেবেছিস? এই সস্তা

কৃত্রিম চটকদার যন্ত্রদুনিয়া ঘেঁটে কি তুই সত্যিকারের কিছু পাবি বা পেয়েছিস? এই কেজো যন্ত্রগুলোকে তোর কাজের জগতে

ব্যবহার কর।এর সাথে মন বা আবেগকে জড়াস না।যন্ত্র এতটা উন্নত হয়নি যে মানুষের আবেগকে পড়তে পারে। বহু চতুর,ধুরন্ধর

মানুষ আছে যারা এই যন্ত্রের মাধ্যমে মানুষের মনের গতি প্রকৃতি বুঝে তাকে নিয়ে খেলা করে ।তাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে

পারে।তাই এই ভুল আর নয়।

-তুই কী বুঝবি রে.... এই একাকীত্বের কী জ্বালা!

-একাকীত্ব বলে কিছু নেই।দুনিয়া জুড়ে অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে যার সঙ্গে নিজেকে জড়ালে দিনে চব্বিশ ঘন্টা কম পড়ে যাবে।আর

তুই নিশ্চয়ই সিরিয়াল দেখা,বাচ্চার কাঁথা পরিষ্কার করা হোম-মেকার নোস।নিজের পটেনশিয়ালটি বুঝতে শেখ।নিজের পছন্দ মত কিছুর

সঙ্গে মেন্টাল কানেক্টিভিটি তৈরি কর।আর নইলে দাঁড়া,আমি একটু ভেবে নিই।একদিন এই নিয়ে আবার বসা যাবে!

অনন্যা এবার হেসে ফেলল।

-হাসছিস যে?হাসিস না।ছেলে কাছে নেই,বর ব্যস্ত…তুই নিজেকে হরেক রকম কাজ দিয়ে বেঁধে ফেল।অন লাইন ভার্চুয়াল প্রুফ রিডার

হয়ে প্রুফ রিডিং এবং এডিটিং এর কাজ করে থই পাবি না।তোর প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টের প্রফেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড আছে,তুই

বাড়িতে বসেই মাল্টিপল ক্লায়েন্টের সাথে কাজ করতে পারবি।তখন একাকীত্ব ,নিঃসঙ্গতা বড়লোকের আয়েসি বউদের এই সব

টার্মগুলো জানলা দিয়ে পালাবে!

-ভাবছি ধীমান থাকলে এখানে আমায় কী বলত! অনন্যা মুক্তোর মত ঝকঝকে হাসিতে উজ্জ্বল হল।

-বাই দ্য ওয়ে,ধীমান কবে ফিরছে?

-সামনের বুধবার।

-হুঁ,এবার থেকে মাঝে মাঝে তুই ওর সাথে ট্যুরে যাবি,বয়স হচ্ছে... বুড়োবুড়ি যত কাছাকাছি থাকবি প্রেম না থাক টান তৈরি হবে

চুম্বকের মত।আমি কথা বলব ওর সাথে।

-আবার? আবার তুই আমার ব্যাপার নিয়ে ওর সাথে কথা বলতে যাবি,মাতব্বরি করবি?


5


-অবশ্যই ।যো ওয়াদা কিয়া ওহ নিভানা পরেগা... বিয়ে করার সময় আমায় ওভারটেক করে হুমড়ি খেয়ে বিয়ে করতে ছুটলে আর এখন

ওসব কথা বলে আমায় চমকে দিলে আমি মানব কেন?ও স্বামী হয়ে কী ঘোড়ার ডিমের দায়িত্ব পালন করেছে জানি না,তা বলে বন্ধু

হয়ে আমি পালিয়ে গা বাঁচাতে পারি কি?

সুনন্দ হো হো করে প্রাণখোলা হাসি হেসে উঠল!

হাসি দেখতে দেখতে অনন্যার মনে এক রামধনুর ছবি ভেসে উঠল।বহু বছর আগে বাবার সঙ্গে একবার শিলং পাহাড়ে গেছিল, অনন্যার

মনে আছে সেদিনটা ছিল ঝড় জলে প্লাবিত এক শেষ বিকেল।চারিদিক বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে ছিল,ঝর্ণা দেখতে পায়নি বলে এক হাঁটু-

ঝুল ফ্রক পড়া কিশোরী মন খারাপ করে বসে ছিল ।হঠাৎ বৃষ্টি থেমে গেল,মেঘ ছিঁড়ে ঝকমকে রোদ উঠল ।আর কুয়াশার আড়াল সরে

যেতে সামনে এক পেঁজা তুলোর মত ঝাঁপিয়ে পড়া ঝরণা দেখে অনন্যার কিশোরী মনে এক অকারণ উদ্বেলতা উছলে উঠেছিল।চোখ

সজল হতে হতে দেখল পশ্চিম আকাশ জুড়ে এক সাত রঙা রামধনু এ পাহাড় আর ও পাহাড়কে জুড়ে এক শালপ্রাংশু পুরুষ হয়ে বিরাজ

করছে । বিস্ময় চোখ থেকে নেমে ঠোঁটের হাসি হয়ে গেল অনায়াসে।

Comments