গল্প - তুষারকান্তি রায়

 

আড়াল

 

সবে বৈশাখের শুরু। আজও  দিনের প্রথম থেকেই সূর্য প্রখর । বেলা বড় জোর চারটে হবে। বাতাসে যেন আগুন মিশে আছে । ঘরের বাইরের মাঠ–ঘাট–পথ - কোথাও কোনো জন প্রাণী নেই । গাছের ছায়ায় পর্যন্ত বিশ্রাম করছে না কেউ। গাঁয়ের মানুষ তার প্রিয় গোরু-বাছুর কিংবা ছাগলটিকে পর্যন্ত মাঠে চরতে ছেড়ে রাখেনি । এমন একটা সময়ে বাঘা রোদ ঠেলে নতুনপল্লির কাঁচা রাস্তা ধরে চলেছে কানাইয়ের ভ্যান রিকশা । ঠিক তার পেছন পেছন সাইকেলে চেপে চলেছে পঞ্চানন ঘোষাল । কিন্তু চড়কের মাঠ পেরোতে না পেরোতেই আকাশ কালো করে এলো । বহুদিন পর  আকাশের এমন  মুখ ভার দেখে খুশি হলো পঞ্চানন ।  উপরের দিকে তাকিয়ে খানিক স্বস্তি বোধ হলো তার । একটানা ভয়াবহ উগ্র গরম থেকে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যাবে । কিন্তু মুহূর্তেই ঘন মেঘে সেজে আকাশ নেমে এলো প্রায় মাথার উপরে । হাওয়া উঠলো জোরে । মাত্র ক’দিন আগেই শেষ হয়েছে চরকের মেলা । মাঠ জুড়ে এলোমেলো ছড়িয়ে পড়ে আছে মেলা শেষের চিহ্ন । হাওয়ায় তারাই পাক খেয়ে ঘুরতে লাগলো মাঠময় । মাঠে পড়ে থাকা  টুকরো কাগজ , পলিথিনের ছোট বড় প্যাকেট , ঝরা পাতারা যেন ডানা পেয়ে উড়তে লাগলো পাগলের মতো । মাঝে মাঝেই ধুলোভরা  বাতাসের  হলকা কানাই ,  তার ভ্যান আর সাইকেলে বসা পঞ্চাননকে ধুলোয় মাখামাখি করে দিতে লাগলো । ভ্যানে কাঁথার উপর চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা পঞ্চাননের স্ত্রী সপ্তমী শক্ত হাতে ধরে রেখেছে ভ্যানের এক প্রান্তের সীমা। রাস্তায় চলমান ভ্যানের ঝাঁকুনিতে তার মুখ থেকে একটা গোঙানির আওয়াজ বেরিয়ে আসছে আপনাআপনি । ঠোঁট কামড়ে আওয়াজ বন্ধ করার চেষ্টা করলেও চাগাড় দিয়ে ওঠা যন্ত্রণা থামাতে পারছে না সপ্তমী । 

কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিলো পাঁচু মাস্টারের সাইকেল । মনে মনে আতঙ্কিত হলো সে । অতি কষ্টে বাতাসের বিরুদ্ধে খানিক এগিয়ে এসে কানাইকে হাঁক দেয় , ‘ ওরে কেনা ! ভাইরে , একটু তাড়াতাড়ি চালা । ঝড় উঠছে । মনে হয় বৃষ্টি নামবে । ’ 

কানাইও গলা চড়িয়ে প্রায় চিৎকার করে বলে , ‘ পোয়াতি মানুষটারে নিয়ে এর চে জোরে যেতে পারবোনি মাস্টারদা । পরে হিতে বিপরীত হবে । ’  

কানাইয়ের উত্তরে আন্তরিকতা ছিল । পঞ্চানন ভাবে , কথাটা কানাই ঠিকই বলেছে । এর আগে তার বউ সপ্তমী তিন তিনবার পোয়াতি হয়েছে কিন্তু ফল হয়নি । এই প্রথম প্রায় দশমাস পূর্ণ হলো । তাবিজ কবজে পঞ্চাননের যতটা অবিশ্বাস সপ্তমীর ঠিক তার দ্বিগুণ ভরসা । হবে নাই বা কেন ! গ্রামের স্কুলে কোনরকমে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজে উঠতেই ওর বাবা – মা সুন্দরী মেয়েকে ঘরে রাখার ঝুঁকি নিতে চান নি । একমাত্র মেয়েকে পাত্রস্থ করে তারাও রাধাকৃষ্ণ ভজনায় মন দিয়েছেন । ছোটবেলা থেকেই আচারে বিশ্বাসী পরিবেশে বড় হয়ে সে কেবল সংস্কারই শিখেছে । পঞ্চাননের মতো যোগ্য বর পেয়ে সেই অন্ধবিশ্বাস অনেকটাই বেড়ে গেছে তার। পঞ্চানন তাকে বোঝাতে পারেনি যে শিবপূজা নয় , যোগাযোগটাই  আসল। এদিকে অকালে স্বামী- সন্তান হারিয়ে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে পঞ্চাননের মাও যথেষ্ট আচার সর্বস্ব জীবন কাটান । দুয়ে মিলে একেবারে চার। আধুনিক চিন্তার ছাপ সে সপ্তমীর উপর চাপিয়ে দিতে পারেনি । তবে শান্ত স্বভাবের সপ্তমী ঘর আলো করে আছে । তার ফুলগাছের নেশাটা পঞ্চাননের মাকেও ধরিয়েছে । সপ্তমীর আবদারে মুলিবাঁশের বেড়া দিয়ে বাড়ির সামনেটা ঘিরে দিতে হয়েছে তাকে । এখন গরমের সন্ধ্যায় গন্ধরাজ-বেলি-টগর আর সন্ধ্যামালতির গন্ধে বাড়ি ম ম করছে। শীতেও তার বাগানে বাহার দিয়ে ফুটে উঠবে গ্যাঁদা , চন্দ্রমল্লিকা , ডালিয়া সহ রকমারি মরসুমি ফুল। পঞ্চাননের মনে পড়েনা তার ছোটবেলায় কোনোদিন অ্যাডেনিয়াম কিংবা পমেলিয়া অথবা পিটুনিয়ার নাম শুনেছে ! অথছ সপ্তমীর বাগানে চিরকালের জবা , কাগজ অথবা নীলকণ্ঠের পাশে তারাও নানা রঙের ফুল নিয়ে মাথা উঁচু করে থাকে।  সপ্তমীর আবদার মতো নিমখৈল থেকে শুরু করে নানা রকমের সার সহ কীটনাশকও এনে দিতে হয় তাকে । স্কুল আর সমাজসেবা নিয়ে দিন কাটিয়ে ঘরোয়া বিষয়ে এর বাইরে নাক গলানোর আগ্রহ কোনোদিনই দেখায়নি পঞ্চানন । আসলে সে বিশ্বাস করে প্রত্যেকের নিজস্ব মতামত থাকা দরকার । সকলের আলাদা পছন্দের কদর থাকলেই মনে খুশির অভাব হয়না । তাছাড়া ক্ষতির সম্ভাবনা না থাকলে এই স্বাধীনতাটুকু সকলের প্রাপ্য । তাই তার মা আর সপ্তমীর আগ্রহে যখন তাদের বাড়িতে পাড়ার বিষ্ণুপদ গোঁসাইকে ডেকে যাগযজ্ঞ , তাবিজ-কবজ হয়েছে তখন সে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি । সপ্তমীর মা আসেন মাঝে মধ্যে। এবারও এসেছেন । এবার অবশ্য থাকবেন। বেশ কিছুদিন সময় নিয়ে এসেছেন । এবার অবশ্য পঞ্চাননেরও সামান্য ভরসা হচ্ছে । কারণটা যদিও  হসপিটালের নতুন লেডি ডাক্তার সন্ধ্যা সরকার । এই প্রথমবার কোনও গাইনো সপ্তমীকে শেষ পর্যন্ত দেখাশুনা করেছেন । পরীক্ষা ইত্যাদি করে ওষুধ দিয়েছেন । ভরসা দিয়েছেন পঞ্চাননকে । বলেছেন , ‘ দেখবেন মাস্টারদা , এবার হয়তো কোনও সমস্যা হবে না। ’ 

রাস্তা জনহীন। যদিও সে রাস্তা এখন বাতাস, ধুলো আর মেঘের ছায়া দখল করে রেখেছে। তার মধ্যে হঠাৎই উল্টোদিক থেকে থানার বড়বাবুর জিপগাড়িটি ঝড়ের বেগে তাদের গা ঘেঁসে বেরিয়ে গেলো । দুর্যোগের পথে তাদের উপর দিয়ে বয়ে গেলো বাড়তি ধুলোর ঝড় । হাওয়ার মাতনে পথের দু’ধারের গাছগুলো থেকে শুকনো পাতা ঝরে পড়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে । এলোমেলো উড়তে উড়তে তারা পঞ্চানন , কানাই বা তার ভ্যানে শুয়ে থাকা পোয়াতি মানুষটির উপরেও ঝরে পড়ছে । আচমকাই একটা বেশ বড় মাপের হলুদ শক্ত পাতা পঞ্চাননের চোখে ঝাপটা দিয়ে পথে গিয়ে পড়লো । বাম চোখে হাত রেখে ডানহাতে সাইকেলের ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো তাকে । চোখ রগড়ে গাল বেয়ে বয়ে আসা চোখের জল মুছে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিতে সময় লেগে গেলো বেশ অনেকটা। তবুও শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সাইকেলটা এগিয়ে নিয়ে কানাইকে ধরে ফেললো পঞ্চানন । পুটুলির মতো শুয়ে থাকা সপ্তমীর শরীরটা ভ্যানের উপর প্রাণহীনের মতো এদিক ওদিক করছে । আতঙ্কিত হয়ে কাছে এগিয়ে  গেলো পঞ্চানন। ভীষণ ভেজা ভেজা লাগছে ভ্যানে পাতা কাঁথাটা । ভালো করে দেখে বুঝলো – রক্ত নয়। যন্ত্রণা কাতর সপ্তমীর মুখে পিটপিট করা চোখদুটো দেখে ভয়মুক্ত হলো । 

ঝড়ের বেগ বাড়ছে একটু একটু করে । হসপিটালটা এখান থেকে কম করে আরও মিনিট পাঁচেক দূরে। ভারি চঞ্চল হয়ে উঠছে পঞ্চাননের মনটা । অন্য সময় এই পথটুকু মালুমই হয়না । আর এখন এই বিপদের সময়ে মনে হচ্ছে এই দূরত্বটুকুই যেন অকুল পাথার  ; সাঁতরে পার হওয়া যাচ্ছে না । চারিদিক অন্ধকার । থমথমে । গুমোট । দূরের তালগাছটার মাথার উপর দিয়ে আচমকা একটা বিদ্যুতের ঝলক আকাশটাকে চিরে দিয়ে গেল । বৃষ্টি শুরু না হলেও খুব একটা সময় দেবে বলে মনে হচ্ছে না । 

কানাইটাকে দেখে পঞ্চানন বোঝে বৃষ্টি শুরুর আগে হসপিটালে পৌছনোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে সে । উল্টোদিকের হাওয়া কাটিয়ে ভ্যানটাকে টেনে নিয়ে যেতে তার হাত-পায়ের মাংসপেশিগুলি ফুলে ফুলে উঠছে । হাওয়ার তোরে কালো মেঘগুলো মাথার উপর দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে উড়ছে । এর মধ্যেই তারা রেলগেটের এপারের বাজার পার করে ঢালাই করা পাকা রাস্তায় উঠে পড়েছে। রেললাইন পার করেই হাসপাতাল চত্তরের বিশাল বটগাছ আর আমগাছ দুটো নজরে পড়তেই পঞ্চাননের প্রাণে জল এলো । শ্বাস ফেলে মনে মনেই বলে উঠলো – ওই তো হাসপাতাল ।

                                           

 

দুই 

সরকারি এই হসপিটালটির বয়েস যথেষ্ট । তবে গাঁয়ের মানুষের ভরসার জায়গা হয়ে উঠতে বহু যুগ পার করতে হয়েছে এটিকে । কয়েক বছর আগেও বেশ খারাপ ছিলো এই হসপিটালের  ব্যবস্থা । তখন সাধারনত পোয়াতি ছাড়া অন্য রোগীর অধিকাংশেরই  এখান থেকে আর বাড়ি ফেরা হতো না। তবুও রোগীর অভাব ছিলো না কোনোদিন । বেড না পেলে মেঝেতে কাঁথা পেতে শুয়ে পড়তো রোগী । ইনফ্রাস্ট্রাকচার যথেষ্ট উন্নত হলেও উপযুক্ত কাজের লোক আর চিকিৎসকের অভাবে এই হসপিটালের গৌরব কেড়ে নিয়েছে নতুন গজিয়ে ওঠা গঞ্জের কয়েকটি নার্সিং হোম । কোলকাতার বড় কোনও হাসপাতালে যাওয়া এখানকার গরীব দুঃস্থ মানুষের সাধ্যে কুলায় না । কেউ কেউ যে যায় না তা অবশ্য নয়। তবে যখন যায় তখন আর করার কিছু থাকে না । গঞ্জের দিকে ক’টা নার্সিংহোম তখনও ছিলো এবং চিকিৎসাও হোতো ভালো। কিন্তু সেখানে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নতুনপল্লির মানুষের তখনও ছিল না এখনও নেই । বাধ্য হয়েই এলাকার গরীব ছাপোষা লোকজন এখানে এসেই ভিড় করে । 

নতুনপল্লি কিন্তু খুব একটা ছোটো গ্রাম নয় । তবু এখনও এখানে সবাই সবাইকে চেনে । এখানকার সবচেয়ে বড় স্কুল মহারাজা হাইস্কুলের অংক শিক্ষক পঞ্চানন ঘোষাল অল্প বয়সেই খুব জনপ্রিয় । এলাকার একজন ভালোমানুষ হিসেবেই পরিচিত । তার বাবা কেদারনাথ ঘোষাল ছিলেন জাঁদরেল শ্রমিক নেতা । বছর দশেক আগে জেলা সদর থেকে মিছিল শেষ করে ফেরার পথে আততায়ীর হাতে নিহত হন । তখন পঞ্চানন সবে কলেজ স্টুডেন্ট । কোলকাতার হোস্টেল থেকে ফিরে বাবার শেষকাজ করতে এসে মায়ের অসহয়তা দেখে কষ্ট পেয়েছিলো খুব । ছোটভাই পরেশ এর পুকুরে ডুবে মারা যাওয়ার দুঃখ তখনও তার মায়ের মন থেকে ফিকে হয়ে যায় নি । পর পর আঘাতে তার পাগল পাগল মা তখন বেঁচে থাকা শেষ অবলম্বন একমাত্র সন্তান পঞ্চাননকে দিয়ে নিজের  মাথায় হাত ছুঁইয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন যে জীবনে কোনোদিন সে রাজনীতিতে পা রাখবে না । কিন্তু বাছবিচার না করে সকলের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার স্বভাবটি পঞ্চাননের রয়েই গেছে । তাই সাধারণ গ্রামবাসীর কাছে পঞ্চানন ঘোষাল প্রিয় পাঁচু মাস্টার অথবা কেবলই মাস্টারদা । এবছর তার বয়স ত্রিশ ছুঁয়েছে । সুদর্শন হলেও পোশাকে বা চালচলনে অতি সাধারণ । আট থেকে আশি সকলের প্রিয়জন সে। কাছের মানুষ । সরাসরি কোনও রাজনৈতিক দলে না থাকায় গ্রামের সব মানুষের মনে তার একটা আদরের ঠাঁই আছে । স্বভাবগুণে একটা বিশ্বাসী সম্ভ্রম সে আদায় করে নিয়েছে মানুষের কাছ থেকে । রাজনৈতিক রং দেওয়ার চেষ্টা তাকে ছুঁতে পারেনি । তাই নদীর বাঁধ থেকে শুরু করে রাস্তা সারাই অথবা হসপিটালের সমস্যা থেকে গাছ লাগানো কিংবা পঞ্চায়েতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার দাবী জানানোর জন্য গাঁয়ের মানুষ পাঁচু মাস্টারকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে ভরসা পায়।  

পাঁচু মাস্টারের গ্রামের মানুষগুলির অধিকাংশ সহজ-সরল-সাধারণ । হয়তো তাই সমস্যাও অনেক । এখানকার মানুষ আসলে নিজেদের সম্যসার কথা নিজেরাই ভালো করে বুঝে উঠতে পারেনা । হাড়েহাড়ে  কষ্ট ভোগ করেও সমাধানের পথ খুঁজে পায় না । সে গল্প বহুদিনের । পাঁচু মাস্টারের বাবা লড়াই করে অকালে প্রাণ দিয়েছেন । ভোটের আগে এখনও এই গ্রামে মানুষের ভালো চেয়ে সাদা অথবা রঙিন পাজামা-পাঞ্জাবি পরা বহু নেতা বাইরে থেকে আসেন । মুখে তাদের আশ্বাসের ফুলঝুরি । সঙ্গে আসা শহরের সুন্দর সুন্দর দাদা-দিদিদের ব্যবহার দেখে আর কথা শুনে প্রাণে ভরসা জাগে । পঞ্চায়েত প্রধান থেকে স্থানীয় মেম্বাররা বলেন , তারা সবাই নাকি এই গাঁয়ের সমস্যার কথা সব জানেন এবং গাঁয়ের মানুষের জন্য কাজ করতে চান। তাদের মোলায়েম গলায় যে আশ্বাস শোনা যায়  তাতে মানুষ মুগ্ধ হয়। বিশ্বাস করে । ভাবে ,  ভোটে জিতলেই তারা উপর মহলে দরবার করবেন , এই গাঁয়ের সমস্যাগুলির কথা ভালো করে বুঝিয়ে বলবেন এবং কাজও হবে নিশ্চয়ই । তবু শেষপর্যন্ত কোনও ফল দেখতে পায় না এই গ্রামের মানুষ।  তারা হতাশ হয়। আবার এটাই স্বাভাবিক বলে মেনেও নেয় । তাই পরেরবার আবার যখন নেতাদের ডাক আসে সুবল , শ্যামল , মইদুল আর রাখহরিরা বড় বড় মিছিলে যোগ দেয় , দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হেঁটে সমাধানের আশ্বাস নিয়ে ঘরে ফেরে। প্রতিবারের মতো হরিপদর জন্য অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে বসে থাকা যমুনার মতো মানুষেরা কিন্তু সব বোঝে । তাই হাত-পা ধুয়ে ঘরে ঢুকতেই থালায় রুটি-তরকারি এগিয়ে দিয়ে হরিপদর কাছে যমুনা জানতে চায়, ‘ আজ মিছিলে কী হলো ? ’ 

রুটির টুকরো মুখে তুলে হরিপদ এবারেও বলে , ‘ আজ পঞ্চায়েত প্রধানের সঙ্গে কোলকাতার সবচেয়ে বড় নেতা এসেছিলেন । তিনি বললেন ,  গাঁয়ের সমস্যা আসলে দেশের সমস্যা । তাই বড় আন্দোলনের দরকার । ’ 

যমুনা বিদ্রুপের স্বরে জানতে চায় , ‘ এবার তাহলে আমাদের অনেক সমস্যাই মিটে যাবে । বলো ? মনে আছে ? গেলো বছর নদীর কাঁচা বাঁধ ভেঙে বন্যায় পুরা নতুনপল্লি ভেসে গেছিলো । কত দরবার করেও নদীর বাঁধ পাকা হয়নি । এবার কী হবে কেজানে ! শহরের বড় নেতা দিয়ে কাজ নেই । তোমরা নিজেরাই বরং গ্রামের হয়ে দরবার করো । মিছিল লাগবে না । পাঁচু মাস্টারকে নিয়ে একজোট হও। তিনি বড় নেতা নন । তাই তার ভোট লাগে না । ’  

গ্রামের এই গুঞ্জনের কথা পাঁচু মাস্টারের কানেও আসে । কিন্তু রাজনীতি নিয়ে পাঁচু মাস্টার যেমন উদাস ছিলো তেমনই থাকে । এটাও সত্যি , গ্রামের উন্নতির জন্য টাকা আসে কিন্তু কাজ দেখা যায় না । এখনও গ্রামের অনেক রাস্তাই মাটির। আর তাই ফাল্গুনের শুরু থেকেই সেইসব রাস্তার ধুলো গাঁয়ের মানুষের পায়ে পায়ে উড়তে থাকে । ভস্মমাখা মানুষগুলি চাতকের মতো আকাশের দিকে চেয়ে বিচার চায় । নিয়ম করে ভোট আসে ভোট যায় । কিছু মানুষের বাড়ি গাড়ি হয় । গ্রামে কোনও কাজ নেই। ভোরের  ট্রেন গ্রামের বহু জোয়ানকে তুলে নিয়ে চালান করে দেয় সারা কলকাতার অলিতে গলিতে। বেশ রাতে তারা ঘরে ফেরে । নতুন করে কিছু ভাবনার অবকাশ তাদের হয়না । গ্রামের একশো দিনের কাজেও আছে কারচুপি । যারা সুবিধা দেওয়ার লোক তারাই ঠকায় । বুদ্ধিমান ভালমানুষ এ গাঁয়ে নেতা হয়ে এগিয়ে আসে না । রাজনৈতিক গরম হাওয়া এখানে তেমন সুবিধা করতে পারে না । একটু উঠেই আবার কেমন নিভে যায় । এই ব্যাপারে সবাই কেমন চুপ করে থাকে । তারা শান্তি চায় । রাজনৈতিক খুনোখুনি তাদের আতঙ্কিত করে । এখন তাই পাঁচু মাস্টার সকলের কাছে নির্বিরোধী জননেতা । বছর ক’য়েক আগে এই গাঁয়ের মানুষ দলমত নির্বিশেষে হসপিটালের সুবিধার দাবীতে পাঁচু মাস্টারকে সামনে রেখে এক বিরাট আন্দোলন গড়ে তুলেছিলো । গ্রামের মানুষ পঞ্চায়েত প্রধান থেকে শুরু করে সমস্ত পঞ্চায়েত মেম্বারদের সঙ্গে বিরোধী নেতাদেরও সামিল করেছিলো এই আন্দোলনে।  স্বাস্থ্যদপ্তরে জমা পড়েছিলো পাঁচু মাস্টারের লেখা চিঠি । তাতে সই করেছিলো গ্রামের প্রায় সকলেই । তারপর থেকেই পাল্টে যেতে লাগলো হসপিটালের সুপার থেকে শুরু করে সমস্ত স্টাফ । সব বিভাগে ডাক্তার এলেন । বদলির নির্দেশ এলো অনেক ডাক্তারের। এখন পাঁচু ওরফে পঞ্চানন ঘোষাল সহ সকলেরই মনে হয় গাঁয়ের মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে । মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে সেকথা । সে নিজেও তো নতুন গাইনো সন্ধ্যা দিদিমনির কথা জানে । গত প্রায় দশমাসে অন্তত পঁচিশবার তার সঙ্গে আপনজনের মতো কথোপকথনে যথেষ্ট শ্রদ্ধা জেগেছে পঞ্চাননের মনে । পঞ্চাননও বোঝে নতুন এসে সন্ধ্যা দিদিমনি তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। 

হসপিটালের সামনে আসতে না আসতেই বৃষ্টি নামলো ঝেঁপে । পঞ্চানন সাইকেল দাঁড় করিয়ে এক দৌড়ে মেটার্নিটি ডিপার্টমেন্টে ঢোকে । ডিউটিতে থাকা সিস্টার রেবা মণ্ডল তার পরিচিত । ব্যস্ত হয়ে বলে , ‘ সিস্টার ,  আমার ওয়াইফকে এনেছি। ভালোই ছিলো । হঠাৎ পেইন উঠেছে । দুই মা বললেন , হসপিটালে নিয়ে যেতে । কিন্তু পথে মনে হয়  খুব কষ্ট হয়েছে । প্লিজ , একটু দেখুন । মনে হয় ভর্তি করতে হবে । ’ 

রুগীর বাড়ির লোকের ব্যস্ততা রেবাদিদের চিন্তিত করে না । দায়িত্ব পালনে অবহেলাও করে না তারা । ইশারায় তাকে শান্ত হতে বলে রেবা মণ্ডল গলা চড়িয়ে দু’জন বয়কে ডেকে বললেন , ‘ মোহন ! সুবলকে ডেকে স্ট্রেচার নিয়ে এসো । স্যারের স্ত্রীকে এগারো নম্বর বেড এ নিয়ে যাও  । ’ এরপর গলা একটা ভয়ানক দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো পঞ্চাননের । রেবাদির কণ্ঠের আন্তরিকতায় তার অস্থির মনটা সামান্য শান্ত হলো । 



তিন 

সপ্তমীকে ভর্তি করে আপাতত নিশ্চিন্ত হয় পঞ্চানন । অফিস ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায় । বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। অন্ধকারে ছেয়ে আছে চারিদিক । বৃষ্টির সঙ্গে চলছে হাওয়ার পাগলামো । তোরে জলের ছাট এসে ভরে যাচ্ছে বারান্দা । হসপিটালের সামনের রাস্তা , রাস্তার ধার ঘেঁসে সারি সারি দোকান , দূরের গাছপালা এমনকি কাছের আম গাছটাকেও ঝাপসা দেখাচ্ছে । বাইরে এসে দ্যাখে কানাই দাঁড়িয়ে আছে । ছাট বৃষ্টিতে তার পা থেকে কোমর প্রায় ভিজে গেছে । বারান্দার শেষদিকে জানালার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে গুটিসুটি দাঁড়িয়ে থাকা কানাই এর পাশে তার ভ্যানটিকে দেখে অবাক হয়ে যায় পঞ্চানন । হসপিটালে ঢোকার ঠিক আগমুহূর্তে জোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছিলো । সেকথা মনে পড়তেই বোঝে বৃষ্টির হাত থেকে রোগীকে বাঁচাতে কানাই তার ভ্যানটিকে হসপিটালের বারান্দায় তুলে এনেছে । কিন্তু পঞ্চানন তো সপ্তমীর চিন্তায় তাকে হসপিটালাইজ করার কথা ভেবে প্রায় ছুটে ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলো । তবে ? কীভাবে সে সপ্তমীকে নিয়ে এই ভ্যান বারান্দায় তুলেছে ! আশ্চর্য হয়ে মনের তাগিদে পঞ্চানন কানাইকে প্রশ্ন করে , ‘ হ্যাঁরে কেনা ! তুই একা এই উঁচু উঁচু সিঁড়ির ধাপ ডিঙিয়ে তোর ভ্যানটা তুলে আনলি কী করে ? ’ 

‘আপনি তো দৌড়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন । এদিকে বৃষ্টিও এলো খুব জোরে । পলিথিন একটা ছিলো । উপায় না পেয়ে সেটা দিয়েই বৌদিকে ঢেকে দিয়ে যখন ভাবছি কী করি ঠিক তখনই দেখি মকবুল ভাই এদিকপানে আসছে । তাকে ডেকে সাহায্য নিলাম । না হলে বউদি ভিজেই যেতো। ঐ তো , মকবুলদাদা হোথায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতিছে । ’  

কানাই এর কথায় পঞ্চানন বারান্দার উল্টোদিকে তাকালো ।  খোলা বারান্দার এককোণে কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তার পাড়ার মকবুলকে দেখতে পেলো । মকবুল তার ক’টা বাড়ির পরেই থাকে । সারাটা শরীর তার চুপচুপে ভেজা । দাঁড়িয়ে আছে একা । হয়তো বৃষ্টি দেখছে । তার গা-মাথা থেকে এখনও ফোঁটা ফোঁটা জল ভেজা বারান্দার মেঝেতে গড়িয়ে পড়ছে । তাদের কথোপকথন শুনে মকবুলও তাকায় । চোখাচোখি হতেই হাসিমুখে মকবুল তাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে । পঞ্চানন একটু গলা চড়িয়ে জানতে চায় , ‘ তুমি এখন এখানে কেন মকবুল ভাই  ? কী হয়েছে ? ’ 

ততক্ষণে মকবুল পঞ্চাননের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে । দু’হাতের আঙুল মচকাতে মচকাতে বলে , ‘ কী আর বলবো মাষ্টার ? বিবির আবার ভরা মাস । দাইই তো সব করে কিন্তু সকালে পড়ে গিয়ে দু’বার জল ভেঙেছে দেখে ভয় পেয়ে বললো হসপিটালে দিতে । তাই তক্ষুনি হাসিনাকে নিয়ে হসপিটালে এলাম । ডাক্তার দেখে ভর্তি করতে বললেন । হাসিনার কথা জানতে চাইলে বললেন , কেসটা সিরিয়াস । তবে উনি দেখবেন । কথা শুনে ভরসা হলো । এখন দেখি কী হয় ! কিন্তু  তুমি এখানে যে ? ’ 

কানাই বলে ওঠে , ‘ ম্যাডামেরও বাচ্চা হবে । তুমি যে জল ভাঙার কথা বললে না , ম্যাডামেরও সাড়া রাস্তায় জল ভাঙতি ভাঙতি দেহে কিছু নাই । আমিই তো ভ্যানে কইরে আনলাম তারে । ’ 

কানাইয়ের কথা শুনে মকবুলের মুখেও চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো । পঞ্চাননের দিকে তাকিয়ে বললো , ‘ বৌদিকে ভর্তি নিয়েছে তো , মাষ্টার ? চিন্তা করোনা । সব ঠিক হয়ে যাবে । ’ 

পঞ্চানন সামান্য এগিয়ে এসে সারি সারি স্টিলের চেয়ারের একটায় এসে বসে । রে রে করে ওঠে কানাই , ‘ আরে ! মাস্টারদা , চেয়ারগুলো যে জলে ভিজে আছে ! ’  

উত্তর না দিয়ে সামান্য হাসে পঞ্চানন । মকবুলকে বলে , ‘ তা তুমি এভাবে ভিজে গেলে কীভাবে ? ’ 

‘আর বলো কেন ? সকাল থেকে কিছু খাওয়ার সুযোগই পেলাম না । সেই ভোরবেলা থেকে হাসিনারে নিয়ে চিন্তায় এরে ডাকি , তারে বলি করতে করতে বেলা হয়ে গেলো । আম্মিও ব্যস্ত রইলো তারে নিয়ে । শেষে নিয়ে এলাম হসপিটালে । এখানকার লেডি ডাক্তারটা খুব ভালো । সব শুনে সামান্য রাগ দেখালেন বটে তবে হাসিনারে ভালো করে পরীক্ষা করে ভর্তি নিয়ে নিলেন সঙ্গে সঙ্গে । তখন অবশ্য ঝড় শুরু হয়ে গেছিলো । ভাবলাম কিছু খেয়ে আসি । তা খেতে খেতে এমন বৃষ্টি নামলো যে রাস্তাটা পার করে এখানে আসতে আসতেই পুরো ভিজে গেলাম । ’ 

‘ভেজা শরীরে এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে মকবুল।’ 

‘ বলছো ? তোমারে দেখে একটা কথা মনে এলো মাষ্টার । বলবো ? ’ 

‘ বলবে যখন ভেবেছো তখন বলবে না কেন ? ’ 

স্বস্তির সুরে মকবুল বলে , ‘ তুমি তো আছো মাষ্টার । আমি তবে বাড়ি যাই ? আম্মিরও শরীরটা বিশেষ ভালো নেই । বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে একা পেড়ে উঠবে না । দু’দিন হলো মফিজুলও বিবি বাচ্চা নিয়ে বহরমপুর গেছে । বাড়ি একদম ফাঁকা । ’ 

‘ কিন্তু মকবুল ! এখানে ভাবীর জন্য যদি তোমাকে দরকার পড়ে ? ’ 

‘ সে , তুমি তো থাকছো । আমি নিশ্চিন্ত । হাসিনাকে নিয়েই চিন্তা । যার মুখ দেখি নাই তারে নিয়ে চিন্তা নাই । যেগুলো আছে তাদের কথা ভাবতে হবে তো  ! নাকি ? কেজানে দুপুরে কিছু খেয়েছে কি না ! এখন বিবিটা বাঁচলেই হয় । একদম কেলিয়ে গেছে গো ।  ভর্তির সময় অবশ্য আমি সই করে দিয়েছি । তুমি একটু দেখো মাষ্টার । তেমন দরকার হলে একটা ফোন দিও । ’  

মকবুলের কথা শুনতে শুনতে পঞ্চানন বাইরের দিকে তাকায় । বৃষ্টি হয়েই চলেছে । কখনও কম কখনও বেশ জোরে । সঙ্গে হাওয়া । মকবুলের দিকে ফিরে উদ্বিগ্ন স্বরে বলে , ‘ কিন্তু এই বৃষ্টির মধ্যে তুমি যাবে কী করে ? ’ 

মকবুল তোয়াক্কা করে না । হাসতে হাসতে উত্তর দেয় , ‘ ভিজেই তো গেছি । তাছাড়া বৃষ্টির গতিক ভালো নয় । থামতে থামতে রাত হয়ে যাবে । তোমার বাড়িতে কিছু বলতে হবে কি ?  যাওয়ার সময় বলে দেবানে । ’ 

‘ ঠিক আছে , তুমি আমার মাকে একবার হাঁক দিয়ে বলে যেও , আমার ফিরতে দেরি হবে । চিন্তা করে না যেন । রাত হলে খেয়ে শুয়ে পড়ে যেন । ‘ 

মকবুল মন দিয়ে পঞ্চাননের কথা শুনে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বারান্দা থেকে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো । হঠাৎ পঞ্চানন বলে ওঠে , ‘ আর শোনো , মকবুল ভাই ! মাকে বোলো কোনও দরকার হলে যেন একটা কল করে । ’  

‘ ঠিক আছে । আমি তবে যাই । দরকার হলে তুমিও একটা ফোন করে দিও । সিস্টারকেও আমার ফোন নম্বর দিয়ে গেছি । ’ বলে মকবুল ভেজা দেওয়ালে ঠেস দেওয়া তার ঝরঝরে সাইকেলটি নিয়ে বৃষ্টি মাথায় বেরিয়ে পড়লো । ঠিক তক্ষুনি আবার শুরু হলো জোর বৃষ্টি। ঘন বৃষ্টিতে দেখা গেলো মকবুল সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখেছে । তার সাইকেল চলতে আরম্ভ করলো এবং ঝাপসা হতে হতে একসময় হারিয়ে গেলো । 

এতক্ষণ মকবুলের সঙ্গে কথার ফাঁকে পঞ্চানন প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো যে কানাই সেই তখন থেকে তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। লজ্জিতস্বরে বলে , ‘ কিরে কেনা ! সেই থেকে দাঁড়িয়ে আছিস ? কোথাও তো বসতে পারতি ! ’

‘ কোথায় বসবো বলো তো মাস্টারদা ? বৃষ্টির ছাটে সবই তো ভেজা । ’ 

পঞ্চানন পকেট থেকে পার্স বের করে কানাইয়ের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলে , ‘ এই নে কেনা , এটা রাখ। আজ বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিস তুই । ’ 

কানাই টাকাটা নিয়ে খুশি হয়ে বলে , ‘ কিন্তু এতো কেন , মাস্টারদা ? ’ 

‘ আরে , নে না । ভালো খবর হলে পেটভর মিষ্টি খাওয়াবো । কিন্তু এখন তুই যাবি কী করে ?’ 

‘ একটু পরেই যাবো ভাবছি । দেখি বৃষ্টিটা যদি একটু ধরে । এখন প্যাসেঞ্জারও তো পাবো না । ’ 

                                               

 

চার 

বৃষ্টি চলছেই । হাওয়ার মাতন একটু কমেছে বটে কিন্তু চোখ ঝলসে দিয়ে চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ । আর , সঙ্গে সঙ্গে বাজ পড়ার কান ফাটানো আওয়াজে রীতিমত চমকে যাচ্ছে পঞ্চানন । কখন থেকে যে পঞ্চানন এই চেয়ারে বসে আছে খেয়াল নেই । পাশেই কমন ইউরিনাল । পেচ্ছাপের উগ্র নাক জ্বালানো গন্ধটা একটু কমেছে মনে হয়। বৃষ্টির জলে ধুয়ে গেছে হয়তো । না কি অনেকটা সময় একটানা বসে থেকে থেকে নাকে সয়ে গেছে তা অবশ্য মালুম করতে পারে না পঞ্চানন । খিদে –তেষ্টা বোধটাই হারিয়ে গেছে তার। 

   এরই মাঝখানে ভিজিটিং আওয়ার এসে পেরিয়ে গেলো । যারা রুগী দেখতে এসেছিলো তাদের সকলেই প্রায় তার চেনা।   প্রিয় পাঁচু মাস্টারের সঙ্গে তাদের কথাও হয়েছে অনেক । হাসিমুখ পাঁচু  মাষ্টারের চিন্তার খোঁজ অবশ্য কেউ পায়নি । একসময় সেটাও শেষ হয়েছে । রোগী দেখতে আসা বারান্দার লোকজন এখন আর নেই । পঞ্চানন কানাই এর কথা ভাবে । মকবুল থেকে শুরু করে পাড়ার সকলের কথাই তার ভাবনায় আসে । নিজের গ্রামে চাকরিটা তার হয়ে যাবে এমন ইচ্ছে থাকলেও হয়েই যে যাবে – ভাবতে পারেনি । এমনটা না হলে মাকে নিয়ে কোথায় যে তাকে যেতে হোতো কে জানে ! বাড়িটার যে কী হতো ! এমন কষ্টের কথা ভাবতে ইচ্ছে করে না । এই গ্রামে তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা । অনুভব , শ্যামল, কনিষ্ক , রাহুল , অতনুরা সকলেই বাইরে স্যাটেল্ড । মহানন্দ তো বাড়ি বিক্রি করে গ্রামের পাট চুকিয়ে দিয়েছে । ঘুরে ফিরে সেই মকবুলের কথাই মনে এলো আবার । ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত একসঙ্গে একস্কুলে পড়েছে তারা । নতুনপল্লীর প্রায় সব জমি একসময় তার পূর্ব পুরুষদের ছিলো । দেশভাগের সময় থেকে তাদের সেই জমি অন্যদের হতে থাকে । প্রথমে জমি বাড়ি বিনিময় করে অনেকেই চলে গেছিলেন তখনকার পূর্ব পাকিস্থানে । কেউ কেউ তাদের বিশাল জমির কিছু কিছু বেচে দিয়েছেন ওপার থেকে আসা মানুষজনকে । উভয়পক্ষেরই প্রয়োজন ছিলো আর তাই নতুনপল্লীতে গড়ে উঠেছে এই নতুন বসতি । আর্থিক কারণেই মকবুলের দাদা – নানা একটু একটু করে তাদের জমিজমার প্রায় সবটাই জলের দরে বেচে দিয়ে সামান্য নিয়ে আছেন।  

   ফিঙা , ছোটফিঙা , বড়ফিঙা , তেতুলতলা , ওলাইচণ্ডীতলা , দেবীতলা , প্রতাপগড় আর ফতুল্লাপুর  দিয়ে ঘেরা তাদের একমাত্র হিন্দুপ্রধান নতুনপল্লী । এই হিন্দু পল্লীতে মকবুল আর মফিজুলদের একটিই মুসলিম পরিবারের বাস । ওরা দুই ভাই এখন ভাগচাষী । একঝাঁক ছেলেপুলে নিয়ে আব্বু আর আম্মিকে সহ তাদের সুখের সংসার । সবাই বেশ মিলেমিশে থাকে । 

   বসে থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে পঞ্চানন ঘোষাল । মেটারনিটি ডিপার্টমেন্ট থেকে কোনও সাড়াশব্দও নেই । চিন্তাও যেন ভোতা হয়ে আসছে । কী করবে ভেবে পায় না । উঠে দাঁড়ায় । পাইচারি করতে করতে পাশের জেনারেল ওয়ার্ডে উঁকি দেয় । ভেতর থেকে মল-মুত্র-ওষুধ-ফিনাইল মেশা একটা গন্ধ ভেসে আসে । গা গুলিয়ে ওঠে পঞ্চাননের । পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে চাপা দেয় । ভিজিটিং আওয়ার পার হয়ে গেছে । রোগীর বাড়ির লোকজন এখন আর আসবে না । ডাক্তারবাবু ভিজিটে আসার আগের সময়টুকুতে রোগীদের অনেকেই নিজেদের বেড এ শুয়ে বসে আছে । তবে তার মধ্য থেকেই অন্য রোগীর কাশি, গোঙানি , আর্তনাদ কানে এলো পঞ্চাননের । ভালো করে তাকালে রোগীদের বেড এর নিচে কোথাও বেডপ্যান , পেচ্ছাপের পাত্র , গামলায় কফ-থুতু , রক্তমাখা তুলো চোখে পড়বেই । দেখে পঞ্চাননের গা ঘিনঘিন করে ওঠে । দরজার সামনে পঞ্চাননকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন কমবয়সী নার্স এগিয়ে আসে । মেয়েটিকে চেনা মনে হলো না ।  ‘ কিছু বলবেন ? কাউকে চাইছেন ?’ 

  পঞ্চানন মাথা নেড়ে বলে , ‘ না না , এমনিই ! কাউকে চাই না । ’ 

  ততক্ষণে হাসপাতালের হলুদ আলোগুলি জ্বলে উঠেছে । সে আবার ফিমেল ওয়ার্ডের সামনের সেই চেয়ারটায় এসে বসে । ফোনও করেনি কেউ । সেও কাউকে কল করেনি । ফোন ঘাটার বিন্দুমাত্র আগ্রহ হলো না তার। ধৈর্য বলতে কিছু আর বাকি নেই । দু’একজন এদিক ওদিক যাওয়া আসা করছে বটে তবে তারা পঞ্চাননকে খবর এনে দিতে পারবে বলে মনে হয় না । নজরে আসে পাঁচিলের পিলারে ঠেকিয়ে রাখা তার দীর্ঘদিনের বাহন সাইকেলটার দিকে । ভিজে ভিজে সেও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে । পকেটে ফোনের পাশ থেকে সাইকেলের চাবিটি মাঝে মধ্যেই অস্তিত্বের জানান দেয় । উদাসীন চোখ চলে যায় সামনের বিরাট আমগাছটার দিকে । ঝড়-জল সামলে বেশ দাঁড়িয়ে আছে । মানুষের পায়ে পায়ে গাছটির নিচে ঘাসের চিহ্নমাত্র নেই । সাদা শক্ত মাটিতে ঝরে পড়া পাতা সহ ডাল আর আমের ছোটো ছোটো মুকুলে ছেয়ে আছে । বৃষ্টিটাও একটু কমের দিকে । দূরের পাড়ার ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠছে । তার মনে হয় – কেমন হাওয়ার মতো সময় চলে যাচ্ছে ! কিন্তু খবর যে কিছুই পাওয়া গেলো না । হঠাৎ সদ্যোজাত শিশুর কান্না ভেসে এলো । তড়াং করে  লাফিয়ে ওঠে পঞ্চানন । যন্ত্রচালিতের মতো ছুটে যায় মেটার্নিটি বিভাগের দরজায় । দরজা ভিতর থেকে বন্ধ । কোনও খবর পাওয়া সম্ভব নয় । শান্ত হয়ে ধীরে ধীরে ফাঁকা চায়ারে এসে বসে । একটু চা অন্তত খেতে ইচ্ছে করছে । কী করবে ভেবে পায় না । ভাবে , সে বেরিয়ে গেলেই যদি তার খোঁজ পড়ে !  পকেটে মোবাইলটা বেজে ওঠে । তুলে দেখে – মা কল করেছে । 

                                               

                                                 পাঁচ 

 

রং চটা নীল জিন্স আর চেক শার্ট পরা পঞ্চানন মাথা নিচু করে কিছু ভাবছিলো । সমস্ত ভাবনা এখন শেষ বিন্দুতেই এসে দাঁড়িয়েছে । যেখানে কিছুই করার থাকে না । চিন্তা করতে করতে ক্লান্ত পঞ্চানন খেয়াল করেনি রেবাদি কখন এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে । কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রেবাদি চিন্তামগ্ন পঞ্চাননকে ডেকে বলে , ‘ মাস্টারদা ! দিদি আপনাকে ডাকছেন । ’   

কিন্তু চেয়ারে দু’হাত রেখে মাথা ঝুলিয়ে বসে থাকা পঞ্চাননের কোনও সাড়া না পেয়ে তার কাঁধে হাত রাখে রেবা । শান্ত স্বরে বলে , ‘ মাস্টারদা ! ডাক্তারদিদি আপনাকে অফিসে আসতে বললেন । ’  

পঞ্চানন যেন ঘোর থেকে জেগে উঠে মুখ তুলে তাকায় । আচমকা সম্বিত ফিরে পেয়ে উঠে দাঁড়ায় । উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চায় , ‘ তাই ? কী হয়েছে রেবাদি ? ছেলে না মেয়ে ? আমার ওয়াইফ ভালো আছে তো? ’   

পাঁচু  মাষ্টারের গলায় অধীর আগ্রহ স্পষ্ট । তার এই উদ্বিগ্নতা স্বাভাবিক । সেটা সিস্টার বোঝেন । আরও শান্ত আর আন্তরিক ভাবে বলেন , ‘ আমার সঙ্গে আসুন মাস্টারদা । ’   

পঞ্চানন আর দাঁড়ায় না । যন্ত্রচালিতের মতো সিস্টারকে অনুসরণ করে মেটার্নিটি বিভাগের অফিসের সামনে এসে দাঁড়ায়।  পর্দা তুলতেই দেখা গেলো মেরুন রঙের ভারী কাপড়ের পর্দা ঘেরা ঘর । চেয়ারে বসে আছেন ব্যক্তিত্বময়ী ডঃ সন্ধ্যা সরকার। ক্লান্ত আর বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছে তাঁকেও । সামনে কাচে ঢাকা টেবিলের বুক থেকে ডেট ক্যালেন্ডার , অগনিত ভিজিটিং কার্ড উঁকি দিচ্ছে । ডানদিকে প্লাইউডের পার্টিশন । ক্যালেন্ডারে হাসিমুখ একটি বাচ্চা মেয়ে ফ্যানের হাওয়ায় দুলছে । রেবা সরকারের পিছন পিছন ঘরে ঢুকে এসেছে উদ্বিগ্ন পঞ্চানন । ডঃ সরকার ফোনে কথা বলছিলেন । তাদের দেখে ফোনের রিসিভার রেখে মৃদু হেসে বললেন , ‘ আসুন , মাস্টারদা ! বসুন । ’ 

ডক্টর্স টেবিলের উল্টোদিকে রাখা দুটো ভারি চেয়ারের একটিতে এসে বসে পাঁচু মাস্টার । টেবিলের কাচে ডঃ সরকারের মুখটি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে । সেদিকেই তাকিয়ে থাকে পঞ্চানন । মনটা অস্থির । সদ্যজাত সন্তানের খবর দিতে যে সময় নষ্ট করা স্বাভাবিক নয় সেকথা  বুঝতে  আর বাকি থাকে না তার। মনখারাপের এক সমুদ্রে ডুবে যেতে থাকে পঞ্চানন । দুশ্চিন্তায় ডুবে যাওয়া জগৎ থেকে আচমকাই শুনতে পায় , ‘ তখন থেকে বসে আছেন । একটু চা খাবেন তো ? ’ 

মুখ তুলে তাকায় পঞ্চানন । নিরুত্তর । সিস্টার রেবা মণ্ডল কলিং বেল বাজালে একজন বয় এলো । চায়ের অর্ডার নিয়ে ছেলেটি বেরিয়ে গেলে পাঁচু মাষ্টার জানতে চায় , ‘ কী খবর ডঃ ? কিছুই বলছেন না যে ! আমি আর ধৈর্য রাখতে পারছি না।’  

‘একটু বসুন । চা খেতে খেতে সবই বলছি । ’  

রোদে পুড়ে শ্যামলা হয়ে আসা পঞ্চাননের ফর্সা মুখ তামাটে রং ধারণ করে ।  পেটের ভিতর থেকে একটা চিনচিন ব্যথা উঠে এসে সারাটা বুক কামড়ে ধরছে । মুখে ফুটে উঠছে সেই যন্ত্রনার চিহ্ন । কাতর স্বরে বলে , ‘ তাহলে ? আপনি যে বলছিলেন ? ’   

তাকে থামিয়ে ডঃ সরকার বললেন , ‘ আমার কথা শুনুন মাস্টারদা । স্বাভাবিক যে কিছু হয়নি তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন । এবার আমার কথা শুনুন । আমরা আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে এসেছি । আপনাকে সামিল হতে হবে । ’   

‘কী বিষয়ে সিদ্ধান্ত ডঃ ? আমার স্ত্রী কেমন আছে ? আর বেবি ? ’ অজানা উত্তেজনায় গলা কাঁপছে পঞ্চাননের । 

খুব নরম স্বরে ডঃ সরকার বললেন , ‘ আপনি শান্ত হোন মাস্টারদা । মকবুলের স্ত্রী খুবই খারাপ অবস্থায় এসে হসপিটালে পৌঁছেছে। কেসটা এতোটাই ক্রিটক্যাল ছিলো যে খুব সাবধানে বেবি এবং মকবুলের স্ত্রীকে বাঁচানো গেছে । কিন্তু আপনার স্ত্রীকে আর অন্তত ঘণ্টাখানেক আগে নিয়ে আসতে হতো । আপনার ওয়াইফের পেটের বেবি হসপিটালে আসার অল্প আগেই জলের অভাবে মারা গেছে । দু’জনেরই সিজার করতে হয়েছে এবং তারা সুস্থ আছে । তাদের ডেঞ্জার পিরিয়ড না কাটলেও চিন্তার কিছু নেই । ’ 

পঞ্চানন ঘোষাল যেন এক পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে । এবার যে সেও মনে মনে খুব আশা করেছিলো তার ঘরে একটা বাচ্চা আসুক। সপ্তমী নিশ্চয়ই খুব ভেঙে পড়বে । বাড়িতে অপেক্ষায় থাকা মায়েদের কথা ভেবে আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে পাঁচু। ডঃ সরকার যা বললেন তা শোনার মতো মানসিক প্রস্তুতি যে তার ছিলো না তার বিবর্ণ মুখে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।  

নীরবতা ভেঙে নার্স রেবা মণ্ডল বলে , ‘ আপনার স্ত্রীর পেটেও একটি মেয়ে ছিলো । ’ 

মাথা নিচু করে শোনে পঞ্চানন মাষ্টার । চা নিয়ে ঢোকে একটি ছেলে । রেবা চায়ের তিনটি গ্লাসের একটি ডঃ  সরকরের সামনে এবং অপরটি পঞ্চানন মাস্টারের সামনে রেখে নিজের গ্লাসটি নিয়ে পাশে দাঁড়ায়। আপনজনের মতো পাঁচু মাস্টারের কাছে এসে বলে , ‘ মাস্টারদা ! বৃষ্টি কমে গেছে । মকবুলও এসে পড়বে । আমার কথা শুনুন , মকবুলের এই বয়সে চার চারটি মেয়ে আর একটি ছেলে । তা নিয়েই ও যথেষ্ট ব্যতিব্যস্ত । তাই ওর একটি মরা বাচ্চা হলে ক্ষতি নেই । তাছাড়া , আপনার স্ত্রীর আর মা হওয়ার আর কোনও সম্ভাবনা নেই । ’  

সিস্টারের কথার ইঙ্গিত না বোঝার মতো মানুষ পঞ্চানন নয় । সে নিরুত্তর ।  মুখে চা তুলতে পারে না । তার চোখে আমতলায় পড়ে থাকা কচি কচি আমগুলির ছবি ভেসে ওঠে । কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের মতো বলে, ‘ তা হলে ? ’

‘তাহলে আবার কী ? মকবুলের বেবি মৃত আর আপনার বেবি জীবিত । এটাই শেষ কথা । ’ 

‘এ বড় অধর্ম হবে রেবাদি । জানাজানি হলে আমি কাউকে মুখ দেখাতে পারবো না । মকবুল আমার বন্ধু । ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছি । তাছাড়া নিজের স্বার্থে মকবুল কেন কারও সঙ্গে এই ধরনের বেইমানী করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় । ’

ডঃ সরকার পঞ্চানন ঘোষালের দিকে তাকিয়ে ছিলেন । হয়তো পুরো বিষয়টি নিজের হাতে সামলাতে করণীয় কর্তব্য স্থির করছিলেন । চা ভর্তি কাচের গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে খুব শান্ত কণ্ঠে বললেন , ‘ মাস্টারদা ! শান্ত হোন । আপনি কেমন মানুষ সেকথা এই গ্রামের সকলেই জানে । প্রশ্নটা সেখানে নয় ,  আপনার সংসারে একটি সন্তানের খুব প্রয়োজন । অথচ স্বাভাবিক ভাবে সেই প্রয়োজন মেটার সম্ভাবনা নেই । কিন্তু মকবুলের স্ত্রী আরও সন্তান নিতে পারবে । এবারে একবার রেবার প্রস্তাবটি ভেবে দেখুন । ’ 

‘কিন্তু ! এটা কী করে সম্ভব ?  ’ ভারি অসহায় শোনায় তরুণ শিক্ষক পঞ্চানন ঘোষালের কণ্ঠ । যেন এমন এক অঙ্কের সামনে তাকে দাঁড়াতে হয়েছে যেখানে সমাধান বলে কিছু নেই । এতদিনের শিক্ষা আর অভিজ্ঞতা কি কোনও কাজে আসবে না ! 

পঞ্চানন ঘোষালের অসহায়তা দেখে ডঃ সরকার আবার বলেন , ‘ আপনি কোনও চিন্তা করবেন না মাস্টারদা । দুটো কেসই খুব ক্রিটিক্যাল ছিলো । আর একটু দেরি হলে মকবুলের স্ত্রীর বেবিকেও বাঁচানো যেত না । তাছাড়া মায়েরা তাদের বেবির কথা জানে না । ওদের জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে । স্যালাইন এর সঙ্গে ট্রিটমেন্ট চলছে । ’ 

‘কিন্তু আপনারা তো জানেন । এতো বড় মিথ্যে মেনে নেওয়া যায় না । ’

সিস্টার রেবা মণ্ডল কিছু বলতে যাচ্ছিলো – ঠিক  এমন সময় বারান্দা থেকে মকবুলের কণ্ঠ ভেসে আসে। ‘ দিদিমনি ! আমিও চলে এলাম । ’ 

আচমকা মকবুলের উপস্থিতিতে চমকে ওঠে পঞ্চানন । ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে ভয়ংকর অপরাধবোধে শীতল পাথরের মতো নীরব হয়ে যায় সে । বুঝে পায় না এখন সে কী করবে ! কিছুক্ষণের মধ্যেই মকবুল সাইকেল রেখে ভিতরে এসে হাজির হয় । রেবা সরকার বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বলে , ‘ এসো মকবুল ভাই ! বোসো । ’ 

মকবুল দরজা ঠেলে সামান্য ভিতরে এসে জানতে চায় , ‘ আমার বিবি কেমন আছে ? ‘ 

ভীষণ নীরব অফিসঘরটায় মকবুলের গলা যেন গমগম করে এতদিনের সৎ মানুষ পঞ্চাননকে বিদ্রুপ করে বেজে উঠলো । অন্তত পঞ্চাননের তেমনই মনে হলো । রেবা সরকার নির্বিকার উত্তরে বলে , ‘ তোমার বিবিকে বাঁচানো গেলেও বেবিকে বাঁচানো যায়নি মকবুল ভাই । ’  

মকবুল আশ্চর্য হয় না । খুব স্বাভাবিক গলায় বলে , ‘ সবই আল্লাহ্‌ এর ইচ্ছা সিস্টার । এতো আমার নসীব । খোদাতালার উপরে তো কারও কোন হাত নাই ! কী বলো মাস্টারদা ? ’ 

মাথা নিচু করে বসে থাকা পঞ্চানন এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলো না । মুখ তুলে মকবুলের দিকে তাকায় । নীরবে উঠে দাঁড়ায় পঞ্চানন । যেন কী করা উচিত ভেবে পায় না । 

 ‘চলো তবে মাস্টারদা । এনারা তো রইলেন । আমরা যাই বাড়ির দিকে । ’ বলে পঞ্চাননের হাত ধরে প্রায় টেনে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায় মকবুল । 

অসহায়ের মত নীরব চাহনিতেই ডঃ সরকার আর নার্স রেবা মণ্ডলকে বিদায় জানিয়ে মকবুলের সঙ্গে অফিসঘর থেকে বেরিয়ে আসে পঞ্চানন । 

তরতর করে সিঁড়ি ভেঙে নেমে যায় মকবুল । সাইকেল নিয়ে এসে অপেক্ষা করে । ধীরে ধীরে একসময় পঞ্চানন তার সাইকেলটি নিয়ে মকবুলের সামনে এসে দাঁড়ায় । মকবুল তার কাঁধে হাত রেখে জানতে চায় , ‘ আচ্ছা , মাস্টার ! তখন থেকে দেখছি তুমি কেমন মেন্তা মেড়ে আছো । মেয়ে হয়েছে । আনন্দ করো । ’ 

‘কিন্তু তুমি সব জানো না মকবুল । ’

‘তবে বলো ! কী করে জানলাম তোমার মেয়ে হয়েছে ? আমি বললাম না ! সবই ওপরওয়ালার ইচ্ছা । তাঁর কিছু কাজ সমাজের আড়ালে ঘটে । কেউ কেউ জানে । এই যেমন আমার ফোনটাই সব জানে । আর এর কোনও সাক্ষী নেই ।  তুমিও ভুলে যেও । চলো এখন বাড়ি যাই । মনে আছে তো ! কাল আমাদের ঈদ আর তোমাদের অক্ষয় তৃতীয়া ।

Comments