চার পুরুষ
ইন্দ্রলোক আবাসনে আজ হঠাৎ দুজন মানুষ ঢুকে পরলো। পঞ্চাশোর্ধ দুজন মহিলা, চেহারায় তাদের মিল আছে। শীর্ণকায়, মুখে মাস্ক, হাতে শাখা পলা, পোষাক এবং শরীরে দারিদ্রের চিহ্ন ।
সাধারনত কোনো মানুষ এখানে এভাবে ঢুকে পরতে পারে না। এই আবাসনে চল্লিশ টি পরিবার থাকে। গেটে সব সময় একজন রক্ষী থাকে। নতুন মানুষ এলে রক্ষী তাদের পরিচয় জেনে নেয়। আবাসনের কোনো মানুষের নাম বললে , জিজ্ঞাসাবাদের পর, নিরাপদ মনে হলে রক্ষী খাতা এগিয়ে দেয়। সেখানে বিস্তারিত লিখে তারপরই ভেতরে আসবার অনুমতি মেলে।
আজ নিরাপত্তা রক্ষী নেই । বিশেষ কাজে সে দু দিনের ছুটি নিয়েছে। সুতরাং আজ এমনটা হতেই পারে। আবাসনের নীচতলায় দাঁড়িয়েছিল ওরা চারজন। লকডাউনের সময় বাইরে যাবার কোনো উপায় নেই। সেজন্য কিছু বাসিন্দা নীচে পায়চারী করেন আর দুরত্ব রেখে গল্পগুজব করেন । তিন জনের পরনে বারমুডা, টি শার্ট, একজন পাজামা পাঞ্জাবী। মুখে তাদের মাস্ক। পকেটে স্যানিটাইজারের বোতল।
যে চারজন নীচে দাঁড়িয়েছিল তারা হলেন অভিজিত, তপন, নীলাদ্রী আর তাপস। অভিজিত, তপন, নীলাদ্রী সরকারী চাকরি করেন। তাপসের শহরে ব্যাবসা আছে। মাঝে মাঝেই এদিক ওদিক ঘুরতে হয়। সকলেই পঞ্চাশোর্ধ , এই আবাসনের বাসিন্দা। ওরা বন্ধুস্থানীয়, প্রায়দিনই নির্দিষ্ট সময়ে নীচে নেমে আসে , তারপর অনেকক্ষণ গল্পগুজব চলে।
বিভিন্ন বিষয়ে ওদের আলোচনা চলে। বেশীর ভাগটা জুড়ে থাকে , হঠাৎ কেউ কোভিড ১৯ আক্রান্ত হলে কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে । কোন রাজ্য কিভাবে মোকাবিলা করছে। রাজ্যের কিভাবে করা উচিত, সরকারের সাথে কিভাবে সহযোগিতা করা উচিত। কিছু ডাক্তার ,স্বাস্থ্যকর্মী কিভাবে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে কাজ করছেন। আর শহরের কিছু ডাক্তার কিভাবে বিপদের দিনে দরজা এঁটে বসে আছেন। কিছু মানুষ ডাক্তার , রোগীর পরিবার কে নিজের পাড়াতে অসহযোগিতা করছে। কিছু হাসপাতাল বার বার রোগীদের ফিরিয়ে দিচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি ।
বাড়িতে আজকাল পুরুষ মানুষদেরও বেশ কিছু কাজে সাহায্য করতে হচ্ছে সেটাও বিরক্তি সহকারে উঠে আসে আলোচনায়। কখনও বাড়ী থেকে টেলিফোন আসতে শুরু হয়, তারপর শেষ হয় ওদের গল্প। কখনও ওদের দলে আরোও তিন চার জন বন্ধু হয়। কিন্তু আজ ওরা চারজন।
মহিলা দুজন সামনে এগিয়ে এলেন --- তাদের কিছু সাহায্য চাই। তারা খুব গরীব। একজনের স্বামী অসুস্থ ।প্রতি বাড়িতে চার/পাঁচ জন মানুষ। প্রায় দুমাস হলো তাদের রোজগার বন্ধ ।দারিদ্র যে তাদের সঙ্গী তা তাকে দেখে না বোঝার উপায় নেই।
দাঁড়িয়ে আছেন মহিলা দুজন । একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওরা চারজন। সকলের মুখে মাস্ক। কিন্তু একটু টেনে নামানো যাতে কথাবার্তা বলা যায়।
ওরা চারজন পরস্পরের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখে । দেশ জোড়া লকডাউনে অনেক মানুষই বিপন্ন। যারা সরকারি চাকরি করেন অথবা বড় ব্যাবসায়ী, তারা ছাড়া অনেকেই নিজেকে বিপন্ন ভাবছেন এইসময়ে।
অভিজিত দের এই আবাসনে অধিকাংশ বাড়িতেই দুমাস হলো কাজের লোক নেই। মাত্র কিছু বাড়িতে আছে। এছাড়া প্রায় দু মাস হলো শহরের প্রায় দোকানপাট, যানবাহন বন্ধ । স্থানীয় এবং অন্য রাজ্য থেকে ফিরে আসা অনেক মানুষেরই হাতে কাজ নেই এখন, ব্যাপারটা ওরা জানে।
অভিজিতদের বাড়িতে একটি মেয়ে কাজ করত, তার নাম মালতী। প্রথম এক মাস তারা মালতীকে মাইনে দিয়েছে । তারপর না বলে দিয়েছে। বলে দিয়েছে – অসুখ বিসুখ শেষ হলে তারপর এসো। মাঝে সম্ভব হলে একবার খবর নিও। মালতী এখন মাত্র কোনও একটি বাড়ীতেই কাজ করে।
ওরা নিজেদের ভেতর আলোচনা করে নিলো। তাতে দু রকমের মতামত তৈরী হল। অভিজিত আর নীলাদ্রী বলল --- এতদিন কাজকর্ম না থাকলে পরিবারগুলো বাঁচবে কিভাবে ? যদিও কিছু সংগঠন সাহায্য করছে, কিছু সরকারী সাহায্যও পাচ্ছে, আর তাতেই বেঁচে আছেন কিছু অতি দরিদ্র মানুষ। সুতরাং আমাদের যা পারা যায় সাহায্য করা প্রয়োজন। সামান্য কিছু সাহায্য করতে তৈরী হয়ে গেলো ওরা।
তপনের কিন্তু মত কিছুটা আলাদা। তপন বলল --- মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলে যে চাঁদা জমা হয় সেখান থেকেই এদের সাহায্য করা উচিত। আমরা তো সরকার কে সময়মত কর দিই। আমাদের এক দিনের মাইনে তো মুখ্যমন্ত্রীর ফান্ডে জমা হয়ে গেছে। শহরের বিধায়ক আছেন, সাংসদ আছেন, মন্ত্রী আছেন তাদেরই তো দেখার কর্তব্য এই সব মানুষদের । তাপস কিছু বলল না । বোঝা গেলনা ও এব্যাপারটায় সহমত নাকি অন্য কিছু ভেবে চলেছে ।
অভিজিত আর নীলাদ্রী সামান্য কটি টাকা তুলে দিলো মহিলা দুজনের হাতে। হাত পেতে সাহায্য নিলো তারা। বাকী দুজনের জন্য একটু অপেক্ষা করলো । কিন্তু পাবার সম্ভাবনা নেই বুঝে তারা আবাসনের গেট পেরিয়ে বেরিয়ে গেলো ।
ওরা কিছু একটা অন্য আলোচনা করতে যাচ্ছিলো। তাপস আবার এই প্রসঙ্গটাই ফিরিয়ে নিয়ে আসে । --- সরকারী সাহায্য অল্প বিস্তর পাচ্ছে ঠিকই মানুষগুলি , কিন্তু আমাদের কি হাত গুটিয়ে বসে থাকা ঠিক হচ্ছে। সামান্য কিছু সাহায্য দিলেও তো আমরা বিশেষ অসুবিধায় পরব না । কিন্তু মানুষগুলোর বিপদ উতরে যেতে পারে। প্রতিদিনই খবরের কাগজ আর সোশাল মিডিয়ায় মানুষের বিভিন্ন অসুবিধার কথা প্রকাশিত হচ্ছে। অনেক মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
এবারে তপন আর কিছু বলছে না । মনে হচ্ছে এই অল্প সময়ে তার মত খানিকটা পাল্টেছে। সে একটু চুপ করে থাকলো তারপর সহমত পোষন করলো তাপসের সাথে । বললো --- ঠিক আছে তুই যা বলেছিস সেটাও ফেলে দেবার মতো নয়। আমাদের বিপদের সময়ে আমরাও তো অন্য মানুষের সাহায্য আশা করি। চল এ সময়ে আমাদের ও কিছুটা সাহায্য করা উচিত। আমরাও এর অংশীদার হই।
ওরা চারজনেই বেরিয়ে এলো আবাসনের গেট খুলে। সোজা রাস্তা ধরে যতটুকু দেখা যায় দেখলো । একটু অপেক্ষা করলো, কিন্তু সেই মহিলা দুজনকে আর দেখা গেলো না।
Comments
Post a Comment