অনুনাটক - অর্পিতা দাশগুপ্ত


অন্ধ বিহঙ্গ

উৎস - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 
নাট্যরূপ - অর্পিতা দাশগুপ্ত



(সূচনা আবহের পর যুদ্ধজয়ের কাড়া-নাকাড়া শোনা যায়। পর্দা উঠলে দেখা যায় হস্তিনাপুরের অন্তঃপুরে ধৃতরাষ্ট্র সমাসীন। প্রতিহারীর প্রবেশ।) 


প্রতিহারী।। (অভিবাদন করে) মহারাজ, প্রতিহারীর অভিবাদন গ্রহণ করুন। যুবরাজ দুর্যোধন আপনার সকাশে উপস্থিত। যদি অনুমতি করেন, তাকে নিয়ে আসি?

ধৃতরাষ্ট্র।। নগরের সংবাদ কিছু জানো প্রতিহারী?

প্রতিহারী।।  আজ্ঞে মহারাজ। দ্রৌপদীসহ পঞ্চপাণ্ডবের বনবাসযাত্রার আয়োজন সম্পূর্ণ। পৌরগণ কেহ ঘরে নাহি। পণ্যশালা রুদ্ধ, বিপ্রগণ সন্ধ্যার্চনা ছেড়ে পান্ডবদের প্রতীক্ষায় পথপার্শ্বে সমবেত হয়েছেন। সন্ধ্যা হল। তবুও দেব মন্দিরে মন্দিরে শঙ্খধ্বনি, সন্ধ্যাভেরী স্তব্ধ, গৃহমন্দিরে দীপ জ্বলেনি। শোকাতুর নরনারী দীনবেশে সজল নয়নে পান্ডবের দর্শনপ্রত্যাশী হয়ে চলেছে নগরের সিংহদ্বার অভিমুখে। 

ধৃতরাষ্ট্র।। উত্তম। যাও তবে যুবরাজকে প্রেরণ করো।

প্রতিহারী।। যথা আজ্ঞা মহারাজ। 


(প্রতিহারীর প্রস্থান। দুর্যোধনের প্রবেশ।)


দুর্যোধন।। তাতঃ, দুর্যোধনের প্রণাম গ্রহণ করুন।

ধৃতরাষ্ট্র।। তোমার অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে তো বৎস?

দুর্যোধন।। জয় লাভ করেছি। হয়েছি বিজয়ী।

ধৃতরাষ্ট্র।। বিজয়ী হয়েছো বটে.....কিন্তু সুখী হয়েছো কী?

দুর্যোধন - মহারাজ, আমি তো সুখ চাইনি। জয় চেয়েছি.....জয়। আর দেখুন.... আজ আমি বিজয়ী।

ধৃতরাষ্ট্র।। অখণ্ড রাজত্ব লাভ করে কি সুখকে জয় করত পারলে যুবরাজ? 

দুর্যোধন।। সুখ? হ্যাঁ.....সুখীই তো ছিলাম। যতদিন কৌরবে-পান্ডবে একত্রে ছিলাম! পান্ডবের গাণ্ডীব-টঙ্কারে শঙ্কিত ছিল শত্রুদল। ধরিত্রী দোহন করে আনা পান্ডবগণের সম্পদের অংশভাগ ভ্রাতৃপ্রেমবশতঃ লাভ করে, নিত্য নব ভোগসুখেই তো ছিলাম... পান্ডবের জয়ধ্বনির প্রতিধ্বনি হয়ে। পান্ডবগৌরবচ্ছটায় উদ্ভাসিত ম্লান উপগ্রহের মতো নিশ্চিন্ত অনন্ত কৌতুকে। ছিলাম মহাসুখে।

ধৃতরাষ্ট্র ।। তবে কেন এই ভ্রাতৃদ্রোহ! ধিক দুর্মতি!

দুর্যোধন ।। পিতা, সর্ব তেজ পরিহার করে,পান্ডব গৌরব তলে কূপমণ্ডূকের সুখে সুখী হওয়ার ইচ্ছা নেই এই দুর্যোধনের। ক্ষত্রকুলজাত প্রপিতামহ মহারাজ শান্তনুর উত্তরসূরী, পিতামহ মহাবীর ভীষ্মের বীরত্বের ঐতিহ্য আর পিতা ধৃতরাষ্ট্রের শোণিত প্রবাহিত এই দেহে। গুরু দ্রোণাচার্যের সুযোগ্য শিষ্য ক্ষত্রিয় দুর্যোধনের ক্ষুধা ক্ষুদ্র সুখে নিবারিত হওয়া অসম্ভব কুরুকুলপতি। ঈর্ষা-সিন্ধু মন্থন করে জয়রসসুধা আহরণ করেছি। সুখী নয়, সুখী নয়.....পাণ্ডুপুত্রগঙ দ্যুতক্রীড়ার পরাজয় বহন করে বনবাসী হবে......আঃ! আজ আমি সুখী কি না জানি না। তবে বিজয়ী তো নিশ্চয়ই। 

ধৃতরাষ্ট্র।। আজ ধর্ম পরাজিত। 

দুর্যোধন।। রাজধর্ম আর লোকধর্ম এক নয় পিতা। রাজা একেশ্বর। রাজদণ্ড যত খন্ড হয়, ততই তার দূর্বলতা....ততই তার ক্ষয়। রাজধর্মে কোনও ভ্রাতৃধর্ম, বন্ধুধর্ম নয়, আছে শুধু জয়। মহারাজ, তাই আজ সেই ধর্মই চরিতার্থ.... আজ জয়ী আমি। 

ধৃতরাষ্ট্র।। হ্যাঁ, তুমি আজ জয়ী বটে। তাই আকাশ, বায়ু আজ তোমার নিন্দাধ্বনিতে মুখরিত।

দুর্যোধন।। নিন্দা! আর তাকে ডরি না। নিন্দারে ধ্বংস করবো তার কণ্ঠ রুদ্ধ করে। মুখরা নগরীর স্পর্ধিত রসনা স্তব্ধ করবো দৃঢ় হস্তে।  রাজদণ্ড স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করছি মহারাজ... আপামর জনতা বলতে বাধ্য হবে...'দুর্যোধন রাজা। দুর্যোধন রাজনিন্দা আলোচনা সহ্য করে না। নিজ হস্তে নিজ নাম বহন করেন দুর্যোধন।'

প্রীতি না পেলেও খেদ নেই মহারাজ, কিন্তু স্পর্ধার ক্ষমা নেই। আমি চাই ভয়...সেই আমার রাজপ্রাপ্য। দুর্যোধন আজ জেগেছে। রাজায়-প্রজায় ঘনিষ্ঠ কঠিন দ্রোহ। দেখি কতদিন থাকে প্রজার পরম স্পর্ধা! দর্পিতে দর্প নাশ করেই আজ আমি জয়ী। নিন্দায়, ধিক্কারে, তর্কে কিংবা শ্লেষে, কেউ যদি বাধা দান করতে চায়...তাকে দমন করবো কঠোর হস্তে। হোন না কেন তিনি বিজ্ঞ সঞ্জয়, খুল্লতাত বিদূর কিম্বা পিতামহ ভীষ্ম স্বয়ং।

ধৃতরাষ্ট্র।। হও জয়ী। হও সুখী। হও তুমি রাজা একেশ্বর। ওহে, তোমরা জয়বাদ্য বাজাও, উড়াও জয়ধ্বজা। আজিকার জয়োল্লাসে থাকবে না ন্যায়, ধর্ম, বন্ধু কিম্বা ভ্রাতা। রবে না সঞ্জয়, বিদূর, ভীষ্ম অথবা লোকনিন্দা, লোকলজ্জা, লোকভয়! নাই বা রইল কুরুকুললক্ষ্মী..শুধু রইবে এক অন্ধ পিতা, এক অন্ধ পুত্র আর কালান্তক যম। শুধু পিতৃস্নেহ আর বিধাতার অভিশাপ।

 

(প্রতিহারীর প্রবেশ)


প্রতিহারী।।(অভিবাদন করে) প্রণাম মহারাজ, রাজমহিষী গান্ধারী দর্শনপ্রার্থিনী আপনার চরণে।

দুর্যোধন।। পিতা, আমি তবে আসি।(প্রস্থান)

ধৃতরাষ্ট্র।। হায় রে পলাতক! সাধ্বী জননীর সকাশে সঙ্কুচিত, লজ্জিত, দুরাশয় পুত্র!


(ধৃতরাষ্ট্র হাত দিয়ে ইশারা করে। প্রতিহারীর প্রস্থান)


ধৃতরাষ্ট্র।। অন্ধ...অন্ধ আমি অন্তরে-বাহিরে চিরদিন। বন্ধুগণ, হাহাকার রবে নিষেধ করেছেন, নিশাচর গৃধ্নু অশুভ করেছে তার জন্মক্ষণে, আসন্ন বিপদে কম্পিত কলেবর। তবু হায় পিতৃস্নেহে অন্ধ হয়ে, অধর্মে যোগ দিয়েছি। জ্ঞানহারা করেছি আপন পুত্রের সর্বনাশ! তারে নিয়ে চলেছি প্রলয় তিমিরে! হাঃ! ধিক ধিক অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র! ধিক!


(গান্ধারীর প্রবেশ)


গান্ধারী।। মহারাজ! 

ধৃতরাষ্ট্র।। মহিষী গান্ধারী? রয়েছি তোমারই প্রতীক্ষায়।

গান্ধারী।। শ্রীচরণে একটি নিবেদন আছে নাথ...অনুনয় রক্ষা করুন। 

ধৃতরাষ্ট্র।। চক্ষুস্মান নই বটে, তবু হস্তিনাপুরের অধিপতি তো নিশ্চয়ই। আমার প্রিয়ার প্রার্থনা অপূর্ণ রবে না মহারাণী। 

গান্ধারী।। তবে ত্যাগ করুন এইবার!

ধৃতরাষ্ট্র।। কার কথা বলছো মহিষী?

গান্ধারী।। যে মূঢ় পাপের সংঘর্ষে শাণ দেয় কৃপাণে...

ধৃতরাষ্ট্র।। কে সে? আছে কোনখানে? কি নাম তার?

গান্ধারী।। পুত্র দুর্যোধন!

ধৃতরাষ্ট্র।। দুর্যোধন? পুত্র দুর্যোধনকে ত্যাগ? দারুণ প্রার্থনা হে রাজমাতা গান্ধারী!

গান্ধারী।। এ প্রার্থনা আমার একার নয় মহারাজ! মন দিয়ে  শুনুন...কুরুকুল পিতৃ-পিতামহ স্বর্গ থেকে এই প্রার্থনা করেন অহরহ। ত্যাগ করো, ত্যাগ করো তারে...যার অত্যাচারে কৌরব কল্যাণ-লক্ষ্মী অশ্রুমুখী...রাত্রিদিন বিদায়ক্ষণের প্রতীক্ষায়।

ধৃতরাষ্ট্র।। বেশ... সে যদি ধর্ম লঙ্ঘন করেই থাকে...ধর্মই তাকে শাসন করবে। আমি পিতা হয়ে...

গান্ধারী।। আর আমি? আমি মাতা নই? গর্ভভার জর্জরিত হয়ে তাকে বহন করিনি এই দেহে? স্নেহ বিগলিত চিত্তে স্তনসুধা পান করাইনি সেই শিশুকে? আমার হাসি, আমার বাণী, আমার প্রাণ কি অর্পণ করিনি সেই শিশুর ক্ষুদ্র  বাহুবন্ধনে? তবু...তবু বলি মহারাজ, সেই পুত্র দুর্যোধনে ত্যাগ করুন আজ।

ধৃতরাষ্ট্র।। তারে যদি ত্যাগ করি, কি নিয়ে থাকবো তবে?

গান্ধারী।। আপনার ধর্ম মহারাজ। 

ধৃতরাষ্ট্র।। ধর্ম! ধর্ম কি দেবে মহিষী?

গান্ধারী।। ধর্ম যদি নব নব দুঃখও দেয়...তাও সহ্য হবে। কিন্তু অধর্মের পণে পুত্রসুখ, রাজ্যসুখ লাভ? সে যে সারাজীবনের কন্টকশয্যা!

ধৃতরাষ্ট্র।। হায় মহারাণী, সত্য তোমার উপদেশ, তবু তীব্র তোমার বাণী।

গান্ধারী।। অধর্মের মধুমাখা বিষফল পেয়ে, পুত্র দুর্যোধন আনন্দে নৃত্যরত। স্নেহ-মোহে ভুলে, তাকে সে ফল ভোগ করতে দেবেন না মহারাজ। কেড়ে নিন, ফেলে দিন...কাঁদান তাকে। ছললব্ধ রাজ্য-ধন-জন ফেলে সেও যাক নির্বাসনে। বঞ্চিত পাণ্ডবগণের সমদুঃখ ভার বহন করুক সেও।

ধৃতরাষ্ট্র।। মনস্বিনী, ধর্মবিধি বিধাতার। ধর্মদণ্ড তাঁর সদা জাগ্রত। নিত্য উদ্যত। তাঁর রাজ্যে তাঁর কার্য তিনিই করবেন। আমি যে পিতা...

গান্ধারী।। আপনি রাজা। রাজ অধিরাজ। বিধাতার বামহস্ত। আপনাতেই ধর্মরক্ষার গুরু দায়িত্ব ন্যস্ত। আপনাকে প্রশ্ন করি, যদি কোনও প্রজা বিনা দোষে, পরগৃহের অবলা সতীকে সর্বসমক্ষে টেনে এনে করে অপমান... কি করবেন তার বিধান? 

ধৃতরাষ্ট্র।। নির্বাসন দন্ড।

গান্ধারী।। তবে আজ রাজ পদতলে সমস্ত নারীর হয়ে, নয়নজলে বিচার প্রার্থনা করি কুরুকুলপতি। পুত্র দুর্যোধন অপরাধী প্রভু। মহারাজ স্বয়ং তার সাক্ষী।  পুরুষে পুরুষে স্বার্থ নিয়ে দ্বন্দ্ব অহরহ।ভালো-মন্দ কিছুই বুঝি না তার। দণ্ডনীতি, ভেদনীতি, কূটনীতি কত শত। বলের বিরোধে বল, ছলের বিরোধে ছল, কৌশলের প্রত্যুত্তরে কৌশল...সেসব পুরুষের নীতি পুরুষেরই জানা থাক। নারী থাকে তার থেকে দূরে, শান্ত অন্তঃপুরে, গৃহকর্মে। বাহিরের দ্বন্দ্ব, বিদ্বেষ-অনল নিয়ে যে পুরুষ অন্তঃপুরে প্রবেশ করে, নারীকে কলুষ স্পর্শে অসম্মান করে, পতির সাথে বিরোধের শোধ নিতে, যে তাঁর পত্নীর ক্ষতি করে, সে শুধু পাষণ্ডই নয়, সে কাপুরষ!  মহারাজ এর বিধান করুন। 

মাতৃগর্বভরে ভেবেছিলাম গর্ভে  বীর পুত্র ধারণ করেছি। হায় নাথ, সেদিন যখন পাঞ্চালীর আর্তনাদ ধ্বনিত হল, প্রাসাদ-পঞ্জর ভেদ করে,  সভা মাঝখানে একবস্ত্রা, ঋতুমতীর বস্তু আকর্ষণ করে, খলখল হাস্যে আকাশ-বাতাস মুখরিত করল গান্ধারীর পুত্র-পিশাচেরা...ধর্ম জানেন, সেদিন চূর্ণ-বিচূর্ণ হল জননীর সমস্ত গর্ব। আর সকল উপস্থিত রথী-মহারথীবৃন্দ, কেউ জড়মূর্তিবৎ, কেউ হাস্যমুখে, কেউ কৌতুক, কেউ বা কানাকানিমাত্রে চিত্রার্পিতের ন্যায় সাক্ষী হয়ে থাকলেন! মহারাজ, মিনতি করি আপনার কাছে, লজ্জা অপনোদন করুন এই জননীর। পদাহত সতীত্বের ক্রন্দন ঘুচিয়ে, উদ্ধার করুন বীরধর্ম। দূর্যোধনকে ত্যাগ করুন। 


ধৃতরাষ্ট্র।। প্রিয়ে সংহর, সংহর তোমার রসনা। পরিতাপ দহনে, জর্জর হৃদয়ে শুধুই নিষ্ফল আঘাত করিছো মহিষী। 

গান্ধারী।। শতগুণ বেদনা কি হানিছে না মোরে? প্রভু, দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সে সমান আঘাতে সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার। যে দণ্ড-বেদনা পুত্রেরে দিতে আপনি অপারগ নাথ, সে দণ্ড দেবেন না কভু অন্যকে। মূঢ় নারী আমি। অন্তরে জেনেছি যে শাস্ত্র, তা বলে, পাপী পুত্রে যদি ক্ষমা করো মহারাজ, তবে নিরবধি দণ্ড দিয়েছো যত দোষীজনে, তা নির্মমতা রূপে আপনাকেই কলঙ্কিত করবে। ত্যাগ করুন পাপী দুর্যোধনে।

ধৃতরাষ্ট্র।। পাপী পুত্র ত্যাজ্য বিধাতার। তাই তো তারে ত্যাজিতে পারি না আমি। আমি না-হয় তার দুর্গতির অংশ নিই। অর্ধফল ভোগ করি তার দুর্মতির! সেটুকুই সান্ত্বনা আমার। ঘটেছে যা ছিল ঘটবার। ফল যা মিলবে, তা নতমস্তকে গ্রহণ করবো পুত্র-সাথে।


(বহুমূল্য অলঙ্কার, বস্ত্র পরিধান করে ভানুমতীর প্রবেশ।) 


ভানুমতী।।(উচ্চস্বরে)  ইন্দুমুখী, পরভৃতে, অবশিষ্ট মাল্য-বস্ত্র-অলঙ্কার আমার কক্ষে রেখে এসো।

গান্ধারী।। ধীরে বৎসে ধীরে। পৌরভবনে আজ কোন মহোৎসব? নববস্ত্র-অলঙ্কারে সেজে, কোথায় চলেছো বধূমাতা?

ভানুমতী৷। শত্রুপরাভব শুভক্ষণ সমাগত শ্মশ্রুমাতা।

গান্ধারী।। শত্রু যার আত্মীয়-স্বজন, অজেয় তার শত্রু। তার শত্রু ধর্ম, তার শত্রু আত্মা। কিন্তু নব অলঙ্কার কোথা হতে পেলে কল্যাণী?

ভানুমতী।। মাতা, বাহুবলে বসুমতী ছেনে পাণ্ডবগণ প্রিয়তমা পাঞ্চালীর জন্য যত রত্ন, মণি, অলঙ্কার,  সূক্ষ্ম মহার্ঘ বসন সংগ্রহ করেছিলেন,  আজ বনবাস গমনের পূর্বে সেই রত্ন, আভূষণে আমাকে সাজিয়ে দিয়ে যেতে হল তাঁরে। সমগ্র কুরুকুলকামিনীর বক্ষে ঈর্ষা হয়ে বিদ্ধ হতো যে আভরণ, যত মাণিক্য, অলঙ্কার সবই আজ শুধুই আমার অধিকারে মাতা।

গান্ধারী।। হা রে মূঢ় দুর্যোধন-পত্নী, সেই রত্ন নিয়ে এত অহঙ্কার তোমার! এ যে প্রলয়ের সাজ। এ মণি মঞ্জীর তোমার সৌভাগ্যের ললাটে বহ্নিশিখা। এ অলঙ্কার শব্দ আমার কর্ণে বাজে তাণ্ডব ঝঙ্কারসম। চিত্তে উঠেছে ক্রন্দন। অঙ্গে যেন ত্রাসের স্পন্দন। 

ভানুমতী।। মাতা, আমরা ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রবীরাঙ্গনা, রাজবধূ। দূর্ভাগ্যের ভয় করি না। কখনো জয়, কখনো পরাজয়। সেই কথা স্মরণ করে সঙ্কটে ভীত নই ক্ষণ কালও। দুর্দিন-দুর্যোগ যদি আসে, তবে ভাগ্যকে উপহাস করে কেমনে মরতে হয়, তা জানি। কেমনে বাঁচতে হয়, সে শিক্ষাও লাভ করেছি দেবী।

গান্ধারী।। বৎসে, অমঙ্গল তো তোমার একার নয়। বীর রক্তস্রোতে একাকার হবে কত বিধবার অশ্রুধারা!! শত শত বধূহস্ত থেকে খসে পড়বে অলঙ্কার, এয়োতি চিহ্ন। কল্যাণী, গৃহ-মাঝে আহ্বান করো না বিপ্লব-কেতন...যুদ্ধ যুদ্ধ ক্রীড়া। আনন্দের দিন নয় আজ। স্বজন-দূর্ভাগ্য সর্ব অঙ্গে পরিধান করে, গর্ববোধ কোরো না বধূ। খুলে ফেলো এ অলঙ্কার, নব রক্তাম্বর, উন্মোচন করো বেণী। থামাও উৎসববাদ্য, রাজ-আড়ম্বর। শুদ্ধচিত্তে, উপবাসব্রতে করো দেব-অর্চনা। অগ্নিগৃহে যাও পুত্রী। কালের প্রতীক্ষা করো শুদ্ধ চিত্তে। 

ভানুমতী।। যথা আজ্ঞা মাতা।(প্রস্থান)


গান্ধারী।। হে আমার অশান্ত হৃদয় শান্ত হও। নত শিরে শুধু প্রতীক্ষা করো বিধাতার বিধানের। প্রণাম করে রমণী মহাকালে। তার পরে যবে গগনে ধূলি উড়বে, ধরণী কম্পিত হবে ক্রন্দনের ধ্বনিতে, হাহাকারে মুখরিত হবে গগনতল। হায় হায় হায় রমণী, হায় রে অনাথা, হায় হায় বীরবধূ, হায় বীরমাতা। তখন হে সুধীরা, ধূলায় আশ্রয় নিও অবনত শিরে, মুদ্রিত নয়নে। তারপর দারুণ, করুণ শান্তি।  নির্বাক, নির্মম, শ্মশানের ভষ্ম মাখা পরমা নিষ্কৃতি।

(নতজানু হয়ে বসে)



যবনিকা

Comments