গল্প - মৃণ্ময় সাহা


অর্জিত ছুটি( Earned leave)                 


ব্লু টুথ স্পিকারে মাঝারি আওয়াজে বেজে চলছে '  তেরে নয়না তালাশ করকে' ---। তার মানে আজ কর্তার মন বেশ ভালো।30 বছর ঘর করার পর মানসী এসব ভালো করেই জানে।নিত্য দিন রবীন্দ্র সংগীত বা নজরুল সঙ্গীত দিয়ে শুরু হলেও বিশেষ বিশেষ দিনে মান্না দে আবির্ভূত হন।54 বছরের মৃদুল এর মনে হঠাৎ এমন সুখানুভূতি মানসী কে ভাবিয়ে তুললো।এমন খুশির আবহ সেই 26 বছর আগে ছেলের জন্ম মুহূর্তে লক্ষ্য করেছিল।তারপর আজ।মাঝের সময়ে ক্ষণিক আনন্দ ,তাৎক্ষণিক রাগ আর মধ্যবিত্ত  এর টানাপোড়নে কেটে গেছে।এমন অনাবিল আনন্দ সত্যিই দুর্লভ।


চা,জলখাবার বানাতে বানাতে মানসী ফিরে গেলো অতীতে।সেই 30 বছর আগের দিন গুলি তার সামনে ভেসে উঠলো।মৃদুল যেদিন কনে দেখার জন্য এলো সেদিন দরজার ফাঁক দিয়ে মৃদুল কে দেখার রোমাঞ্চ কেন জানি না ফিরে পেলো।তারপর শুভ দৃষ্টি,ফুলসজ্জা সবই মনে পড়তে শুরু করলো।মনে পড়লো তাদের প্রথম সন্তান যেদিন পৃথিবীর আলো দেখতে পেলো না, বিকলাঙ্গতা এর কারণে তাকে বর্জন করার মুহূর্তে মৃদুল এর সেই কান্না।সেদিন পাশে থেকে তাকেই তো সামলাতে হয়েছিল সেই ঝড়।কারণ মৃদুল বরাবরই একটু ইমোশনাল আর মানসী বাস্তবমুখী।


বিনা বি ,এড এর গ্রাজুয়েট শিক্ষক মৃদুল ছেলে কে মানুষ করেছে নিজেই আদর্শেই। সততা আর নিষ্ঠা মিলে এক সহজ সরল জীবন ওর।কিন্তু ছেলে হয়েছে মায়ের মত।ভীষণ বাস্তববাদী আর চাপা।মনের কথা মনেই লুকিয়ে রাখে। মধ্য মেধার যুবক দের এ সমাজে টিকে থাকা খুব মুস্কিল সেটা ও ভালই জানে।বেকার শুধু এই কারণে ওর নির্ভেজাল প্রেম কবেই পালিয়েছে।সেই দুঃখ চেপে রেখে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল একটা চাকরি জোগাড় করার।কারণ ও জানে অতি সাধারণ একটা ব্যবসা করার প্রয়োজনীয় মূলধন জোগাড় করাও সম্ভব নয়।


ইদানিং মৃদুল এর সাস্থ্য ভালো যাচ্ছে না।খুব সামান্য পরিশ্রমেই হাপিয়ে যাচ্ছে।সে ভাবে খিদেই পায় না।সব সময় তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব।দুজনের জেদে শেষে ডাক্তার  দেখলেন।ডাক্তার দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ করে শেষ করে বেশ কিছু পরীক্ষা দিলেন।যেগুলো সুদূর কলকাতা থেকে করাতে হবে।নমুনা পাঠিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।


কই গো তুমি কোথায়? আমি আজ স্কুল যাচ্ছি না।কিছু জরুরী কাজ নিয়ে বের হলাম ডি, আই অফিসে।মৃদুল হাক দিয়ে বললো।সে জানে এই আগামী তিন ঘণ্টা গিন্নির ধারে কাছে যাওয়া আর এভারেস্ট জয় সমতুল্য। যাওয়ার সময় ছেলে কে বললো মাকে বলিস ঠিক দুটোয় আলমারি তে রাখা ফাইল টা খুলে আমাকে ফোন করতে ।কারণ ওর মা তখনই রান্না,ঠাকুর পুজো শেষ করে স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস নিতে শুরু করবে। ছেলে কে জড়িয়ে ধরে আদর করে আজ সে বের হলো।ছেলের কিছু টা অস্বাভাবিক মনে হলেই তেমন কিছু বলে নি।

 
তখন বেলা দুটো বেজে 10 বা 15 হবে।ফাইল খুলে মানসী দেখতে পেলো তার উদ্দেশে মৃদুল এর লেখা একটি চিঠি।বিয়ের পর প্রথম প্রথম সৌখিন প্রেম পত্র কয়েক খানা পেয়েছিল বটে আজ হঠাৎ,,,।তাই তাড়াতাড়ি সেটা পড়লে শুরু করলো,,,,,


আমার মানসী।আমি জানি তুমি বাস্তব মুখী।সমস্যার গভীরে গিয়ে তুমি সমাধান খোজ।সেখানে কোনোদিন আবেগ স্থান পায় নি।সেটাই আমার বড়ো ভরসা।তোমাকে জানানো হয় নি।আমার মেডিক্যাল রিপোর্ট। জীবনে প্রথম কিছু তোমাকে গোপন করলাম।আমি যে নিরুপায়।আমায় ক্ষমা করো।কর্কট বাসা বেঁধেছে আমার অন্ত্রে।সঞ্চিত সমস্ত অর্থ  ব্যয় করে হয় তো আয়ু দু বছর বাড়াতে পারি।তার বেশি কোনো ভাবেই হয়।তারপর আমাদের ছেলের কি হবে ? তোমার কি হবে? বেচেঁ থাকার নূন্যতম অর্থই থাকবে না তোমার কাছে।তাই অনেক ভেবে আজ ভোরে সিদ্বান্ত নিতে পারলাম।পরম আনন্দে আমি চললাম মহাপ্রস্থানে।মহা সিন্ধু এর সুর আমি খুজে পেয়েছি। বেচেঁ যাওয়া অর্থ আর পি,এফ এ জমানো টাকা,এল, আই ,সি এর টাকা গুলো একত্রিত করে ওকে একটা ব্যবসা শুরু করতে বলো।হেড মাস্টার কে বলবে আমার পেনশন এর কাজ দ্রুত শেষ করতে।দুঃখ করবে না মোটেই।তুমি তো জানো এ যুগে জীবিত মানুষের চেয়ে মৃত মানুষের দাম বেশি।দেখবে আমি মারা গেলে সহানুভূতির জোয়ারে ছেলের চাকরি হতেও পারে।এই তো সেদিন দেখলে না খবরে মৃত্যুর ক্ষতি পূরণে পরিবারের এক জনের চাকরির খবর।ভালো থেকো।কেমন।ছেলে কে দেখে রেখো।তুমি ছাড়া ওর আর কেউ নেই গো।


চিঠি  খানা পরেই মানসী ছেলে কে চিৎকার করে ডেকে বাইরে বেরিয়ে এলো।অনেক দেরি হয়ে গেছে তখন। ব্লু টুথ স্পিকারে তখন বাজছিল,,' এপারে থাকবে তুমি,,আমি রইবো ওপারে,,।

Comments

Post a Comment