কবিতা - মোস্তফা তোফায়েল হোসেন


উপনিবেশের দূর্গ ভেঙে দেওয়া


প্রমিথিউজ সেই দিন অ্যাকিলিস গুণে, 
বায়ুতে ভাসিয়ে দেন একটি জাতিকে।
আগুন-চেতনা, তার বাক্যবাণে তিনি
তেজেদীপ্ত করে দেন বাঙালি জাতিকে।
আগুনের শিখা তার তর্জনী দুলিয়ে
 জাদুমন্ত্রে উজ্জীবিত করেন জাতিকে।
প্রদীপ্ত আলোকবানে সমস্ত বাতাস
 উথাল উত্তাল ছন্দে নেচে নেচে ওঠে;
খরতাপ তীব্র কোপে বিল ঝিল জলা
 টগবগে লকলকে ফুঁসে ফেঁপে ওঠে;
দ্রুততায় ছুটে ধায় ক্ষুদ্ধ রুদ্ধ বায়ু;
 সচঞ্চল আলোরেণু খোঁজে দীপ্ত প্রাণ; 
উৎসর্গে দীপ্যমান উদয়ের পথে।
মুক্তির সংগ্রামে, স্বাধীনতা সংগ্রামে, 
মাঠে নেমে আসে সব কৃষক জনতা--
ছদ্মবেশী ডাকাতের দাঁত ভেঙে দেবে। 
মুক্তির সংগ্রামে, স্বাধীনতা সংগ্রামে
কোমরে আঁচল বেঁধে দাঁড়ায় বোনেরা;
ভাঁওতাবাজ কুমিরের মুখোস খসাবে।
বাংলার পুলিশেরা, ইপিআর সেনা, 
ব্যারাক ফটক ভেঙে বের হয়ে আসে;
বাজায় পাগলাঘন্টি, যুদ্ধে যাবে তারা
নেকড়ের পালে দেবে লাঠ্যাঘাত তাড়া।
সাত কোটি বাঙালির সাত কোটি বুক,
সাত কোটি তিতুমির দুর্গপ্রাকার,
আপন হৃদয়ঘরে কেল্লা গড়ে তোলে:
বাঁশের কাশের ঘরে দুর্গ গড়ে তোলে;
শনের টিনের ঘরে দুর্গ গড়ে তোলে;
জমিদার-পরিত্যাক্ত ভাঙা বাড়িঘরে
 প্রতিজ্ঞাপ্রাচীর তুলে দুর্গ গড়ে তোলে।
ভ্রাতাভগ্নি পিতামাতা দাদাদাদীনানা 
উৎসর্গমন্ত্র পাঠ করে প্রতিদিন,
পাঠায় সন্তান সব মুক্তিবেদীমূলে;
দুর্গ গড়ে তোলে তারা বিশ্বাসের তোড়ে।
হিমালয় পাহাড়ের সমান সবল,
ওদের পায়ের তলে কাঁপে বিন্ধ্যাচল।
রংপুর ক্যান্টনমেন্টে চাকুরিতে-থাকা
ট্যাংকের ড্রাইভার, বাঙালি সেনারা 
খুলে দেয় বাতায়ন গোপনীয় খামে;
গোপন ওয়্যারলেসে নেতাদের সাথে
 সুকৌশল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। 
সেনাক্যান্ট ঘেরাওয়ের পরিকল্পনা, 
মাথায় মাথায় ঘোরে কবুতর ঠোঁটে--
এবার বাঙালি হাতে ক্যান্ট ধরা দেবে,
দুর্গ কেল্লা আধিপত্য পেয়ে যাবে তারা--
ওড়াবে সবুজ লাল পতাকা আকাশে।
দাসত্বের-প্রভুত্বের মরীচিকা ভেঙে, 
আসবে বাইরে তারা স্বাধীন বাতাসে।
সাঁওতাল ভীল গারো ওঁরাও জনতা
 তীর-ধনু হাতে নিয়ে মাঠে নেমে এলো।
সহসা সহস্র বাঘ ফোঁসে, গর্জে, রোষে;
মেলায় মলিন হস্ত মুক্তিরক্তে লাল 
নগরীর সব্যভব্য ছাত্রযুবা সাথে।
গ্রাম-গঞ্জে বটতলে সবুজ চত্বরে
 সমবেত হয়ে গর্জে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি।
মেহগনি শালবন সবুজ চত্বরে, 
সমবেত হয়ে গর্জে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি।
ওদের গর্জন ধ্বনি দোলায় বাতাস, 
মেঘেরা মেঘের সাথে সংঘর্ষে মাতে;
বিজলি চিকুর জাল ঝলকে আকাশে।
শ্যাম-কালো-তামাটেরা সম্মিলিত জোশে 
বিশাল বাঙালি জাতি বিনির্মাণ করে।
ঝড়ের তাণ্ডব রবে ছুটলো বাঙালি তারাগঞ্জ-গঙ্গাচরা-কেল্লাবন্দ থেকে;
ঝড়ের তাণ্ডব রবে ছুটলো বাঙালি হারাগাছ-কাউনিয়া-মাহিগঞ্জ থেকে;
ঝড়ের তাণ্ডব রবে ছুটলো বাঙালি পীরগাছা-পীরগঞ্জ-চৌধুরানি থেকে;
ঝড়ের তাণ্ডব রবে ছুটলো বাঙালি শ্যামপুর-শ্যামগঞ্জ-ভেন্ডাবাড়ি থেকে;
ঝড়ের তাণ্ডব রবে ছুটলো বাঙালি, তামফাট-পালিচরা-বনগাঁও থেকে।
ঝড়ের তাণ্ডব রবে ছুটলো বাঙালি
রানিপুকুর আর শটিবাড়ি থেকে ।
প্রণোদিত স্বতঃস্ফূর্ত মানুষ প্রস্তুত!
মানবিক শক্তিপুঞ্জ ছোটে তালে তালে,
মাথায় কঠিন জেদ শত্রু হননের।
রংপুর ক্যান্ট তারা করলো ঘেরাও- 
রংপুর ক্যান্ট ওরা করেছে ঘেরাও,
ঈষাণ বিষাণ কোণে গুরু গর্জে মেঘ!
ঈষাণ বিষাণ কোণে গুরু গর্জে মেঘ!
বাঙালি জনতা আর বিজাতীয় ফৌজ, 
এভাবেই সেদিনের মার্চের দুপুরে
মুখোমুখি হয়ে লড়ে উত্তরবঙ্গের
 রংপুর নগরভূমে ঘাঘটের তীরে।
‘আমরা দিয়েছি রক্ত-- আরো রক্ত দেবো,'
ভূমিপুত্র মানুষের মুক্তি এনে দেবো।’
'যখন দিয়েছি রক্ত-- আরো রক্ত দেবো,'
ভূমিপুত্র মানুষের ভূমি ফিরে নেবো।

Comments