গল্প - সুজয় নিয়োগী


আবার দেখা হবে?


রুশ বোমার আঘাতে অ্যানা যেদিন মা-বাবাকে হারালো সেদিন ছিল রবিবার, অন্য অনেকের সাথে মা-বাবাও চার্চে গেছিল প্রার্থনা করতে। খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে গিয়ে দেখেছিল ছড়িয়ে থাকা প্রানহীন দেহ---শনাক্ত করবার পর কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না।সেনাদের সাথে গিয়ে সমাধিস্থ করে বাড়ি ফিরে চুপ করে বসেছিল অনেকক্ষণ--বরিসকে হাজার চেষ্টা করেও ফোনে পায়নি সেদিন। গোটা শহরটা যেন কেমন হয়ে গেছে--- কোন শোক নেই, কোন দুঃখ নেই, একটু চিন্তা করবে সে সময়ও নেই, শুধু প্রানভয়ে দৌড়চ্ছে। 


ঠিক দু'দিন পর অ্যানা ফোন পেল বরিসের, ও তখন ক্যালমিয়াস নদীর ধারে লড়াই করছে রুশিদের সাথে। সব শুনে আশ্বাস দিল-- দু-তিন দিনের মধ্যেই আসছে, ততক্ষণ সাবধানে থাকতে। বরিসের সাথে কথা বলে একটু শান্তি পেল --শেষ দুদিন যে কিভাবে কেটেছে তা নিজেই জানে।


আজ সকালটাতে আর বোমা পড়ছে না, অ্যানা ইন্ডোর স্টেডিয়ামের কাছে গিয়ে দেখলো সেটা ভেঙে চুরে একশেষ হয়ে পরে আছে।টেনিস কোর্টের দুটো নেট এখনও অক্ষত। দিদি নাতালিয়ার সাথে সাত বছর বয়স থেকে এই স্টেডিয়ামের টেনিস কোর্টে আসা- যাওয়া। দিদি সিঙ্গলসের দারুন প্লেয়ার ছিল, এটিপি র‍্যাংকিয়ে প্রথম একশোর মধ্যে যখন ঢুকবে ঢুকবে করছে তখনই খুব বাজে একটা হ্যামস্ট্রিং ইঞ্জুরি খেলার থেকে সরে যেতে বাধ্য করলো। জার্মানিতে অপারেশন করতে গিয়ে সার্জেন হেলমুটের সাথে প্রেম, শেষমেশ ওখানেই থেকে গেলো। এখন একটা একাডেমিতে ছোটদের টেনিস শেখায়। গতকাল ফোনে বার বার বলছিল কোনভাবে পোল্যান্ড চলে যেতে, তারপর ওখান থেকে  জার্মানিতে নিয়ে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করবে হেলমুট। কিন্তু ও বরিসকে একা ফেলে যেতে চায় না। ছোট থেকেই ওর জীবনটা লড়াই করে কেটেছে ,  যখন ১২ বছরের তখন ও বাবা-মাকে হারায় এক প্লেন এক্সিডেন্টে, তারপর থেকে ও চার্চেই মানুষ হয়। বরিস ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে, আজ চার বছর হল লিভ-ইন করছে ওরা । এই টেনিস কোর্টেই ওর সাথে অ্যানার প্রথম আলাপ, তারপর প্রেম। অ্যানা নিজে টেনিসে খুব একটা এগোতে পারেনি, কিছুদিন বরিসকে নিয়ে মিক্সড ডাবলসে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সফল হয়নি সেরকম। তাই বরিসকে শুধু ডাবলসেই মনোনিবেশ করতে বলে। ও এখন ডাবলসে ইউক্রেনের একজন সেরা খেলোয়াড়, এবার ডেভিস কাপের জন্যও হয়তো সিলেক্ট হতো। 


আনন্দেই কাটছিল ওদের জীবন, বরিসের রুশি ডাবলস পার্টানার টোপোলভ, ওর স্ত্রী নাতাশা আর ওরা দুজন একসাথে কত জায়গা ঘুরেছে। যুদ্ধ না বাধলে বরিস আর টোপোলভ হয়তো ডাবলস র‍্যাংকিং এ প্রথম তিরিশে ঢুকেও যেত। 


বরিস যেদিন প্রেসিডেন্ট জেলোনেস্কির ডাকে দেশ রক্ষার জন্য টেনিস র‍্যাকেট ছেড়ে অস্ত্র ধরল, সেদিন কিয়েভের তিন কামরার ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে, অ্যানা কে ওদের কালচিক নদীর ধারের বাড়িতে বাবা মায়ের কাছে রেখে গেলো। 


খুব ঠান্ডা লাগছে-- ক'দিন ধরে ভয়ে ঘুম প্রায় নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝেই খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বাড়ি ফেরার সময় ভাবল,বাবা মায়ের সমাধিতে গিয়ে একটু বসবে--শুনতে পাচ্ছে  ক্যালমিয়াস নদীর ওদিকটায় ভীষণ লড়াই এর শব্দ  , বরিসের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে --নাহ্, বাড়ি ফিরে যাই।


ফেরার পথে সেনারা পথ আটকালো--জানিয়ে দিল কালচিক নদীর দিকে নাকি রুশিরা এগোচ্ছে, তাই বাড়ি ফেরা আর নিরাপদ নয়। আজভ সাগরের কাছে একটা বাংকারে আশ্রয় হল ওর। একটু পরেই বরিসের ফোন-- বাংকারে আশ্রয় নিয়েছে জেনে নিশ্চিত হল,জানালো রাতের মধ্যেই ফিরে আসছে। ক্যলমিয়াস নদীর ওদিকটা হাতছাড়া হয়ে গেছে।


বরিসকে অনেক কষ্টে রাজি করানো গেলো পোল্যান্ডে চলে যাওয়ার জন্য। যুদ্ধ ছেড়ে কাপুরুষের মতো কিছুতেই চলে যেতে রাজি হচ্ছিল না। শেষ অব্দি হেলমুটই ফোনে ওকে রাজি করিয়েছে। বরিস খবর পেয়েছে আজভ মেডিকেল কলেজ থেকে ভারতীয় ছাত্রদের নিয়ে একটা কনভয় পোল্যান্ড যাচ্ছে। এটাই শেষ কনভয়।বরিস তৈরি থাকতে বলেছে, কাউকে কিছু জানাতে মানা করেছে। মারিয়াপোল প্রায় অর্ধেকের বেশি রুশদের দখলে চলে এসেছে। গতকাল কিছু জিনিস কিনেছে তড়িঘড়ি,  যা পেয়েছে, সেগুলোই ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছে অ্যানা।খুব ভোরে বের হতে হবে। ওখানে তো সবাই ভারতীয়রা যাবে,তারা  কিভাবে যাবে!!! বরিস আশ্বাস দিল ও ব্যবস্থা করেছে। সারারাত প্রচন্ড বোমাবর্ষণ-- কিছুক্ষন পর পরই বাংকার কেঁপে কেঁপে উঠছে--সবাই ভয়ে কুঁকড়ে  আছে বরিস মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে আর বলছে সব মনে হয় শেষ হয়ে গেলো। 


খুব ভোরে ওরা বেড়িয়ে পড়লো-- চুপি চুপি আজভ মেডিকেল কলেজের গাড়ি পার্কিং এরিয়ায় আসতেই, ওখানে অপেক্ষায় ছিল বরিসের ছোটবেলার বন্ধু বসচিক,  মেডিক্যাল কলেজের পার্কিং সুপারভাইজার।ও নিজেও পোল্যান্ড চলে যাবে।  বরিসকে তাড়াতাড়ি পোশাক পরিবর্তন করতে বললো বসচিক। ওর গায়ে তখনও ইউক্রেন আর্মির পোশাক। চারিদিকে রুশিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, এই পোশাকে দেখলে আর রক্ষে নেই। আর্মির পোশাক দূরে ফেলে দিয়ে ওরা একটা বাসের ডিকিতে ঢুকে গেলো। বসচিক বললো, এ গাড়িতে দশ জন যাবে তাই ওদের মালপত্র ডিকিতে ঢুকবে না। ড্রাইভার জানে ওরা এখানে থাকবে। মেলিটোপোল পর্যন্ত কষ্ট করে যেতে হবে, তারপর বেড়িয়ে আসতে পারবে ওদিকটায়-- এখনও রুশিরা কিছু করে উঠতে পারেনি।


ওরা বুঝতে পারছে গাড়িতে লোক উঠছে। গাড়ি স্টার্ট দিলে সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু  একটু পরেই গাড়ি থেমে গেলো। চারিদিকে বুটের শব্দ। রুশি ভাষায় কথা শুনতে পাচ্ছে। রুশিরা হয়তো তল্লাশি চালাচ্ছে। হঠাৎ ডিকির দরজা খুলে গেলো। রুশি সেনারা বন্দুক তাক করে বেড়িয়ে আসতে বললো। বরিস, বসচিক ও অ্যানা একে একে বেড়িয়ে এলো। প্রথমে চললো তল্লাশি তারপর জিজ্ঞাসাবাদ। টোপোলভের সাথে থাকতে থাকতে বরিস অনর্গল রুশ ভাষা বলতে পারে।বুঝিয়ে বললো পোল্যান্ড চলে যেতে চায়, ওরা টেনিস প্লেয়ার। বেশ কিছুক্ষন পর ওরা সন্তুষ্ট হলে ছেড়ে দিল । ডিকিতে নয় বাসেই উঠে বসতে বললো। বসচিক, অ্যানা গাড়িতে উঠলেও বরিসকে হঠাৎ আটকে দিল রুশ সেনা। ওরা চিৎকার করতে লাগলো ওকে ঘিরে, অ্যানা নীচে নেমে বুঝলো আর্মির জুতো দেখে ওদের সন্দেহ হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রের পোশাক বদলালেও জুতো বদলাতে পারেনি। বরিসের দিকে বন্ধুক তাক করে আছে রুশ সেনারা, এনার মতো ভারতীয় ছেলে মেয়েগুলোও ভয়ে চিৎকার করছে। একটা রুশি ট্যাংক থেকে একজন বেড়িয়ে এদিকে আসছেন, কোন বড় অফিসার হবে হয়তো। বরিসের সামনে এসে সপাটে চড় কষালো গালে। সেনারা বন্ধুকের বাট দিয়ে মারতে লাগলো বরিসকে। অ্যানা দৌড়ে কাছে যেতে চাইলে, ওকে আটকে দিল। অ্যানা চিৎকার করেই চলেছে, বরিসকে ছেড়ে দিতে বলছে-- সেনারা সেদিকে দেখছেই না। হঠাৎ বরিস --সের্গে-ই -ই  বলে চিৎকার করল। ফিরে যেতে যেতে ওই ডাকে অফিসার থমকে গেলো, বরিসের সামনে এসে ওকে দেখতে লাগল । বরিস চেঁচিয়ে বলছে সের্গেই আমি তোমার ভাই আন্দ্রেই -এর ডাবলস পার্টনার বরিস। অ্যানার মনে পড়লো আন্দ্রেই টোপোলভের দাদা রাশিয়ান আর্মির একজন বড় অফিসার, ওদের আলেক্সানদ্রোভের বাড়িতে অ্যানার সাথেও পরিচয় হয়েছিল ওনার । উনি এখানে! সের্গেই জড়িয়ে ধরেছে বরিসকে। তা দেখে রুশি সেনারা থেমে গেল, সেনাদের সাথে কিছু আলোচনা করল সের্গেই। 


রক্তাক্ত বরিসকে ছেড়ে দিল রুশ সেনা। বাসে উঠে এলো বরিস। বাস ছেড়ে দিলে সের্গেইকে বিদায় জানাল ওরা। অ্যানা তাড়াতাড়ি একটা রুমাল দিয়ে বরিসের গায়ের রক্তগুলো মুছতে লাগলো, একটি ভারতীয় ছাত্রী একটা এন্টিসেপ্টিক লোশন দিল অ্যানাকে। বরিসের ক্ষতগুলোতে লোশন লাগিয়ে, মেয়েটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে লোশনটা ফেরত দিল।


বাস ধীরে ধীরে এগিয়ে চলতে লাগল। এতক্ষণে  একটু শান্তি হল  অ্যানার, সবদিক দেখল-- ভারতীয়দের মতো বসচিকও কেমন থম মেরে আছে।বরিসের কাঁধে মাথা রেখে বলল রুশিরা যদি আবার আটকায়?বরিসের ক্লান্ত স্বর বেরিয়ে এল--


মনে হয় না, আমরা তো মারিয়াপোল প্রায় পেরিয়েই গেলাম। এদিকটা এখনো আমাদেরই কব্জায়। রাস্তার ধারে সাইনবোর্ডে লেখা "আবার দেখা হবে, গুডবাই মারিয়াপোল" অ্যানা ঘাড় ঘুরিয়ে  ফেলে যাওয়া শহরটাকে দেখতে দেখতে বিড় বিড় করতে লাগলো--


বিদায় মা-বাবা,বিদায় মারিয়াপোল, বিদায়। আবার দেখা হবে?


(গল্পের ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক)

Comments