রঙ্গিলা দালানের মাটি - সুবীর সরকার

সমস্ত বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল জুড়ে নিয়মিত চলছে কবিতাচর্চা। কবিতা নিয়ে প্রবল স্বপ্ন দেখা। বাংলা কবিতা লেখা হচ্ছে প্রান্তে প্রান্তে। অন্তর্জাল এবং মুদ্রিত পত্রিকার মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে পাঠকের কাছে। সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যেও কিছু ভালো আর সৎ কবিতার মুখোমুখি দাড়াতে পারছি আমরা। কত প্রানবন্ত নুতন কলম নুতন কবিতা লিখছেন। পাঠক হিসেবে আমি সমৃদ্ধ হচ্ছি। আমাদের এই উত্তর জনপদ জুড়েও অনেক তরুণতম কবি খুব নিবিড়তা নিয়ে লিখে চলেছেন বাংলা কবিতা। 

তেমনই কিছু কবিকে নিয়েই এই লেখা লিখছেন 

কবি সুবীর সরকার আজ সপ্তম কিস্তি। 


সুব্রত দেবনাথ। কুচবিহারের তুফানগঞ্জের কামাত ফুলবাড়ী গ্রামে তার যাপন ও বসবাস। সে একজন সমাজকর্মী।বেছে নিয়েছে নিজস্ব পেশা। দুই বছর ধরে ডাহুক কাব্য সমাজ নামে একটি ওয়েব ম্যাগ সম্পাদনা করে আসছে। স্বপ্নপ্রবন এই তরুণ কবিতায় নিমজ্জিত। কবিতা নিয়ে তার নিরন্তর নিরীক্ষা আমাকে চমৎকৃত করেছে।

সুব্রতর কবিতা পাঠ করতে গিয়ে আমি লক্ষ্য করি এক নিবিড়তা। কোন কঠিন শব্দ সে আরোপ করে না।খুব সহজ শব্দ তার কবিতার নির্মাণের ইট কাঠ। সুব্রত তার ব্যাক্তিগত যাপন, তার দেখা, তার আবেগ, তার স্বপ্নের এক মস্ত ভুবন রচিত করতে থাকে। কোন ভান কিংবা ভনিতা তার কবিতার জার্নি কে কৃত্রিম করতে পারে না। নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে নিজস্ব আলপথ ধরে সুব্রত হেঁটে যাচ্ছে বিস্তারিত এক কবিতা ক্যাম্পের দিকে।




আসুন আমরা সুব্রত দেবনাথের কয়েকটি কবিতা পাঠ করি_


গন্তব্য


ব্যস্ত জীবন,
আঙুল বাঁকা করে ঘী তুলতে হয়
রেল গেটের সাইরেন পড়েছে
ফেরি পারাপারের চিন্তা নেই
শুধু ছোটা ছুটি
উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যে
নিজের ছায়া চোখে পড়ে না
                                        আয়নায়।
অগোছালো কথাবার্তা
মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে ভুলে গেছে
চিন্তা শুধু ফলের, কর্মের বালাই নেই
চিলের স্পর্ধা বেড়ে গেছে আজ কাল
অনায়াসে সবার কান নিয়ে যেতে পারে,
বোবা মুঠোফোন এখন বিশ্বাসযোগ্য প্রিয় বন্ধু ।




অভিসন্ধি


ছাদের উপর আলো রং বদলায়
ফ্রিজে বাসি কথা রেখে
বাষ্পে স্নান করি

গ্রিন সিগন্যালে
জেব্রা ক্রসিং ধরে হাঁটি
পোড়া দেহের গন্ধে
মনে পরে আত্মগোপন করা
অভিসন্ধি
রক্ত মাংসের শরীর
লুকোতে পারে না মৃত্যুভয়,
তবু গোগ্রাসে খেয়ে নেই পাপ

অনায়াসে রাস্তায় হাঁটি
মেকী ভদ্রতা নিয়ে ।




সাদা কালো ক্যানভাসে


ভিড়ে ঠাসা কোলাহলে
হঠাৎ চোখে পরে তোমার লাল টিপ,
বরফ গলতে শুরু করে
মানসের চূড়া থেকে
বর্হিবিশ্ব কত সুন্দর সেদিন উপলব্ধি করি,
শীতলতার পারদ থার্মোমিটার ভেঙে
বেড়িয়ে আসতে চায়
ফুরফুরে মেজাজ মুচকি হাসি
এসব, এখন আর আমার আওতায় নেই।
যে গানে সুরের অভাব ছিল
বাজছে তা গুনগুনিয়ে
দেহ মনের অন্তঃকলহ
ক্রমশ শান্ত হয়ে আসে
মনের আসকারায় রঙিন তুলি দিয়ে
আঁকছি তোমায় সাদা কালো ক্যানভাসে ।




ডাক


অস্বীকার করতে পারিনি
                 বেলা শেষের ডাক,
অভ্যস্ত জীবন শৈলীতে মজেছিলাম
           বর্ণচ্ছটা জনমোহিত আসরে
স্টেজের পেছনে নিঃশব্দে দাড়িয়ে ছিল
                আত্মহরণকারীর দল
ঘুরে তাকাইনি একবারও,
         বিন্দু বিন্দু ঘামে ভরে যাচ্ছে
           এক একটি জলের বোতল।

আমি কথা দিয়েছি
     কথা রাখার সময় টুকু চাই মাত্র,
আলোগুলো তখনও জ্বলছিল
চোখের সামনে
সুর ধরলাম জীবনের শেষ গানের
বিদায় জানালাম মায়ানগরীকে।

তারা ডাকছে ...
বুঝলাম এ ডাক সে ডাক নয়
এ ডাক পরাকাষ্ঠার ডাক।




কোরাস


আমি হারিয়ে যাই
মুঠো ফোনে স্ক্রল করতে করতে
ভুলে যাই দিন তারিখ
অযথা কাজে ব্যস্ত থাকি
সময়কে দেখাই লাল চোখ,
জীবনকে উপেক্ষা করে
ডেকে আনি স্বেচ্ছামৃত্যু

তবু বেশ আছি
আঠাশ দিনের প্যাকেজে
জ্ঞান কে অজ্ঞানে ঢেকে
সমবেত কোরাসে ডুব দিয়েছি
আধুনিক মায়াজালে ।




ক্লোরোফিল


জৈষ্ঠের অসহ্য দুপুর।
গ্রামের মেঠো পথ এখন কংক্রিটে বাঁধা
পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চম্পাবতী
নির্জন বাঁশঝাড়ে
চেনা সুরে গান ধরেছে
অচিন বাঁশিয়াল -
   "আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি
              মন বান্ধিবি কেমনে..... "

মরুঝড় এখানে হয় না,
তাই আজও পল্লী সুরে শান্তি খুঁজে পাই
বাঁশের মাচায় বসে
ক্লোরোফিলের ছায়ায়।



ঘুনসি


রায়ডাকের পাশে কাশবন
নির্ধারণ করে শরৎ বসন্তের মাপকাঠি,
রোজনামচার জীবন শৈলী
নতুন পাতা থেকে রংচটকা দেওয়াল হয়,
সংসার আর সন্ন্যাসের
পার্থক্য বুঝিনি
সপ্তজন্মের বহু আকাঙ্খিত জীবণ
শুধু চলে সময়ের ঘুনসি গলায় নিয়ে
নৈরাশ্য মৃত্যুর পথে ।


যে ভূগোল যে ইতিহাসের ভেতর সুব্রতর যাপন সেই ভূগোলের মায়া খুব জড়িয়ে থাকে সুব্রতর কবিতাকে। সে আমাদের দেখায় রায়ডাকের পাশে কাশবন,সংসার আর সন্ন্যাসের পার্থক্য, বাঁশের মাচা,ক্লোরোফিলের ছায়া,আর সমবেত কোরাসে আটাশ দিনের প্যাকেজ। সত্যিই তো সময়ের ঘুনসি গলায় আমরা পেরিয়ে যাচ্ছি আমাদের জীবন। আর প্রেম,দ্রোহ,লাল টিপ সাজিয়ে সুব্রত তার কবিতাকে খুব আড়ালের কোন বাঁশবাগানের গহনে নিয়ে যাচ্ছেন। যদি সৎ থাকে, যদি পরিশ্রম করে, যদি নিরন্তর পাঠ ,সংশোধন ও কাটাকুটির মধ্য দিয়ে নিজেকে নিয়ে পারে তাহলে আগামীতে সুব্রত দেবনাথ অনেক লিখবে।

এই তরুণের প্রতি শুভেচ্ছা রইলো। শুভ কামনা রইলো।

Comments

  1. সুব্রত ভট্টাচার্যJuly 26, 2022 at 9:30 AM

    প্ৰতি মাসে এই বিভাগটি বেশ ভালো লাগছে l এমাসের কবিতাগুলো পড়া হলো, শব্দের ব্যবহার সুন্দর l ভালো লাগলো l

    ReplyDelete

Post a Comment