রম্যরচনা - দেবাশিস ধর


একটি তথ্যচিত্র ও তার সার্থক নামকরণ  

                        

'এ ম্যান ইজ নোন বাই দ্য কোম্প্যানি হি কিপস'- কথাটা অন্তত আমার বেলায় ঠিক খাটেনা। এই দেখুন না যে বাল্যবন্ধু সুধাবিন্দুর নিজস্ব বিরাট লাইব্রেরিটায় বসে ওর কাজের বিঘ্ন ঘটাচ্ছি তার পকেটে কিন্তু খান ছয়েক এমএ ডিগ্রি। বন্ধু যেমন বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী আমি তেমনিই পল্লবগ্রাহী অর্থাৎ ভাসা ভাসা জ্ঞান থাকা একজন লঘূ প্রকৃতির মানুষ। অবশ্য পাড়ার মোড়ের আড্ডায় বা চায়ের দোকানে তর্ক জিততে এর চেয়ে বেশী জ্ঞানের দরকার এখনও হয়নি আমার। এতদসত্বেও সুধাবিন্দু আমাকে সমীহ করে চলে কারণ আমি বিবাহিত এবং সে এই দুঃসাহসিক কর্মটি ষাট পেরিয়েও গেলেও সেরে উঠতে পারেনি।   

            

এমনিতে সবসময়েই আমার বন্ধুর টেবিলে খোলা বই, নোটখাতা, পেপার কাটিং, প্রিন্ট আউট ও খোলা ল্যাপটপ থাকেই তবে আজ দেখলাম খোলা বইয়ের সংখ্যাটা একাধিক। বন্ধুর ব্যস্ততাও বেশী। কি ব্যাপার? বন্ধু জানাল ও একটি ছোট তথ্যচিত্র বানাবার উদ্যোগ নিয়েছে। তথ্যচিত্র? মনে পড়ে গেল বন্ধুবর এতগুলো এমএ ডিগ্রি পকেটস্থ করার ফাঁকে ফাঁকে চলচ্চিত্র সংক্রান্ত কয়েকটি স্বল্পমেয়াদী কোর্সও করেছে। তা' কিসের উপর তথ্যচিত্র? আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সুধা বক্তৃতা শুরু করে দিল- 'জানিস আমাদের দেশে প্রতিবছর কয়েকহাজার কোটি টাকার পার্গেটিভ বা জোলাপজাতীয় পেট পরিষ্কারের ওষুধ বিক্রি হয় এবং প্রতিবছর এই বিক্রি আট থেকে দশ শতাংশ হারে বেড়ে চলেছে। বয়স্ক মানুষদের আদ্ধেকই এই কোষ্ঠবদ্ধতার সমস্যায় জেরবার। বয়স্কমানুষদের এই সমস্যা এবং তার সমাধান নিয়েই আমার তথ্যচিত্রটা তৈরী করব যদিও এটা উৎসর্গ করব বঙ্গনারীদের'।      

     

এমন কেন? 'দ্যাখ, এই বঙ্গনারীরা সেই শৈশব থেকেই বেগ ও আবেগ দুটোই চেপে রাখা শিখতে একরকম বাধ্যই হয়। মেয়েদের স্কুলে একসময় টয়লেটই ছিলনা। এখন থাকলেও যথেষ্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নয়। বলিউডের প্রাক্তন তিন বিখ্যাত নায়িকা কিছুদিন আগেই এক টিভি শোয়ে বলেছিল যে সেই পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে বোম্বের বিখ্যাত স্টুডিওগুলোতেও মেয়েদের কোন আলাদা টয়লেটই থাকতোনা। আউটডোরে তো প্রশ্নই নেই। নায়িকাদের তরফ  থেকে  এ'ব্যাপারে কোন দাবীও ছিলনা। এই চেপে রাখার ফল কি ভাল হয়েছে বলে তুই মনে করিস? স্ট্যাটিস্টিক্স বলছে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা অনেক বেশী ভুগছে এই পৈটিক সমস্যায়' - সুধার গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে।   


'তুই তো এই বুড়ো বয়সেও নানান জায়গায় আড্ডা মেরে বেড়াস, এই কোষ্ঠকাঠিন্যে লাগাতার ভোগা মানুষজনদের থেকে তাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনে আমাকে জানাসতো। ওগুলো আমার কেসস্টাডিতে কাজে লাগবে। তথ্যচিত্রে কৃতজ্ঞতা স্বীকারে তোর নামটা দিয়ে দেব'। পর্দায় আমার নাম ভাসবে! আমি সেদিনই কাজে লেগে পড়ি।  


পড়ন্ত বিকেলে পার্কে জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের আড্ডায় কায়দা করে বিষয়টা তুলি। রসিকবাবু রসিকলোক। 'আরে আর বলেন কেন? সেই দুবছর আগে এত ভুগলাম যে যাকে পাই তাকেই জিজ্ঞেস করি এই কন্সটিপেশন থেকে মুক্তির উপায় কিছু জানা আছে নাকি? সেইসব উপদেশ শুনে প্রায় হাফ কুইন্টাল পেঁপে(সেদ্ধ), শ' দেড়েক বেলের শরবত, এন্তার ত্রিফলার জল, ইসবগুলের ভুসি ছাড়াও কাঁচা সাদা মূলো, কাঁচা গাজর, পাকা কলা, দিনে চার লিটার জল এমনকি শোয়ার আগে এককাপ গরম দুধে তিন চামচ ব্র্যান্ডি কি না খেলাম। দুধে ব্র্যান্ডি মিশিয়ে খাওয়াটা অবশ্য মাসখানেক পরে বন্ধ করে দিতে হল'।  


কেন? কেন? কেন?    


'আরে বলবেননা, মাসখানেক পরে এককাপ দুধে তিন চামচ ব্র্যান্ডির জায়গায় আমি নাকি এককাপ ব্র্যান্ডিতে তিন চামচ দুধ মেশাচ্ছিলাম। আমার খেয়াল হয়নি কিন্তু গিন্নির চোখে ব্যাপারটা ঠিক ধরা পড়ে গেল'- রসিকবাবু ও উপস্থিত অন্যেরা হাহা করে হাসে।   

'তারপর রসিকবাবু, তারপর'?- আমার আর তর সয়না।                     


'কিছুতেই কিছু না হওয়াতে বাধ্য হয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে সব বললাম। অল্পবয়সী ডাক্তারবাবু সব শুনে জিজ্ঞেস করলেন- 'কোন ফ্রী হ্যান্ড এক্সারসাইজ টাইজ কিছু করেন'?  


'সে তো করতেই হয়, বিশ পঁচিশ মিনিট ধরে তো প্রায় ঘাম ঝরানো কসরৎ করতেই হয়'- আমার চটপট জবাবে একরকম সন্তুষ্ট ডাক্তার বললেন- 'বেশ, বেশ তা' ঐ এক্সারসাইজ কি মাঠে করেন না ঘরে'?    


'কি যে বলেন ডাক্তারসাহেব, মাঠে এসব করে পুলিশের হাতে মার খাব নাকি! ঘরেই সারি বসে বসে'?


'বসে বসে'?- ডাক্তার মশাই একটু অবাকই নন- 'কিসে বসে? মেঝেতে, চেয়ারে না খাটে'?    


'আজ্ঞে না, কমোডে। এমন কসরৎ না করলে যে পেট খালিই হয়না'- আমি  নিজেকে প্রাঞ্জল করি। আমার জবাব শুনে ডাক্তারবাবুর মুখ অনেকক্ষণ হাঁ হয়েই থাকল'।      


পরদিনই গিয়ে সুধাবিন্দুকে রসিকবাবুর বয়ান জানিয়ে আসি। সুধা মাথা নাড়ায়-' ভেবে দেখ সমস্যাটা কত গভীর আর ব্যাপক। ২০১৫ সনে অমিতাভ বচ্চন, দীপিকা পাড়ুকোন, ইরফান খানদের নিয়ে 'পিকু' নামে একটা হিট হিন্দী সিনেমা হয়েছিল যেটার কাহিনী একজন বয়স্ক মানুষের কন্সটিপেশন বা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা নিয়ে আবর্তিত। 'পিকু'-র স্টোরিলাইন দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে কেন জানিস? কারণ সমস্যাটা প্যান ইন্ডিয়ান শুধু নয়, ইট'স ইউনিভার্সাল। যদিও আমাদের কাব্যসাহিত্যে এর কোন রিফ্লেকশন নেই, সেই এক গোপাল ভাঁড়ের গল্পে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে শিক্ষাদানের একটি ঘটনা ছাড়া'।         


সুধা আরো বলে- 'দেখবি, বুড়োদের সায়ংকালীন আড্ডায় নিত্য আলোচ্য সূচিতে ব্যাঙ্কের ক্রমহ্রাসমান সুদের হার, উচ্ছন্নে যাওয়া যুবসমাজ এবং কোষ্ঠকাঠিন্য থাকবেই থাকবে। এমন কোন আড্ডার পাশ দিয়ে যেতে যেতে যদি শুনিস যে আড্ডায় সেই মুহূর্তে অনুপস্থিত কারও নামে সবাই একসুরে উত্তেজিতভাবে মিথ্যুক, চালবাজ, ভোটে দাঁড়াবার উপযুক্ত ইত্যাদি বাছা বাছা বিশেষণ ছুঁড়ে দিচ্ছে তাহলে ধরে নিতে পারিস যে সেই অনুপস্থিত বৃদ্ধ অবশ্যই বলে থাকবেন যে তার নিত্যদিন দুবেলা কোষ্ঠ সাফ হয়। কোন বৃদ্ধের প্রতি তার বাড়ির লোকেরা সবিশেষ যত্নশীল এমন কথাও কখনো সখনো বিশ্বাস করা যায় কিন্তু নিত্য দুবেলা কোষ্ঠ সাফ! ইট'স ইম্পসিবল অ্যান্ড ডাহা অনৃতভাষণ'।  সুধা এরপর ইউটিউবে লতা মঙ্গেশকর পুরনো একটা টিভি সাক্ষাৎকার আমাকে দেখায়।     


লতাজী বলেছেন যে তিনি একসময় কিশোরকুমারের সাথে একসঙ্গে গান রেকর্ডিং করতে চাইতেন না। কারণ রেকর্ডিঙের আগে কিশোরকুমার এমনসব উদ্ভট কথা বলতেন যে লতাজী হাসতে হাসতে আর নাকি ঠিকমত গান গাইতে পারতেন না। টিভি সাংবাদিক একটা এমন ঘটনার কথা বলার অনুরোধ করলে লতাজী প্রথমেই একচোট হেসে নিলেন। 'আপ কি কসম' সিনেমার একটি ডুয়েট ছিল- 'সুনো সুনা, কুছ হুয়া ক্যা, কুছ ভি নহী অভী তো নহী'। গানটি রেকর্ডিঙয়ের আগে কিশোরকুমার নাকি লতাজীকে বলেছিলেন- 'ধরে নাও লতা তুমি আর আমি সকালের  দিকে  নিজেদের ঘরের কমোডে বসে ফোনে পরস্পরের খবরাখবর নিচ্ছি তা্হলে এই গানটা গাইলেই হবে।  ঠিক কিনা বল'?- সুধা মাথা নাড়ায়- 'দেখলি তো এই সমস্যা  থেকে সেলিব্রেটিদেরও নিস্তার নেই। অথচ তাদের জন্য ডাক্তার, বদ্যি, কবিরাজের কোন কমতি নেই। তাইতো, তাইতো! আমিও মাথা নাড়ি।     


'আমি শুনেছি কোষ্ঠের এই রুদ্ধ বা মুক্ত হওয়ার ব্যাপারটা আমাদের ব্রেন নিয়ন্ত্রণ করে'- পতিতপাবনবাবু তার স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য বজায় রেখে মন্তব্য করেন। আড্ডার বাকি সকলে জানতে চায়- আপনি কোথায় শুনলেন এমন কথা।   'বছরখানেক আগে আমার হঠাৎই লুজ মোশন শুরু হল। সেই টয়লেটে যাচ্ছি আর আসছি। দিন তিনেক চলল, তারপর নিজে্র থেকেই থেমে গেল। এমনিতে খাওয়াদাওয়ায় আমি কোন অনিয়মই করিনি। তাহলে?- পতিতপাবন বলে চলেছেন- 'এর কয়েকদিন পর থেকে শুরু হল ভয়ঙ্কর কন্সটিপেশন, তাও চলল দিন চার পাঁচেক। ব্যাপারটা কিছুদিন পরপরই ঘটতে থাকল। ছেলে জোর করে নিয়ে গেল আটশ টাকা ফিজ-এর ডাক্তারের কাছে। তারপর এন্ডোস্কোপি, কোলনোস্কোপি ইত্যাদি করেও কিছুই পাওয়া গেলনা। কয়েকহাজার টাকার শ্রাদ্ধই হল'। 


'আমি একটু অসহিষ্ণুভাবেই ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম- 'কিছুই যদি সমস্যা না থাকে তবে এমন হচ্ছে কেন? বাড়ি থেকে ব্যাঙ্কেও যাওয়ার সাহস হচ্ছেনা আমার, রাস্তায় যদি আবার হড়পা বেগ আসে! আমার হয়েছেটা কি'? আটশ টাকা করে তিনবারে চব্বিশ টাকা নেওয়া ডাক্তার আমার কথা শুনে হাসেন- 'আপনার আইবিএস মানে ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম হয়েছে। আপনাকে আমি লুজ মোশন আর কন্সটিপেশন- দুটোরই তিনটে করে ওষুধ দিয়ে দিলাম। যখন আপনার সমস্যা হবে সিভিয়ারিটি বুঝে ওষুধ খেয়ে নেবেন। আর আপনাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবেনা। এই রোগের বিশেষ কোন ওষুধ নেই। ব্রেন থেকে হঠাৎ সিগন্যাল পাঠায় আর স্টার্ট হয়ে যায়। ব্রেন কেন এমন সিগন্যাল পাঠায় তা' নিয়ে রিসার্চ চলছে'।- পতিতপাবন থামেন।        


পরদিন সুধাকে পতিতপাবন ও আটশ টাকা (টোট্যাল চব্বিশ শ টাকা) ভিজিটের ডাক্তারবাবুর কথপোকথন সবিস্তারে শুনাই। 'বুঝলি সুধা, এই ব্রেনের কলকাঠি নাড়ানোর ব্যাপারটা মনে হয় ঠিক, নাহলে স্কুলে ঠিক পরীক্ষার দিনগুলোতেই ঘর থেকে বেরোবার মুখে আমাকে টয়লেটে দৌড়াতে হত কেন বল? ভয়েই তো নাকি! তা' পেট কোথা থেকে জানবে যে আমি পরীক্ষার জন্য ভয় পেয়েছি যদিনা ব্রেন জানায়'- আমার কথায় সুধাও মাথা নাড়ে- 'ভয় একটা ফ্যাক্টর বটে। ভয়ের আবহ তৈরী করে কারও ব্রেনকে কিঞ্চিৎ লুজ মোশনের সিগন্যাল পাঠাতে বাধ্য করতে পারলেই তো কেল্লা ফতে! কিশোরবয়সে একটা গল্প পড়েছিলাম, মনে হয় শিব্রাম চক্কোত্তিরই হবে।          


'এক ভদ্রলোক তার সুন্দরবনে কর্মরত বন্ধুর আমন্ত্রণে সুন্দরবনের উদ্দেশ্য রওনা হয়েছে। সুন্দরবনের বন্ধু চিঠিতে লিখেছিল- আসিবার সময় অবশ্যই একডজন এক্সট্রা ধুতি আনিও। আমন্ত্রিত বন্ধু ভাবল- ওটা এক ডজন ধুতি না হয়ে শার্ট হবে কারণ ধুতি তো ফ্রী সাইজ। তবুও চিঠির উপদেশ অনুযায়ী এক ডজন ধুতি নিয়েই রওনা হল। স্টীমার সুন্দরবনে প্রবেশের অল্পক্ষণের মধ্যে জঙ্গলের থেকে বাঘের গর্জন শোনা গেল এবং ভদ্রলোকের পরে থাকা ধুতিটি খারাপ হল। আশ্চর্যের কথা বন্ধুর কুঠিতে পৌঁছতে পৌঁছতে ভদ্রলোকের ঠিক এক ডজন ধুতিই খারাপ হয়ে গেল ব্যঘ্রগর্জন শুনতে শুনতে'। সুতরাং তুই ঠিকই বলেছিস- ভয়কে কাজে লাগাতে হবে এ'ব্যাপারে। বাট হাউ'?- সুধা মাথা ঝাঁকায়- 'বাট হাউ'।

  

পরদিন গিয়ে দেখি সুধা বেজার মুখে বসে আছে। 'কিরে তোরও কি আইবিএস জাতীয় কিছু শুরু হল নাকি'?- আমি রসিকতা করলেও সুধা গায়ে মাখেনা- 'বুঝলি, অনেক ভেবে দেখলাম এই 'ভয়' জিনিসটাকে ব্যবহার করে এই কাজে দীর্ঘদিন রেজাল্ট পাওয়া যাবেনা। ধর তোর যদি প্রতিদিনই পরীক্ষা থাকত তবে তোর পরীক্ষার ভয়টাই কেটে যেত। অথবা এই গল্পের ভদ্রলোক যদি বছরে তিনবার করে সুন্দরবনে বেড়াতে যেত তবে বাঘের গর্জন শুনে খুববেশী হলে পরে থাকা ধুতিটাই হয়ত খারাপ হত। তাইনা'? আমি যথারীতি মাথা নাড়ি। চিন্তাও হয় শেষমেশ তথ্যচিত্রটা হবে তো? আমার নামটা কি আর পর্দায় ভাসবেনা?     


'তবে বুঝলি হতাশ হবার মত ব্যাপারও নয়। কিছু না কিছু তো বেরোবেই- তোর সেই রসিকবাবুর কমোডে বসে কসরৎ করার মত আরকি'!- সুধা হাসে, আমিও আশাবান হয়ে উঠি। হঠাৎ আমার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে।   'আচ্ছা, সুধা আমরা যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন পাড়ার বৈকুন্ঠ সাহার বাড়িতে একবার বিরাট চুরি হয়েছিল- তোর মনে আছে? সুধা মনে করতে পারেনা। 'অদ্ভুত ব্যাপার কি ছিল জানিস, চোরের দল সবকিছু নিয়ে তো গেছেই আবার হাঁড়িতে, সসপ্যানে রাখা রাতের রান্না করা সব খাবারও খেয়ে গেছে'। 'তাতে কি হল? চোরের  খিদে পেয়েছিল তাই খেয়ে গিয়ে থাকবে- সিম্পল'- সুধা বিরক্ত হয়েই বলে।


'আরো আশ্চর্যের ব্যাপার কি ছিল জানিস চোরদের মধ্যে দুজন সেই হাঁড়ি আর সসপ্যানে বাহ্যি করে গেছে'। 'কি বলিস বাহ্যি করে গেছে'- সুধা শিরদাঁড়া সোজা করে বসে। সুধার প্রতিক্রিয়া দেখে আমি এগিয়ে যাই- 'পাড়ার লোক অবাক হলেও পুলিশের অভিজ্ঞ বড়বাবু জানালেন যে চোরদের ওস্তাদ তার সাগরেদদের শিক্ষানবিশি শেষ করার পর প্র্যাক্টিক্যাল টেস্ট নেয়। সেই প্র্যাক্টিক্যাল টেস্টের ওয়ান অব দ্য মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট আইটেম হল চৌর্যকর্ম সমাপনা্ন্তে সেই স্পটেই এই অতি গুরুত্বপূর্ণ কোষ্ঠখালি করার টাস্ক। চোর যদি নার্ভাস থাকে, তার হার্টবিট যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে সে স্বচ্ছন্দে এই কর্মটি সারতেই পারবেনা। ইন দ্য ইন্সট্যান্ট কেস দেখা যাচ্ছে তস্করগুরুর ছাত্ররা যোগ্যতার সাথেই পাশ করেছে। তবে এমন কেতাবী শিক্ষাগুরু আর নাকি বেশী জীবিত নেই।          


সুধা আমার বর্ণিত কাহিনী শুনে উদ্দীপিত হয়ে ওঠে- 'ইয়েস, নিজেকে সঙ্কটকালেও শান্ত, স্ট্রেস অ্যান্ড টেনশন ফ্রী রাখাটা অত্যন্ত জরুরী। যেমনটি ছিল আমাদের ঋষিমুনিরা। এই স্ট্রেস, চিন্তাভাবনার জটিলতাই এই কন্সটিপেশনের অন্যতম কারণ। ওয়েল ডান মাই ফ্রেন্ড! ভাবছি তোর নামটা সহকারী পরিচালক হিসেবেই দেখাব'।      


সহকারী পরিচালক? আমার হার্টবিট বেড়ে যায়। 'বুঝলি সুধা, সঙ্কটকালে এই হার্টবিট ম্যানেজ করা বহোৎ কঠিন কাজ'- আমার কথায় সুধা হেসে উৎসাহ দেয়- 'তা' কিরকম শুনি'? সুধা হয়ত ভেবেছে আমার কথা শুনে নতুন কোন ক্লু পাওয়া যাবে। আমি হাসি- 'ধর তুই একজন বিবাহিত পুরুষ'। অন্যদিন হলে সুধা এ'কথায় আপত্তি করতই কিন্তু আজ করেনা। আমিও বলে যাই- 'কোন বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক ঘন্টা কয়েক খুব সুন্দর সময় কাটিয়ে তুই বাড়ি ফিরে এলি। অনেকদিন না দেখা অনেকের সাথেই দেখা হওয়াতে মনটাও বেশ খুশী খুশী। রাতে শুয়ে সেগুলোই হয়ত ভাবতে ভাবতে অন্ধকারেই নিঃশব্দে হাসছিস- সে বড় সুখের সময়।  


এমন সময় তোর বউ বুকে মাথা রেখে খুব মিঠেসুরে জিজ্ঞেস করল- 'ঐ মেয়েটা কে ছিল গো'? 'কো ক্কো কোন মেয়েটা? আরে ওতো সিতিমা আমাদের একরকম আত্মীয় হয়'। 'দূর, সিতিমাকে আমি তো চিনিই, ঐ যে মহিলা ম্যাজেন্টা রঙের একটা জারদৌসি সিল্ক পরে এসেছিল। শ্যামলার মধ্যে খুব ভালো দেখতে। চমৎকার মেকআপ করেছিল। ও তোমার সাথে কলেজে পড়ত বুঝি? সেম ক্লাসে? এই সময় তুই মুখে কি জবাব দিচ্ছিস সেটা সেকেন্ডারি। আসল কথাটা বলছে কিন্তু তোর হার্টবিট। কি কঠিন পরিস্থিতি মাইরি! বুকের উপর কান পেতে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে খতরনাক লাই ডিটেক্টর। শালা হার্টবিট বেড়েছে কি ঐ মাঝরাতেই স্টার্ট হড়পা ঝাড় ঐ আইবিএস-এর মত। সুধা হার্টবিটের গুরুত্বটা ধরে ফেলে- 'ইয়েস, ইয়েস কোষ্ঠবদ্ধতার রোগীদের নিরুত্তেজিত  থাকা, নার্ভাস না হওয়া, হার্টবিট নিয়ন্ত্রণ করতে পা্রার বিষয়গুলো নিয়ে স্টাডি করতেই হবে।   

পরের কয়েক মাস সুধা আহারনিদ্রা ভুলে তথ্যচিত্রের পেছনে লেগে থাকে। প্রচুর সাক্ষাৎকার নেয়, ডাক্তার, কবিরাজ, হেকিম এমনকি হাতুড়ে ডাক্তারের সাথে রীতিমত দক্ষিণা দিয়ে আলোচনা করে, নোট নেয়। কয়েকবার তো বিভিন্ন তীর্থস্থানে গিয়ে সাধু সন্ন্যাসীদের সাথেও কথা বলে আসে। অবশেষে তথ্যচিত্রের কাজ শেষ হয়। আমিও পাবলিসিটি শুরু করে দিই। বয়স্ক মানুষদের মধ্যে আশাতীত উৎসাহ দেখতে পাই। এমন অবস্থা যে তাদের কৌতূহল মেটাতে না পেরে আমিই আড্ডাগুলো এড়িয়ে চলা শুরু করি।


সুধাকে বলি যে তথ্যচিত্রটা মুক্তি পেলেই ওর জন্য একটা বিশাল নাগরিক সম্বর্ধনা বাঁধা।   সুধা হাসে কিন্তু কিছুতেই আমাকে তথ্যচিত্রে কোষ্ঠকাঠিন্য সহজেই দূর করার জন্য ঠিক কি সমাধান আছে তা' ভাঙ্গেনা। শুধু বলে আইবিএস যেমন হড়পা বেগ আর রুদ্ধ বেগের চূড়ান্ত ঘটিয়ে ছাড়ে, ওর সমাধানটা এই দুটো এক্সট্রিম ব্যাপারের সামহোয়্যার ইন বিটুইন- নিয়ন্ত্রিত বেগমুক্তি। কিন্তু সেটা কিভা্বে সম্ভব তা' বলেনা। শুধু জানায় তথ্যচিত্রটা মুক্তি পেলেই ও পেটেন্টের জন্য আবেদন করবে। আমার পুলক দেখে কে! এমন একটা ঐতিহাসিক আবিষ্কারের সাথে যুক্ত থাকতে পাড়ার গৌরবের অনুভূতি আমাকে স্বপ্নের আকাশে ভাসিয়ে রাখে। ইয়েস, আই উইল বি নোন বাই দ্য কোম্প্যানি আই কিপ!        


তথ্যচিত্রের নামকরণ ঠিক করতেই সুধা মাসখানেক সময় নেয়। অবশ্য আমাকেও জিজ্ঞেস করেছিল এ'ব্যাপারে। আমি বলেছিলাম- 'সহজ মুক্তি'। সুধা সে নাম খারিজ করে বলেছে- আরে না, যত সহজ ভাবছিস তত সহজ সমাধান নয়। নামকরণটা অর্থবহ হতে হবে। স্কুলে বাংলা পরীক্ষায় প্রশ্ন থাকত না- অমুক কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা ব্যাখ্যা কর। একটা নামকরণের মধ্যে অনেক কিছু বলা থাকে। শেষমেশ সুধাবিন্দু নিজেই তথ্যচিত্রের নাম ঠিক করে- "গ্রেট ডিফিকাল্টিজ ইন রিলিজ"। এই নামটা মানুষজনকে আকর্ষিত করবেই দেখে নিস্‌। ডিফিকাল্টিটা রিয়েলাইজ না করলে সমাধানের প্রতি আগ্রহ থাকবে কেন বল?  শহরের সব সুলভ শৌচালয়ের গায়ে এই তথ্যচিত্রের পোস্টার সেঁটে দিতে হবে কিন্তু।       


তথ্যচিত্রটির মুক্তির ব্যবস্থা করতে সুধা দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। নানান ক্লিয়ারেন্স, কপিরাইট আইনের ব্যাপারে ডিক্লারেশন আরো এমন কতশত কাজ সুধা প্রায় একাই সমাধা করতে করতে এসে যায় করোনা অতিমারী এবং দুবছরের লকডাউন। সব কিছু আবার নুতন করে আবেদন করার নির্দেশ আসে। সুধা একরকম হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয়। সাধের তথ্যচিত্রটির রিলিজ খুব ডিফিকাল্ট হয়ে পড়ে।


"গ্রেট ডিফিকাল্টিজ ইন রিলিজ"- তার নামকরণের সার্থকতা যে চূড়ান্ত ভাবেই প্রমাণ করেছে সে ব্যাপারে আমার আর কোন সন্দেহ থাকেনা। সুধাবিন্দুরও থাকার কথা নয়। 

Comments