গল্প - আশিস ধর



রহস্যে মোড়া জীবন মৃত্যু

                                              

     দরজা খুলে অবাক হয়ে শ্রীময়ী জিজ্ঞেস করলো- আরে ঠাকুরঝি দুপুরবেলা এত সেজগুজে কোথা থেকে আসলে?                                            

      একটু মুচকি হেসে কঙ্কনা বলল- ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম। তোমার জামাইবাবু বারবার বলে, বুড়ি হ’তে চল্লে এখনও ব্যাঙ্কের কাজকর্ম কিছুই শিখলেনা। তাই কয়েকদিন ধরে যাচ্ছি, ও বলছিলো, আমাকে ব্যাঙ্কে নিয়ে শিখিয়ে দেবে। বেটাছেলেরা ভাবে আমরা ঘাসে মুখ দিয়ে চলি। আমিও লেখাপড়া জানি। ঠিক করলাম, আমি একাই যাবো, কারো সাহায্যের দরকার নেই।                         

     - তথাগতদা ঠিক বলেছে। তোমার দাদাও এই কথা বলে। আমার কেমন জানি ভয় ভয় করে। টাকা পয়সার ব্যাপার, যদি কোন ভুল হয়। তা ঠাকুরঝি তুমি একা একা গেলে? কোন অসুবিধা হয়নি।

    - কিসের অসুবিধা। চিন্তা হচ্ছিল ঠিকই তবে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট। চেক বইয়ে অ্যামাউন্ট লিখে সই কোরে কাউন্টারে জমা দিয়ে দিলাম, ব্যাস টাকা পেয়ে গেলাম। বৌদি, একটা মজার ব্যাপার শোন। দু’দিন আগে চেকে কম অ্যামাউন্ট লিখতে কেমন জানি লজ্জা করছিলো। লিখে ফেল্লাম পাঁচ হাজার টাকা। পরে কোন এক সময় বলে দিলে হবে। টাকটা নিয়ে চলে গেলাম বাজারে। ইচ্ছেমত বাজার কোরে চলে আসলাম। আমার একার নয় তোমার দাদার জন্যও রেডিমেড শার্ট কাপড় নিয়ে এসেছি।    

      -ঠাকুরঝি তোমার কি সাহস। তথাগতদা জানতে পারেনি? আর তোমার দাদা হাড় কিপটে, এক পয়সাও এদিক ওদিক করার উপায় নেই। রিটায়েরমেন্টের পর আরো হিসেব নিকেশ যেন বেড়ে গেছে।

      কঙ্কনা কপাল কুঞ্চিত কোরে বলল-বৌদি অতিরঞ্জিত কোরে বলছ। মার কাছে মাসির গল্প কোরনা। আমার দাদা মোটেই কিপটে নয়। হিসেবী বলতে পার। অকারন খরচ পছন্দ করেনা।   

      শ্রীময়ী অপ্রসন্ন হয়ে বলল- বিয়ের আগের কথা তোমরাই বোলতে পারবে। বিয়ের পর থেকে দেখছি, হাতের মুঠি কখনো আলগা হতে দেখিনি। যে ঘর করে সেই বোঝে। তথাগতদার মত দিলখোলা মানুষ হ’লে বর্তে যেতাম।

      হাসতে হাসতে বলল কঙ্কনা- বৌদি, অন্যের বরের প্রতি নজর দেবার অভ্যাস তোমার এখনও গেলনা। ওই যে তুমি বললে না, যে ঘর করে সেই বোঝে। আমিও তো এত বছর ঘর করলাম মানুষটার সাথে। রিটায়েরমেন্টের পরে যেন আরো খিটখিটে আর বায়নাক্কা বেড়ে গেছে। তুমিই বল, এই বয়সে হাটু আর কোমড় ব্যথা নিয়ে অত দৌড়ঝাপ করে তেল নয়, ঝাল নয় অখাদ্য খাওয়ার ফিরিস্তি মেটাতে পারি?

     -ঠাকুরঝি বাদ দাও, মেয়ে হয়ে জম্মানোর কষ্ট আমাদের ভুগতে হবে। এ তো জানাই কথা। তা এত বাজার দেখে তথাগতদা কি বলল?   

    - এত বাজার দেখে তোমার জামাইবাবু একটা কথাই বলল- পাঁচ হাজার টাকা খরচ কোরে আসলে? আমি তো অবাক। জিজ্ঞেস করলাম- তুমি জানলে কি কোরে?

    -তথাগত মুচকি মুচকি হাসতে বলল- আমি গুণতে জানি। পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছি জানতে পেরেছে মোবাইলের ম্যাছেজ থেকে। দেখ ওদের যথেষ্ট বয়স হয়েছে, সুগার প্রেশার ছাড়াও নানা বার্দ্ধক্য রোগে ভুগছে। কিন্তু দুঃখ হোল খাওয়ার খটিমিটি তাতে কমছেনা। ছেলে কাছে নেই, জীবনের কি ভরসা আছে বল! কিছু হলে পা ছড়িয়ে কাঁদতে না বসে, আগেভাগে আমাদের সবকিছু বুঝে নেয়া উচিত।

     -ঠাকুরঝি ঠিক বলছ। তোমার দাদাতো প্রায়ই বলে- এটিএম থেকে টাকা তুলে নিয়ে এস, ব্যাঙ্কে যাও। আামি যেতে চাইনা, বলে দিয়েছি- ঘরের এত হ্যাপা সামলিয়ে বাইরের কাজ করতে পারবোনা।  মাঝে মাঝে আমার শরীরটা এত খারাপ লাগে, দেখবে আমিই আগে চলে যাবো। মরে, এই লোকটাকে শিক্ষা দিতে চাই।

     কঙ্কনা জোড়ে হেসে উঠলো- সে গুড়ে বালি! মেয়েদের কাছিমের প্রাণ। বয়সের গাছ পাথর নেই। গুজো হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লেও বেঁচে থাকবে। সেজন্য ঠিক করেছি, টাকা পয়সা সংক্রান্ত সবকিছু আগে থেকে বুঝে নেবো। তথাগতর কিছু হ’লে, যেন কোন কষ্ট না হয়। বৌদি, আজকের দিনে টাকা থাকলে, মনে রাখবে, সবকিছু তোমার হাতের মুঠোয়। পরে কঙ্কনা উঠে দাড়িয়ে বলল- না যাই। অনেক বেলা হোল। তোমার জামাইবাবুর আবার সবকিছু টাইমলি চাই। সময়ের এদিক ওদিক হবার জো নেই। তুমি আজ বিকেলে বাড়িতে এস। আরো কথা আছে।

     সেদিন বিকেলে যাওয়া হয়নি। দু’দিন পরে শ্রীময়ী পাশের বাড়ির নিশিকে নিয়ে দোতালায় কঙ্কনের বাড়িতে গেল। তথাগত দরজা খুলে দিয়ে বলল- আরে বৌদি আপনারা? আসুন আসুন, ভুল কোরে মনে হচ্ছে?

     সোফায় বসতে বসতে শ্রীময়ী বলল- ভুল কোরে মানে! আমরা প্রায়ই আসি। তুমি, তোমার সহধর্মিনী কয়দিন যাও? সব সময় ঘরে বসে এই বয়সে কি গুজগুজ কর তোমরাই জান।

    -সম্পর্কে বড় হলেও দাদা আমার থেকে দু’তিন বছরের ছোট হবে। আর এ বয়সে কি গুজগুজ করতে পারি তুমি ভালই জান। তোমার ঠাকুরঝি ঘরকুনো হলেও আমি নিয়ম কোরে বাইরে আড্ডা মারতে যাই। তবে কয়েকদিন ধরে মাথায় কি ক্যারা ঢুকেছে, আমার ব্যাঙ্কের বই নিয়ে খুব ঘাটাঘাটি করছে। আমি অবশ্য একটু উসকেছিলাম।

    -তাই বলি। কঙ্কনার হঠাৎ কি হোল। শান্তশিষ্ট মেয়ে মানুষটাকে কয়েকদিন সিরিয়াসলি ব্যাঙ্কে যাতায়াত করতে দেখছি। দু’দিন আগে ঠাকুরঝির মুখ থেকে জানতে পেরেছি তোমার গুপ্তধনের কথা।

    -গুপ্তধন! হেসে উঠলো তথাগত। তবু যা আছে, পেনশন নিয়ে ভালই চলে যাবে। তবে তোমাদেরকেও বলছি, কোথায় কোন অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে জেনে রাখা ভালো। আজকাল তো মোবাইলের মাধ্যমে পেটিএম, ফোনপে ট্রানজাকসান করতে পারলে আরো ভাল। পার্সে টাকা বয়ে বেড়াতে হবেনা। আমাদের জীবনটা পদ্মপাতার জলের মত কখন গড়িয়ে পড়বে ঠিক নেই।

       নিশি হাসতে হাসতে বলল- জামাইবাবু আমাদের আমাদের করছেন কেনো, আমরা মেয়েরাও তো চলে যেতে পারি। 

     - ভগবানের এটা ইচ্ছে নয়। তোমরা মেয়েরা এত হিংসা হিংসি কর সেজন্য তোমাদের পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়ে থাকে। শেষ বয়সে ভগবানের নাম গান কোরে পাপ স্খালন হ’লে তবে মর্ত্য থেকে যাবার পারমিশান পাওয়া যায়। আর পারমিশন্ পেতে পেতে আশি নব্বই বছর পার হয়ে যায়।

     শ্রীময়ী, নিশি হাসতে হাসতে বলল-কি আজগুবি যুক্তি! এবার কঙ্কনার সাথে দেখা কোরতে যাই।

কি কাজ করছে না ঘুমিয়ে পড়েছে ভেতরে গিয়ে   দেখি।

      তথাগত হাসতে হাসতে বলল-তোমার ঠাকুরঝি এখন খুব ব্যস্ত। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে কোথায় কত টাকা জমা আছে, আর আমার অবর্তমানে ফ্যামিলি পেনশন কত পাবে তাই হিসেব করছে।

      সত্যি তাই, ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে শ্রীময়ী আর নিশি দেখলো বিছানার নানা কাগজ ছড়িয়ে উপুড় হয়ে আছে কঙ্কনা। পায়ের শব্দে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল- তোমরা এসেছ? বস।

      আমরা এসেছি অনেকক্ষন আগে। তথগতদার সাথে কথা বলছিলাম। আশ্চর্য! তুমি টের পাওনি? কি এত দেখছ। আমি সব হিসেব ভগবানের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। নিশি কি একটা কথা বলতে যাচ্ছিলো।        

শ্রীময়ী নিশিকে চেপে দিয়ে বলল- তুমি এখানে কোন কথা বোলনা নিশি। বিয়ে হলেও তোমার কর্তার যা বয়স, আরো দশ বছর পরে এসব চিন্তা কোর।

     নিশি প্রতিবাদ কোরে কি বলতে যাচ্ছিলো।

     কঙ্কনা শ্রীময়ীর দিকে তাকিয়ে বলল- বৌদি বয়সটা কোন ফ্যাকটর নয়। সবাইকে সবকিছু জানা উচিত। কারো বিপদ কোনদিক থেকে আসবে কেউ জানেনা। আমাদের তৈরী থাকতে হবে। একটা কাগজ তুলে ওদের দেখিয়ে কঙ্কনা বলল-জান এটা কিসের কাগজ?

     শ্রীময়ী নিশি মুখ চাওয়া চাউয়ি করলো। ওরা পারছে না। তবে এটা বুঝতে পারছে খুব দরকারী অফিসিয়াল কাগজ। তাতে কি, কত কাগজ তো বিছানার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঠাকুরঝির মাথাটা গেছে মনে হয়। শ্রীময়ী বলল- কি আর হবে পেনশনের কাগজ টাগজ হবে আরকি।

     কঙ্কনা খুশি হয়ে বলল- কারেক্ট, এটকে পিপিও বলে। পেনশন পে অর্ডার। এই কাগজটায় ওরা কত পেনশন পাবে লেখা আছে। ওর ডিমাইস হ’লে আমি ফ্যামিলি পেনশন কত পাবো সব লেখা আছে। তবে তোমার জামাইবাবু অফিসার হয়ে উচু পোষ্টে কাজ করতো বলে ওর পেনশন বেশি, আমিও ভালই পেনশন পাবো। তাছাড়া কোথায় কোন ব্যাঙ্কে কত এফডি, সব দেখছি। তথাগত নিজমুখে বলেছে, খুটিয়ে খুটিয়ে সব দেখে নিতে। আমার জন্য ওর খুব চিন্তা। ছেলে কাছে থাকেনা, বয়স হয়েছে, হুট কোরে ওর কিছু হয়ে গেলে আমার কি হবে! বলে, আগের থেকে সব দেখে না রাখলে, বারো ভুতে সব লুটপাট কোরে খাবে। না হলে, বেওয়ারিস লাশের মত বেওয়ারিস টাকা হয়ে ব্যাঙ্কে পড়ে থাকবে।

    শ্রীময়ীর ঠকুরঝির কথাগুলো ভালো লাগেনি। কেমন অবলীলাক্রমে বলছে, তথাগতদা মারা গেলে ভালই পেনশন পাবে। মুখে এতটুকু আটকালো না। খানিকটা মৃদু হাসি মুখে ঝুলিয়ে বলল- তাহ’লে ঠাকুরঝি তোমাকে আর পায় কে!

     -বৌদি ঠিক বলছো। স্থাবর, আস্থাবর, অন্যান্য ডিপোজিট সব মিলিয়ে মালিক হব আমি। কয়েক    

কোটী টাকার সম্পত্তি হবে আমার। ছেলেটা ষ্টেটসে গ্রীন কার্ড হোল্ডার। চিন্তা হয়, হয়তো কোন বিদেশীনীকে বিয়ে কোরে সংসার পাতবে, মনে হয়না আর ইন্ডিয়াতে ফিরে আসবে। বাবাইয়ের শীঘ্রই বিয়ের ব্যাবস্থা করতে হবে। এত টাকা পেয়ে আমার মাথাটা না ঘুরে যায়, সেজন্য আগেভাগে চিন্তা কোর রাখবো, ফুর্তি করেও কি কোরে টাকার সদব্যবহার করা যায়।                

      - আচ্ছা ঠাকুরঝি একটা কথা, সত্যব্রতদা এসেছিলো ওনার বড় মেয়ের বিয়েতে নিমত্রণ করে গেছে। তোমাদেরকও নিশ্চয় বলে গেছে? তোমরা যাবে তো?

      - হ্যা করেছে। এ মাসের চৌদ্দ তারিখ তাইতো। তোমার জামাইবাবুর জন্য যেতে ইচ্ছে করেনা। নিজের হাই সুগার, প্রেসার আরো কত কি। ইনসুলিন নেয়, পরিমিত আহার। নিজে না খেলেও আমাকেও খেতে দেয়না। আমি টেষ্ট করিয়েছিলাম বর্ডার লাইনে সুগার, এখন ঔষধ খেয়ে সুগার, থাইরয়েড কট্রোলে, তবু ছাড় নেই। তুমি তো জান, মিষ্টি খেতে ভালোবাসি। সুগার বোলে আমাকে একদম মিষ্টি খেতে দেয়না। গ্যাসের ট্রাবল আছে, একবার বমি শুরু হলে থামতেই চায়না। কোন কোন সপ্তহে দু’তিন দিন সিদ্ধভাত খেয়ে থাকি। তবুও তো ভালোই আছি। রান্না থেকে শুরু কোরে ঘরের সব কাজ করি।

      শ্রীময়ী আর চুপ কোরে থাকতে পারেনা। বলে- তুমি কি ভুলে গেলে? তোমার থাইরয়েড গ্ল্যান্ড মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলো রে দেওয়াতে। মাথার সব চুল সব উঠে গিয়েছিলো? শারীরীক মানসিকভাব। তার জের এখনও টানছ। বুঝতে পারছোনা, সেজন্য তথাগতদা সব সময় জন্য চিন্তা করে। তাছাড়া, একটা চোখ টিপে বলল- জামাইবাবু তোমাকে ভালোবাসে। কাছ ছাড়া করতে চায়না।

      কথাটা বলে শ্রীময়ী আর নিশি খিলখিল কোরে হেসে ওঠে। কঙ্কনা লাজুক স্বরে বলল- কি যে বল ঠাকুরঝি আমার দাদাকে চিনি, তোমার মত ভাগ্য হ’লে ভালো হোত! পান থেকে চুন খসলে গালি খেতে হয়। কি বলবো, গ্যাসের প্রবলেম সবার থাকে। তা বলে, ভালমন্দ খেতে পারবোনা? ডাক্তার বলছে, মোটা হয়ে ষাচ্ছি নাকি, তাই অধিক প্রোটিন ফ্যাট কার্বোহাইড্রেট শরীরের পক্ষে হার্মফুল। বড় মাছ, তাতেও রেস্ট্রিকশন্! বড় মাছে নাকি অধিক ফ্যাট থাকে, তাই ছোট পোনা মাছ। আমার অবস্থা এখন বোঝ। খেতে ভালোবাসি অথচ পেট ভরে খেতে পারিনা। সেই কবে অসুস্থ হয়েছিলাম, প্রায় পয়ত্রিশ বছর হয়ে গেল। ছেলে তখন দেড় বছর। এখনো আমাকে নিয়ে শঙ্কিত থাকে। ভালো লাগেনা। সবসময় ধমকে কথা বলে, মাঝে মাঝে কয়েকদিন কথা বন্ধ করি। রাগ রাগ ভাব দেখাই। তাতে ওর মনে হয় মাথাটা বুঝি আমার গেছে। মাথার ঔষুধ খাচ্ছি। তবু নিজেকে শোধরাবে না। সবই আমার দোষ।

         - না না সেসব নয়, তথাগতদা তোমাকে সুইট সিক্সষ্টিন বানিয়ে ছাড়বে। হিহি কোরে উচ্চস্বরে হেসে ঊঠলো শ্রীময়ী আর নিশি। ঠাকুরঝি তুমি এত শান্ত, নম্রভাবে কথা বল, সেই তুমি এত রাগতে পার ভাবতেও পারিনা।

     খানিকটা মিষ্টি হেসে কঙ্কনা বলল- যতই খবরদারি করুক না কেন আমার মত আমি আছি। একটু থেমে চোখ মটকে আবার বলল- তুমি চল ডালে ডালে আমি চলি পাতায় পাতায়।

      - মানে!! শ্রীময়ী আর নিশি দুজনের কপাল কুচকে গেলো।

      মৃদু হেসে এর কোন জবাব দিলোনা। বলল- তোমারা যা বোঝার বুঝে নাও। তবে বিয়েতে  যাচ্ছি বৌদি। তুমি ও দাদা থাকবে, অত চোখ পাকাতে পারবেনা।

       আজ ডিসেম্বরের চৌদ্দ তারিখ। বিয়ের শেষ তারিখ, অনেক বিয়ে। শহরের শেষ প্রান্তে গ্রীণ রিসর্টে সত্যব্রতদার মেয়ের বিয়ের আসর। পৌছাতে পৌছাতে প্রায় আটটা। রিসর্টের মাঝের ফাঁকা যায়গায় অনেক স্টল বসেছে। আর একপাশে ছাদনাতলা। গাছগাছালির মাঝে অত্যাধুনিক আলোয় আলোকিত অপরূপা রিসর্টে যেন মায়াবী হাতছানি। উপস্থিত সকলের সাথে পরিচয়ের পালা সাঙ্গ কোর বসে আছে ওরা। কঙ্কনা চুপিচুপি বলল- তোমার জামাইবাবু আর আমার দাদা বন্ধু বান্ধবদের সাথে গল্পে মশগুল, বৌদি চল, স্টলগুলো ঘুরে আসি। অনিচ্ছাসত্বেও কঙ্কনার পিছুপিছু গেলো শ্রীময়ী। অবাক হয়ে দেখলো, কঙ্কনা টক ঝাল মিষ্টি নানা আইটেমগুলো চাখতে লাগলো, একবার নয় কয়েকবার। সেসাথে শ্রীময়ীকেও খাওয়াতে কসুর করেনি। একসময় তথাগত এসে নিরস্ত না করলে হয়তো আরো চলতো খাওয়া।

      খাওয়াদাওয়ার সময়ও শ্রীময়ীকে নিয়ে আলাদা বসল কঙ্কনা। ওর নিষিদ্ধ খাওয়ারের মধ্যে দৈ মিষ্টি আইসক্রিম পড়ে। সেগুলোর প্রতি অত্যধিক আসক্তি অবাক করেছে শ্রীময়ীকে। অন্য টেবিল থেকে চোখ পাকিয়ে কঙ্কনাকে খেতে নিষেধ করলেও শোনেনি। আসবার সময়ও মিঠা পাতার জর্দাপান মুখে ঠুসে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে বাড়িতে ফিরে এসেছে ওরা। আসতে আসতে শ্রীময়ীকে বলল- আাজকে আমার কপালে দুর্ভোগ আছ। দেখছো না তোমার জামাইবাবু কেমন হুদো বেড়লের মত মুখ কোরে দেখেছে আমাকে, কথাটা বোলে খুকখুক কোরে হাসতে লাগলো কঙ্কনা।

     বিয়েবাড়ি থেকে আসার ঠিক দুদিন পরে। সকালে একবাটি পায়েস নিয়ে উপস্থিত হোল কঙ্কনা। কি ব্যাপার জানতে চাইল শীময়ী, ও বলল- বাবাই তো পায়েস খুব ভালোবাসে, ওর নামে ঠাকুরের কাছে পায়েস বানি্য়ে পূজো দিয়েছিলাম। তাই আরকি। একথা সেকথা বলার পর, শ্রীময়ী বলল- সেদিন নিমন্ত্রণ বাড়ি থেকে আসার পর তথাগতদা কিছু বলেনি?

    - না, ও অত খেয়াল করতে পারেনি। আসার পর তেল ছাড়া আধাসেদ্ধ সবজী, ট্যালট্যালে মাঝের ঝোল আর সেদ্ধ খাচ্ছি। কপালের দোষ খন্ডাবে কে!  ঠিক আছে উঠছি। একটা কথা, দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পর একবার যেও। বাবাইর জন্য পেপার আর ম্যারেজ সাইটে বিয়ের অ্যাড দিয়েছিলাম, পেয়েছি বেশ কয়েকটা ফটো। বৌদি তোমাদের মত নিয়ে একটা সুন্দরী শিক্ষিতা বাবাইর ঊপযুক্ত মেয়ে দেখে বিয়ের ডেট ঠিক করে ফেলবো।

     সেদিন দুপুরে ননদ বৌদি মিলে বিছানায় শুয়ে বসে গোটা তিনেক ফটো পছন্দ হোল। পরে তথাগতদার  জিম্মায় ফাইনাল চয়েসের ভার দিয়ে, শ্রীময়ীর ঘরে ফিরে আসতে আসতে বিকেল পাঁচটা। এরপর দৈনন্দিন নির্দ্ধারিত কাজের অংশ হিসেবে সন্ধ্যা পূজো দিয়ে টিভির সামনে বসে পড়েছিলো শ্রীময়ী।

সাতটা পেড়িয়ে কয়েক মিনিট, তথাগত উপর থেকে একরকম ছুটে এসে ভীত সন্ত্রস্থ স্বরে বলল- দাদা, বৌদি কঙ্কনা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। এখনই নার্সিং হোমে নিয়ে যেতে হবে। অজ্ঞান, কোনরকম সাড়হীন কঙ্কনাকে কাছেই কোনমতে কাছের নার্সিং হোমের ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হোল। বাইরে সবাই অপেক্ষা করছিলো আশঙ্কিত মনে। ঠিক মিনিট পাঁচেক পরে ইমারজেন্সীর ডাক্তারবাবু বেড়িয়ে এসে বললেন- স্যরি, এখানে নিয়ে আসার আগেই উনি মারা গেছেন। যা বুঝলাম, অ্যাপারেন্টলি মনে হচ্ছে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। আর কিছু আমাদের হাতে নেই।

     কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেনা শ্রীময়ী। সারাদিন যার সাথে এত কথা হোল, খানিকক্ষন আগেও যার গলার আওয়াজ পাচ্ছিলো, সে নেই! দু’দিন আগেও যে মনের আশ মিটিয়ে বিয়েতে এত খেলো এই মুহূর্তে সে পাশে নেই! ভাবতো, স্বামীর নানা রোগ, ওর জীবনের স্থয়িত্ব পদ্ম পাতার জল বিন্দুর মত ক্ষণস্থায়ী। বিশ্বাস ছিলো, মেয়েরা অসুস্থ হলেও অত সহজে মরেনা। কাছিমের প্রাণ। সেজন্য আগভাগে স্বামীর স্থাবর আস্থাবর সব সম্পত্তি, প্রাপ্য ফ্যামিলী পেনশন কত হবে বুঝে নিয়ছিলো। আজ সে কোথায়? কে জবাব দেবে। কঙ্কনা হেরে গেলো জীবন মৃত্যুর রহস্যের কাছে। কোন মতে উদগত কান্না ওড়নায় চাপলো শ্রীময়ী। তাকিয়ে দেখলো, স্তম্ভিত তথাগতদা দুহাতের তালুতে মাথাটা চেপে নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা কোরছে। তবু চোখের জল বাঁধ মানছেনা। সবাই নিথর নিস্তব্ধ! 

Comments

  1. সুব্রত ভট্টাচার্যNovember 5, 2022 at 8:07 AM

    ভালো লেখা, ভালো বিষয় l সংলাপ গুলি সুন্দর ভাবে এসেছে গল্পেl বেশ ভালো লাগলো l

    ReplyDelete

Post a Comment