গল্প - দেবাশিস ধর

মেলাবেন তিনি মেলাবেন

       

'মেলাবেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর
পোড়ো বাড়ীটার
ঐ ভাঙ্গা দরজাটা
মেলাবেন

- কার লেখা বলতে পারলে এক্ষুনি কড়কড়ে একশ টাকা ইনাম পাবে। অপশন লাগবে'? কয়েকদিন ধরে বিতনু এই নুতন ধরণের খেলা কবিতা-ক্যুইজ মানে বিখ্যাত সব কবিতার কয়েকলাইন বলে সেটা কার লেখা মধুরিমার কাছে জানতে চাওয়া শুরু করেছে। বিতনুর ছেলেমানুষিতে বেশ মজাই পায় মধুরিমা। আবার ক'দিন পরে এই কবিতা-ক্যুইজ ভুলে গিয়ে অন্যকিছু একটা শুরু করবে সে সম্পর্কে মধুরিমা একরকম নিশ্চিত। তবে সেটাও ছেলেমানুষি ধরণেরই হবে তাও বলে দেওয়া যায়।

               

এমন মানুষের উপর রাগ না করে থাকা যেমন মুশকিল তেমনি আবার রাগ হলেও বেশীক্ষণ তা' ধরে রাখা অসম্ভব। দুনিয়াদারীর পাকা বুদ্ধি থাকা হাজারো লোকের ভীড়ে বিতনুর মত এমন ছেলেমানুষি মনের কাউকে খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। বিতনু জীবনে প্রতারিত হতে পারে কিন্তু কাউকে প্রতারণা করতে পারবে না- কারণ ওর ভাবনার জগৎটাই যে আলাদা।  এমন মানুষ চিনতে মধুরিমার আর ভুল হওয়ার কথা নয়। অন্যদিন বিতনু কোন  কবিতার দু'চার লাইন আউড়ে এমন প্রশ্ন করলে উত্তরে মধুরিমা রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ বা নজরুল বলে নিজেই হাসতে থাকত। আর বিতনুও যেন মধুরিমার কাছ থেকে এমনই একটা উল্টোপাল্টা উত্তরের অপেক্ষায় থাকত।                  

              

আজ অবশ্য তেমন কোন জবাব না দিয়ে মধুরিমা উল্টে জানতে চায়- 'আচ্ছা তুমি বলতো দেখি 'শিশির-বিমল প্রভাতের ফল/ শত হাতে সহি পরখের ফল/ বিকালবেলায় বিকায় হেলায় সহিয়া নীরব ব্যথা'- কার লেখা কবিতার লাইন। 'কার লেখা, কার লেখা'- বিতনু কপট চিন্তিত মুখে পায়চারী করে- 'হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে এটা রবীন্দ্রনাথ না না জীবনানন্দ ওহ্‌ নো নজরুলের লেখা'। 

               

'তুমি আমাকে নকল করে ইন্ডাইরেক্টলি হিউমিলিয়েট করছ কিন্তু মিস্টার বিতনু। তোমার মত দুর্বোধ্য সব কবিতার লাইন না আউড়ে আমি স্কুলে পড়া সহজ কিন্তু গভীর মিনিংফুল একটা কবিতার অংশ বললাম বলে তুমি এভাবে ব্যঙ্গ করছ'- মধুরিমার কথায় বিতনু হাতজোড় করে- 'স্যরি ম্যাডাম, ভেরী স্যরি। এটা যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর লেখা 'হাট' কবিতার অংশ। কিন্তু তোমাকে আমি হিউমিলিয়েট করলাম কিভাবে? তুমিও যদি আমাকে তোমাদের পেট সাবজেক্ট রান্নাবান্না বা ঘরকন্না নিয়ে প্রশ্ন কর তবে আই উইল স্কোর এ বিগ ডাক। তখন তো তুমিও হাসবে- হাসবে কিনা'?                   

      

'এইখানেই তোমাদের আই মীন পুরুষদের ভাবনার সঙ্কীর্ণতা। তুমি বিনাদ্বিধায়  রান্নাঘরই যে আমাদের কমফোর্টের জায়গা সেটা নির্দিষ্ট করে দিলে- তাই না? মেয়েরা কবিতা লিখবে না, মেয়েরা এটা করবেনা ওটা করবেনা, শুধু বাচ্চা বিয়োবে আর ঘরের কাজ করবে তাই না? আমি যদি তোমার ঐ 'মেলাবেন তিনি মেলাবেন' কবিতার লাইনগুলো কার লেখা বলতেও পারতাম তাহলে কিন্তু তুমি আদৌ খুশী হতে না। মেয়েদের এভাবে নাহলে ওভাবে বেকায়দায় ফেলে এনজয় করাটা ইজ এ পার্ট অফ মেল ডমিনেশন ট্যাক্টিক্স’- মধুরিমার এক নিশ্বাসে নিক্ষিপ্ত  বাক্যবাণে  বিদ্ধ হলেও বিতনু  নীরবই থেকে যায়।

              

এমন হঠাৎ হঠাৎ মধুরিমার ক্ষেপে যাওয়া স্বভাবের সাথে বিতনু ভালোই পরিচিত। কিন্তু যতবার এমন ঘটনা ঘটেছে কোনবারই বিতনু বুঝে উঠতে পারেনি ওর ওই মুহূর্তে ঠিক কি বলা বা করা উচিত ছিল। প্রতিবারই নীরব থেকে বিতনু ওর কোন কথাটা বা আচরণটা মধুরিমার মেজাজ-চ্যুতি ঘটালো সেটা খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করে গেছে। তবে এবার মধুরিমার প্রশ্নের উত্তরে অমন মজা করাটা মনে হয় ঠিক হয়নি। ফের কোনদিন এইসব কবিতার উদ্ধৃতি  জিভের ডগায় এলেও তৎক্ষণাৎ আবার গিলে নেবে।                      

      

'তুমি কি যেন বলবে বলেছিলে আজ'- মধুরিমার স্বাভাবিক গলা শুনে বিতনুর চমক ভাঙ্গে। 'না, তেমন কিছু না। পরে একদিন বলা যাবে- বরং চল উঠি আজ'- বিতনু সেই বিশেষ কথাটা বলে এই অল্প সময়ের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফায় আগ্নেয়গিরি থেকে লাভা উদ্গিরণ দেখতে চায়না। 'সকালে মোবাইলে যখন তুমি কি একটা কথা বলবে বলেছিলে তখন কিন্তু একবারও মনে হয়নি যে কথাটা তেমন কিছু না। জানতো মেয়েদের কেউ যদি একবার একটা কথা বলবে বলে তবে সেটা না শোনা পর্যন্ত তাদের মনে শান্তি বা স্বস্তি থাকে না। দিস ইজ ইউনিভার্সাল। অবশ্য তোমার মত ঢ্যাঁড়শ কিসিমের লোক এটা নাও জানতে পারে'- মধুরীমা খিল খিল করে হাসে। বিতনু হা করে তাকিয়ে থাকে সেই শরীর দুলিয়ে হাসতে থাকা পার্শ্ববর্তিনীর দিকে- মেয়ে মাত্রেই কি পাগলী নাকি? কথাটা না বলে আজ পার পাওয়া যাবে না, বিতনু বুঝে যায়।      

     

'পাগলী তোমার সাথেই ভয়াবহ জীবন কাটাতে চাই/ অশান্তি চরমে তুলবে, কাকচিল বসবে না বাড়িতে/ তুমি ছুঁড়বে থালা বাটি, তুমিই ভাঙ্গবে কাঁচের বাসন/ পাগলী তোমার সঙ্গেই বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাতে চাই'- বিতনুর আবৃত্তি মাঝপথে থামিয়ে দেয় মধুরিমা- 'দারুন কবিতাটা কিন্তু! তুমি আর একদিন বলেছিলে এটা- ইয়েস মনে পড়েছে জয় গোস্বামীর লেখা, ঠিক কিনা'? বিতনুকে নীরব থাকতে দেখে কনুই দিয়ে গুঁতো মারে মধুরিমা- 'কি ভুল বললাম? হতেই পারে না। বলেছিলাম না আমি যদি কবির নাম ঠিক ঠিক বলি দেন দ্যাট উড ডিজহার্টেন ইয়্যু। তোমাদের জন্য রিয়েলি করুণা হয় আমার'। 

          

'শোনো ম্যাডাম, ওটা আমার প্রয়োজনে, আমারই করা জয় গোস্বামীর কবিতাটার আংশিক পরিবর্তিত বা বিকৃত ভার্সন'- বিতনু এই অব্দি বলতে না বলতেই ওর মুখ থেকে ফের বাকি কথা ছিনিয়ে নেয় মধুরিমা- 'ও আচ্ছা আচ্ছা, পাগলী  তোমার সাথেই ভয়াবহ জীবন কাটাতে চাই- মানে এই কথাটাই তোমার আজ আমাকে বলার ছিল। ইয়্যু মীন আই অ্যাম ক্রেজি! বেশ তাহলে আমার মত পাগলী যে তোমার থালা বাটি, গ্লাস বা মাথা ভাঙ্গবে তার সাথেই বা তুমি সারাজীবন কাটাতে যাবে কেন? এই পাগলী একাই বেশ আছে, আমাকে আমার মত থাকতে দাও। উঠি আজ- শুভরাত্রি'।                  

     

পার্কটার বেঞ্চে বসে বসেই বিতনু মধুরিমার চলে যাওয়া দেখে- কুর্তি আর জিন্স পরা দীর্ঘাঙ্গী চেহারাটা লম্বা লম্বা পা ফেলে একসময় দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। মনে মনে কপাল চাপড়ায় বিতনু, জয় গোস্বামীর উপরও রাগ হয়। ভদ্রলোক কয়েক হাজার অতি চমৎকার কবিতা তো লিখেইছেন, অন্তত এই কবিতাটা না লিখলেও তো পারতেন। লিখলেও অন্তত পাগলী শব্দটা বাদ দিতে পারতেন। তবে মধুরিমা পাগলী না হলেও মুড সুইয়িং এর মরীজ তো বটেই- টু মাচ আনপ্রেডিক্টেবল। অবশ্য মধুরিমার স্বভাব এমন তরঙ্গোচ্ছ্বাসে ভরা বলেই হয়ত  বিতনুর মধুরিমাকে নিয়েই এক উথাল পাথাল জীবন কাটাবার বাসনা জেগেছে।

         

মধুরিমাকে নিয়েই বিতনু তরঙ্গক্ষুব্ধ জীবনসমুদ্রে একবার ডুবতে একবার ভাসতে চায়। আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে বিতনুও উঠে পড়ে। রাতে শোয়ার আগে নিজের আহাম্মকির জন্য অনুতাপ প্রকাশ করে বিতনু একবার মধুরিমাকে ফোন করার কথা ভাবে। কিন্তু ম্যডাম ধরবেন কিনা কে জানে। ধরলেও আবার কি মুখঝামটা দেবে- না থাক।  তা' পিছিয়ে গেলে হবে? নিজেই তো পাগলীর সাথে এক ভয়াবহ অশান্তিকর বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলে। আর এখন মুখঝামটা খাওয়ার ভয়ে গুটিয়ে যাচ্ছ! তাই তো! 'সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কি ভয়'। যা হবার হবে। বিতনু মোবাইলের দিকে হাত বাড়ায়। হ্যালো-                          

     

'এত রাতে ফোন, কি ব্যাপার কবি জয় গোস্বামী পেত্নী, চুড়েইল নিয়ে আরও কি কি কবিতা লিখেছেন সেগুলোও তোমার প্রয়োজনে বিকৃত করে শোনাবে নাকি? ভদ্রলোক কোন নারীর পাগল জীবনসঙ্গীর সাথে উত্তাল অশান্তির সংসার করার বাসনা নিয়ে কিছু লেখেননি বুঝি। দেখলে তো সেই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাধারা'- মধুরিমা যেমন শরীর দুলিয়ে হাসে এখন যে ঠিক তেমনি করে হাসছে তা যেন দিব্যি দেখতে পাচ্ছে বিতনু। 

              

'বুঝলে ম্যাডাম একজন পাগলী যতটা বর্ণময়, যতটা আকর্ষণীয় চরিত্রের হয় একটা পাগল ঠিক ততটাই বর্ণহীন, ম্যাড়মেড়ে, টোট্যালি আনঅ্যাট্রাক্টিভ। জয় গোস্বামী লেখেননি তো কি হয়েছে কোন জয়া গোস্বামী হয়ত লিখবেন, চাইলে তুমিও লিখতে পার'- কথাটা বলেই বিতনুর মনে হয় আবার বাক্‌বিচ্যুতি ঘটে গেল। তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ বদলাতে সচেষ্ট হয় বিতনু- 'কি করছিলে এখন? তখন ওভাবে উঠে চলে এলে তাই তোমাকে তো ভালোমত দেখিইনি। এই মুহূর্তে তোমাকে না ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে, একটা ভিডিও কল করি'?   'নো, একদম না, এই রাত বিরেতে তুমি আমার প্রাইভেসিতে উঁকিঝুঁকি মারতে চাও কোন আক্কেলে? এখন ফোন রাখো, পাগল কোথাকার'।  'দেখলে তো কবি অমিয় চক্রবর্তী কি এমনি লিখেছিলেন মেলাবেন তিনি মেলাবেন- এক পাগলী আর এক পাগলকেও তিনি মেলাবেন'- বিতনু মোবাইলকে আজ রাতের মত ছুটি দিয়ে দেয়।             

       

পরদিন মধুরিমার দেখা পায়না বিতনু, মোবাইলও সুইচড অফ। কি হল আবার?  শুভ্রাদিকে জিজ্ঞেস করবে? শুভ্রাদির বাড়িতেই মধুরিমার সাথে বিতনুর প্রথম দেখা  হয়েছিল। না থাক বরং মধুরিমাদের ওয়ার্কিং লেডিজ হোস্টেলের ম্যানেজার তুলসীবাবুকে ফোন করা যেতে পারে। তুলসীবাবু জানায় আজ সারাদিন মধুরিমা ঘর থেকেই বেরোয়নি, লাঞ্চ রুমেই সার্ভ করা হয়েছে। তার মানে বিতনুর ওর সাথে জীবন কাটাবার প্রস্তাব মধুরিমাকে আবার ভীষণভাবে ভুলতে চাওয়া সেই অপমানের দুঃসহ স্মৃতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘদিনের প্রেমিক যার সবরকম ইচ্ছার কাছেই নিজেকে সমর্পণ করেছিল তারই বিশ্বাসঘাতকতার অভিঘাতে সৃষ্ট সেই মনের মাঝের ক্ষতস্থান থেকে যে মাঝেমাঝেই ক্ষরণ হতে থাকে তা' মধুরিমার মুখ থেকেই বিতনু শুনেছে। বিতনু এটাও বুঝেছে একমাত্র ভালোবাসাই মধুরিমাকে দুঃস্মৃতি ভুলিয়ে এক নতুন জীবন শুরু করার স্পৃহা যোগাতে পারে।           

       

শুভ্রাদি বিতনুর দিদির ছোটবেলাকার বন্ধু। দিদির অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর শুভ্রাদি নিজের উদ্যোগে বিতনুর দিদির জায়গাটা পুরোপুরি নিয়ে নিয়েছিল। শুভ্রাদির মেয়ে খেয়ার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে শুভ্রাদির অফিসের কয়েকজনও এসেছিল, মধুরিমা তাদের একজন। শুভ্রাদিই বিতনুর সাথে সবার পরিচয় করিয়া দিয়েছিল। গল্পগুজবের মাঝে একসময় গানবাজনাও শুরু হয়ে গেল। অনেকেই বেশ ভালো গাইল, মধুরিমা সবার অনুরোধ সত্বেও কিছুতেই গাইতে রাজী হলনা। অতিথিদের মধ্যে ভদ্রতাবশত কেউ বিতনুকেও গান গাইতে বলে থাকবে। আমুদে ও সঙ্কোচহীন স্বভাবের বিতনু তৎক্ষণাৎ শুরু করে দেয়- 'জিন্দগি এক সফর-'। কেউ যে এমন বেসুরো গাইতে পারে বিতনুর গান না শুনলে শুভ্রাদিরও জানা হতনা। খেয়ার বন্ধুদের সে কি হাসি! সেই হাসি মুহূর্তে ছোঁয়াচে হয়ে গেল। বিতনুর অবশ্য এসবে একটুও হেলদোল নেই বরং বিতনু শরীর দুলিয়ে মধুরিমার হাসি দেখে যাচ্ছিল। এমন আরও একবার দেখা যেতেই পারে।         

     

'কেউ কি আর হাসতে বাকি আছে তাহলে আমি আরও একটা গান গাই'- বিতনুর ঘোষণায় শুভ্রাদি হেসে হাতজোড় করে- 'বিতনু, তুই কি চাস সবাই না খেয়েই পালিয়ে যাক'। 'একজন কিন্তু হাসেনি'- বিতনুর দৃষ্টি অনুসরণ করে সবার চোখ মধুরিমার উপর পড়ে।  'রাইট, আমি হাসিনি কারণ গানটা সত্যিই আমি খুব এনজয় করছিলাম'- মধুরিমার চটপট জবাব শুনে বিতনু তো বটেই বাকিরাও হকচকিয়ে গেল- বলে কি এই সুন্দরী? মাথায় গোলমাল কিছু নাকি কে জানে। ততক্ষণে মধুরিমা আবার শরীর দুলিয়ে হাসা শুরু করে দিয়েছে। সে হাসি যেন আর থামতে চায়না। অপ্রতিভ বিতনু কি বলবে বা করবে ভেবে পায়না- একদৃষ্টিতে মধুরিমার দিকে তাকিয়ে থাকে। রাতে শুয়ে শুয়েও মধুরিমার হাসিটা বারবার বিতনুর মানসপটে ভেসে ওঠে। আচ্ছা, মধুরিমাও কি বিতনুর হেঁড়ে গলার গানটা মনে করে হাসছে? কে জানে। নো প্রবলেম- কাল বিতনু ফোন করে জেনে নেবে। তারজন্য তো মধুরিমার মোবাইল নম্বরটা তো চাই।          

      

পরদিনই আবার শুভ্রাদির বাড়িতে হাজির হয় অফিস ফেরতা বিতনু। শুভ্রাদি চা করতে গেলে সেন্টার টেবিলে পড়ে থাকা শুভ্রাদির মোবাইল থেকে মধুরিমার নম্বরটা তুলে নেয় বিতনু। বাড়িতে ফিরেই বিতনু মধুরিমাকে রিং করে, মোবাইল বেজে যায় কেউ ধরে না। পরের বার অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে- 'হ্যালো'। 'আমি বিতনু, আপনার সাথে কাল'- বিতনু আর কিছু বলার আগেই মুখঝামটা খায়- 'সো হোয়াট! হোয়াই ইয়্যু পিপ্‌ল আর সো শেমলেস। আর যদি কখনো ভুলেও ফোন করেছেন তবে ইয়্যু উইল শিওরলি ল্যান্ড ইন বিগ ট্রাবল'।

             

বিতনুর হাত থেকে মোবাইল পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। বাপরে বাপ! অমন শরীর দুলিয়ে হাসা একজন সুন্দরী মহিলা যে এমন খতরনাক মেজাজের হতে পারে ভাবাই যায়নি। নাঃ, এত অধৈর্য না হয়ে আরও একটু হোম ওয়ার্ক করা দরকার ছিল। বিতনুকে বন্ধুরা এমনি এমনি তো আর 'চিরবালক' অভিধা দেয়নি। সেদিন আড্ডায় আর যাওয়া হয়না বিতনুর। বাইরের পোশাক না ছেড়েই বিছানায় শুয়ে শুয়ে বিতনু নিজেকে সান্ত্বনা দেয়- সবার দ্বারা সবকাজ হয়না, এটাই জগতের নিয়ম। একটা শিক্ষা হল বটে! হঠাৎ পাখা গজানো একটি পিঁপড়ার মিসঅ্যাডভেঞ্চার! কিন্তু ভদ্রমহিলার কি স্প্লিট পার্সোনালিটি? নাহলে অমন শরীর দুলিয়ে হাসা সুন্দরী এমন আজব ব্যবহার করে? বিতনুর কথাটাই শুনল না- আশ্চর্য।              

     

শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে দুচোখ লেগে এসেছে বিতনু টেরই পায়নি। এদিকে মোবাইলটা যে অনেকক্ষণ ধরে রিং টোন 'বারান্দায় রোদ্দূর' বাজিয়ে চলেছিল সেটা আবছা টের পেয়েও বিতনু ধরেনি। বন্ধুদের কেউ হবে, আজ আড্ডায় গরহাজিরার কারণ শুনতে চাইবে। ভুল হল, ফোনটা ধরা উচিত ছিল। খবর না পেয়ে বন্ধুরা শিওর খোঁজ নিতে বাড়িতে এসে হাজির হবে, আর এলে রাত দশটার আগে উঠবেই না। বিতনুর আজ কথা বলার মুডই নেই। আবার 'বারান্দায় রোদ্দূর' বেজে ওঠে। বিতনু শুয়ে শুয়েই মোবাইল কানে ধরে- 'হ্যালো'। 'ফোন ধরছিলেন না কেন? ভয়ে? তা' বেশ। তখন কেন ফোন করেছিলেন? আবার একটা গান শোনাবার ইচ্ছে হয়েছিল নাকি। তা' এখন শোনাতে পারেন। অবশ্য গানটা না শুনেই আমার হাসি পাচ্ছে'- বিতনু নিশ্বাস নেয়া বন্ধ করে অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে আসা রমণীকন্ঠের হাসির শব্দ শুনতে থাকে। কিন্তু কিছু তো বলতে হয়। 

                

'আজ্ঞে'- বিতনু কথা ফিরে পায়- 'মুকুন্দরাম লিখেছিলেন না 'পিপীলিকার পাখা উঠে মরিবার তরে'- ধরুন সেরকমই এক পিপিলিকা মরার বাসনায় ফোন করেছিল'। 'মুকুন্দরাম কে?'- মধুরিমা জানতে চায়। 'আপনি সিবিএসই না আইসিএসই? এনি ওয়ে- মুকুন্দরাম মানে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী যিনি আজ থেকে'- বিতনু বলা থামিয়ে দেয়। 'হ্যাঁ, আজ থেকে- তারপর?'- মধুরিমা শোনার আগ্রহ দেখালেও বিতনুর বিশ্বাস হয়না- 'তারপর শুনতে হলে কাল ফোন করুন তবে রাত দশটার পর'। কাল আর বিতনু নিজের থেকে ফোন করতে যাচ্ছেনা।         

     

আচ্ছা, মুকুন্দরামের নাম নেবার কি দরকারটা ছিল? এর পর চন্ডীমঙ্গল এসে যেত। ওটা কোন প্রার্থিত মহিলার সাথে প্রথম আলাপনের প্রিল্যুড না বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ক্লাস ছিল? সিম্পলি পিঁপড়ের পাখা গজায় মরার জন্য বললেই তো মতলব কি বাত বলা হয়ে যেত। ডিজগাস্টিং! নিজের উপর রাগ চেপে রাখতে পারেনা বিতনু। পরদিন সন্ধ্যাটা একটি ফোনের অপেক্ষায় কেটে যায় বিতনুর। রাত বারোটার পরে 'বারান্দায় রোদ্দূর' বেজে ওঠে। রিং টোনটা বদলাতে হবে, রাতের বেলায় 'বারান্দায় রোদ্দূর' যে আসেনা সে খেয়াল অবশ্য এতদিন হয়নি।  

                 

'হ্যালো ম্যাডাম'- বিতনুর সাবধানী গলার উত্তরে শোনা যায়- 'শুনুন মিস্টার বিতনু, আমি কিন্তু বাংলা মাধ্যমেই পড়াশোনা করেছি। আমি জানি মুকুন্দরাম কে ছিলেন, দেখতে চাইছিলাম আপনি জানেন কিনা, কিন্তু সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেলনা'- মধুরিমা হাসতে হাসতেই ফোন কেটে দেয়। একজন প্রায় অপরিচিতা সেন্সিটিভ মহিলাকে প্রথম দিনের আলাপেই সিবিএসই না আইসিএসই জিজ্ঞেস করে চিমটি কাটার আহাম্মকি কেন যে করতে গেল- বিতনুর আঙ্গুল কামড়াতে ইচ্ছে করে।                   

      

পার্কটার বেঞ্চে একা একা বসেই বিতনু মনে মনে হাসে- সেই আহাম্মকি করে আঙ্গুল কামড়ানোর ইচ্ছে হওয়ার ট্র্যাডিশনটা গত বছরখানেক ধরেই বিনা ব্রেকে চলে আসছে এবং আগামী দিনেও না চলার কোন কারণ নেই। মধুরিমা এখনও এলনা, অন্যদিন এলে আরও আগেই চলে আসে। বরং বিতনুই মাঝেসাঝে দেরী করে ফেলে তারপর দেরী হওয়ার ঝুটা অজুহাত দেখাতে গিয়ে মধুরিমার হাতে ধরাও পড়ে। বিতনু ঘড়ি দেখে, আর দশ পনের মিনিট অপেক্ষা করে দেখা যাক্‌- ওর মন বলছে মধুরিমা আজ আসবেই। নাঃ! বিতনুর মন ঠিক বলেনি- মধুরিমা আজও এলো না। নিরাশ বিতনু উঠে পার্কের গেটের দিকে হাঁটা ধরে।

            

হঠাৎ চোখ পড়ে কিছুটা দূরে একটা বেঞ্চের দিকে- এই প্রথম শাড়ী পরে এলেও মধুরিমাকে চিনতে একটুও অসুবিধা হয়না। বিতনু বেঞ্চটার কাছে গিয়ে মধুরিমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। বেঞ্চটায় বসা অন্য দুজন বিতনুকে দেখে উঠে চলে যায়। 'শরীর ঠিক আছে তোমার?'- বেঞ্চে বসতে বসতে বিতনু জানতে চায়। মধুরিমা অন্য দিকে তাকিয়েই মাথা নাড়ে। 'তা' এখানে একা একা বসে আছ, রাগ করেছ নাকি আমার উপর?'- মধুরিমা মুখ না ঘুরিয়ে এবারও মাথা নাড়ে। বিতনুর অভিজ্ঞতা বলে এই থম মেরে যাওয়া আবহাওয়া কালবৈশাখীর নিশ্চিত পূর্বাভাস। সতর্কতা হিসেবে এখন আর কথা না বাড়ানোই যথার্থ হবে।            

     

'তুমি জানতে চাইলে না কেন তোমার উপর রাগ করেছি'- মধুরিমা এবার বিতনুর মুখোমুখি হয়- 'সত্যিই কি তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও বিতনু? তুমি তো জান আমার একজনের সাথে দীর্ঘদিন ইন্টিমেট রিলেশনশিপ ছিল। তাও তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও?  তোমার উপর আমার খুব রাগ হয় বিতনু- তুমি এমন কেন'। বিতনুর বুকে মাথা রেখে এবার কান্নায় ভেঙ্গে পরে মধুরিমা। কাঁদুক, কেঁদে হালকা হোক- বিতনু মধুরিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এই পার্কে বসে দুজনে এতদিন শুধু হাসাহাসিই করে এসেছে, আজ না হয় কাঁদার পালা এসেছে। বিতনুর লক্ষ্য করে আশেপাশের লোকজনের চোখ ঘুরেফিরেই ওদের দিকে আকর্ষিত হচ্ছে। বিতনু হাত দিয়ে ধরে মধুরিমাকে উঠিয়ে বসিয়ে দেয়- এই দু'দিনেই চেহারাটা কি বানিয়েছে! বোঝাই যায় মনের উপর দিয়ে কি ভয়ঙ্কর ঝড় বয়ে গেছে। দুজনেই নির্বাক হয়ে বসে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতা বিতনুর ছেলেমানুষি শুষে নিয়েছে।           

      

'দ্যাখো মধুরিমা, তোমার প্রেমে প্রতারিত হওয়ার কথা তুমিই আমাকে বলেছ। আমি কিন্তু তোমাকে এই ব্যাপারে কোনদিনই কিছু জিজ্ঞেস করিনি বা জানতে চাইনি। নাউ প্লীজ  ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড যদি আমি তোমার অতীতের অ্যাফেয়ার্সটা অন্যভাবে নিতাম তবে আমি আগেই তোমার থেকে দূরে সরে যেতাম- তাইনা? একটা ঘটনা ঘটে গেছে, না ঘটলে ভালো ছিল।      আমি স্বীকার করছি প্রথম প্রথম ব্যাপারটা মেনে নিতে আমার একটু কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু এক উন্মাদিনী যে আমাকে উত্তাল জীবনের প্রলোভন দেখিয়েছে তাকে ছাড়া যখন বাঁচবোই না তখন বাকি সব আমার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেল'- বিতনু হাসে- 'এখন আমাকে ডোবালেও তুমি, ভাসালে ভাসালেও তুমি'।    

      

'ওরে আমার ন্যাকা চৈতন্য রে! বিতনু তোমার এইসব বোকা বোকা ভালোবাসার কথাগুলো আমাকে একটুও ইম্প্রেস তো করেইনা বরঞ্চ মাথা গরম করে দেয়। পুরুষদের মুখে ভালোবাসার কথা একধরণের ছল। এখন তুমি এমন একটা ভাব দেখাচ্ছ যেন তুমি প্রেম, ভালোবাসার একজন পোস্টারবয়- এই তুমি, ইয়েস তুমিই যথাসময়ে তোমার আসল চেহারাটা দেখাবে লাইক অল আদার মেন। থাবার লুকনো নখগুলো বের করে আমাকে ছিন্নভিন্ন করবে'- মধুরিমা আবার কাঁদে।   


'এই পুরুষতন্ত্রের উপর তোমার তো ভীষণ রাগ, কিন্তু একবার ভেবে দেখেছ এই সমস্ত  শারীরিক শুচিতা, পবিত্রতার সংস্কারগুলো মেয়েদের মাথায় এই পুরুষতন্ত্রই তার স্বার্থে গেঁথে দিয়েছে। আমি যখন এসব নিয়ে ভাবিত নই তখন শিক্ষিত, আত্মনির্ভর হয়েও তুমি কেন এসব নিয়ে অপরাধবোধে ভুগছ, অকারণে কষ্ট পাচ্ছ।  কাম অন মধুরিমা, লেট'স স্টার্ট এ নিউ লাইফ, সব ঠিক হয়ে যাবে'।                           

'আরে ব্বাঃ! তুমি তো মনে হচ্ছে আমাকে বিয়ে তো নয় উদ্ধার করে নিজেকে ভগবানের লেভেলে নিয়ে যেতে চাইছ। কিন্তু কেউ একজন বলেছেনা শয়তানের সাথে কষ্ট করে হলেও হয়ত মানিয়ে চলা যায় বাট নো নেভার উইদ দ্য ভগবান। সো আই উইশ নট টু লিভ টুগেদার উইথ দ্য সেল্ফস্টাইল্ড ভগবান নেম্‌ড বিতনু। আমি একাই বেশ ভালো আছি। লেট আস পার্ট অ্যাওয়ে ফর এভার- তুমি অন্য কোন পাগলী খুঁজে নিও। আমার শুভেচ্ছা রইল'। মধুরিমা আর বিতনুর প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা না করেই হাঁটা দেয়। 


পার্ট অ্যাওয়ে ফর এভার? হতবাক বিতনু মধুরিমার গমনপথের দিকে অপলক চেয়ে থাকে। মধুরিমার আজকের চলে যাওয়া অন্য দিনগুলের চেয়ে আলাদা। বিতনুর মনে হয় মধুরিমা মনস্থির করেই আজ এসেছিল। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়েও উঠে দাঁড়াতে পারেনা। সমস্ত বোধশক্তিই যেন নিমেষে উবে গেছে। পৃথিবীর সমস্ত আলো যেন নিভে গেছে, সব কোলাহল থেমে গেছে। বিতনুর নিজকে ঝড়ে ভেঙ্গে পড়া গাছের মত মনে হয়। একসময় পার্কের গেট বন্ধ হওয়ার সময়সঙ্কেত শোনা যায়। কোনমতে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায় বিতনু।      

      

রাতে শুয়ে শুয়ে বিতনু ভাবে মাত্র এক বছরের একটা সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ায় যদি এমন মানসিক যন্ত্রণা হয়, এমন অবসাদ আসে তাহলে মধুরিমাকে  প্রেমে প্রতারিত হয়ে কতটাই না মানসিক কষ্ট সইতে হয়েছে। শুভ্রাদি, বন্ধুরা সবাই তো এই সম্পর্কের কথা জেনে বসে আছে- এবার কি হবে? বিতনু বিছানায় এপাশ ওপাশ করতেই থাকে। হায়! এক উন্মাদিনীকে ভালোবাসার পুরষ্কার এই নিদ্রাহীন যামিনী আর অনন্ত হতাশা। সব শেষ! বিতনুর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে।  রাত ক'টা হল কে জানে? দুটো আড়াইটা তো হবেই। জলতেষ্টা পাচ্ছে- বিতনু উঠে বসে। 'পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব'- বেজে ওঠে! 


কয়েকদিন হল মাত্র আগের রিংটোনটা বদলে নিজের আবৃত্তি করা 'পাগলী, তোমার সঙ্গে....' কবিতাটার প্রথম কয়েকটি লাইন নিজের মোবাইলের রিংটোন হিসাবে আর মধুরিমার আবৃত্তি করা কবি অমিয় চক্রবর্তীর 'সংগতি' (মেলাবেন তিনি মেলাবেন) কবিতাটার কয়েকটা লাইন মধুরিমার মোবাইলের রিংটোন হিসেবে সেট করে দিয়েছিল বিতনু। একটু পরে মোবাইল আবার বেজে ওঠে। স্ক্রিনে মধুরিমার নাম- অদ্ভুত নির্লজ্জ মহিলা তো! কোন দরকারই নেই ধরার। কলটা কেটে দিয়ে মোবাইল সুইচ্‌ড অফ করে দেবে? না, না, কারো মুখের উপর এমন করা যায় নাকি? না ধরলেই হোল, নিজেই ছেড়ে দেবে। বিতনু টয়লেটের দিকে পা বাড়ায়। 


টয়লেট থেকে চোখেমুখে জলের ছিটা দিয়ে ফিরে এসে বিছানায় বসতে না বসতেই আবার 'পাগলী, তোমার সঙ্গে-'। নাঃ, ইটস ট্যু মাচ, কিছু বলা দরকার- হ্যালো। প্রয়োজনে নিজের কন্ঠস্বর যে এমন শীতল, গম্ভীর, ধাতব করতে পারে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়ে বিতনু নিজেই অবাক হয়।    

                                       

'কলটা ধরলে কেন? আমি তো তোমার রিংটোনটা তোমাকেই শোনাচ্ছিলাম।    কথা না বাড়িয়ে বিতনু কলটা কেটে দেয়। একটু পরে মোবাইল আবার বেজে ওঠে তারপর থেমেও যায়। বিতনু মোবাইলটা সাইলেন্ট মোডে রেখে দেয়। কয়েকমিনিট পর মোবাইলের স্ক্রিনে আলো জ্বলে ওঠে। আর একবার স্ক্রিনে আলো জ্বললেই বিতনু মোবাইল সুইচ্‌ড অফ করে দেবেই- তবে সেটা অন্য প্রান্তের বিরক্তকারিনীকে জানিয়েই করবে। কয়েকমিনিটের মধ্যেই মোবাইলের স্ক্রিন আলোকিত হয়ে বিতনুকে তার মোবাইল সুইচ্‌ড অফ করার সিদ্ধান্ত মনে করিয়ে দেয়। মনটা শক্ত করে বিতনু কলটা রিসিভ করে মোবাইলটা কানে লাগায়- হ্যালো, এবার কিন্তু আমি  মোবাইলটা সুইচ্‌ড অফ করে দিতে বাধ্য হব'।       

              

'সুইচড অফ করে দেবে মানে? হাউ ডেয়ার ইয়্যু!'- মধুরিমা হুঙ্কার দিয়ে ওঠে- 'তুমিই তো চেয়েছিলে কোন এক পাগলীর সাথে  চরম অশান্তির জীবন কাটাতে- চাওনি? 


'হ্যাঁ, আমি চেয়েছিলাম কিন্তু পাগলী রাজী হয়নি। সুতরাং'- বিতনু কন্ঠস্বরে দৃঢ়তা বজায় রাখতে সচেষ্ট।


'সুতরাং মিস্টার বিতনু ইয়্যু আর এ গ্রেট ঢ্যাঁড়শ'- মধুরিমা খিল খিল করে হাসতেই থাকে যেন থামবেই না আর কোনদিন। ঠিক সেই হাসি-  যে হাসি বিতনু মধুরিমাকে শরীর দুলিয়ে শুভ্রাদির বাড়িতে প্রথম হাসতে দেখেছিল। যে হাসি বিতনুকে এক পাগলীর সাথে উত্তাল জীবন যাপনের অপ্রতিরোধ্য বাসনা জাগিয়েছে- ঠিক সেই হাসি! এই হাসিই বিতনুকে একবার ডুবিয়ে একবার ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে।  বিতনুর সব হিসেব আবার গোলমাল হয়ে গেল। হতাশা, অবসাদ ভুলে বিতনুর এই মুহূর্তে মধুরিমাকে ভারী দেখতে ইচ্ছে করে। ম্যাডামকে বলবে সে কথা? এই মাঝরাতে যদি মুখঝামটা দেয়? তা' দিলে দিক- এই তো গ্রেট ঢ্যাঁড়শ বলল। বললো তো বললো।  মধুরিমার হাসির মাঝেই ওকে এই মুহূর্তে একবার দেখার কাতর বাসনা জানায় বিতনু।


'তাই?- ঠিক আছে, আমিই তোমাকে একটু পরে ভিডিও কল করছি'- মধুরিমা হেসে ফোন কেটে দেয়।      

      

বিতনুর অপেক্ষার প্রহর যেন আর কাটে না, কিন্তু মধুরিমার কল যে আর আসে না।  বিতনু বুঝে যায় নিজেও জেগে থেকে বিতনুকে এভাবেই সারারাত জাগিয়ে রাখবে এই উন্মাদিনী। আচ্ছা ঠিক আছে,  ধরবেনা জেনেও বিতনু মধুরিমাকে বারবার কল করে যায়। উন্মাদিনীও শুনুক, শুনতে থাকুক ওর মোবাইলের রিংটোনটা- 'মেলাবেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর/ পোড়ো বাড়ীটার/ ঐ ভাঙ্গা দরজাটা/  মেলাবেন' যেমন বিতনু এতক্ষণ শুনেছে- 'পাগলী, তোমার সঙ্গে  ভয়াবহ জীবন কাটাব'।      

Comments

  1. সুব্রত ভট্টাচার্যMarch 6, 2023 at 1:37 PM

    সাধারণ বিষয় বস্তু থেকে একটু অন্যরকম l কবিতার ছোঁয়া আছে l বেশ ভালো লাগলো l

    ReplyDelete

Post a Comment