গল্প - সুব্রত ভট্টাচার্য



লড়াইটা জারি আছে   

                               

দীপিকা রণজয়কে বলেছিলো -- অলকেশদা কেমন শৌখিন আর জমজমাট মানুষ। তুমি তো একেবারেই বেরসিক। এমন কথা তাকে মাঝে মাঝেই শুনতে হয়। একসময় রাগ হতো, এখন আর হয় না। অপমানটা হজম করে ফেলে। ওর এক বন্ধু তাপস বলেছিলো – অ্যাডজাস্ট করতে শিখতে হয় রণ, সংসারে অনেক সময় ফ্লেক্সিবল হতে হয়। কথাটা বেশ পছন্দ হয় রণজয়ের।  সেই থেকে তার সহ্যশক্তি অনেকটা বাড়িয়ে নিয়েছে। দু একটা ছোটখাট কথা তাকে আর উত্তেজিত করেনা।



রণজয়ের বন্ধুবান্ধব কম নয়। যেমন অশোক, তাপস, মৃন্ময়, শুভজিত, অলোকেশ। তাদের পরিবারের সাথেও খুব ভালো যোগাযোগ। ওরা বয়সে কাছাকাছি। কোনও পারিবারিক অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝে সকলের দেখা হয়। হাসি ঠাট্টা, মজার গল্পগুজব চলে। তাদের মধ্যে অলোকেশদাকেই একটু অন্যরকম মনে হয়।  



আসলে অলোকেশদার সাথে কিছুতেই পাল্লা দিয়ে উঠতে পারে না রণজয়। বার বার পিছিয়ে যায়। এক বছর হলো ট্রান্সফার হয়ে এসেছে ওদের অফিসে। একই রকম চাকরি করে তারা দুজন। কিন্তু অলোকেশদার জীবনযাত্রার চাকচিক্যই আলাদা। ভাড়া ঘরে থাকলেও ভীষণ সুন্দর সব আসবাব। একটু  পুরনো হলেই সেগুলি সে পাল্টে ফেলে। ছেলেমেয়েরা দামী স্কুলে পড়ে। কাউকে বাড়ীতে ডাকলে ভীষন আপ্যায়ন করে। রণজয় সে তুলনায় বেশ খানিকটা পিছিয়ে।

 


(২)

 

আজ দিনটা বেশ মজা করে কাটলো রণজয়দের। আজ ওদের বাড়ীতে এসেছিলো অলোকেশদা আর  পরিবারের সবাই। সবাই মানে অলোকেশদা, নন্দা বৌদি আর  তাদের ছেলে মেয়ে। দীপিকা যত্ন করে অনেক কিছু রান্না করেছিলো। মালতী আজ দুপুরে আর বাড়ীতে যায়নি। ওকে বেশ সাহায্য করেছে প্রায় সব ব্যাপারেই। 



দীপিকার খুব পছন্দ অলোকেশদা আর নন্দা বৌদিকে। খুব প্রাণোচ্ছল মানুষ অলোকেশদা। বৌদিও খুব মিশুকে। রণজয়েরও বেশ ভালো লাগে। ওদের মেয়ে রিনিরও খুব পছন্দ দাদা আর বোনকে। গল্পগুজবে সারাটা দিন বেশ ভালো কেটে গেলো। এক দু বার ওদের বাড়ীতেও গেছে রণজয়রা। 

     

 

গতমাসে  ওদের বাড়ীতে নিমন্ত্রন ছিলো রণজয়দের। রাতে খাবারের ব্যাবস্থা। আরও দুজন বন্ধুও ছিল নিমন্ত্রিত। ঠিক সন্ধ্যায় যেতে বলেছিলো ওদের। ঢালাও ব্যাবস্থা করেছিলো অলোকেশদা। সাত/আট  ধরনের স্ন্যাক্স আর মেইন কোর্সেও অনেকগুলি আইটেম।  এত বড় আয়োজন দেখে একটু সংকোচ হয়েছিলো রণজয়ের। যাই হোক সেবারেও বেশ মজা হয়েছিলো। রাতে বাড়ীতে পৌঁছে দিয়েছিলো অলোকেশদা নিজে।  আজ ওরাও অনেক আয়োজন করেছিলো, তবে সেদিনের মত নয়।       

 


রণজয় আসলে একটু হিসেবি মানুষ। কিন্তু  প্রয়োজনীয় সব কাজই করার চেষ্টা করে। একখানা বাড়ী করেছে তার ই এম আই চলছে। ছেলেমেয়েরাও ভালো স্কুলে পড়ে, প্রাইভেট টিউশন রয়েছে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাকে কিছুটা সঞ্চয়ও করতে হয়। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনদের  সাথে তার যোগাযোগ আছে। অফিসে এবং বন্ধু মহলেও সে বেশ জনপ্রিয়। দীপিকা যেমন ভাবে তেমন সেও মাঝে মাঝে ভাবার চেষ্টা করে সত্যিই কি সে বেরসিক? রসিক হবার জন্য তার কতটুকু পরিবর্তন দরকার?  



বাইরে ঘুরতে গেলে অলোকেশদা বিলাশবহুল হোটেলে ওঠে।  খুব সুন্দর ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দেয়। তার সাথে নিত্যনতুন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি। রণজয়ও বেশ কয়েকবার সপরিবারে ঘুরতে বেরিয়েছে। তবে অলকেশদার মত মাঝে মাঝেই বের হতে পারে না। আর চাকচিক্য দেখে মনে হয় অলোকেশদার ধারেকাছে সে পৌঁছুতে পারেনা। তার একটা হীনমন্যতা কাজ করে।    


(৩)

       

মাঝে মাঝেই দীপিকা ফোন করে নন্দা বৌদিকে। আবার কখনও  নন্দা বৌদিও  ফোন করে দীপিকাকে। অনেকক্ষণ তাদের গল্পগুজব চলে। ছেলে মেয়েদের স্কুল, পড়াশোনা, টিউশন, টিভি সিরিয়াল ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা চলে। শরীর, স্বাস্থ্যের খবর নিয়েও আলোচনা হয়। বেশ মনটা হাল্কা হয় দুজনারই।  



আজ দীপিকা ফোন করেছিল নন্দা বৌদিকে। বেশ কবার রিং হবার পরও কোনও উত্তর পাওয়া গেলনা। মিনিট পনরো পরে আবার ফোন করতেই ফোন ধরলেন নন্দা বৌদি। কয়েকটা কথা বিনিময় হলো। অন্য দিনের চেয়ে একটু নিস্প্রভ মনে হলো। মনে হচ্ছিল আজ একটু তাড়াতাড়িই কথা শেষ করতে চান। দীপিকা সংক্ষেপেই কথা শেষ করলো।  



কথা শেষ করে ফোনটা রেখে দিলেন নন্দা বৌদি। দীপিকা লক্ষ্য করলো টেলিফোন তখনও চালু আছে। কিছু কিছু তর্ক বিতর্কের কথা কানে আসছে।  অলোকেশদার কখনও সখনও সুরাপানের শখ আছে। বিভিন্ন দামী ব্র্যান্ড বাড়ীতেই রাখেন। আজ সম্ভবত একটু বেশীই নিয়ে ফেলেছেন।  নন্দা বৌদির কিছু কিছু কথা কানে আসছে – তুমি এমন বেহিসেবি ভাবে চললে আমাদের চলবে কি ভাবে বলোতো? বাড়ীর ই এম আই  কয়েকমাস  বাকী পড়ে গেছে। অফিসের পি এফ অনেকটা তুলে ফেলেছো। দু তিন জায়গা থেকে আমাদের ধার হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েদের কথাতো তোমাকে ভাবতে হবে। আমাদেরও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। অলোকেশদার কিছু কিছু কথাও কানে আসছিলো। বৌদির প্রতি তারও অনেক অভিযোগের কথা।  



দীপিকা শুনতে পাচ্ছিলো কথাগুলি। কিন্তু ভাবলো লুকিয়ে ওদের কথাগুলি শোনা আর ঠিক হবে না। দীপিকা ফোনের লাইনটা কেটে দিলো। খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলো। যে ছবিটা সে এতদিন দেখতে পাচ্ছিল তা আজ একটু অন্য রকম মনে হচ্ছে। 

  


(৪)  


বেশ কিছুদিন হলো রণজয় অফিসের কিছু নতুন কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। তাকে মাঝে মাঝে বাইরে যেতে হয়। অলোকেশদাও তার অফিসের কাজ নিয়ে আজকাল ভীষন ব্যাস্ত। অফিসে সামান্য কিছু সময়ের জন্য দেখা হলেও আড্ডা বিশেষ হয় না। 



প্রায় মাস খানেক হলো তাদের যাওয়া হয়নি অলোকেশদার বাড়ীতে। ওরাও আসেনি রণজয়দের বাড়ীতে। অফিসের পরে অবশ্য টেলিফোনে দু একবার কথা হয়েছে অলোকেশদার সাথে। দীপিকার সাথে নন্দা বৌদির দু এক বার কথা হয়েছে তবে তেমন দীর্ঘ সময় ধরে নয়। রণজয় দুবার ওদের বাড়ীতে যাবার কথা বললে বা আসবার কথা বললে দীপিকার উৎসাহ খুব কম লক্ষ্য করেছে। ব্যাপারটা একটু আশ্চর্য লেগেছে তার কাছে। তবে কি দীপিকার নতুন কোনও বন্ধু হয়েছে, নন্দা বৌদির জন্য সময় দিতে পারছে না আজকাল।  



দীপিকা একদিন রণজয়ের কাছে বলেই ফেললো ব্যাপারটা। রণজয় একটু আশ্চর্য হলো। কি উত্তর দেওয়া উচিত সে তখন মনে মনে ভাবছে। কথাবার্তায় বোঝা গেলো দীপিকার চোখে রণজয় আপাততঃ আর বেরসিক, হেরে যাওয়া মানুষ নয়।  বন্ধু হিসেবে অলোকেশদা তার যথেষ্ট প্রিয়। কাউকে পিছিয়ে  পরতে দেখলে খুশী হয়না রণজয়। তবু নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া তো অন্যায় নয়। অনেক প্রতিযোগীতাতেই জিততে পারেনি রণজয়। লড়াইয়ে পিছিয়ে গেলেও সে তেমন দুঃখবোধ প্রকাশ করেনা। নিজস্ব ছন্দে সে চলতে থাকে। এবারে কিন্তু জেতার একটু স্বাদ পেলো সে। সে এখন খানিকটা এগিয়ে আছে। মনে হলো লড়াইটা শেষ হয়ে যায়নি। 

Comments

  1. লড়াইটা জারি আছে পড়লাম। ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  2. সুব্রত ভট্টাচার্যOctober 7, 2022 at 6:12 PM

    ধন্যবাদ l

    ReplyDelete

Post a Comment