চক্কর
রাসচক্রে হাত ঘুরিয়েই সুপর্নার চোখ পড়ে গেল ইন্দুদির গোলগাল হাতটার দিকে... চওড়া ফর্সা হাতে সরু পলার পাশে ঝকঝক করছে নতুন একখানা বাঁধানো শাখা...সুপর্নার সাদা হাতে নতুন ব্যাণ্ডের টাইম্যাক্স ঘড়ি আর অন্য হাতে সরু রুলি-- বাহূল্য না পসন্দ ওর সবকালেই। চেহারাতেও ওর মেদবাহূল্য না থাকলেও , স্বভাবগত গাম্ভীর্যেই স্কুলে সবাই ওকে বেশ রাশভারী বলেই জানে এবং মানে। ইন্দুদির সঙ্গে বন্ধুত্বটা প্রায় ইন্দুদির উৎসাহেই তৈরি হয়েছে বলা যায়।
ইন্দুদির মুখটা বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে। সুর্পনা বোঝার চেষ্টা করতে করতেই ভারি গলায় ইন্দিরা দি বললো,'মেলা ঘুরবি তো তাড়াতাড়ি কর্। ' এখন মেলা কোথায়? 'ধুর, বসেনি কিচ্ছু... ' এজন্যই তো বলি পাকাচুলের আদর করতে শেখ্.. শুরু আর ভাঙা এই দুই সময়েই তো কেনাকাটি করে সুখ!' 'হ্যাঁ, হ্যাঁ তোমার কেনাকাটা তো জানাই আছে আমার.. দশটা দেখবে তবু, একটা কিনবে না! 'ওই দ্যাখো, এখনই সব কিনবো?! দরদাম করবো না.. ঘোরাঘুরি করবো না? কী যে বলে মেয়েটা!! " সুপর্না হাসে, বলে,' হ্যাঁ এই তো কদিন চলবে.. এ তোমার টাইম পাস এখন।' ইন্দুদিও হাসে.. একটু জোলো হাসি, বলে.. 'এতো তাড়াতাড়ি কী করবো বাড়ি গিয়ে বল্? সংসার আছে কী নাই মাঝেমাঝে বুঝি না "!তারপর যেন সব ঝেড়ে ফেলছে এমনভাবে বলে 'তোরই বা কী এমন রাজকার্য আছে রে? বিয়ে তো করলি না... সেদিনও স্কুলের দীনুদা অত ভালো সম্বন্ধটা নিয়ে আসলো?! না করে দিলি.. কী যে আছে রে তোর মনে তুইই জানিস!..এরপর পরীক্ষা শুরু হবে.. ফিরতে ফিরতে তিনটে হবে তখন আর হয়েছে মেলা ঘোরা! ", অন্যমণস্ক সুপর্নার বারবার চোখ চলে যায় শাঁখা বাঁধানোর দিকে। বলি, বলি করে বলা আর হয় না। ইন্দুদি পাপোশ কিনতে গিয়ে দরদাম করে, পিতলের হাঁড়ি কলসি দেখতে দেখতে দোকানদার আর তার বৌয়ের সঙ্গে গল্প করে... সুপর্নার মনে খেলা করে নানা রকম প্রশ্ন। কিছুই বলা হয় না। "উলের দোকানগুলো একবার দেখবি নাকি রে সুপু? " ইন্দিরাদি এবার ঠেলা দেয়..."শীতকাল এলো নাকি ও সুপর্না?কী এতো ভাবছিস বল্ তো?সুপর্না এবার শব্দ করে হেসে এবার বলে " চলো।" পারোও গো ইন্দিরাদি... শাঁখা বাাঁধালে নতুন?
একটু ইতস্তত করে, ধরা ধরা গলায় ইন্দিরা বলে," নারে, এতো সেই গতবারের রে ...তপু যেবার চাকরি পেলো... তখনই করিয়েছিলাম.. পরা হয় না... একটা গয়না ছাড়া এখন এ আর আর কী?" সুপর্নার বলতে ইচ্ছে হয়, তা সব ছেড়ে এ গয়নাই বানাতে হলো তোমার? কিন্তু, বলতে পারলো না। আড়চোখে সে দেখলো একদা সমাজ বিজ্ঞানের এক তুখোড় ছাত্রীকে.. ঘটনাচক্রে, গত দুদিন আগে কমনরুমে তিনি বিয়ের অসারতা নিয়ে বাছাবাছা জ্ঞান ঝেড়েছেন.. । আবার সুপর্ণাকে সবসময় বিয়ে নিয়ে জোর করেন। আর এখন নিজের কথা বলতেই অস্থির হয়ে আছেন ইন্দিরা দি।
প্রসঙ্গ পাল্টাতে চেয়ে সুপর্ণা বলে তপু র চাকরি কেমন চলছে? ইন্দিরা দি যেন এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেন সেকথা... "তপু কী চাকরি করার লোক? তুই জানিস না! ঘরে বসে আছে তিন মাস.." সেকী! " মশলার কৌটো থেকে অল্প মশলা মুখে ফেলে কৌটোটা সুপর্ণার দিকে এগিয়ে দিয়ে ইন্দিরা বলেন, "হূমম.. কালসাপ বুজলি কালসাপ.. ওদিকে আবার জাত ঢোঁড়ার বাচ্চা... এদিক নাই ওদিক আছে। ফুটানি কী কম? সেসব জোগান দেয় কে? এই মা মাগী আছে না.." .জোর গলার আওয়াজ টা বড্ড কানে বাজছিল। চাপা দিতেই যেন, সুপর্ণা বলে, "সংসারের কাজ মানে বাজার টাজার এগুলো তো ওকে বললেই পারো...'ইন্দিরা থেমে থেমে বলে, "বলতে পারি না রে, কী পেলো ছেলেটা বল্.. জন্মের পর থেকে তো বাপ কী জানালো না.. আর অপুকে দেখ ..কতো যত্ন তার.. কম করেছি নাকি তার জন্য... কোনো কোনো তার রাতে খাওয়ার মর্জি হতো না... কত বড় অবধি , ভোররাতে তার খিদে পেতো... সেই রাতে কাঠের উনান জ্বালিয়ে রান্নার জোগাড় করতে হতো... জ্বর জারি হলে তো আর কথাই নেই! যা জ্বালান জ্বালিয়েছে বজ্জাতগুলো.. আর ঐ ধাড়ি বজ্জাত দুটো... হাড়জ্বালানি মা আর মেয়ে.. না মেয়েটাকে বিয়ে দিল না আমাকে সংসার করতে দিল... তাড়িয়ে ছাড়ল আমাকে ঐ বাড়ি থেকে...!!"
ইন্দিরাদি হঠাৎ যেন কনফেসন পয়েন্টে গিয়ে কথা বলছে , সুপর্ণা যেন নির্জন রাস্তার সেই গাছটা যেখানে গিয়ে বলা যায় সব কথা ;এমনি হড়হড় করে কথা উগড়ে দিচ্ছে ইন্দিরা দি।সুপর্ণা খুব ধীরে ধীরে বললো, যেন নিজেকেই বলছে , 'নতুন করে আবার শুরু করা যায় না?' বলতেই যেন তেলে ফোড়ন পড়ে... হৈ হৈ করে ইন্দিরাদি বলে",পাগল !! শুরু করবো মানে কী?সে তো ন্যাকাকার্তিক .. দুইপাশে কলাগাছ, মধ্যিখানে মহারাজ!! না,না মাঝখানে ভ্যাবলাকান্ত ন্যাকাবজ্জাত.. সারা দুনিয়া জানে তিনি খুব সজ্জন.. খুব বিদ্বান.. আর আমি জানি কতটা শয়তান সে..." থামিয়ে দিয়েই সুপর্ণা বলে", দাদা কিন্তু এসেছিলেন!" হ্যাঁ, আসবেই তো .. শোন্ তাহলে আসল কথা, সামনেই অপুর বিয়ে দেবে ওরা... লোকজন কে দেখাতে হবে না কত ভালো মানুষ তিনি.. কেমন নিষ্কলঙ্ক!! তাই, বোঝা পড়া চাইছে..." ভালো তো! শাশুড়ি হচ্ছো! " আরে, মর্, শাশুড়ির নিকুচি করেছে! " কিন্তু, অপুও তো তোমারই ছেলে! ""হোকগে, ছেলে! সে আমাকে মা বলে মানে , ঐ বাড়ি তে বড় হয়েছে .. সে একখান্ তৈরি ছেলে.. পেয়েছেও অনেক .. সারাজীবনভর.. আর,আমার তপু কী পেলো বল্?ওকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করলে আমি এবার কোর্টে যাবো.. বলে দিলাম দেখিস। " ' কী অদ্ভুত হঠাৎ আসছে কেনো সব কথা? " তুই চিনিস না ওদের , এসব আমাকে জব্দ করার তাল.. সব তপুকে ফাঁকি দেওয়ার মতলব।..এর পরে অপুর ছেলেপেলে হবে ,আর তারপর সব অপুর হবে...! তপু কী পাবে তা'লে?ক'দিন যাক আমিও তপুর বিয়ে দেবো।" "কিন্তু, তপু কী করে? মানে, তপু তো এখনো... তেমন..." " করে না তো কিছু? করবে.. আমি ব্যবস্থা করে দেবো.. না হলে আমি খাওয়াব.. আমাকে টেক্কা দেবে.. অতো সোজা।"
সুপর্না এবার হেসে ফেলে... ' কী অদ্ভুত ইন্দুদি!! তুমি বলো যে সংসার করোনা .. তাহলে এটা কী চক্কর?' হো হো করে হাসে, এককালের গোল্ড মেডেলিস্ট সমাজতত্ত্বের তুখোড় ছাত্রী ইন্দিরা ব্যানার্জী, বলে, " খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি.. দেখবি এবার চিরকাল গোল খাওয়া ইন্দুদি বাপ ছেলেকে কেমন ঘোল খাওয়ায়! সারাজীবনে অনেক ছেড়েছি.. এবার সব সুদে আসলে বুঝে নেবো! ডিভোর্স যেমন দিই নি... এবার বুঝে নেবো সব..." "ফিরে যাবে?" "পাগল! কী পেয়েছি সারাজীবনে, যে, শেষ জীবনে সেবা করার দায় নেবো.. "" তবে, তপুর অধিকার আমি ছাড়বো না... আমাকে তাড়ালে কী হবে, তপুকে সরাতে পারবে না। প্রেস্টিজে ওদের গ্যামাক্সিন না দিয়েছি তো!...
আরো কতো কী বলে ইন্দিরা দি... বলে, বলতেই থাকে... কতৌ কী... এলোমেলো হাবিজাবি, অযৌক্তিক... !! যেন ডুবে যেতে একটা মানুষ যা পাচ্ছে তাই ধরে তীরে উঠতে চাইছে.. , যুদ্ধ ক্ষেত্রে একা একাই লড়ছে প্রায় উন্মাদ একটা মানুষ! সুপর্ণার মনে হয় ইন্দিরাদি কী পাগল হয়ে যাবে?
ফেরার পথে ওরা দেখে রাসচক্র আপাতত স্থির ... । ইন্দিরা দি ভাঙা আর শুরুর মেলায় বাজিমাত করতে চেয়ছিল... পারেনি। শেষের একটা মোক্ষম চাল দিয়ে জিততে চাইছে.. অথচ কোনো লাভ নেই নিজেও জানে ভালো করেই। অদ্ভুত গোলকধাঁধায় পাক খায় জীবন... হায় রে! কী এক চক্র ঘিরে দিনরাত কেমন ঘোরে ফেরে এ জীবন!!!
খুব ভালো লাগলো
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো
ReplyDeleteশ্যামলী সেনগুপ্ত
জীবনের একটি অন্যতম আলোচিত বিষয়ে আলোকপাত, খুব ভালো লাগল।
ReplyDeleteখুব সুন্দর।
ReplyDelete