গল্প - দেবাশিস ধর

                      তটিনী ও মানবী


       'এই বান্দরের দল- সর্‌ সর্‌- আমি দুইটা ডুব মাইরা যাই- ইভেনিং ডিউটি আছে'-   কানাইকাকু চিৎকার করলেও ছেলের দল  আদৌ কর্ণপাত করেনা- একদু'জন একটু সরলেও বাকিরা জলে হুটোপাটি করতেই থাকে। ইদানিংকার অন্যদিনের মত আজও কানাইকাকু ফের ধমকে ওঠলে বেআদব মন্টুতো বলেই বসে- 'ইভনিং ডিউটিতো দু'টার থেকে, এখনো অনেক সময় আছে'।   এমনিতেই আজ স্কুল ছুটি- তাই এমন একটা দিনে নদীর জলে স্নানের নামে হৈহুল্লোড়ে কোন খামতি রাখতে চায়না বালকের দল। তাছাড়া আজ এই পাহাড়ী নদী সানঝোরাতে চমৎকার বুক সমান জল আছে, পাহাড়ে দু'দিন বৃষ্টি না হলেইতো আবার জল কোমরের নীচে নেমে যাবে- আর যদি দু'তিন দিন জোর বৃষ্টি হয় তবে জল মাথার উপর দিয়ে বইবে। এদিকে আর কিছুক্ষণ পরেই তো ঘন্টাখানেকের জন্য নদীর লাগোয়া রেলপাড়ার মহিলাদের প্রায়-দখলে চলে যাবে এই জায়গাটা- তার আগেই মনা মন্টুদের অনিচ্ছা সত্বেও কেটে পড়তে হবে- মা'মাসীরা কেউ যে শুধু মুখের ব্যবহারেই থেমে থাকবেনা সেটা সবার ভালোই জানা আছে।       



       নদীর লাগোয়া রেলপাড়ার এই অংশটার সব কোয়ার্টারে জলের লাইন থাকলেও সময় ধরে জল যা আসে তা' অপ্রতুল বলে পাড়ার লোকজন অনেকেই সানঝোরাতেই স্নানের কাজটা সারে। সামর্থ্যবান দু'চারজন অবশ্য নিজেদের ঘরের উঠানেই টিউবওয়েল বসিয়ে নিয়েছে। আমাদের টিউবওয়েল থাকলেও আমি নদীতেই স্নান করি- নদী, মানুষ  আমাকে খুব টানে। আমাকে বাড়িতে কেউ কোন ব্যাপারে মানা করেনা- করার তেমন প্রয়োজনও কখনো অবশ্য হয়নি। আমার মায়ের চোখে আমার হাবভাব, তাকানো, অনুসন্ধিৎসা নাকি আমার সাথে ক্লাস সেভেনে পড়া অন্য ছেলেদের মত একদম নয়। আমার সহজেই কোন কিছুতে অবাক হয়ে অপলক চেয়ে থাকার অভ্যাস- মনে হয় মা সেটাই লক্ষ্য করে থাকবে।        



       মহিলাদের দখলদারির সময়টাতে সাধারণভাবে পুরুষমানুষরা নদীতে স্নান করতে আসাটা পরিহার করলেও কেউ যে আসেনা তা নয়- আসলেও চটপট স্নান সেরে চলে যায় কোনদিকে বিশেষ না তাকিয়ে। আগে কানাইকাকু মর্নিং শিফ্‌টের ডিউটি ছাড়া অন্য দিনগুলোতে প্রায়ই এই সময়টাতে স্নান করতে আসত নদীতে- কানাইকাকুকে নিয়ে মহিলাদের কোন বিশেষ অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ  ছিলো না। কানাইকাকু মানুষটা সোজা সরল- তিনতিনটে  বোনের বিয়ে দিতে গিয়ে ধারদেনায় জর্জরিত কাকুর  বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাওয়ার মুখে। নিজের বিয়ের ব্যাপারে কাকু নির্লিপ্ত থাকলেও পাড়া প্রতিবেশীরা তাদের 'ইতিকর্তব্য' সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন।



       পাড়ার মহিলাদের মধ্যে নেত্রী গোছের সরকার কাকিমা বলে- 'কানাই ঠাকুরপো- অনেক হইছে, এইবার ব্রহ্মচারীগিরি ছাড়েন, বুড়ি মা'টারে আর কত কষ্ট দিবেন-  আমি কই কি শাখাসিন্দুর দিয়াই কোন গরীবের মেয়েরে ঘরে নিয়া আসেন, খরচপত্রের দরকার নাই- তুমি কি কও গো মামণির মা'।  মামণির মা তৎক্ষণাৎ সায় দেয়- 'এই কথা আর কইতে লাগে সরকারদি! বুড়া বয়সে দেখবোটা কে, সেই কথাটাও তো ভাবতে লাগে নাকি'-  তারপর বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করে- 'বুড়া হওয়ার বাকিটা কি আছে'। কানাইকাকু কথাগুলো শুনতে পেল কিনা বোঝা যায়না- মুখে মুচকি হাসি একটা ঝুলিয়ে নদীর জলে আঙ্গুল দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পৈতা পরিস্কার করতে থাকে।  সরকার কাকিমা গলা নামিয়ে পাশে পায়ে সাবান ঘষতে থাকা চন্দনদার মাকে বলে- যুগির বাওনের পৈতার যত্ন বেশী। আরও এক'দুজনের কানে যায় জ্যেঠিমার মন্তব্যটা- একটা চাপা হাসির রোল ওঠে।  কানাইকাকু এসবে কান না দিয়ে জোরে জোরে 'ওঁ গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতী'-  আউড়াতে আউড়াতে জলে উপর্যুপরি ডুব লাগায়।    



     রেলকলোনির ঘটনাবিহীন নিস্তরঙ্গ জীবনে একদিন প্রবল ঢেউ তুলে পবনগতিতে একটা অভাবিতপূর্ব খবর ছেলেবুড়ো সবার কানে সজোরে ধাক্কা মারে-  কানাইকাকু নাকি বিয়ে করেছে- তাই? কবে? কোথায়? কাকে?- কাল সন্ধ্যেবেলায় কালীবাড়িতে কানাইকাকুর কোয়ার্টারে ঠিকা কাজকর্ম করতো যে বিধবা মহিলা তাকে। বলে কি?  মহিলার তো একটা বছর তিন-চারেকের ছেলে আছে, তাই না?    'বুড়া বয়সে ভীমরতি ছাড়া আর কি'- খবরটা শুনে আমার মা বলে। বাবা  মা'র কথাটা শুনতে পেয়েও কিছু বলেনা। আমি বইয়ে পড়েছি বিধবাবিবাহ আইন পাশ করাতে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে কি কঠিন লড়াই করতে হয়েছিল। আমার কাছে তাই কানাইকাকু হীরোর মর্যাদা পায়। বন্ধুদেরও বোঝাবার চেষ্টা করি কেন কানাইকাকুকে আমাদের হীরো ভাবা উচিত। মন্টু, নারুদের অবশ্য এসব নিয়ে বিশেষ মাথাব্যাথা দেখা যায়না- বউভাতের খাওয়াটা ফস্কে যাবে কিনা সেই ব্যাপারেই ওদের বেশি উদ্বেগ  চোখে পড়ে।      



      কানাইকাকু নদীতে স্নান করতে আসার সময় বদল করে- মহিলাদের এড়াতে আগের চেয়ে ঘন্টাখানেক আগেই এসে স্নানকার্য সেরে ফেলে।  মহিলারা কিন্তু কানাইকাকুকে নিয়ে তাদের আলোচনা অব্যাহত রাখে। সরকার কাকিমা বলে- 'আমারতো লোকটাকে তেমন সুবিধার বইলা কোনদিনই মনে হয় নাই- কবের থিকা ভিতরে ভিতরে এইসব চলতেছিল কে জানে'। মামনির মা বলে- 'ব্যাটার বুদ্ধি আছে মানতেই লাগবে- বাছুর শুদ্ধাই আনছে- বিয়া করতে যা লেট করছিল সব মেক-আপ কইরা নিছে'। পাড়ায় নতুন আসা সন্ধ্যার মা জানতে চায়- 'ঐ বেটি দেখতে কেমন'? দাঁতে মিশি ঘষতে ঘষতে সরকার কাকিমা বলে- 'ঠিকা কাম করা ঝিরা যেমন  হয়'।  মামনির মা হেসে ফোড়ন কাটে- 'সন্ধ্যার মা- নিজের চোখে এখন সাজানো বউ দেখবা তার তো উপায় নাই- বউভাত তো হইবনা শুনতাছি- এইবার যখন দশমীর দিন দুর্গাঠাকুররে সিন্দুর পড়াইতে যাইবা তখন লালপাইড় শাড়ী পড়া পাড়ার নুতন বউরে প্রাণ ভইরা দেইখা নিও'। মামনির মায়ের কথাটা বলার ধরণে সন্ধ্যার মা ছাড়া সবাই হেসে কুটিকুটি হয়।



     একরকম পাড়ার লোকজনদের চাপে পড়ে বিয়ের সপ্তাহ দুয়েক পরে কানাইকাকু আবারও  ধারদেনা করেই একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। নিমন্ত্রণ রাখতে আমাদের  বাড়ি  থেকে আমি আর দিদি শুধু যাই-  দিদি বাড়ি ফিরে মা কে জানায় যে বউ বেশ ভালোই  দেখতে। মা শুনে বিরক্তির সুরে বলে- 'খাওয়াইছে কেমন সেইটা বল'। আমার যে মৃদুভাষিণী, শান্ত স্বভাবের কাকিমাকে দেখে আমাদের ছোটনদী সানঝোরার মতই লাগছিল সেকথা  আর মাকে বলাই গেলনা।       



      মন্টু, মনা, নান্টাই, স্বপনরা স্নান করার ভালো জায়গাটা সামান্য সময়ের জন্যও ছাড়তে চাইছেনা দেখে কানাইকাকু অসহায়ভাবে আমার দিকে তাকায়- কাকু আগের থেকেই লক্ষ্য করেছে যে আমার বন্ধুরা আমার কথাই একআধটু শোনে।। আমি তখন নিজের স্নান সেরে নদীর পাড়ে একটা পাথরের উপর বসে সবার স্নানতো নয় হুটোপাটি দেখছি। আমার বন্ধুরা বুঝতে চায়না যে সাঁতার কাটার সময় ওদের পায়ে লাগা জল ছিটকে গায়ে লাগলে পৈতাধারী কানাইকাকু মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারবে না- তাই কাকু ওদের একটু সরতে বলে। আমি বুঝি কাকু বিয়েটা করার পর সামগ্রিকভাবে একটু অসুবিধায় আছে- সবসময় হাসিখুশি থাকা মানুষটা আর তেমন যেন নেই। ছেলেছোকরাও মনে হয় তাই আগের মত কাকুকে পাত্তা দিতে চায়না। আমি বলার পর স্বপন মন্টুরা অনিচ্ছা সত্বেও কাকুকে স্নানের জায়গা ছেড়ে দেয়।  



      কানাইকাকু সত্যিই ঝটপট স্নান সেরে মন্ত্র আউড়াতে আউরাতে জল থেকে পাড়ে উঠে আসে। তক্ষুণি হঠাৎ নান্টাই 'আজকে ইষ্টবেঙ্গল হারবেই হারবে'-  চিৎকার করেই আবার জলে ডুব দেয় সঙ্গে বাকিরাও।  'কে রে? কোন শালা জানোয়ারের বাচ্চা এই কথা কয়'- কানাইকাকু মন্ত্রোচ্চারণ ছেড়ে গালিগালাজ করতে থাকে যাদের উদ্দেশ্যে তারা সাঁতরে ততক্ষণে  অনেক দূরে চলে গেছে।   'আপনি ওদের কথায় একদম কান দেবেন না কাকু, আজ ইষ্টবেঙ্গল মোহনবাগানকে গুনে গুনে চার গোল দেবেই- পরিমল দে হ্যাট্রিক করবে'- কাকু আমার গলায় রাস্তার জ্যোতিষিদের মত প্রবল আত্মবিশ্বাসের সুর শুনে তখনকার মত শান্ত হয়ে বাড়ির পথে হাঁটা ধরে।



       কিন্তু কয়েক পা এগিয়ে গিয়েও আবার ফিরে এসে চোখে প্রবল সন্দেহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে- 'ইষ্টবেঙ্গলের প্লেয়ারদের নাম বলতে পারবি'?  'ক্যাপ্টেন পরিমল দে, গোলে পিটার থঙ্গরাজ, ডিফেন্সে প্রশান্ত সিনহা, শান্ত মিত্র-' আমি গড়গড় করে নামগুলো বলে যাই। কাকুর মুখ দেখে মনে হয় প্লেয়ারদের নাম তো নয় যেন কারও উদাত্ত কন্ঠে পবিত্র বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ   শুনছে। ভালোমানুষ কানাইকাকুর কাছে আমি ইষ্টবেঙ্গলের সমর্থক বনে যাই- যদিও আমি সব বড় দলের প্লেয়ারদেরই নাম ঠিকুজী সব বলে দিতে পারবো আলাদা করে কারও সমর্থক না হয়েই। সেদিন বিকেলের খেলায় কিন্তু  সীতেশ দাসের একমাত্র গোলে মোহনবাগান জিতে যায়।



     পরের রোববার দিন স্নান করতে এসে কানাইকাকু নদীতে শুধু আমাকে পায়- বাকিরা আপাতত হাওয়া।  আমি কাকুকে বলি মনখারাপ না করতে- এরপর শীল্ড আছে, ডুরান্ড আছে, রোভার্স আছে। কানাইকাকু অদ্ভুত ম্লানমুখে শুধু বলে- 'বুঝলা স্নিগ্ধ-  আমি কিন্তু দেখছি লোকের খারাপ কথাগুলিই ফলে বেশি'। পাড়ার ছেলেদের মধ্যে এই প্রথম কাউকে কাকু 'তুমি' করে সম্বোধন করলো বলে আমার আনন্দ হওয়ার বদলে কাকুর কথাগুলোর মধ্যে এক উচ্চারিত অসহায়তা আমার মনটা খারাপ করে দেয়।              



     রেলকলোনির পাশ দিয়ে বয়ে চলা পাহাড়ী নদী এই সানঝোরা- বর্ষার সময়টুকু ছাড়া অন্য সময় স্বল্পস্রোতা- অবশ্য আমাদের এই উত্তরবঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয় এপ্রিল থেকেই আর থামতে থামতে সেই অক্টোবরের শেষ। গত কয়েকদিন ধরেই খুব বৃষ্টি হচ্ছিল- আজ এই লক্ষ্মীপূজার দিনই তো ভোর হওয়ার আগেই পাড়ার লোকজনসব ছুটে এসেছিলো নদীর পাড়ের দিকে- সেকি ভয়ঙ্কর চেহারা আমাদের ছোটনদীর! কালচে ঘোলা জল প্রায় দোতলার সমান উঁচু হয়ে পাশের বড় পিচরাস্তা বরাবর বইছে প্রবল তরঙ্গে গর্জন করতে করতে-  উঁচু এই পিচরাস্তাটা না থাকলে সানঝোরার জলে রাতেই আমাদের রেল কলোনি প্রায় ডুবে যেত। কিছুক্ষণ পরে  শোনা গেলো তিস্তা আর করলা নদীর  জলে জলপাইগুড়ি শহর নাকি একদম ভেসে গেছে- কথাটা কানে যেতেই আমার মা কান্নাকাটি শুরু করে দিলো- ছোটমাসীদের জন্য। বাবা মা'কে বুঝিয়েই চললো- অতসীগো তিনতলা বাড়ি আর  সেইটাও তিস্তার থিকা অনেক দূরে- ঐ বাড়ি ডুবলে জলপাইগুড়িতে কেউ আর-। বাবা কথাটা আর শেষ করেনা- মা'র সাথে দিদিও কান্না জুড়ে দেয়।        



      আমারও কিছু ভালো লাগেনা- আমাদের এই মিষ্টি ছোটনদী সানঝোরার এমন ভয়ঙ্কর, বিধ্বংসী রূপ আমাকে খুব ব্যথিত করে। সানঝোরার ঘোলা জলের তীব্র স্রোতে পলকে ভেসে চলে যায় গাছপালা আরো কত কি- একটা গাছের ডালে দেখা গেল বড় একটা সাপ জড়িয়ে আছে।   বন্ধু নারু  এসে খবর দেয় একটা ছোট চিতাবাঘ সানঝোরার জলে ভেসে এসে রেলের পাম্প হাউসে ঢুকে পড়েছে- সব্বাই দেখতে যাচ্ছে। কিন্তু আমি যেতে অনীহা দেখাই- এই মুহূর্তে সানঝোরার এই অচেনা করাল রূপ আমার ভাবনা এমন আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে  অন্য কোন কিছুতেই আমার আর মন নেই। আমি নিশ্চিত যে নারু পাম্প হাউসের কাছে জড়ো হওয়া আমার অন্য বন্ধুদের বলবে যে ওর হাফপ্যাডেলে চালানো সাইকেলের সামনে বসতে হবে বলে আমি আসতে চাইনি। সানঝোরাকে নিয়ে আমার এই বিষন্নতা শুধু বন্ধুরা কেন অন্য কেউও বুঝে উঠতে পারবেনা।    



       রাস্তার ধারে বড় কদম গাছটায় এখনো অপূর্ব সুন্দর ফুল ধরে আছে। মানুষতো গোলাভরা ধান,  পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা গরু- এসবকেই কামনা করেছে সমৃদ্ধির প্রতীক হিসাবে- কিন্তু জলভরা নদী, ফলভরা বৃক্ষ বা ফুলভরা গাছ কি কারুরই চোখে পড়েনি? নিশ্চয়ই  পড়েছে কিন্তু ভেবে নিয়েছে যে প্রকৃতিতো মায়ের মতো- সন্তানের জন্য সবকিছু সাজিয়ে দেয়াটাই যার স্বাভাবিক ধর্ম, তারজন্য আলাদা করে কিছু বলার বা উল্লেখের প্রয়োজন কোথায়।   আমারও হঠাৎ খেয়াল হয় যে আমিওতো কখনো মা'র কাছে জানতে চাইনি যে মা সকালের জলখাবারটা কখন খেল- আমারতো চোখে পড়েনি। মায়েদেরও যে ক্ষিদে পায়- এই কথাটাই কখনো ভাবনায় আসেনি। মা'কে এক্ষুনি গিয়ে জিজ্ঞেস করবো  সকালের জলখাবারটা খেয়েছে কিনা। না থাক- হঠাৎ আমাকে এই সজল চোখে এমন প্রশ্ন করতে শুনলে মা আবার কাঁদতে  শুরু করবে- জলপাইগুড়ির ছোটমাসিদের জন্য কান্না হয়তো এতক্ষণে একটু সামলে থাকবে। আজকে থাক!     



      সারাবছর তাকাবার ফুরসৎ না হলেও বর্ষার মাসে এই ফুলে ভরা কদম গাছটার দিকে আমি প্রতিদিন অপলক চেয়ে থেকেছি। বছরের নির্দিষ্ট  এক'একটা সময়ে গাছ ফুলে সাজে, ফলে সাজে,    নবপল্লবে  সাজে- কিন্তু প্রকৃতি নদীকে কিভাবে সাজায়? বর্ষায়  দুকুলব্যাপী জলে ভরা নদীর তরঙ্গলহরীই কি তার পল্লবে, পুষ্পে, ফলে ভরা প্রকৃতি-নির্দিষ্ট সাজ? তাই হবে হয়তো- এটাতো নদীর টলমলে পরিপূর্ণতার রূপ।   কিন্তু  সানঝোরার এই ভয়ংকর, উগ্র চেহারা ওর পল্লবিত, পুষ্পিত মরশুমি সাজ বলে আমি মেনে নিই কি করে? এতো রণসাজ!



     আমরা সানঝোরাকে স্বল্পস্রোতা দেখলেও নারুর দাদুর কাছে গল্প শুনেছি বাইশতেইশ বছর  আগেও সানঝোরাতে  ডিঙ্গি নৌকা চলত- রেল কলোনি, উঁচু রাস্তা, ব্রীজ, বাজার, নদীতে  নোংরা জল উগরানো ড্রেন  কিছুই তখন ছিলনা- দেশভাগের পরই এখানে নুতন রেল স্টেশন হয়েছে। মানুষ তার নানান স্বার্থে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে শৃঙ্খলিত করে স্রোতস্বিনীকে ক্ষীণস্রোতা করেছে।  আজ  এমন রণসাজে সেজে সংহারমূর্তি ধরে সানঝোরা কি তার উপর মানুষের নিত্য নিগ্রহের বিরুদ্ধে শেকলভাঙ্গা প্রতিবাদ উদযাপন করছে? তাই হবে!  আমি আর ব্যথিতচিত্ত থাকিনা।          



       কানাইকাকুর সাথে ইদানিং আমার আর তেমন একটা দেখা হয়না-  ক্লাস ইলেভেনের পড়ার চাপ অনেক বেশি- সময় বাঁচাতে নদীতে আমার আর স্নান করতে যাওয়া হয়না। ইষ্টবেঙ্গলে ফিরে এসেও অসীম মৌলিক কেন খেলতেই পারল না বা হাবিবকে কিছুতেই না ছেড়ে বরং সুভাষ ভৌমিককেও মোহনবাগান থেকে নিয়ে আসা যায় কিনা-  এসব চুলচেরা আলোচনা কাকু এখন কার সাথে করে জানিনা। শুনতে পাই কানাইকাকুকে আজকাল পাড়ার লোকজন একরকম পাশ কাটিয়েই চলে। আসল দূরে থাক সুদের টাকাই সময়মত দিতে না পারায় মতি সাহার মত বদ্‌ লোকও নাকি মাঝে একদিন পাড়ার রাস্তায় কাকুকে কলার ধরে শাসিয়ে গেছে। কাকু মতি সাহাদের এড়াতে ঘুরপথ ধরে আসাযাওয়া করা ধরেছে- সুদের অঙ্কও ঘুরপথে বাড়তেই থাকে।   ভদ্রলোকদের পাড়ায় এসব অনভিপ্রেত ঘটনায় পাড়াপড়শিরা বেজায় বিরক্ত।         



       পরশুদিন সন্ধ্যারাতের দিকে রায়স্যারের বাড়ি থেকে ট্যুইশন নিয়ে ফিরছিলাম- হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি কানে আসে। খানিকটা এগিয়ে মনে হল কানাইকাকুর কোয়ার্টারের দিক থেকে আওয়াজটা আসছে- হাতের বইখাতা নিয়েই ছুট লাগালাম। পৌঁছে দেখি মতি সাহা তার পোষা সাগরেদদের নিয়ে কাকুর ঘরের বন্ধ দরজায় ধাক্কাধাক্কি করছে সেই সঙ্গে চলছে অশ্রাব্য গালিগালাজ- সাগরেদদের লব্‌জ, শরীরি ভাষাই বলে দিচ্ছে যে তারা সব নেশাগ্রস্ত। আমি ছাড়া পাড়ার কোন লোক আর সেখানে নেই।  মতি সাহা বন্ধ দরজায় লাথি মেরে বলে- শালা কানাইর বাচ্চা- বউয়ের শাড়ীর তলায় কয়দিন লুকায় থাকবি- তোর বউকে...'।  আমার আর সহ্য হয়না- মতি সাহাকে এক ধাক্কায় দরজা থেকে সরিয়ে দিয়ে আমি চিৎকার করে উঠি- 'এক্ষুনি এখান থেকে চলে যান- নাহলে-'।       'নাহলে? নাহলে কি করবি রে মদন'?-  মুহূর্তে মতি সাহার সাগরেদরা ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার উপর- ঝাপটাঝাপটি হতে থাকে- হাতের বইখাতা সব  ছিটকে পড়ে মাটিতে। কানাইকাকু আমার গলার আওয়াজ শুনে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে হাতজোড় করে আমাকে ছেড়ে দেবার জন্য কাতরভাবে অনুরোধ করতেই থাকে।  সাগরেদরা আমাকে ছেড়ে এবার কাকুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।       



      'খবরদার- তোদের একটাকেও আজ প্রাণ নিয়া ফিরতে দিব না'-  একটা লম্বা কাটারি  হাতে এক নারীমূর্তির তীব্র রণহুঙ্কার আছড়ে পড়ে - 'আসলের কয়েকগুন সুদ দিয়াও যে ধার শোধ হয় নাই বলে সেই সুদের মহাজনটা কই'?- নারীমূর্তি কাটারি কয়েকবার এপাশওপাশ চালনা করতে গেলে কাটারির উল্টোদিকটা সজোরে লাগে দরজার একদম কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা মতি সাহার মাথায়। মতি 'বাপরে' বলে দুহাতে মাথা চেপে ছিটকে বেরিয়ে যায়।  আরক্তনয়না ক্রুদ্ধা  নারীমূর্তি কাটারি শূন্যে চালাতে চালাতে হুঙ্কার দিয়ে পলায়ন-প্রস্তুত সাগরেদদের দিকে এগোয়!    



      কানাইকাকু বিস্ফারিত চোখে অপার বিস্ময়ে চেয়ে থাকে তার ক্ষীণাঙ্গী, শান্ত স্ত্রীর উগ্র  দনুজনাশিনী মূর্তির দিকে ঠিক যেমন করে সেই লক্ষ্মীপুজোর দিন সকালে আমিও অবাক হয়ে অপলক চেয়ে থেকেছিলাম আমার শান্ত ছোটনদী  সানঝোরার  শেকলভাঙ্গা ভয়ঙ্কর বিদ্রোহিণী  রূপের দিকে।

Comments

  1. সুব্রত ভট্টাচার্যJune 23, 2022 at 10:15 PM

    নিম্নবিত্ত পরিবার গুলির জীবনযাত্রার বর্ণনা চমৎকার l শেষে এক প্রতিবাদী মহিলা চরিত্র দেখে ভালো লাগলো l শুভেচ্ছা l আরও নতুন নতুন গল্প আসুক l ভালো থাকুন l

    ReplyDelete

Post a Comment