কবিতা - অরুণ চক্রবর্তী



চিত্রপট


সেই কান্নার দুপুরে
প্রায় আঠারো বছর আগের কথা
চৈত্রের তপ্ত মধ্যাহ্ন 
আকাশ নেমে এসেছিলো মাথার উপর দৈত্যের মতো
কি করবো ভাবছিলাম,
মা,কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিলে নিঃশব্দে সব কাজ করতে
তারপর তোমার স্বরই বন্ধ হয়ে গেলো, মা-
চোখ আর খুললেনা
তাকিয়ে থাকলাম সবাই আশায়
দেখলাম প্রকৃতই সব নিঃশব্দ
তারপর কতো বছর পার হয়ে গেলো,মা-
তোমাকে শেষ যে জায়গায় শুইয়েছিলাম মাঝে মাঝে দেখে আসি মাটি সরে গেছে কি না,
আজও গিয়ে দেখলাম
একটু উঁচুনীচু হয়েছে ঠিকই 
মাথা নামিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম
 ঈশ্বর সব চিঠিগুলো আশপাশে ঠিক রেখেছেনতো;
কেমন একটা ঝাকুনি ঘুরিয়ে দিল সমস্ত শরীর
ফিরে এলাম বাড়ি
ইচ্ছে হলো মার ফেলে যাওয়া সব একবার দেখি বাড়িতে ঠিকঠাক আছে কি না-
ইত্যবসরে গিয়েছে বন্যা দাঙ্গা ক্ষতবিক্ষত বহু ইতিহাসের দলিল
খুঁজে পাচ্ছিলামনা মার সেই দেশগাঁয়ের পুরোনা বাক্সের চাবি
চোখমুখের পারদ উঠছে নামছে দেখে ছেলের প্রশ্ন,'কি হয়েছে বাবা?'
সোজাসুজি বললাম,'ঠাকুমার সেই দেশভাগের আগের বাক্সের চাবি কোথায় জানিস?'
হতভম্ব কিছুক্ষণ 
তারপর নিঃশব্দে একটা অদেখা চাবি দিয়ে বলল,'ঠাকুমাকে শেষ যখন নিয়ে যাচ্ছিলে তখন পরণের শাড়ি থেকে খুলে পিসি চাবিটা আমায় দিয়েছিল নিঃশব্দে, আমিও ভুলে গিয়েছিলাম।'
সেই চাবি দিয়ে খুললাম মার সেই পুরোনো বাক্স-
একগুচ্ছ কাগজ,কয়েকটা ঠাকুরের ফটো,কিছু কাপড় আর পাঁচটা চিঠি --
একটা চিঠিতে জ্বলজ্বলে লেখায় দিদিমার নির্দেশ,'আগামী সোমবার রাতে যার নাম বলেছিলাম তার সাথে নীলফামারী হয়ে নিঃশব্দে সীমান্তের ওপার চলে যাবি।'
বাকি চিঠিগুলো মায়েরই লেখা
যার মধ্যে আছে শেষের কদিন টাঙ্গাইলে নিঃশব্দে ভয়ে দিনযাপনের কান্না--
মা,এখনো কাঁদছি নিঃশব্দে
তোমার সেই নিঃশব্দ কতো আনন্দ কতো দুঃখ দিয়েছে হিসেব দিতে আজ আর পারবো না
কাকেই বা দেবো
 একবার যদি বলতে অন্য কিছু 
ভাবতাম
তবুও ভাবি বেঁচে আছি নিঃশব্দে তোমার কথায়--
মা,যেখানেই থাকো শুধু তোমাকেই বলছি,'সময় ভীষণ বদলেছে এখন,নিঃশব্দেও ইদানিং শব্দ ভীষণ গর্জে ওঠে-
ক্ষমা করে দিও,মা।'


আকাশের তারাগুলো মৃদু তাকিয়ে দেখছে।

Comments