ভালো মন্দ
পোড়া অসুখটার জন্য ক্ষমার যখন বাইরে বেরোনো বন্ধ হয়ে গেল, তখন নবুটা হাতে করে একখানা দামী ফোন এনে দিল একদিন। ছেলেটার ওই এক স্বভাব, হাতে টাকা এলেই যন্ত্রপাতি কিনতে থাকে। কিছুদিন বাদে সেগুলো আর পছন্দ হয় না, তখন একে ওকে দিয়ে দেয় অথবা ওর গ্যারেজঘরে জমিয়ে রাখে। ঘরটা একেবারে জঙ্গল হয়ে গেছে। ও গোছাতে গেলে রাগ করে, কে যায় বাবা অশান্তি বাড়াতে!
ওদের মা-পোয়ের সুখে দুঃখে দিন কেটে যাচ্ছে একরকম, ছেলে বড় হলেও ক্ষমার বয়স অতটা নয়! ছেলে হয়েছিল তার ঠিক সতেরো বছর বয়সে, এখন ছেলে পঁচিশ। ওর বাবা হঠাৎই মারা গেল একরাতের মধ্যে, দশ মিনিটের বুক ব্যথায়! সেই দুঃখের কথা আর মনে করতে চায় না ক্ষমা। সেই থেকে নবু বাবার গাড়িটা চালাচ্ছে। ও যদি কিছু করতে পারতো মন্দ হত না, ছেলেটার ওপর বড্ড চাপ পড়ে, ওকেও সংসার চালাতে অনেকটা ভাবতে হয়। কিন্তু করবেটা কি!
নবু মোবাইলটা কিনে ওকে ফেসবুক খুলে দিয়েছে। বলেছে, বাড়িতে একা একা থাকো, তোমার ভালো লাগে না। এই দেখো, ফেসবুক, এতে বন্ধু বানাও, ছবি দেখো। মজা হবে! সেই থেকে কেমন নেশা লেগে গেছে। অনেক ফ্রেন্ড হয়েছে ক্ষমার। ওরা সুন্দর সুন্দর পোষাক পরে ছবি দেয়, খাবার বানিয়ে ছবি দেয়, খেতে খেতে ছবি দেয়! নব দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে লাইক করে, ও লাইক করে সেসব।
এখন অসুখের প্রকোপটা একটু কমেছে, মুখে মাস্ক বেঁধে দরকারে বেরোয় মাঝে মাঝে, সারাক্ষণ বাড়িতে বসে থাকতে ভালো লাগে না। বাড়ির কাজ ওর নিমেষেই শেষ হয়ে যায়। আলো ঝলমল দোকানের আশেপাশে গেলে মনটা আপনিই ভালো হয়ে যায়। তবে আজকাল যে মুশকিলটা হয়েছে, দোকান পশরার দিকে চোখ না গিয়ে শুধু মানুষের দিকে চোখ যায় আর সবাইকে চেনা চেনা লাগে, আধো চেনা! ফলে মনে করতে করতেই সময় চলে যায়, চিন্তা করতে করতে ভুরুতে ভাঁজ পড়ে, ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে ক্ষমা।
বাড়িতে ফিরে যখন ফেসবুক খোলে, তখন হয়তো ফেসবুকের পোস্ট দেখে ওর মনে পড়ে যায়, এই লোকটিকে রাস্তায় দেখে ওর অত চেনা চেনা লাগছিল। একটা লাইক মেরে দেয় তখন। কিন্তু সামনাসামনি দেখা হলে তো কেউই কাউকে কিছু বলে না। ক্ষমা নাহয় চিনতে পারেনি, অন্যজনও কি তাই? সামনাসামনি দেখা হলে কেউ কথা বলে না, বলতে ইচ্ছেও করে না, এ কেমন কাণ্ড হল! ক্ষমার ভয়-ভয় করে, কেমন যন্ত্রের মতো ব্যাভার হয়ে যাচ্ছে না?
ও একেবারেই ফেসবুক খুললো না তিনদিন। কিন্তু মনটা বড়ো উশখুশ করতে লাগলো। কি করবে কি করবে ভাবতে ভাবতে ও ট্রাঙ্কটা খুললো। ক্ষমা আগে সেলাই করতো খুব, সেগুলো কিছু অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় জমানো আছে ওতে। ঘাঁটতে ঘাঁটতে হাতে উঠে এলো এক টুকরো কাপড়, হালকা গোলাপি জমির ওপর লাল-সাদা-হলুদ-নীল সুতো ব্যবহার করে ও রাধাকৃষ্ণের মূর্তি ফুটিয়ে তুলছিল। খুব সুন্দর হচ্ছিল কিন্তু! শেষে ওটাই হাতে তুলে নেয় ক্ষমা। ধীরে ধীরে মগ্ন হয়ে যায় সেলাই-এর কাজে।
নবু এসে এসে দেখে। কিছু বলে না। ক্ষমা জানে ও দেখছে, নবুর মধ্যে একটা শিল্পী মন আছে। এ পাড়ার পুজোর মণ্ডপটা ও-ই সাজায়। ছোটোর মধ্যে ভারি সুন্দর হয় দেখতে!
আস্তে আস্তে ও শেষ করে ফেলে রাধাকৃষ্ণের সম্পূর্ণ মূর্তি। কাঁথা ফোঁড়ের কাজ। শেষ করে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যায়। নবুকেও দেখায়। ওর মুখের মুগ্ধতার হাসিটা এত ভালো লাগে!
সেই আলোটা বুকের ভেতর নিয়ে রাতে ঘুমোতে যায় ক্ষমা। সকালে ফোনে মেসেজ ঢোকার পিড়িং পিড়িং শব্দে ঘুমটা ভাঙে। কি এতো মেসেজ? ফোন হাতে নিয়ে দেখে---ওমা! এ তো নবুর কাণ্ড, ওর রাধাকৃষ্ণের ছবি ফেসবুকে, তাতে হাজারটা লাইক! পোস্টের ওপরে লেখা—আপনিও কি এরকম একটি পেতে চান? অনেকেই লিখেছে—আমি একটি কিনতে চাই, মূল্য কত?
তাই তো! এরকম একটা স্বপ্ন তো চিরকালই ছিল ক্ষমার মনে, একটা পথ তো খুলে গেল! একটু আশার আলো, একটু চেষ্টা করলে এই আলোটা তো ও জ্বালিয়ে রাখতে পারে!
না, ফেসবুকটাকে মন্দ বলে এত গাল দেওয়া যাবে না আর!
সাধারণ বিষয় নিয়ে ঝরঝরে লেখা l ভালো লাগলো l
ReplyDeleteতোমার ছোটো গল্পটি খুব ভালো লাগলো গো মঞ্জুশ্রীদি ।
ReplyDeleteঅসাধারণ হয়েছে লেখাটি। একটি সামান্য বিষয় অসামান্য হয়ে উঠেছে লেখিকার লেখার গুণে।
ReplyDeleteবড় সুন্দর, মায়া মাখানো গল্পখানি।
ReplyDelete