গল্প - সুনৃতা মাইতি


আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন...


পাশে বসে থাকা দীর্ঘদেহী অতি সুদর্শন ভদ্রলোকের দিকে বারে বারে চোখ চলে যাচ্ছিল আমার। অতি উজ্জ্বল তার গাত্রবর্ণ। এটা ঠিক কোন জায়গা বুঝতে পারছি না আমি। কেন সেটা জানিনা। অনেকদিনের অনভ্যাসে হবে। জলপাইগুড়ি ছেড়েছি বহুদিন। একসময় হাতের তালুর মত চিনতাম এর প্রতি আনাচ কানাচ। তিস্তার পারে সন্ধ্যা নেমে আসছে চুপিচুপি। একটা নির্জন জায়গা দেখে বসে আছি অনেকক্ষণ ধরে। হঠাৎ দেখি ওই ভদ্রলোকটিকে।  নিভন্ত মৃদু আলোর প্রভাবে এক অপার্থিব আবহ চারিদিকে। নেশার প্রভাবে আমার মাথাটা হাল্কা ফুরফুরে। তবে নেশা পুরোদস্তুর গ্রাস করতে পারেনা আজকাল আমায়। ঝানু নেশারু এখন আমি। তিস্তার সাথে আমার কি সম্পর্ক তা বোঝানোর জন্য ভাষা অপ্রতুল আমার কাছে। এই জলপ্রবাহের কাছে কিভাবে যেন বাঁধা পড়ে আছে আমার চেতন আর অবচেতন। অযুক্তা এটা কখনও বুঝবে না।  বহুকাল আগে কিশোর বয়সে নেশাতুর অবস্থায়  তিস্তার পারে এসে যখন বসতাম জল থেকে গুটি গুটি পায়ে একটি কিশোরী এসে বসত আমার পাশে। তারপর তারাভরা জলশহরের আকাশকে সামিয়ানা করে নদীর পারে শুয়ে আমরা দুজন অলৌকিক কোনও জগতের নিবাসী হতাম। তাকে আমি স্পষ্ট দেখিনি কখনো। সম্পুর্ণ  কল্পনা করতে পারতাম না তার অনিন্দ্যকান্তি অবয়ব। সারাজীবন আমি তাকেই খুঁজে গেছি অনবরত। অযুক্তা কি করে জানবে তা! অযুক্তা অতি সাধারণ । একটি কেঠো আর কেজো স্বভাবের মেয়ে।  উফ্, আমি ভুলতে চাই ওকে। সত্যিই ভুলতে চাই।


আমি এই মুহূর্তে সত্যিই অযুক্তার কথা ভাবতে চাইছি না । বিরক্ত লাগছে আমার। তবু বার বার কেন যেন অযুক্তার ডাগর চোখদুটি কেবল উঁকি মারছে মনগহনে।


পথিক তুমি কি নেশা করিয়াছ? 


পাশে বসা ভদ্রলোকটি হঠাৎ মৃদুস্বরে বলে ওঠেন।


না না...ওটা হবে "পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ"? হ্যাঁ , আমি পথ হারাই আর ফিরে আসি তিস্তার পারে।কিন্তু  আপনি কে হে বিদেশী আগুন্তুক?


 বলেই দিক কাঁপিয়ে হেসে উঠি আমি। 


সুদর্শন ভদ্রলোক সন্ধ্যার মৃদু ছায়ার আবরণ গায়ে জড়িয়ে মৃদু হাসলেন মনে হল। তারপর অস্ফুট স্বরে বল্লেন...



সেরকম নিপাট বিদেশী তো নই আমি। এখানে সবাই খুব ভালো চেনে আমায়। বিবাহ করেছি এখানকারই এক কন্যাকে। বাই প্রফেশন আই অ্যাম অ্যান ইনজিনিয়ার।


তা হবে। এখন জলশহরে নতুন সব কেউকেটা মানুষের ঢল নেমেছে। তাদেরই কেউ হবেন ইনি। ভাবি আমি।


আমি দক্ষিনবঙ্গেও ছিলাম একসময়। শিবপুর ইনজিনিয়ারিং কলেজে পড়েছি। 


আবার বলে ওঠেন ভদ্রলোক।


অযুক্তার কলেজের পোড়ো! যা ব্বাবা! ধুস্, আবার সেই অযুক্তা! আসলে ওর কথা আমার ওঠাতে ভালো লাগেনা। জানি  ঔচিত্য অনৌচিত্যের বিচারে সেটা ধোপে টেকেনা। কারণ অযুক্তা আমার স্ত্রী। আর অযুক্তা বার বার চেষ্টা করে। আমাকে তার চেনা পথে ফিরিয়ে নিতে। সেই কলেজের সময় থেকে অযুক্তা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু  আমার পক্ষে যদি থিতু হওয়া সম্ভব না হয় তবে আমি কি করতে পারি! আমি নারীপ্রিয়  আর সৌন্দর্যপিপাসু এক মানুষ। সৌন্দর্যের লেলিহান শিখা দেখতে পেলেই আমি পতঙ্গের মতো সেদিকে ছুটে যাই।বার বার তাতে ঝাঁপ দিই। আমার কাজের সূত্রে আমি সর্বদা সৌন্দর্য পরিবৃত হয়ে থাকি। যদি খুব প্রচলিত ভাষায় বলতে হয় তা হলে বলা যেতে পারে ফিল্ম লাইনে আছি আমি।  ছোট শহরের ছেলে হয়েও এই গন্ডীর বাইরের জীবন আমি বেছে নিলাম কেন তা ঠিক গুছিয়ে বলতে পারব না। তবে কলকাতায় পড়তে আসার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল সিনেমার প্রবহমান ফ্রেমওয়ার্কই আমার কাজের পরিসর হওয়া উচিৎ । তারপর এল অযুক্তা। অগাধ প্রেম, স্নেহ , বন্ধুত্ব আর বটের মত নিশ্চিত এক ছায়া নিয়ে। ওর জন্য আমাকে পেটের ভাতের কথা ভাবতে হয়নি কোনওদিন।



কিন্তু  অযুক্তাকে আমার আর ভালো লাগেনা। কেন! সেটা খুব স্পষ্ট নয় কারণ ভালো লাগার আর না লাগার কোনও সরলরৈখিক নিয়ম নেই। তবে একটা আঢপৌরে শাড়ির মত ঝ্যালঝেলে আর পুরোনো হয়ে গেছে অযুক্তা। তার ওপর এখন বোধহয়  আমার ওপর সে তিতিবিরক্ত। ভয়ানক অশান্তি হতে চলছে আমাদের সংসারে। এবার বোধহয় বিয়েটা আর টেঁকানো যাবেনা। সন্তানও নেই আমাদের যে কোনও বাঁধন টিকিয়ে রাখবে। সে যাক তো! অযুক্তা নিপাত যাক। নবপরিচিত মানুষটির দিকে তাকিয়ে আমি বলে উঠি...


তাহলে স্হপতি আপনি?


মানুষটি মাথা নাড়ায়। তারপর বিষন্ন গলায় বলে... 


না বেশিদিন সে কাজ করতে পারিনি। জলঢাকা আর জয়ন্তীতে পূর্তদপ্তরের সাথে হাত মিলিয়ে কাজ কিছু  করেছিলাম বটে। তারপর ব্যবসায় নামলাম। 


এখানে এসে বসেন বুঝি প্রায়ই? আমি শুধোই...


হ্যাঁ ...প্রতিদিন বসি। ঐ পিশাচিনী ঐ ডাকিনী তিস্তার সাথে আমার বৈরিতা।


কেন...কেন...তিস্তা তো আশ্রয়...প্রেয়সী আর প্রেরণা...আমি জোর গলায় প্রতিবাদ জানাই।


না...না...ও তো স্বৈরিণী..যখন যাকে খুশি গ্রাস করে নেয়। নারী ,শিশু কিংবা জনপদ। কাউকে রেহাই দেয় না। যেমন আমার প্রেয়সীকে খেয়ে নিল...আমি তাই ঢেউ গুনি আর .....



ঢেউ কোথায়...নদীতো ক্ষীনাঙ্গীএক অবলা নারীর মতো হয়ে আছে এখন...এই কার্তিকের  প্রহরে...আমি হেসে উঠে বলি।

 


আমার অন্যরকম কথা শুনতে পাশের মানুষটির ভালো লাগছে না আমি বুঝতে পারছি একটু একটু। কিন্তু  অন্ধকারে তার মুখের ভাবটি পড়তে পারি না। কোথা থেকে একটা লম্বাটে বন্দুক হাতে নিয়ে লোকটি আমার দিকে তাক করে আর অদ্ভুতভাবে হেসে ওঠে। পাগল নাকি! কিন্তু  আমার ভারী অস্বস্তি লাগতে শুরু করে। শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যায় ঠাণ্ডা স্রোত। মৃন্ময়দা বলেছিল দেখে শুনে জায়গা বুঝে বসতে। তিস্তার পার এখন আর খুব একটা নিরাপদ নেই। পরক্ষনেই দেখি, না, আমার দিকে নয়। আমি ভুল বুঝেছি। লোকটি জলের দিকে তাক করে গুলি ছুড়ছে আর বিড়বিড় করছে, ফার্স্ট ওয়েভ...সেকেন্ড ওয়েভ...থার্ড ওয়েভ। সেটা দেখতে  দেখতেই আমার কিরকম একটা ঘোর লাগতে থাকে। চোখে অন্ধকার নেমে আসে আমার আর আমি পড়ে যেতে থাকি এক সুগভীর মহাশূণ্যের গহীন ফাটলে। সেসময় একটাই নাম মনে পড়ছিল কেবল। অযুক্তা। আর একটি শক্তপোক্ত হাতের ছবি। যা শত পরিশ্রমেও ক্লান্ত হয়না।  আর আমার যখন চোখ খুলল তখন দেখি সেই অতি পরিচিত  মুখ । অযুক্তা। চোখদুটো ফুলোফুলো আর লাল। বেদম কান্নাকাটি করেছে হবে।


তুই কিং সাহেবের ঘাটে কি করতে গিয়েছিলি রে? ওখান থেকে অচৈতন্য অবস্থায় তোকে তুলে এনেছে ত্রিদিবদাদের গ্রুপটা। কিছুই হলো না। শুধুমুদু বৌদিকে কাজে গুলি মেরে বাগডোগরার ইমিডিয়েট ফ্লাইট ধরে হাচোঁড়পাচোড় করে আসতে হলো। তুই কি ভদ্রমহিলাকে একটুও শান্তি দিবিনা?


 বলে পাশে দাড়ানো শ্রবণ একটা অদ্ভুত মুখভঙ্গী করল। অযুক্তা চোখ দিয়ে কি একটা ইশারা করছে শ্রবণকে। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম। বোধহয় এখন এসব কথা বলতে বারণ করছে।



অযুক্তার সাথে কলকাতায় ফিরে এসেছি।  বাধ্য আর পোষ্য প্রাণীর মতই আছি। অযুক্তাও দেখি অনেক নরম । তবে শিবপুর কলেজের ওই রহস্যময় স্হপতির ব্যাপারে কূলকিনারা করতে পারিনি। কাউকে বলিনি ঘটনাটার কথা। বন্ধুদের তো নয়ই। এসব শুনলেই বলবে, " বয়স হচ্ছে তোর। নেশাটেশা আর স্যুট করেনা।" একদিন সুযোগ বুঝে  জলপাইগুড়ির বিশেষ পরিচিত ভানুদাকে ফোন করলাম একদিন। ভানুদা কলকাতায় বহুবছর আছেন কর্মসূত্রে।  আই টি সিতে উচ্চপদে কাজ করেন । সাথে অনেকরকমের লেখালেখি করেন । সবই প্রকাশিত হয় নামী- বেনামী নানা পত্র- পত্রিকায় । সিটি সেন্টারের উল্টোদিকে লোফারস ক্যাফেতে দুটো ক্যাপুচিনো নিয়ে বসলাম দুজনে মুখোমুখি। আমার সে রাতের অভিজ্ঞতা শুনে ভানুদা কফির কাপে চুমুক দিতে ভুলে গেছেন দেখি। শুকনো গলায় বল্লেন...



অভি! তুই কিং সাহেবকে দেখিস নি তো! তিস্তার জলে ডুবে মারা যায় ওর এদেশীয় আদিবাসী কালো স্ত্রী। তারপর স্ত্রীর শোকে পাগলপারা কিং সাহেব একটা দোনলা বন্দুক নিয়ে নদীর ঘাটের কাছে বসে থাকতেন অবিরত। নদীর ঢেউ গুনতেন আর প্রতিটি ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে বন্দুকের গুলি ছুঁড়তেন। হ্যাঁ রে অভি, তুই কী কী বই পড়ছিস আজকাল বল তো? আর কী কী নেশা করছিস?


নেশায় আমি চোস্ত ভানুদা। সেটা না। বই খুব একটা পড়া হয়না এখন। তবে জলপাইগুড়ির ওপর কয়েকটা ডকুমেন্টারি দেখেছি ওখানে গিয়ে। আচ্ছা , কিং সাহেব কী করতেন গো?


যতদূর জানি পাটোয়ারী ছিলেন। পাটের গোলা ছিল তার। আর স্ত্রীকে ভয়ানক ভালোবাসতেন। তার অকালমৃত্যু মেনে নিতে পারেন নি।


তাহলে শিবপুরের ইনজিনিয়ারটা কে? 


ভানুদা আমাকে চুপ করবার ইশারা করে কাকে যেন ফোন লাগালেন। তারপর বেশ কিছু  কথাবার্তার পর ঢোক গিলে বললেন...


হ্যাঁ রে অভি , ১৯১৫ সালের দিকে শিবপুরের প্রথমদিকের ছাত্রদের মধ্যে এরকম একটা নাম পাওয়া যায় বটে। এইচ এ কিং। যিনি পরে ডুয়ার্সে গিয়ে পাটের ব্যবসা শুরু  করেন।


আমার আবার কেমন যেন লাগতে শুরু  করে শরীরটা। অমনি অযুক্তাকে একটা ফোন করতে ইচ্ছে হয়।

Comments