এ এক অন্য পূজা
"বৌদি ও বৌদি কি হয়েছে গো তোমার? কেমন মন খারাপ মনে হচ্ছে। দাদাবাবুও দেখলাম কি রকম চুপ করে বেরিয়ে গেল। জানো বৌদি আমারও মনটা ভীষণ খারাপ গো।❞
পারুলদির কথা শুনে অনামিকা দেবী আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তিনি। বয়স্ক মানুষের কান্না দেখে মনটা যেন কেমন হয়ে গেল পারুলদির। পারুলদি মনে মনে বলে উঠলেন এত বড় বাড়ি কিন্তু বাড়িটা কত ফাঁকা। এত সম্পদ তাও কেমন সবকিছু ফাঁকা এদের। " জানিস পারুল খুব আশা করেছিলামএবারে স্বরসতী পূজার দিন বাড়িতে পূজা করব। নাতনির হাতেখড়ি দেব। নাতনি কে আমি নিজ হাতে সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দেব। খুব মজা করব চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু অপূর্ণই রয়ে যাবে মনের ইচ্ছা। সব ইচ্ছাত পূরণ হয়নারে পারুল।❞
"কেন গো বৌদি ছোট দাদাবাবুরা কেন আসতে পারবেন না? এই ত আধাঘন্টার রাস্তা। তোমাদের ত বয়স হয়েছে। তোমাদের মনে এইভাবে দুঃখ না দিলেই পারত দাদাবাবু। একটা দিন কি অফিস থেকে ছুটি নেওয়া যেত না?"
" আসলে কি বলতো সেদিন ওদের বাড়ি কিসব পার্টি আছে। শহরের অনেক নামীদামী মানুষেরা আসবেন। সেই পার্টি ক্যানসেল করা মুস্কিল। দুদিন আগে থেকে সব কিছুর বন্দোবস্ত করতে হবে। তাই ওদের কারোর সময় হবে না নাতনিকে নিয়ে আসার। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল রে পারুল। তা তোর কি হলোরে? তোর মন কেন খারাপ?"
"বৌদি আমার মেয়ে বায়না ধরেছে বাড়িতে স্বরসতী পূজা করবে। অনেক বার বুঝিয়েছি ঐ ত একচিলতে মাথা গোজার ঠাঁই। ভালোভাবে চলাফেরা করা যায় না সেখানে কি করে মায়ের পূজা করবো বলো? তাছাড়াও খরচের ও ত একটা ব্যাপার আছে না। কিছুতেই কথা শুনছিল না। তাই দিয়েছি এক থাপ্পড়। এখন মনটা খুব খারাপ লাগছে গো বৌদি।"
" তোদের ভীষণ ধৈর্য্য কম। ঐটুকু বাচ্ছা মেয়ে কে কেউ মারধোর করে? ও কি বোঝে টাকা পয়সা কমবেশীর। ও ত একটু আনন্দ করতে চেয়েছে তাই না পারুল? " অনামিকার দেবীর কথায় মাথা নেড়ে পারুল বলে " গিয়ে এবার মেয়ের রাগ ভাঙ্গাতে হবে। ও ত আর বুঝবে না গরীবদের সব মনের ইচ্ছা পূরণ হয় না"। সেদিন মনখারাপ নিয়ে কাজ করে পারুলদি বাড়ি ফেরেন। অভাবে বড় হওয়া বাচ্ছাদের একটা বিরাট বড়ো গুণ আছে। তাদের একটু আদর দিয়ে ভালোবেসে কথা বললে তারা কোনো একদিন তাদের মনের ইচ্ছা পূরণ হবে এই বিশ্বাসে বিশ্বাস করে। পারুলদির মেয়ে টিয়াও মায়ের দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি তে শান্ত হয়েছিল।
"টিয়া ও টিয়া মা কি করছিস?"টিয়া একটা পুরানো পুতুল নিয়ে তার বন্ধুদের সাথে খেলা করছিল। হঠাৎ অনামিকা দেবীকে তাদের বাড়ির দালানে উপস্থিত দেখে সে চেঁচিয়ে উঠল " মা ওমা দেখো দিদা এসেছে। ও দিদা আসো আসো ভেতরে আসো। ওমা আসো না তাড়াতাড়ি। "
মেয়ের চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি বাইরে এসে পারুলদি অনামিকা দেবীকে ভেতরে নিয়ে এসে বসতে দেন। " বৌদি গো এই প্রথম তুমি এলে আমার বাড়িতে কোথায় যে তোমায় বসতে দিই"।
অনামিকা দেবী বলে ওঠেন " পারুল আমি এবার অন্য রকম ভাবে স্বরসতী পূজা করব। তুই সকাল বেলা টিয়া এবং ওর বন্ধুদের নিয়ে আমার বাড়িতে চলে আসবি। আর হ্যাঁ সেদিন ওদের সবার আমার বাড়িতে নিমন্ত্রণ রইলো। ওখানেই ওরা ভোগ খাবে। আজ আসি রে। "
স্বরসতী পূজা সেদিন ভীষণ সুন্দর করে হয়ে হয়েছিল অনামিকা দেবীর বাড়ি। বাড়ির দালানে স্টেজ তৈরী হয়েছিল। সংসারের চাপে ধূলামাখা তানপুরাকে পরিস্কার করে স্টেজে বসেছিলেন অনামিকা দেবী। একটার পর একটা গান গেয়েছিলেন তিনি। বাচ্ছারা যে যার মত কবিতা পাঠ করেছিল। কেউ একেছিল। কেউ কোন গল্প বলেছিল। অনামিকা দেবী নিজেই পূজার মন্ত্র বলেছিলেন। ওনার সাথে বাচ্ছারাও মন্ত্র পাঠ করেছিল। হয়েছিল দারুন খাওয়াদাওয়া। খিচুড়ি, আলুর দম, চাটনি, পাঁপড়, পায়েস। বাচ্ছাদের হৈ হুল্লোড়ে সেদিন ভরে উঠেছিল অনামিকা দেবীর শূন্য দালান। সন্ধ্যাবেলায় বাচ্ছারা বাড়ি ফিরে গিয়েছিল তাদের বাড়ির লোকেদের জন্য ভোগ নিয়ে। বাড়ি ফেরার সময় তারা সমস্বরে চিৎকার করেছিল আসছে বছর আবার হবে।
অনামিকা দেবী নিজের মনকে বলেছিলেন চিরাচরিত প্রথা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের মত করেও ভাল থাকা যায়। যতই হোক মানুষই ত নিয়ম গড়ে, মানুষই ত নিয়ম ভাঙ্গে। সেদিন রাতে ফোন করে তিনি ছেলেকে বলেছিলেন " বাবু আজ আমার বাড়িতে প্রকৃত স্বরসতী পুজা হলো।❞
ধন্যবাদ কথালহরী।
ReplyDelete