ভার
এক
শমীক বুঝে ওঠার আগে ঘটনাটা ঘটে গেল। এক লহমায়, ওর চোখের সামনে। চারমাথার মোড়ের ট্রাফিক লাইটে তখন লালবাতি জ্বলছে। বিএমডব্লিউ গাড়ির ড্রাইভারের সিটে বসা ছিল ও। ব্রেকটা পায়ে চেপে রেখে শমীক জানালার কাঁচ নামিয়ে সিগারেট ধরিয়েছিল। দু মিনিটের স্টপ। সিগারেটটা শেষ হয়ে যাবে। বাতি সবুজ হলে সোজা গিয়ে বাইপাস ধরবে। যাদবপুরের দিক থেকে গাড়ী বাস স্কুটার গড়িয়াহাটের দিকে ছুটে যাচ্ছিল। লালবাতির দিকে তাকিয়েছিল শমীক। ট্রাফিক লাইট সবুজ হওয়ার আগে আগে লালবাতিটা দুবার দপদপ করে, তারপর সবুজ হয়। দুবার দপ দপ করার সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাকসিলেটার আলতো চাপ দিতেই জ্যামুক্ত তীরের মত এগিয়ে গিয়েছিল জার্মান যান্ত্রিক দৈত্যটি। ট্রাফিক নিয়ম মেনেই শমীক এগিয়ে গিয়েছিল। গড়িয়াহাটগামী যানবাহনের জন্য তখন নিশ্চয়ই লালবাতি জ্বলছে। কোন গাড়ি আসার কথা নয়। কিন্তু তীব্রবেগে ছুটে এল একটা মোটরবাইক। শমীক যখন ব্যাপারটা বুঝল তখন আর সময় নেই। শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ও ব্রেক টিপল, কিন্তু যা হবার ততক্ষণে হয়ে গেছে। প্রচণ্ড জোরে একটা ধাতব শব্দ হল, ঝাঁকুনি খেয়ে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়িয়ে গেল শমীকের গাড়ি। অপেক্ষারত গাড়ি, মোটরবাইকের আরোহীরা এক ন্যানো সেকেন্ডের জন্য নির্বাক। তারপরই শুরু হল চিৎকার কোলাহল।
ঝাঁকুনিতে এয়ারব্যাগ খুলে গেছে। এয়ারব্যাগ আর সিটের মধ্যে স্যান্ডউইচ হয়ে শমীক কয়েক সেকেন্ডের জন্য হতভম্ভ হয়ে রইল। সংবিৎ ফিরতেই সিট পিছিয়ে সিটবেল্ট থেকে নিজেকে মুক্ত করে গাড়ির বাইরে বেরল শমীক। ততক্ষণে গাড়ির চারপাশে ভিড় জমে গেছে। শমীককে দেখে সরে গেল কয়েকজন। রাস্তার ওপর উল্টে পড়ে আছে মোটরবাইক। পিছনের ক্যারিয়ার খুলে রাস্তায় ছিটকে পড়েছে খাবারের প্যাকেট। চাউমিন, চিলি চিকেন, বিরিয়ানি। গাড়ির নিচে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটি কম বয়সী ছেলে। হেলমেট মাথায়।
পুলিশ সমবেত জনতাকে সরিয়ে দিল দূরে। রোড রেল দিয়ে আটকে দিল জায়গাটা। পুলিশের একজন এএসআই শমীককে ডেকে থানায় নিয়ে গেল।
এখানে থাকাটা ঠিক হবে না, আপনি থানায় চলুন, এএসআই গম্ভীর মুখে বলল। শমীকের মাথা ঠিকঠাক কাজ করছে না। ছেলেটা কি মরে গেছে? ও জিজ্ঞেস করল। কিন্তু পুলিশ অফিসার ইশারায় ওকে চুপ থাকতে বলল। থানার ভেতরে ওকে ওসির ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। খালি ঘর, এসি চলছে।
বসুন, চেয়ার এগিয়ে দিয়ে পুলিশটি চলে গেল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মাঝবয়সী একজন পুলিশ পেছন পেছন ঢুকলেন।
লাইসেন্স সঙ্গে আছে?
শমীক মানিব্যাগ থেকে বের করে দিল লাইসেন্স। শমীক দেখল সাদা উর্দির পকেটের ওপর নাম লেখা আছে। বিনয় মুখোপাধ্যায় এস আই।
শমীক রায়? এস আই চোখ তুলে জিজ্ঞেস করল।
সাউথ সিটিতে থাকেন?
শমীক মাথা নাড়ল।
কোথায় যাচ্ছিলেন?
এয়ারপোর্ট।
খুব তাড়াহুড়ো ছিল?
খুব না, একটু ছিল। আসলে প্লেন আসার সময় হয়ে গিয়েছিল। বাইপাসে আজকাল বড্ড জ্যাম হয় বলে টেনশন করছিলাম।
কাউকে রিসিভ করতে যাচ্ছিলেন?
হ্যাঁ, মা আসার কথা। ব্যাঙ্গালোর থেকে।
আচ্ছা। উনি একা আসতে পারবেন? আপনি তো এখন যেতে পারবেন না, এস আই মুখোপাধ্যায় বললেন।
পারবে, মা উবার করে নিতে পারবে।
ঠিক আছে তাহলে; নাহলে আমি পুলিশের গাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারি।
না,না তার দরকার হবে না। বলা আছে মাকে, আমাকে না দেখলেই মা উবার বা ওলা বুক করে নেবে।
এস আই মোটা বাঁধানো একটি খাতা বের করলেন। কিছু লিখতে লিখতে মুখ তুললেন।
আপনার সঙ্গে আর কি কি আছে এই টেবিলের ওপরে রাখুন।
শমীক মোবাইল ফোন, গাড়ি আর ফ্ল্যাটের চাবি, সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার, মানিব্যাগ আর রুমাল টেবিলের ওপর রাখল।
আমি কি একটা ফোন করতে পারি? শমীক জিজ্ঞেস করল।
করুন, করে মোবাইলটা অফ করে দিন।
শমীক দুটো ফোন করল, আর টেক্সট করল দুজনকে।
ছেলেটা কি মরে গেছে? শমীক জিজ্ঞাসা করল।
বলতে পারব না। তবে সিরিয়াস ইনজুরি তো হয়েছে। অ্যামবুলেন্সে খবর দেওয়া হয়েছে। এল বলে।
বলতে বলতে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শুনতে পেল শমীক। বাইরে প্রচণ্ড চিৎকার হচ্ছে। তাহলে কি ছেলেটা মারা গেছে?
দুই
কিছুক্ষণ বাদে অর্ক আর সায়ন্তন এসে হাজির। অর্ক উকিল, হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করে। সায়ন্তন টিভি এখনের মুখ্যসাংবাদিক। শমীক চুপ করে বসেছিল। এস আই মুখোপাধ্যায় উঠে গেছেন, এক কাপ চা পাঠিয়েছেন ওর জন্য। কিন্তু এরপর কি করনীয় বা ও যেতে পারে কিনা কিছু বলে যাননি। শমীককে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে অর্ক ওর কাঁধে চাপড় দিল।
চিন্তা করিস না। সব বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। ইন অ্যান আওয়ার ইউ উইল গো হোম।
ছেলেটা কি মারা গেছে? শমীক জিজ্ঞেস করল।
মাল্টিপল ফ্র্যাকচার আর চেস্ট ইনজুরি শুনেছি। পিজি হাসপাতালের আইসিইউ তে নিয়ে গেছে। ডাঃ সান্যালের সঙ্গে কথা বললাম। উনি বললেন, এমারজেন্সি সার্জারি হবে। লাংসে কনটিউশন হয়েছে। রক্ত জমে আছে বুকে। তিনটে হাড় ভেঙ্গেছে। হেলমেট থাকাতে মেজর হেড ইনজুরি হয়নি। তবে কঙ্কাশনের জেরে পুরো সেন্সে নেই।
বাঁচবে তো? শমীক জিজ্ঞাসা করল।
সে তো ডাক্তাররা বলবে। তুই কেন ভাবছিস?
না, একদম বাচ্চা ছেলে। আর নিশ্চয় নিডী। নাহলে আর সুইগিতে কাজ করে?
তোর একটা গিলটি কনশাসনেস কাজ করছে, আমি বুঝতে পারছি, অর্ক বলল। আমি সব খবর নিয়ে নিয়েছি। ইউ ডিনট কমিট এনি মিস্টেক। পুলিস আইপিসি ২৭৯ আর ৩০৪এ ধারায় তোর নামে কেস দিয়েছে। যদিও ওরা জানে এ কেস টিকবে না। সিসিটিভি ফুটেজ দেখলেই বোঝা যাবে তুই সবুজ হওয়ার পরই বেরিয়েছিস।
শমীক বন্ধুর দিকে তাকাল। সায়ন্তন সিগারেট বের করল, নে একটু বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দে। জাম হয়ে গেছে তোর মাথা।
এখানে সিগারেট খাওয়া যাবে?
কুল, ম্যান! এই ওসি মুখুজ্জেকে আমি চিনি। তুই চাপ নিস না, সায়ন্তন বলল।
সিগারেট ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিতে মাথাটা একটু ঝিমঝিম করে উঠল শমীকের।
তোরা না এলে আমাকে কি জেলে নিয়ে যেত?
তা যেত। তবে জেলে না, হাজতে। সারারাত মশার কামড় খেতি আর পেচ্ছাপের গন্ধে বমি আসত। হাজত দেখেছিস? এই থানাতেই আছে। পেছনের দিকটায়। ওদের ওপর ছেড়ে দিলে পুলিশ কাল সকালে কোর্টে নিয়ে রিমান্ড চাইত দু সপ্তাহের জন্য।
তার মানে আমাকে দু সপ্তাহ জেলে থাকতে হত?
না, এটা অন্যলোকের কথা বলছি। এনি এক্স, ওয়াই বা জেড হলে যা বললাম তাই হত। কিন্তু তুই তো তা নস।
কিন্তু তুই তো বলছিস আমি ভুল করিনি, তাহলে কেন?
বাইরে বেরলে বুঝতে পারতিস। পাবলিক ক্ষেপে আছে। ওদের ধারনা তুই রেড লাইটে গাড়ি চালিয়ে ছেলেটাকে কুচলে দিয়েছিস। কারণ তুই শুধু গাড়ি না, বিএমডব্লিউ চালাচ্ছিলি। ইফ ইউ আর ড্রাইভিং আ কার ইউ আর অলরেডি আ ভিলেন, ইউ নো? পুলিস উত্তেজিত জনতাকে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল। তারপর ওসি গিয়ে শান্ত করল এইবলে যে তোর নামে জবরদস্ত কেস দেওয়া হচ্ছে।
সায়ন্তন ফোনে কারুর সঙ্গে কথা বলছিল। শমীককে ফোন ধরিয়ে বলল, কাকিমার সঙ্গে কথা বল।
মা? তোকে ফোন করেছে?
তুই আগে কথা বল। বল চিন্তা না করতে। আমরা আছি। ঘণ্টাখানেক বাদে নিয়ে যাচ্ছি বাড়িতে।
আচ্ছা।
শমীক ফোন কানে ধরল। মায়ের ভীত সন্ত্রস্ত গলা।
টুবু, তোর কিছু হয়নি তো?
না মা।
সায়ন্তন আমাকে ফোনে জানিয়েছে। তোর ফোন বন্ধ দেখে আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।
তুমি ফোন করেছিলে আমাকে?
হ্যাঁ।
আচ্ছা শোন পুলিশ যদি তোমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে তাহলে বলবে আড়াইটেতে তোমার ফ্লাইট পৌঁছানর কথা ছিল ব্যাঙ্গালোর থেকে। আমার তোমাকে আনতে যাওয়ার কথা ছিল। আমি যাইনি দেখে তুমি উবার করে নিজেই চলে এসেছো।
মিথ্যে কথা বলতে হবে কেন? মা উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
পরে এসে বলছি, শমীক ফোন কেটে দিল।
সায়ন্তন চোখ পিটপিট করে তাকাল।
ব্যাপারটা কি? কোথায় যাচ্ছিলি তুই?
আইটিসি রয়্যালে। অ্যাপয়েনটম্যানট ছিল।
কার সাথে?
সব জানতে হবে?
অফিসিয়াল ভার্সনটা তো শুনে নিয়েছি। এবার আসলটা বল।
পরে বলব।
তিন
ছ’মাস হয়ে গেছে। কেস অনেকদিন চলেছে। শমীককে কয়েকবার কোর্টে যেতে হয়েছে। তবে কোনবারই শমীক ছেলেটিকে দেখতে পায়নি। একবার একজন বিধবা মহিলাকে দেখেছিল, সঙ্গে রোগা মত সালওয়ার কামিজ পরা একটি কম বয়েসি মেয়ে। অর্ক সঙ্গে গেছে, সব ঝামেলা ওই সামলেছে। ভিডিও ফুটেজে দেখা গিয়েছে যে সময় মোটরবাইকটি চারমাথার মোড় পেরচ্ছিল তখন ওইদিকে সবুজ বদলে ভগ্নাংশ মুহূর্তের জন্য বাতিটি কমলা হয়েছিল। এবং শমীকের ক্ষেত্রে লালবাতি দুবার দপদপ করে মাত্র সবুজ হওয়া শুরু হয়েছিল। টেকনিক্যালি ন্যানোসেকেন্ডের জন্য শমীক আগে বেরিয়েছিল। সুতরাং দুজনের কেউ ই ট্রাফিক নিয়ম মানেনি। তবে স্বস্তির ব্যাপার হল ছেলেটি মারা যায়নি। দুমাস হাসপাতালে থেকে বাড়ি চলে গেছে। সব বিবেচনা করে জজ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করে শমীককে সাবধানে গাড়ি চালাতে উপদেশ দিয়েছেন। যেদিন রায় বেরল সেদিন শমীক অর্ক আর সায়ন্তনকে নিয়ে স্যাটারডে ক্লাবে ছোট খাট একটা পার্টি দিল। আঠারো বছরের গ্লেনফিডিচ সঙ্গে বিফ স্টেক আর মুসাকা। তবে সেদিন শমীক গাড়ি চালায়নি। অর্কর ড্রাইভার ওকে ছেড়ে গেছে।
সেদিন রাতে শমীক স্বপ্ন দেখল ও মোটরবাইকে করে ছুটে যাচ্ছে। পরনে সুইগির কমলারঙের টি-শার্ট, পেছনে সুইগির মস্ত ক্যারিয়ার। কাস্টমার বারবার ফোন করে ডাকছে। আর কত সময় লাগবে? এত দেরি হচ্ছে কেন?
রাস্তায় ভিড় স্যার, শনিবারের বাজার তো বুঝতেই পারছেন, শমীক বলার চেষ্টা করল।
আমি ওসব শুনতে চাইনা। আর দশ মিনিটের মধ্যে না এলে আমি অর্ডার ক্যান্সেল করে দেব, লোকটি রেগে বলল।
স্যার পাঁচটা মিনিট বেশি দিন। পনের মিনিটে আপনার দরজায় পৌঁছে যাব, শমীক কাতরগলায় অনুরোধ করল।
যাদবপুর থানার চারমাথার মোড়ে আসতেই দেখল সবুজ আলোটা নিভবে নিভবে করছে। কব্জি ঘুরিয়ে বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিল শমীক। প্রায় পেরিয়েই গেছিল, এরমধ্যে আলোটা কমলা হতে শুরু করেছে কিন্তু আসুরিক গতিতে ছুটে এল এক বিশাল কালো রঙের গাড়ি। শমীক চোখ বন্ধ করে ফেলল।
ঘুম ভেঙে যেতেই উঠে বসল শমীক। এসি চলছে, তবুও ঘেমে উঠেছে ও। উঠে বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দিল। বসার ঘরে গিয়ে সিগারেট ধরাল। কফি বানাল। পরপর সিগারেট খেল তিন চারটে। তারপর কখন সোফায় শুয়ে পড়েছে ওর খেয়াল নেই। সকালে মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙল।
একি রে? তুই এখানে ঘুমোচ্ছিস, আর তোর বেডরুমে এসি চলছে!
না মা, একটা বিদঘুটে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। তারপর আর ঘুম আসছিল না।
চা খাবি তো? বসাচ্ছি।
চা খেয়ে শমীক থানায় গেল। যাদবপুর থানা বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে দশ মিনিট। ওসি মুখোপাধ্যায় থানায় ছিলেন। শমীককে দেখে আশ্চর্য হলেন।
কি ব্যাপার? আপনি এখানে?
ওই ছেলেটার ঠিকানা পাওয়া যাবে?
কেন বলুন তো?
না, একটা কাজ ছিল।
মুখোপাধ্যায় মুচকি হেসে বিশাল বাঁধানো খাতাটা বের করে ঠিকানা আর ফোন নম্বর বললেন।
এটা কোন দিকে বলতে পারবেন?
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা। ক্যানিং লাইনে। কেন জিজ্ঞেস করছেন?
আমি যেতে চাই। কি ভাবে গেলে সুবিধা হবে?
লোকাল ট্রেনে সবচাইতে সুবিধা হবে। কিন্তু আপনি কি ট্রেনে যেতে পারবেন?
পারব।
তাহলে চলে যান। যাদবপুর ইউনিভারসিটির তিন নম্বর গেট পেরিয়ে বাঁ দিকে গেলেই রেল স্টেশন। কোনদিন ওঠেন নি মনে হচ্ছে ট্রেনে?
শমীক লজ্জিত মুখে মাথা নাড়ল।
অল দ্য বেস্ট! মুখোপাধ্যায় স্মিতহেসে থাম্বস আপ দেখালেন।
দেড় ঘণ্টা পর ট্রেন ও সাইকেল ঠেলা করে যখন নোনাগ্রামে রতন হালদারের বাড়ি পৌঁছল তখন দুপুর হয়ে গেছে। একজন বিধবা মহিলা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। দৈন্যদশা বাড়িটির। টিনের চালে জং ধরেছে, বিবর্ণ দেয়াল থেকে সুরকি খসে পড়েছে এখানে সেখানে। বছর দুয়েকের একটি ছোট বাচ্চা ছেলে খালি গায়ে বেরিয়ে এল তারপর অচেনা লোক দেখে বিধবা মহিলার শাড়ির আঁচলের পিছনে লু্কোল।
কাকে চাই? বিধবা মহিলা ঘোমটা তুলে জিজ্ঞেস করলেন।
রতন হালদার আছে?
আপনি কে?
আমি শমীক রায়। ছ’মাস আগে আমার গাড়ির সাথে অ্যাকসিডেনট হয়েছিল রতনের।
ওঃ, আচ্ছা। আমি রতনের মা। আসুন আসুন, ভেতরে আসুন। রতন তো হাঁটতে চলতে পারে না আর। কোমরের নিচ থেকে অসার হয়ে গেছে অ্যাকসিডেনটের পর থেকে।
মাথা নিচু করে শমীক ভেতরে ঢুকল। প্রায় অন্ধকার ঘর। মলিন বিছানায় শুয়ে আছে শীর্ণ চেহারার একটি পুরুষ। গামছা দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে একটি রোগা মত মেয়ে। খালি থালা গ্লাস পাশে রাখা। বোঝা যাচ্ছে রতনকে খাইয়ে দিতে হয়। শমীক চিনতে পারল একেই একবার দেখেছিল কোর্টে। রতনের মা ঘরে ঢুকে বললেন, রতন, এই ভদ্রলোকের গাড়ির সঙ্গেই তোর অ্যাকসিডেনট হয়েছিল। তোর সাথে দেখা করতে এসেছেন।
শোনার সঙ্গে সঙ্গে রোগা মেয়েটি আহত সাপিনীর মত হিসহিস করে উঠল, কি করতে এসেছেন এখানে? মজা দেখতে?
শমীক মানসিক ভাবে তৈরি হয়ে এসেছিল। দুহাত জোড় করে বলল, এরকম করে বলবেন না প্লিজ। আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। প্রতি মাসে আমি কিছু টাকা পাঠাব। এখন এটা রাখুন। বলে কুড়ি হাজার টাকার একটা বান্ডিল তুলে দিল রতনের বউয়ের হাতে। টাকাটা হাতে পেয়ে চুপ করে গেল মেয়েটি, যেমনভাবে সাপুড়ের মুষ্টিবদ্ধ হাতের স্পর্শে সাপ ফণা গুটিয়ে ঝুড়িতে ফেরত যায়। রতনের মা চা খাওয়ার জন্য অনেক জোরাজুরি করেছিল, কিন্তু শমীক আর দাঁড়ায়নি। জোরকদমে পা চালিয়ে রাস্তায় চলে এসেছিল।
ভরদুপুর, তাই সাইকেল ঠেলা কম। কদম গাছটার নিচে একটা গুমটি মত দোকান আছে। শমীক এগিয়ে গেল। একজন বুড়ো ঘোলাটে চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
চা হবে?
আজ্ঞে, হবে।
চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে শমীক সিগারেট ধরাল। এখন মাথাটা একটু হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে মাথা থেকে কিছু একটা প্রচণ্ড ভারী কিছু নেমে গেল।
টানটান প্লট, অযথা দীর্ঘায়িত নয়, লেখার শৈলী পাকা হাতের।
ReplyDeleteসুলিখিত । ভালো লাগলো ।
ReplyDeleteVery well written! Khub bhalo laglo
ReplyDelete