গল্প - বনশ্রী রায় দাস

 

আমার দেবী দুর্গা দর্শন 


জলা জঙ্গল পেরিয়ে সাপখোপের ভয়,  রাবনলতা, মুথাঘাস দুপায়ে দলে কখনো কোথাও এক হাঁটু কোথাওএক কোমর জল পেরিয়ে জমির আলপথ ধরে তিন চার গাঁ পার করে ওরা আসে খুব গরীব তারা প্রান্তিক মানুষ । মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে আসে শুধু পেটের আগুন নেভানোর দায়ে । ভাদ্রের শুক্লাষষ্ঠীর ওই  দিনটি ঘরে ঘরে পালন করা হয় অরন্ধন। 


এই বিশেষ দিনটির জন্য  হাপিত্যেশ করে থাকতো তারা । গ্রামের পর  গ্রাম  ঢাক বাজাতে বাজাতে আসে।


অসময়ে ঢাকে কাঠি পড়লেই আমরা  বারান্দায় জড়ো হতাম ঢাকের বাজনা শুনতে । এক সঙ্গে তিন চার জন আসতো বা তারও বেশি । পুরুষ মানুষ পরনে আধময়লা কাপড় কোমরে গামছা আঁটা উদোম গায়ে । গলায় ঝোলানো ঢাক  মাথায় থাকতো পুঁটলি ঘাড়ে চাপিয়ে নিত বাচ্চাকে  । মহিলাটি হাড়কঙ্কালসার কাঁখে একটি ন্যাংটো শিশু পিছু পিছু আর ও একটি । হাতে ধরা থাকতো বালতি ,কাপড়ের পুঁটলি তিন চারটে । না চৌকাঠ পেরোতে পারতো না তারা ,মহিলাটি  খোলা বাইরে  বসে খুলে দিতে কাপড়ের পুঁটলি । ঢাক বাজানো শেষ হলে পাশাপাশি বাড়ি থেকে অরন্ধনের পান্তাভাত এনে ঢেলে দিত ওর মধ্যে যে যার মত । কেউ দয়াপরবশ হয়ে আগের  দিনের বাসি তরকারি জুটতো তাদের কপালে । নেওয়া হয়ে গেলে ঢাক বাজিয়ে বাজিয়ে চলে যায় অন্য একটি পাড়ায় । বেশ কয়েকটি গ্রাম জুড়ে পান্তাভাত সংগ্রহ করে তারা।


আমার মা ও বাইরে এসে দেখলেন কাপড়ের ওপর ঢেলে দেওয়া পান্তা ভাতের চূড়ো । 


ওদের স্বামী স্ত্রী  কে মা বললেন, 


হ্যাঁরে তোরা যে এতো পান্তা ভাত সংগ্রহ করেছিস একি একমাস ধরে খেতে পারবি ? এতো নষ্ট হয়ে যাবে।


 পুরুষ মহিলা উভয়েই বিষণ্ণ করুণ চোখে  বললে কি করবো মা জননী বাচ্চাদের খিদের জ্বালা মেটাতে এই পান্তা ধুয়ে ধুয়ে রেখে ওদের পেটের আগুন শীতল করি এই যতদিন যায় আর কি ; ওদের খাওয়াই মা জননী  !


তখন মা ---  এইভাবে কি হয় রে ? অন্যের খেতখামারে খাটাখাটনি কর তবে তো দু পয়সা হাতে আসবে ! আর হ্যাঁ ছেলে মেয়েকে লেখাপড়া শেখাবি নিজেরা যেমন এই রহস্যে মোড়া  দুনিয়াটাকে কেবল চেয়ে চেয়ে দেখে যাচ্ছিস দূর থেকে,  অন্ধ হয়ে আছিস, ওদের অমন অন্ধকার পথে ঠেলে দিস না । শুধু সন্তান জন্ম দিলেই তো হয় না ওদের পালন পোষণ করে বেঁচে থাকার আলোমুখ দেখাতে হবে ওরা বড় হয়ে যাতে মানুষের মতো মানুষ হয় নিজের পায় দাঁড়াতে পারে। পেটের জ্বালায় যেন ভিক্ষে করতে না হয় দোরে দোরে  -- - --


আমার ঠাম্মা তখন ঘরের ভিতর থেকে ওদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন " কাকে দিলে রাজার পাট। মাকে বললেন ঘরে এসো ছোটো বৌমা মেলা কাজ পড়ে আছে কেন ওদের সঙ্গে বকবক করছো ওরা তোমার কথা শুনবে ? এদের সৎ উপদেশ দেওয়া আর ভস্মে ঘি ঢালা সমান "। মা হাল ছাড়বেন কেন  ; বললেন এই যাচ্ছি মা ।


নারী পুরুষ উভয়েই তখন কাঁদ কাঁদ হয়ে বলল কি করে ওদের লেখাপড়া শেখাব মা আমরা লিখতে পড়তে জানি না । টাকা খরচ করে পড়ানোর ক্ষমতা আমাদের নেই  দুবেলা দুমুঠো গরম ভাতের জোগাড় করতে পারি না  


তা তো আপনি জানেন মা জননী  । 


মা বললেন  --- আমাদের গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওদের ভর্তি করে দিবি আমি আমার ছেলেকে বলে সব ব্যবস্থা করে দেব খন। 


এখন পুঁটলি খোল দেখি ; বলতেই স্ত্রী লোকটি তার শীর্ণ হাত দুটি দিয়ে মেলে ধরল পুঁটলি আমার মা তাতে অনেকটা চাল আলু ডাল দিয়ে বললেন এইবার থেকে সমস্ত গ্রামের ঘরগুলি থেকে চাল ডাল নিবি । ছেলে মেয়েকে পচা পান্তা না খাইয়ে তা খাইয়ে চাল-ডাল ফুটিয়ে খাওয়াতে পারবি । তাতে অনেকদিন চলেও যাবে ।


ওদের চোখ ছলছল করে ওঠে বলে ঠিক আছে মা জননী তাই হবে চাল দিতে বলবো । হাত জড়ো করে বলল আপনি আমাদের কি যে উপকার করলেন মা আমাদের বেঁচে থাকবার সঠিক পথ দেখালেন এ ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারবনি মা জননী !


সঙ্গে সঙ্গে ওরা মাকে হতজুড়ে নমস্কার করলো


চোখে মুখে খুশির ঝিলিক    - - --


অবাক হয়ে আমি ভাবলাম অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে গেলে যে শুধু অর্থের প্রয়োজন হয় তা কিন্তু নয় চাই আমার মায়ের হৃদয় ও মনের  মতো একটি বিগলিত হিরণ্ময়  হৃদয় উন্নয়নশীল মন , চাই বিবেক ও মনুষ্যত্ব ।


ওরা জোরে জোরে ঢাক বাজালো, আমার মা উঠনে দাঁড়িয়ে চির অবহেলিত মানুষগুলোর  মুখের হাসি দেখছিলেন । আমি দেখলাম   মায়ের মুখে চোখে অনাস্বাদিত তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠতে  । ওরা মাকে দূর থেকে প্রণাম করে চম্পা নদীর স্রোতের মতো খুশির ঝিলিক নিয়ে ঢাক বাজাতে বাজাতে অন্য গাঁয়ের দিকে রওনা  দিল -- - -


ভাদ্রের নতুন  শিশিরের সুগন্ধ , আকাশে পেঁজা তুলোর মেঘে কাশের দোলুনি,  শিউলি মাখা হাওয়া , পুজোর বেশ কয়েকটি দিন বাকি থাকলেও  আমার দেবী দুর্গা দর্শনের সৌভাগ্য হলো। পরনে আটপৌরে শাড়ি ভোরের আলোর মতো পানরাঙা ঠোঁটে কপালে চাঁদ মতো লাল টিপ ,সিঁদুরে সিঁথি ভরাট করে আলতা পায়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে আমার মা !!!

Comments