বই কথা - মাধবী দাস


কবি সুবীর সরকারের  
'বায়োপিকে'র নিবিড়পাঠ


বায়োপিকের বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায় জীবনীচিত্র। বায়োপিকে ছেয়ে গেছে হলিউড থেকে বলি, টলি, ঢালিউডের মতো বিভিন্ন ভাষার সিনেমা জগৎ। সাহিত্যে এই ধারাটি আত্মজীবনীমূলক। তবে তা গদ্যেই রচিত হয় মূলত। মন্ময় কবিতা মাত্রই কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ভাবনা-চিন্তা এবং বহির্গত অনুভূতি। বিশেষ প্রেক্ষিতে যে কোনও একটি সূত্রকে ঘিরে কবির আনন্দ বেদনা যখন প্রকাশের ভাষা পায় তখন একটি কবিতার জন্ম হয়। "Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings" কবি সুবীর সরকার (সুবীরদার) কাব্যগ্রন্থ 'বায়োপিক' এতবড় ভূমিকা লিখিয়ে নিল। কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতাটি এমন ঘোরের মধ্যে নিয়ে গেছে আমাকে, আমি পাঠকের অনুমতি চেয়ে শেষ থেকে শুরুর দিকে হাঁটা শুরু করলাম! কবি লিখেছেন - 'দুধে ভেজানো চিতই পিঠে/ পাটিসাপটা,মুগের পুলি/চা বাগানের গ্রাম,খড়ের চালের ওপর পৌষ-মাঘের শিশির/আমি ঘুরে বেড়াতাম গো-রাখালের সাথে/সাইকেল-পথে মাইল মাইল/ দুপুর গড়াতেই শীত নামে / হ্যারিকেনের আলোর মায়ায় মা তখন রান্নাঘরে' এই যে বাংলার চিরকালের পটচিত্র, কবির আর আত্মগত থাকে না। হয়ে ওঠে সাধারণের। এখানেই কবির পরিণত হয়ে ওঠা। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের কবিতাযাপন কবিকে এভাবেই অন্যদের থেকে বিশিষ্ট করে তোলে।


কবি সুবীর সরকারের কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য elimination. খণ্ডখণ্ড কথার ভাঁজ দিয়ে অখণ্ড ভাব ফুটিয়ে তোলা। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় যেন সংক্ষেপে কাজ সারতে চাইছেন, আসলে এই ভাবেই তিনি কবিতাকে রহস্যে মুড়ে রেখে শ্রীমণ্ডিত করে তোলার পথ বেছে নিয়েছেন। অত্যন্ত সুন্দর একটি উদাহরণ মনে পড়ল- 'ইঁদুরের গর্ত থেকে কাহিনি বের করে আনি/উঠোনে ছড়িয়ে থাকা স্মৃতি/কথারা ভিড় জমাচ্ছে গাছের ছায়ায়'(কাহিনি)। এ কবির জীবন জুড়ে লোকসংস্কৃতি। যারা সুবীরদার খুব কাছে এসেছেন, তাঁরা একবাক্যে স্বীকার করবেন কী অপরূপ ভাবে স্মৃতি থেকে ইতিহাস ধরে ধরে গড়গড়িয়ে বলতে থাকেন বাংলার বিভিন্ন লোকগানের পঙক্তি। হাতের মুঠোয় উত্তরবাংলার লোকজীবন। বাউদিয়ার মতো ঘুরে বেড়ান উত্তরের আনাচকানাচ। তারই প্রতিফলন রয়েছে এই বইয়ের বিভিন্ন কবিতায়।- 'হরিপদ বলে চলেছেন পদ্মবিলের কথা/তাঁর বন্ধ চোখের ভেতর বাইচের নাও/ হরিপদ শোনাচ্ছেন জোতজমির কথা /রতিকান্ত দেউনিয়ার কবেকার সেই মাকনা হাতি/গোপন সিন্দুকে রাখা চিরুনি/ অথচ আমি তোমার দিকে আর তাকাতে পারি না'( চিরুনি) । মাটির মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালবাসেন কবি, মাটির কথাই তাই কলম জুড়ে- এই পড়ন্ত রোদের ভিতর ফিরে আসতে হয়/ঘুম পাড়িয়ে দেবে মাঠের যাদু/ চাষপদ্ধতি বদলে গেলে ইতিহাসটি এসে পড়ে, নিম্নবর্গীয়' কল্পনা আর বাস্তব মিলেই সাহিত্য । কিন্তু সমাজবাস্তবতাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন না বলেই তীব্রতর ঘোরের মধ্যে ভালবাসাকে পেতে চেয়েও, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার কথাই বলেন - ' বলেছিলে, আমাকে হাঁসমিছিল দেখাবে / একজোড়া চোখের চাপে আজ পুড়ে যাচ্ছি আমি/ সবকিছু তো আর মুখে বলা যায় না!/দূর থেকেই তোমার মোম মাখা আঙুল দেখি' এখানে মোমমাখা আঙুল কী কোনও বাস্তবের নারীর না কাব্যলক্ষ্মীর তা কিন্তু কবি খোলসা করলেন না। এই elimination টাই কবিতার প্রাণ। এত রহস্যময়তার মধ্যেও এই কাব্যগ্রন্থের এমন অনেক পঙক্তি পাঠককে ভালো লাগায়। কবিতাকে সাংবাদিকতার সারল্য থেকে দূরে সরিয়ে আনে।


অসাধারণ প্রচ্ছদ করেছেন সাকিল মাসুদ। প্রকাশক, মাসুদ রানা সাকিল, আইডিয়া প্রকাশন, রংপুর, বাংলাদেশ, মূলত ২০০ টাকা

Comments

  1. সুব্রত ভট্টাচার্যJune 28, 2022 at 4:34 PM

    সুন্দর কবিতার লাইন গুলি আর তার বিশ্লেষণ l

    ReplyDelete
  2. সুন্দর বিশ্লষণ । দারুণ লাগল ।

    ReplyDelete

Post a Comment