গোপাদির সাজঘর
বিনুনি, উড়ো খই এবং আমরা--
স্কুলের অনুষ্ঠান। আমরা সবে ক্লাস সিক্স। গোপাদি বোধহয় নাইন টাইন হবে। টিনের বেড়া দিয়ে পাশের ক্লাবঘরে তৈরি হয়েছে মেক আপ রুম। আমরা বলি কী 'সাজঘর'। অনেক ঝক্কি পেরিয়ে তবে, সাজঘরে উঁকি দিই। ঝক্কি মানে এইসব, লোকজনকে বলা কওয়া, সামলে সুমলে আসা , পারমিশন নানারকম... এই আর কী!! সাজঘরে ঢুকে দেখি গোপাদি বসে আছে। সাজগোজ কিচ্ছু হয় নি। চুলে জড়ানো খই এর মালা। সস্তার জিনিস, সাজিয়েও তোলা যায়। গোপাদি বলল,' খুব খিদা লাগছে রে... এট্টু খই খাই? কেউ বুঝতে পারবে না, দেখিস। তোরা খাবি?' ঐটুকু তো খই !! খেলে আর থাকে কী? আমরা মাথা নাড়ি। গোপাদি আমাদের কেউ না। আমার বাড়ির পাশে থাকে। আমাদের চেয়ে খানিকটা বড়। তবে, খুব আগলে আগলে রাখে আমাকে আর আমার বন্ধুদেরও। ও আমাদের সবচাইতে বড় গাইড। দুপুরবেলার চড়া রোদ এসে গোপাদির কালো গালকেও লাল করে দিচ্ছে। পাখাটাও চলছে না। ইস্ কী গরম! পিউ বলল। " তুমি সাজবা কেমনে গোপাদি? আর কাউরে তো দেহি না... সব গেল কই?"আরে দাঁড়া বাপু!! প্রোগ্রাম তো সেই সন্ধ্যায়।' গোপাদি বলল বটে একথা কিন্তু তার চোখমুখে কীসের ব্যস্ততা ধরা পড়ে গেল আমাদের চোখে। চারজনের দল , আমি , পিউ, বিলু মানে বিল্বদল আর সোমসুন্দর মানে সমু ওরফে কালু আমরা সব্বাই সেটা বেশ বুঝতে পারলাম। আমরা ঘুরঘুর করছি , এমন সময় উঁচু ক্লাসের দীপদা , সুবীরদা আর সবার পিছনে সুদীপ্তদা, সাজঘরে চলে এল হৈ হৈ করে।সুদীপ্তদা আমাদের স্কুলে এগারো ক্লাসেই নতুন এসেছে। ওর বাড়ি আরও গ্রামে।মামাবাড়ি থেকে পড়ে এখন। বেশ চৌকস ছেলে সুদীপ্তদা ... হেডস্যর বলেন, ওর কথা উঠলেই, 'দ্যট্ ব্রাইট বয়। ' এই একবছরে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে ফেলেছে সুদীপ্তদা। চমৎকার ফিগার , দারুণ আবৃত্তি করে। স্পোর্টসেও দুর্দান্ত। সুদীপ্তদা দারুণ জাগলিংও পারে। কী ব্যালেন্স, কী টাইমিংস। মুগ্ধ হয় সবাই। আজ স্টেজে সেটাই পারফর্ম করবে ও।
আমাদের দেখেই দীপুদা আর সুবীরদা এগিয়ে এলো,' তোদের কী, কী এখানে নে... যাহ্ ভাগ এখন। কাজকাম নাই. খালি আড্ডা।' " বিলু ঢোঁক গিলে কী একটা বলতে যাচ্ছিল, আমরা ওকে নিয়ে তাড়াতাড়ি সরে পড়লাম। সুদীপ্তদাই কিছু বলল না, হাসল শুধু। আমরা সরে আসতে আসতে দেখলাম খাবারের প্যাকেট খুলে তার গন্ধ শুঁকছে গোপাদি, আর কোনোদিকে খেয়াল ই করছে না সে।একটু খাবার মুখে নিয়ে তরিবত করে খাচ্ছে গোপাদি, আমরা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি। মুখের চকাস চকাস শব্দ শুনে ফিরে আসছি ধীরে ধীরে, হঠাৎ বুনো বেড়ালের মতো দীপুদা এগিয়ে এসে ঘেঁটি ধরে একেকটাকে বের করে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
সাজঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি চারমূর্তি.. কার জন্য গোপাদি নাকি খাবারের লোভে .. ঠিক বুঝতে পারছি না। বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে খিলখিল হাসির ঢেউ উঠছে, আর পড়ছে। যেন সমুদ্র উথাল পাথাল !! গোপাদির তো আজকে সাগরিকা সাজার কথা... "সাগর জলে সিনান করি সজল এলো চুলে / বসিয়ো ছিলাম উপল উপকূলে"। এই সংলাপ ছিল তার । নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে বিলু ভাঙা গলায় গান ধরল 'কেন এলে মোর ঘরে আগে নাহি বলিয়া/ এসেছো কী হেথা তুমি পথ তব ভুলিয়া?' সাগরিকা নৃত্যনাট্যে এটাই গোপাদির গাইবার কথা আজ। আমরা মোহগ্রস্তের মতো চলতে শুরু করি। কোথায় যাবো বুঝতে না পেরে আমরা হাঁটতে থাকি। শুধু একটা বিহ্বল দুপুর আর একটা সাজঘর প্রশ্নচিহ্নের মতো গেঁথে যায় আমাদের মনে। আমরা কেউ কাউকে কিছুই বলি না। হাঁটতে থাকি।
জুঁইফুল : সাজানো সিন্দুক
সুদীপ্তদা একটা ফাটাফাটি রেজাল্ট করে বসলো এইচ, এস এ। সম্ভবত জেলায় প্রথম আর রাজ্যে দশম। এই প্রথমবার আমাদের স্কুল জেলায় এবং রাজ্যের মানচিত্রে উঠে এলো। সুদীপ্তদা যেন তারকা হয়ে গেলো মফস্বল শহরে। তাকে ঘিরে সংবর্ধনার হিড়িক আর মিছিলের পর মিছিল। তার জয়েণ্টের র্যাঙ্ক বিশেষ সুবিধার না হলেও এইচ , এস এর রেজাল্ট আরও কী কী সব যোগ্যতায় ভালো কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেলো সুদীপ্তদা । এরপর আর ওড়ার সময় থাকেনা। আমাদের মফস্বলকে পিছনে ফেলে , আমাদের সামনে মরীচিকার হাতছানি আর দূরের আলোর ঝলকানি রেখে বিদায় নিল সে। উড়াল বন্ধ হলো গোপাদির। এক একা কিছুদিন ঘুরে বেড়িয়ে আবার অন্য ডালে বসলো গোপাদি। তবে, এর মধ্যেই আরও একবার সংবর্ধনা সভা হলো, সম্ভবত জেলাস্তরের মেধাবীদের নিয়ে। হলো ঠিক পুজোর মুখে। সুদীপ্তদা এলো। একটা বৃত্ত থেকে বেরিয়ে গিয়ে ভারভারিক্কি হয়েছে সুদীপ্তদা। তাই তার বক্তব্যে সে বলল, নিজের ভেতরের আগুনকে সবসময় জ্বালিয়ে রাখতে, বললো , কখনোই তা যেন না নেভে। বিলুর চোখে সুদীপ্তদাই হিরো। প্রচুর খাটছিল বিলু। আমাদের ক্লাস নাইন শেষ হয়ে আসছে, আমাদের আগুন প্রস্তুত হচ্ছে...আপ্লুত বিলু গোগ্রাসে গিলছিল সুদীপ্তদা ও তার বচন।
ইতিমধ্যে, গানের দল রেডি হলো। একক সংগীতে গোপাদি গাইল... " কোন সুদূরের পার হতে আনে কোন সাগরের ধন'। শরৎকাল তখন, শিউলি ফুটে ওঠাই নিশ্চিত ছিল-- অথচ, গোপাদির খোঁপায় জড়ানো ছিল জুঁইফুলের মালা... ফুলটা আসল নাকি সস্তার নকল জিনিস সে খোঁজ অবশ্য নেওয়া হয় নি সেদিন। তবে, কেন জানিনা , আমার খুব মনে হচ্ছিল গোপাদির সিন্দুকে না জানি কত কথা , অমূল্য রত্নের মতো অব্যবহৃত থেকে গেলো।
জিরো ব্যালেন্স: মেঘের পাশে আলো
কোনোমতে দায়সারা একটা রেজাল্ট করল গোপাদি , ঠিক তার পরের পরের বছর। কাছের কলেজে ভর্তি হলো, বাড়ির নিতান্তই অনিচ্ছায়। আশ্চর্য হয়ে আমরা দেখলাম , গোপাদির বন্ধুদের কাউকেই তার আশেপাশে আর দেখা যাচ্ছে না। শুনলাম, গোপাদির বিয়ের জন্য সম্বন্ধ আসছে, যাচ্ছে। শুনলাম, মানে গোপাদিই শোনালো একদিন। তাহলে , ' বিয়েটা হচ্ছেনা কেন? '" ওসব বিয়ে করতে আমার বয়েই গেছে। 'গোপাদি উবাচ।আর বন্ধুরা? 'ধূর ধুর, কীসব বাজে... রুচি নাই আমার।' বলো কী? ' ছাড় তো.. ছবি দেখবি তোরা? দাঁড়া, এক মিনিট। ' 'আমাদের ক্লাস টুয়েলভ্ এখন গোপাদি। সময় নেই.. 'বিলু ব্যস্ত হয়। গোপাদি ছাড়ে না তবু, "এই দ্যাখ...হোটেল তাজ.. এই যে সমুদ্র। ওই দ্যাখ্, চারমিনার।--" "আর এই সব লোকজন কারা?" সমু মানে কালু বলেই ফেলে একসময়। হো হো করে খুব একচোট হেসে গোপাদি বলে," চিনলি না তো, কেমন? এতো সুদীপ্ত রে...!! 'আমরা চমকে উঠি। বিলুর হাঁ করা মুখ থেকে বুলেটের মতো শব্দকটা বেরিয়েই যায়.. ' ছবিগুলো. সবতোমার কাছে এলো কী করে?' আমি থতমতো খেয়ে কথাটা চাপা দিতে চাই। বলি, ' সঙ্গে কারা গো? ' 'কারা তা জানিনা। 'হবে... কতো ফ্যান্ তো ওর!' ', সুদীপ্তদা যে হিরো হলো গো'!!সোমু একটু ঢোঁক গিলে, বলে, ' কিন্তু, মনে হচ্ছে না তা.. মনে হচ্ছে ভেরি ক্লোজ ওয়ান অফ দেম্'। গোপাদি ছিনিয়ে নেয় ফটো। গম্ভীর ভাবে বলে.. 'মনে অমন অনেক কিছু হয়, সব সত্যি নাও হতে পারে।'
ওলট পালট : তাসের ঘর
আমরা সব বেরিয়ে একে একে এসেছি সেই মফস্বল ছেড়ে। গোপাদি বের হতে পারে নি। ওখানেই আছে। আমরাও যাই মাঝে মধ্যে। রিইউনিয়ন হয়। বিলুটা ডাক্তারি পড়ছে, সে বেচারি খুব একটা আসতে পারে না। বাকিরা আসি যাই.. সমুর একটা প্রেম হয়েছে, সে গল্প শুনি। ওকে এখন কালু বলে ডাকলে বেশ বিরক্ত হয়। আমি লড়ে যাচ্ছি একটা চাকরির জন্য। আমার মনে হয়েছে উচ্চ শিক্ষার চেয়ে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাটা বেশি জরুরি। ছাপোষা মধ্যবিত্ত হিসেবে এটাই দরকার। সময় পেলেই এসব নিয়ে বন্ধুরা জ্ঞান দেয়। শুনি, তবে চলি নিজের মতো। একবার গিয়ে শুনলাম, নতুন নাচ গানের একটা খুব পপুলার স্কুল হয়েছে। শুনলাম সেটা গোপাদির স্কুল। গোপাদির কথা মনে ছিল না, হঠাৎ মনে হতে সবাই গিয়ে তার বাড়িতে উপস্থিত হলাম। গোপাদি আমাদের দেখে হৈহৈ করলো বটে, তবে , এই প্রথম মনে হলো বড্ড রোগা হয়ে গেছে গোপাদি। আমি হেসে বললাম, বিয়েটা করে নিলে পারতে গোপাদি... দ্যাখো কেমন বুড়ো হয়ে যাচ্ছো!! "' গোপাদিও হাসলো তারপর কেমন বিহ্বল হয়ে বললো'.. বিয়ে তো হয়েই ছিল, স্বীকার হলো না'। আমি বললাম, 'মানে? পরীনীতা,? তুমি কী শরৎচন্দ্রের নায়িকা নাকি?," কালু বললো, "তোমার এককালের হিরোও বিয়ে করেছে , এই দ্যাখো ফেসবুকে সুদীপ্তদার বিয়ের ছবি।" গোপাদি তেমনি হেসে বলল.. 'হূমম, তিনকাল গিয়ে আমার এককালে ঠেকেছে... তাই তো?" আমি বললাম "ঝেড়ে কাশো তো বাপু, তোমার বিয়ে না করা র কারণ কী শুনি? ," গোপাদি বলল,"এ্যাই চুপ, চুপ। বাড়িতে এই নিয়ে পোচুর ঝামেলা চলছে.."
আমরা ফিরে আসি। দিন কাটে। ছন্দে কিংবা ছন্দ হীন। যোগাযোগ কমে আসে পুরোনো জায়গার সঙ্গে। যে যার মতো দাঁড়ে বসি। আমার পুরো পরিবার শহরেই থিতু হয়। বন্ধুদের সঙ্গে কালে ভদ্রে দেখা হয়। গোপাদির কথা ভুলেই গেছি আমরা। ভোলার ই তো কথা । গোপাদি আমাদের বন্ধু না, আত্মীয়ও না। শুধুমাত্র প্রাণবন্ত মানুষ হিসেবে সে একদিন আমাদের বোঝাপড়ার কেন্দ্রে এসে গিয়েছিল .. এমনই ভেবেছি একদিন , হঠাৎ কখনো মনে হলে।
লোকাল ট্রেনে ফিরছি। তেমন ভিড় নেই সেদিন। আমার অফিসে এখন চাপও নেই তেমন.. বৈশাখ মাস আসতে চলেছে.. উড়ো উড়ো বসন্ত চারপাশে। হঠাৎ একটা গলা শুনে আগ্রহ বাড়ে। মানুষটি আমার কামরা তে এলে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি ধূপ বিক্রি করেছে গোপাদি!!
তাসের ঘর তো এমন করেই ভাঙে। আমি তাকিয়েও দেখি না। গোপাদিও দেখে না। তবে, অনেক বোঝা পড়ার শেষে, অনেক ঝড় ঝাপ্টা সামলে এসে, এই মধ্য বয়সে এসে না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারি কিছু স্বপ্নের ভাঙচুর হয় না কোনোদিনই। এমন করেই বাতাসে বাতাসে নেশায় নেশায় থেকে যায় তারা, বুঁদ হয়ে!!!
Porinoto ekta lekha...bhison vlo laglo
ReplyDeleteখুব সুন্দর লাগল ।
ReplyDelete