পদবীর উত্তরাধিকারের নাগপাশ
পল্লবী মিত্র যেদিন বিয়ে করল ইউস্যুফ খান -কে, সেদিন থেকেই পল্লবীকে সবার কাছে পরিচিত হতে হলো তাজমিরা বেগম নামে। এর মূলে ছিল বিভিন্ন রকম সামাজিক প্রথা রীতি আচার আচরণ। তার পাশাপাশি মানব মনে বাসা বেঁধেছিল নানারকম কুপ্রথা কুসংস্কার। এসবই ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে যুগযুগ ধরে। বহু কুপ্রথার মতো পদবি প্রথাও আজ আর বিজ্ঞানকে হার মানাতে পারছে না পদবী শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করলেও নৃতাও্বিক ব্যাখ্যায় এর স্থান নেই। কারন মানুষের উৎপত্তি বিবর্তন ও বৈচিত্র্যের চিত্র Phisical Anthropological analysis এর দৌলতে। পদবি যে কেবল জাতপাতের ধারক বাহক তা আমাদের কাছে স্পষ্ট।
পদবি হঠাৎ করে মানুষের পাশে নিশ্চয়ই উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। পদবি কর্ম ও বৃত্তি, গ্রাম-নাম, ব্যক্তিগত পরিমন্ডল অথবা প্রাপ্য কোনো উপাধিকে কেন্দ্র করে এসেছে। শাস্ত্র স্মৃতি সংহিতার শাস্ত্রকারদের সুক্ষ্ম স্বার্থ রক্ষাই সৃষ্টি করেছে সমাজের বুকে নানারকম অন্ধবিশ্বাস। কথায় বলে পদবিই জাতের মান।তাই উঁচুজাত নিচুজাত নির্নয় করবার জন্য বেশ বানানো কিছু শব্দ প্রয়োগে সমাজের সেসময়ের বিধাতারা নামের পাশে বসিয়ে দিলেন আর একটি নাম ; পদবি। গুরুমশাইরাই সেসময় থেকে শিষ্যদের শিখিয়েছেন উঁচুজাতের ভূমিকা কী হবে। পূজা পার্বনে তাই চন্ডালের মতো তথাকথিত নিচুজাতের প্রবেশ ছিল না। ঋকবেদে বলা হয়েছে, আর্যরা দাসদের প্রচন্ড তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখতেন। এখনোও পাত্রপাত্রির বিজ্ঞাপনে লক্ষ্য করি পদবি বর্ণ গোত্র এসবের কী প্রকট এবং অবাধ বিস্তার। কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ খ্যাত পদবির অহংকারেই কোনোকোনো ব্যক্তি নিজেকে এই মর্ত্যলোকের তো বটেই পারলে বিশ্বব্রহ্মান্ডের মহান ব্যক্তি মনে করতেও দ্বিধাবোধ করেন না। অথচ তথাকথিত নিম্নবর্ণীয় ব্যক্তির শিক্ষা গুণাবলী উঁচু স্থানের হলেও তাকে উঁচু বলে স্বীকার করতে সমাজবদ্ধ মানুষের কার্পন্য লক্ষ্য করা যায়। জাত ব্যাপারটি একটি পারিবারিক শিক্ষা সংক্রামিত।রক্ষণশীল অভিজাত পরিবারের পাঁজি পুঁথি কোষ্ঠি বিচারের মাধ্যমে বিবাহ অনুষ্ঠান পর্ব বেশ শান্তির এবং স্বস্তির শ্বাস ফেলতে দেখা যায়। এসব উচ্চশিক্ষিত(?) সংস্কার প্রিয় জনেরা এখান থেকে এক চুলও নড়বেন না বলে শপথ নিয়েছেন যেন। এই ভাইরাসে আজও মেয়েরা আক্রান্ত হচ্ছেন।পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ক্লেদাক্ত অন্ধকার ব্যবস্থার চাপে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে মেয়েরা। তারা জন্মাবার পর পিতার পদবি বহন করে বিয়ের পর নিয়মের গন্ডিতে অনিচ্ছাকৃত পা রেখে বাধ্য হয় স্বামীর পদবি নিতে।বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রে জানা যায়, " পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্তা ক্ষতি যৌবনে।" (৫/১-২/২)। নারী স্বাধীনতার যোগ্য নয়। 'ন স্ত্রী স্বাতন্ত্রমইতি ' (২/৪৫)। স্বামীর পদবি গ্রহণ করতে হবে এটাই নিয়ম। নিয়মটা মুনিগণ বলে দিয়েছেন বৃহদারণ্যক উপনিষদে 'পতিং বা অনু জায়া' (১/৯/২/১৪) অর্থাৎ স্ত্রী স্বামীর পশ্চাতে। কালখন্ডে মেয়েদের একপ্রকার জোড় করে বশ্যতা স্বীকার করাতে বাধ্য করালেন। রবীন্দ্রনাথ এই সূত্র ধরেই বুঝি বলেছিলেন 'পতির পুন্যে সতীর পুন্য' আপস্তম্ব ধর্মসূত্রে পাই (২/১০/২৭/৩) বিয়ের সময় পিতা কন্যাদান করেন। ভাবতে অবাক লাগে এই একবিংশ শতকেও কন্যাকে পুত্রসম ভাবা যায় না। তাকে বস্তুর মতো দান করতে হয়।
বিয়ের পর স্বামীর পদবি গ্রহণ না করলে সেই মহিলার সন্তানের জন্ম দিতেও বেগ পেতে হয়। দেখা যাবে সন্তানের 'বার্থ সার্টিফিকেট' দিতে ঝামেলা করছেন স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্তৃপক্ষ। কারন সেখানে সন্তানের মায়ের স্বামীর পদবী রাখতে হবে। তবে দীর্ঘদিন পর এটি সুখের যে সমাজবিশেষজ্ঞদের চেতনায় শুদ্ধতা এসেছে। আজ গর্ভধারিনী মায়ের পদবী নিতে পারে সন্তান। পদবি মেয়েদের জীবনে তো বটেই এমনকি পুরুষের নামেও পদবি আর কতকাল অভিভাবকত্ব বহণ করবে।
হীরেন মুখোপাধ্যায় বলেছেন, "আমাদের সংস্কৃতি প্রাচীন বলে আমাদের মগজে বহুকাল ধরে অনেক আবর্জনা এসে জমেছে।" এই আবর্জনাকে কবরচাপা দিতে আধুনিক শিক্ষা কতখানি সহায়তা করতে পারে? এ দায়িত্ব কার? এ দায়িত্ব আমাদের। এই প্রজন্মের। একটি কবিতার অংশ দিয়ে এই লেখা শেষ করছি --
' মানুষ
তুমি চন্ডাল, ব্রাহ্মণ, নারী বা পুরুষ
তুমি কোরান, গীতা, বাইবেল
যাই হও
পদবীর অধিকারে নয়
নিজের কক্ষপথে তুমি সবুজ গ্রহবাসী।'
Comments
Post a Comment