গল্প - অমলকৃষ্ণ রায়

ইচ্ছাপত্র

 

রামতনুবাবুর বয়সের অঙ্কটা তাঁকে সিনিয়র সিটিজেনের দলে ভিড়িয়েছে পাঁচ বছর হলো। ‘সিনিয়র সিটিজেন’ শব্দটা যেদিন হুট করে এসে তাঁর দৈনন্দিন জীবনে পরিবর্তন এনে দিল, অফিসজীবনের চরৈবেতি থেকে বের করে নিয়ে এল, সেদিন থেকে রামতনুবাবু জীবনের রুটিনটাকে নিজের মতো করে আবার সাজিয়ে নিয়েছেন। অফিসের বন্ধুদের সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে যেতে লাগল। তাই হঠাৎই বন্ধুবলয়টাই বদলে গেছে। আজকাল তিনি অফিসের সময়টাকে অন্যখাতে ব্যয় করতে শিখে গেছেন। সেটা করতে গিয়ে সকালবেলার হাঁটার সময় বাড়িয়ে দিয়েছেন। আড্ডার সময়ও বেড়েছে। তাছাড়া বাজারঘাট সেরে আজকাল খবরের কাগজে সময় বেশি দিচ্ছেন। যেসব ধরনের খবর তাঁর কাছে এতদিন একেবারেই গুরুত্বহীন মনে হতো, সেসবও সময় কাটানোর তাগিদে পড়ে নিচ্ছেন। কাগজ পড়া হয়ে গেলে ব্রেকফাষ্ট সেরে আরেকপ্রস্থ কোথাও বেরিয়ে পড়ছেন। বইয়ের দোকান, মুদির দোকান কিংবা চায়ের দোকানে খবরের কাগজের নির্যাস নিয়ে বিতর্কে মেতে থাকছেন অনেকটা সময়। একসময় ঘড়ির ঘণ্টা আর মিনিটের কাঁটা যখন গা জড়াজড়ি অবস্থায় সবচাইতে বড় অঙ্কের সংখ্যার উপরে উঠে আসে, তখন হুঁশ ফেরে রামতনুবাবুর। তড়িঘড়ি তর্কে ইতি টানেন, 

‘উঠলাম।’

‘উঠলাম মানে! কথাটাইতো শেষই হলো না।’

‘আরেকদিন হবে। চান করতে হবে, খেতে হবে।’

কোনওরকমে আসর থেকে ছিটকে বেরিয়ে ঘরে ফিরে, চান খাওয়া, বিশ্রাম সারেন। তারপর একপ্রস্থ ভাতঘুম, চাকরিজীবনে যা কোনওদিনই তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো না।

বেশ কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। সেদিন সকালবেলায় এক কাকুতুল্য অশীতিপর মানুষের একটা কথা রামতনুর মনের ভিতরটা বেশ নাড়িয়ে দিল। পুবপাড়ার হৃদয়কাকা রামতনুবাবুর বাবার ভাল বন্ধু ছিলেন। যদিও তিনি বয়সে বাবার চেয়ে বছরপাঁচেকের ছোটই হবেন। সেইসূত্রে রামতনু তাঁকে কাকু বলেই ডাকেন। মানুষটা অস্টাশি বছর বয়সে দিব্যি দুবেলা হেঁটেচলে জীবন কাটাচ্ছেন। দেখা হলেই রামতনুর সঙ্গে অনেক পুরনো কথা বলেন। বিশেষ করে রামতনুর বাবার কথা—

তোর বাবা এরকম ছিলেন, এটা করতে ভালবাসতেন, সেটা ভালবাসতেন। খুবই স্পষ্টভাসি ছিলেন। তবে তাঁর মনটা ছিল শিশুর মতো সরল। সবসময় হাসিখুশি থাকতেন। রামতনুবাবু নিজেও বাবার এসব বৈশিষ্ট্যের পক্ষে দুএকটা উদাহরণ টেনে দেন।

দিনকয়েক আগে কাকুর সঙ্গে রামতনুর ভোরবেলায় হাঁটতে বেরিয়ে দেখা হতেই তিনি আবার কিছু একটা গল্প জুড়তে যাবেন, এমন সময় এক জীবনবীমার এজেণ্ট এসে মাঝে নাক গলিয়ে দিল,

‘দাদু একটা ভাল খবর আছে।’

‘কী খবর শুনি?’

‘আশি-উর্দ্ধদের জন্য একটা নতুন পলিসি বেরিয়েছে।’

‘বলিস কী!’

‘হ্যাঁ, তবে প্রিমিয়ামটা একটু বেশি লাগবে। তবে মাত্র পাঁচ বছর পরে ভাল রিটার্ণ পাবে। এ ছাড়া মেডিক্যাল ফেসিলিটিতো পাবেই।’ শুনে হৃদয়কাকা ঠোঁট উলটালো,

‘আমার বয়সটা এখন কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে জানিস?’

‘সাতাশি হবে হয়তো, তাইতো একদিন তুমি বলেছিলে যে বছর ভারত স্বাধীন হয়েছিল, সে বছর তুমি ক্লাস সেভেনে পড়তে। জলপাইগুড়ি শহরেও ১৫ আগষ্টের দিনে পতাকা ওড়ানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। কে ওড়াবেন পতাকা? স্বাধীনতাসংগ্রামে এই শহরের বহু মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাদের মধ্যে যারা বেঁচে আছেন, তাদের মধ্যে কে সবচাইতে এই পতাকা উত্তোলনের যোগ্য উত্তরসূরী? তা নিয়ে শহরের বিদগ্ধজনের মধ্যে জল্পনা শুরু হলো। তাতে অনেকের নামই উঠে এল। তবে যে নামটা বেশির ভাগ মানুষের পছন্দের তালিকায় উঠে এল, তিনি হলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী ডা. ধীরাজমোহন সেন। ঠিক হলো, তিনিই সেদিন পতাকা উত্তোলন করবেন। উড়ালেনও। সেই পতাকা উত্তোলনের মাঠে তুমি উপস্থিত ছিলে। তখন তোমার বারো বছর বয়স। ঠিক বলিনি?’

‘একদম ঠিক। ধীরাজ জেঠু ছিলেন আমার বাবার বন্ধু। ঢাকা বিক্রমপুরের বেগাঁওএ ১৯০১ সালে জন্মালেও ১৯১৮ তে ঢাকা থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতা আর জি কর মেডিক্যালে ডাক্তারি পড়তে চলে আসেন। ১৯২৫ এ ডাক্তারি পাশ করে পাকাপাকিভাবে জলপাইগুড়ি শহরে চলে আসেন। সেখানেই ডিস্পেন্সারি খুলে ডাক্তারি পরিষেবা শুরু করেন। এর পাশাপাশি দেশসেবা ছিল তাঁর লক্ষ। তিনি ছিলেন আমাদের পারিবারিক ডাক্তার। বাড়িতে কারও কিছু হলেই ধীরাজজেঠুকে ডেকে আনা হতো।’

‘তুমি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের পতাকা উত্তোলন দেখেছ। সত্যিই তুমি ভাগ্যবান। আর তোমাকে আমি দেখছি, সেটাও আমার ভাগ্য। ইতিহাসকে ছুয়ে থাকা মানুষদের আমি ভীষণ শ্রদ্ধা করি।’

‘ইতিহাসতো বটেই। জলপাইগুড়ি শহরের বুকে প্রথম তেরঙা পতাকা উড়ানোর ঘটনাটা নিদানপক্ষে তো জলপাইগুড়ি স্বাধীনতার ইতিহাসে স্থান পাবেই।’

‘তাতো পাবেই। তাহলে তুমি একটা বীমা করে নাও। সুরক্ষা পাবে। আর আমিও কোনওদিন গর্ব করে লোককে বলতে পারব, যিনি ভারতের প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উড়াতে দেখেছেন, আমি তাকেও বীমা করিয়েছি।’

‘নারে বাবা, না। ঘাটের মরার দায় কেন বীমা কোম্পানীর কাঁধে তুলে দিবি? সত্যি কথা কী, আমি আজকাল কলাও কাঁচা কিনি না।’

’কেন বলোতো?’

’যদি ওটা পেকে যাবার আগেই মরে যাই। পাহাড়ের খাদের কিনারে এসে ঠেকেছি। বুঝতে পারছিস। বিনা নোটিশে যখন তখন পা ফসকে যাবেই।’ এজেণ্ট মহাশয় দ্বিতীয় কোনও কথা খরচ না করে বিদায় হলো। ঘরে ফিরে এসে রামতনুবাবু সেই কথাটাই ভাবছিলেন, একজন মানুষের ভবিষ্যতের প্রত্যাশা একটা জায়গায় এসে কী করে থমকে দাঁড়ায়। তখন তার কাছে বর্তমানই সব। আগামীদিনের পরিকল্পনা বলে কিছুই থাকে না। কোনওরকম ইচ্ছা, প্রত্যাশা? 

ক’দিন ধরে রামতনুবাবুর ভিতরে এ নিয়ে একটা তোলপাড় চলছে। তাঁরও একদিন বয়স হবে। সেও তখন নিজেকে হৃদয় কাকার মতো জীবনপাহাড়ের খাদের কিনারায় দাঁড়ানোর মতো অবস্থায় মনে করবে। তারপর বিনা নোটিশে একদিন এই পৃথিবীতে কোনওরকম প্রত্যাশা অপূর্ণ না রেখে বিদায় নেবে। কিন্তু কিছুই কি প্রত্যাশা থাকবে না, যা মৃত্যুর পরে হোক, সেটা তিনি চান।  তাহলে কি এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ ইহলোক ত্যাগ করার সময় কোনওরকম ইচ্ছাপত্র রেখে যান না? পরবর্তী প্রজন্ম এবং শুভানুধ্যায়ীদের কাছে কোনওরকম মরণোত্তর নির্দেশপত্র বা বার্তা রেখে যান না?

সেসব জানতেই রামতনুবাবু কিছু পৃথিবীর বিখ্যাত মানুষজনের জীবনের শেষ ইচ্ছা সম্পর্কিত কিছু বইপত্র ঘাটতে শুরু করলেন। প্রথমেই তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মরণোত্তর ভাবনা কী ছিল জানতে চেষ্টা করলেন। বিশ্বকবি এ ব্যাপারে লিখেছেন—– তখন স্মরিতে যদি হয় মন/তবে তুমি এসো হেথা নিভৃত ছায়ায়/সেথা এই চৈত্রের শালবন। 

রামতনু কবিতা ভাল বোঝেন না। তবে বিশ্বকবির এই ক’টা ছত্র বুঝতে কোনও অসুবিধে হয়নি। সামান্য কয়েকটা শব্দবন্ধের মাধ্যমে তিনি তাঁর অগণিত ভক্তবৃন্দদেরকে কথা দিলেন, যখন তিনি এই পৃথিবীতে থাকবেন না, তখন শালবনের শুকনো ঝরাপাতার মধ্যে তিনি বিলীন হয়ে থাকবেন। কেউ যদি তাঁর মরণোত্তর অস্তিত্ব অনুভব করতে চায়, তাহলে সেখানেই যেতে হবে। শালবনের শুকনো পাতার উপর হেঁটে গেলে যে মর্মর ধ্বনি শোনা যাবে, সে ধ্বনির মধ্যেই তাঁর ইহজগতের না-বলা কথাগুলো শোনা যাবে। যে কথাগুলো হয়তো কলমে লিখে যেতে পারেননি, কাউকে বলে যেতে পারেননি। হয়তো বলার সাধ ছিল। মাথায় সাজানো কিছু সাহিত্য চিন্তা মৃত্যুদূত তাঁকে প্রকাশ করার মতো কয়েক দণ্ড সময় দিল না বলে লিখে যেতে পারেনি।

রামতনুবাবু সেটা বুঝতে পেরে একদিন কোনও এক শালবনের গভীরে গিয়ে হাজির হলেন। সারাটা দিন একা একা জঙ্গলের গা-ছমছমে পরিবেশে হেঁটে বেড়ালেন। তাঁর পায়ের পাতার চাপে যে শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি কানে আসছিল, সে ধ্বনির আড়ালে কোনও শব্দবন্ধ উচ্চারিত হচ্ছে কিনা, কান পেতে শুনতে, বুঝতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি। তাঁর এই অদ্ভূতরকমের পরীক্ষানিরীক্ষার চরম ব্যর্থতার কথা কাউকে বুঝতে না দিয়ে হতাশ হয়ে ঘরে ফিরলেন। ফিরে এসে মনকে বোঝালেন, শুকনো পাতার ভাষা না শিখতে পারলে বিশ্বকবির মরণোত্তর অস্তিত্ব অনুভব করা সম্ভব নয়। তাই বিশ্বকবির অস্তিত্ব বুঝতে না পারার পিছনে নিজের অজ্ঞতাকেই দায়ী করলেন। তার ভিতরে যদি বিন্দুমাত্র কবিত্বশক্তি থাকতো তাহলে হয়তো বুঝে নিতে পারতেন। 

এরপর রামতনুবাবু একের পর এক সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব্দের জীবনের শেষ ইচ্ছা কী ছিল জানতে চেষ্টা করলেন। ভারতবর্ষের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল রনেহেরু শেষ ইচ্ছা ছিল তাঁর মৃত্যুর পর চিতাভষ্ম যেন গঙ্গার জলে মিশে থাকে। সেটা কোনও তাঁর ধর্মীয় কিংবা আধ্যাত্মিক বাসনার কারণে নয়। তিনি শুধু গঙ্গার প্রমিতিহীন প্রবল প্রবাহেরই অংশ হয়ে থাকতে চান। 

বিশ্ববিখ্যাত জাদুকর হ্যারি হুডিনি তাঁর মৃত্যুর আগে তাঁর ইচ্ছাপত্রে লিখে গেছেন, তাঁকে যেন মৃত্যুর পরে প্ল্যানচেট করে ডাকা হয়। তিনি একটা দশ শব্দের গোপন কোড লিখে যাচ্ছেন। এর মাধ্যমে তাঁকে ডাকা হলে সে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে এসে সেই কোড উচ্চারণ করে স্ত্রীকে নিশ্চিত করবেন যে, তিনিই তাঁর স্বামী। মৃত্যু নামক বিচ্ছেদটা তাঁর কাছে অনেকটা ম্যাজিকের মতোই। জীবনে ম্যাজিকের শো দেখাতে গিয়ে কতবার তিনি কবরে সমাধিস্থ হয়ে আবার ফিরে এসেছেন। তিনি সেরকমই তিনি মৃত্যুর পরে স্ত্রীর সঙ্গে কায়া-অকায়ায় মিলে যেতে চান।

নোবেলজয়ী আইরিশ নাট্যকার জর্জ বার্ণার শ তাঁর ইচ্ছাপত্রে লিখেছেন, বিশ্বের সবচাইতে নাকউঁচু জাতির ছাব্বিশ অক্ষরের বর্ণমালার দাসত্বশৃঙ্খল মুক্ত হোক। নতুন বর্ণমালা তৈরি করুক। সে বর্ণমালা হবে চল্লিশটি অক্ষর দিয়ে। কাজটি নির্ভুলভাবে করার জন্য তিনি অর্থ রেখে যান। 

এসব তথ্য জানার পর এবার রামতনুবাবু নিজের কথা ভাবতে বসেন। তিনি কী করবেন? তিনি কি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ইচ্ছা নিয়ে কিছু পরিকল্পনা করবেন, নাকি হৃদয় কাকার মতো বর্তমানের বাইরে কিছুই ভাববেন না। যদি কিছু ইচ্ছাপত্রে লিখে যেতে চান, তো কী লিখবেন? তিনিতো আর মনিষীদের মতো এই পৃথিবীতে কোনও দাগ রেখে যাননি। সারাজীবন আত্মকেন্দ্রিক ভাবনার মধ্যেই জীবনটা স‘ৎপথে কাটিয়েছেন। ঘুষের টাকা চোখের সামনে দিয়ে উড়ে গেলেও কোনওদিন ছোবার চেষ্টা করেননি। শুধু স‘ৎপথে কী করে একটু বেশি উপার্জন করতে পারবেন, ভাল খেতে পরতে পারবেন, স্ত্রীসন্তান ভাল থাকবে সেকটাই ভেবেছেন।

হৃদয়কাকা তবুও নাহয় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের একজন সাক্ষী। নিজের চোখে ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকা উড়তে দেখেছেন। বর্তমান প্রজন্মের ঐতিহাসিকেরা জলপাইগুড়ির স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস লেখার সময় শহরে সেদিনের মাঠে কারা কারা ছিলেন, তার তালিকা লিখতে বসলে সেখানে নিশ্চিতভাবে হৃদয়কাকার নাম চলে আসবে। অর্থাৎ তিনি স্বাধীনতার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রইবেন। কিন্তু রামতনুর মতো গড়পড়তা মানুষের কী হবে? রামতনু নামে যে একজন মানুষ এই শহরে ছিলেন, সেটা কি কেউ মনে রাখবেন? মোটেও না। তিনি তো শুধু সারাজীবন নিজের সংসারের সুখ বৈভবের জন্য স্বামীর ভূমিকা, বাবার ভূমিকা এবং সরকারি কর্মীহিসেবে অফিসের কর্তব্য কর্ম ঠিকঠাক পালন করে গেছেন।

কবিত্ব শক্তি নেই বলে বিশ্বকবির মতো দু’লাইন কবিতা লিখে তার পক্ষে্ মরনোত্তর অস্তিত্বের কথা আগাম জানানো সম্ভব  নয়। প্লানচেট করে তাকে কেউ ডেকে এনে সারাজীবনের আত্মসমীক্ষণের কাঠগড়ায় দাঁড় করাক, সেটাও তিনি চান না। তার মতে, কী ভাল কাজ করেছি, কী করিনি, কী করতে পারতাম, অথচ করিনি। এসব শুনে বুঝে আর লাভ কী। তিনি তো পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন না যে, পরজন্মে সেসব শুধরে নিতে আবার জন্ম নেবেন।

হঠাৎ মনের মধ্যে একটা চিন্তা এল। অফিস চত্ত্বরে সারাটা জীবন তিনি দালালদের আনাগুনা দেখে তিতিবিরক্ত। অনেকসময় ভুল করে তাকেও কেউ কেউ ঘুষের প্রস্তাব দিয়ে ফেলত। তিনি তা হাতজোড় করে প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন। তার অবর্তমানে কেউ তার অফিসের চেয়ারের পিছনের দেওয়ালে ব্যঙ্গ করে ‘সততার প্রতীক’ লিখে রেখেছিল। তিনি সেটা না দেখার ভান করে বাকি চাকরিজীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন।

অবসর নেবার দিনও তিনি তার কিছু সহকর্মীদের ব্যাঙ্গোক্তি আড়াল থেকে শুনেছেন— আজ তাহলে আমাদের সততার প্রতীক বিদায় নিচ্ছেন। আপদ গেল! হুম, সততা। সততা দেখিয়ে কী করতে পারলেন জীবনে। সেইতো একখানা পুরনো টিনের বাড়ি। মরচে ধরেছে। চাকরিজীবনে সারাবারও মুরোদ হয়নি। নেই-নেই করেই জীবনটা কাটিয়ে দিল। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। কিন্তু এই লোকটাকে বোঝানো গেল না। 

শেষদিনেও এসব কথা শুনে রামতনুবাবু নীরবে সহকর্মীদের লোকদেখানো সম্ভর্ধনা নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। সেজন্য তার মনে একটা গোপন কষ্ট বহুদিন ধরেই ঘোরাফেরা করছিল। রামতনুবাবু এবার তার গোপন ডায়েরিটা হাতে নিয়ে তাতে গোটা গোটা অক্ষরে লিখে ফেললেন— বিএলআরও অফিসে আমার চেয়ারের ঠিক পিছনে লেখা ‘সততার প্রতীক’ শব্দবন্ধটা যেন মুছে দেওয়া হয়।

Comments

Post a Comment