গল্প - সুস্মিতা নাথ


ভূত ও ভূতুম

 

ভূতুম নামটা রেখেছিল ওর ছোটমামা। মায়ের চাঁপাফুলের মতো গায়ের রঙ নয়, বাবার চাপা রঙটাই ও পেয়েছে বলে মজা করে ছোটমামা এই নামটা রেখেছিল।  এই নামটা তাই ভূতুমের একদম পছন্দ নয়। তবে ওর একটা সুন্দর নামও আছে, কৃষ্ণকলি। স্কুলের দিদিমণি আর বন্ধুরা ওকে কৃষ্ণকলি বলেই ডাকে। কিন্তু বাড়িতে ও শুধুই ভূতুম।   

 

একবার এই নামের জন্যেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। সেবার ওরা দিল্লী বেড়াতে যাচ্ছিল। ওরা বলতে, ভূতুম ও তার মা-বাবা।  দিল্লীতে ওর মাসিরা থাকেন। উদ্দেশ্য মাসির বাড়িতে যাওয়া, এবং সেই সঙ্গে দিল্লী তো বটেই, আগ্রার তাজমহল ও আশেপাশের বিশেষ জায়গাগুলো বেড়িয়ে আসা। রাজধানী এক্সপ্রেসে হাওড়া থেকে উঠেছে সবাই।  ট্রেনে চড়তে ভুতুমের খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে জানলার পাশে বসে বাইরেটা দেখতে দেখতে চলার আনন্দই আলাদা। এখনও তাই জানলার ধারের সিটের দখল নিয়েছে ভূতুম। স্বচ্ছ কাচের  ওপারে মাঠ-ঘাট, গাছ গাছালি, পাহাড়, নদী, আকাশ, মেঘের দল, গ্রাম, শহর --সব যেন ছুটে ছুটে পেছনে চলে যাচ্ছে। সন্ধের আগ পর্যন্ত, যতক্ষণ না কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল সব, ভূতুম তাকিয়েই থাকল ওদিকে।  

 

ভূতুম দেখেছে, ট্রেনের ভিতরে রাত্রি বড় তাড়াতাড়ি নামে। বাড়িতে এগারোটা-বারোটার আগে যারা শুতেই চায় না, ট্রেনে তারাও সাত-তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ে। সাড়ে সাতটার মধ্যেই প্যান্ট্রি থেকে ডিনার বিতরণ শুরু হল। এর আগে বিকেলের টিফিন, স্যুপ ইত্যাদিও জমিয়ে খেয়েছে সবাই। রাত আটটা বাজতে না বাজতেই  খাওয়ার পাটও চুকে গেল ভূতুমদের। তারপরেই অন্য যাত্রীদের মতো ওরাও বিছানা করে শুয়ে পড়ল।  

 

ভূতুম শুয়েছে উপরের বার্থে। ওটাই ওর পছন্দের। নীচের মুখোমুখি দুই বার্থে ওর বাবা ও মা। উপরে ভুতুমের উল্টোদিকে একজন গোমড়ামুখো বয়স্ক সহযাত্রী ঘুমোচ্ছেন। তিনি যতক্ষণ নীচে বসে ছিলেন, তখনও ঘুমিয়েছেন। আবার উপরের বার্থে উঠে শুতে শুতেই নাক ডাকতে শুরু করে  দিয়েছেন। 

 

কামরার ভিতরের জোরালো আলোগুলো নিভে গেছে। ঘুমে ব্যাঘাত ঘটবে বলে যাত্রীরাই নিভিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ভূতুমের চোখে ঘুম নেই। এত তাড়াতাড়ি ওর ঘুম আসে না। ও মাথার কাছের হলুদ আলোটা জ্বেলে ওর ডায়েরি খুলে বসেছে। আজকাল ও নিয়মিত  ডায়েরি লিখছে। রোজনামচা ছাড়াও ওর যাকিছু ভালো লাগছে, সব লিখে রাখছে। কিন্তু আজকে ট্রেনের দুলুনিতে কিছুই ঠিকভাবে লিখতে পারছিল না ও। বরং এতে ঘুম এসে যাচ্ছে। কামরার ভিতর সোরগোলও থেমে গেছে। সবাই সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছে। ভূতুমও ঘুমোতে চেষ্টা করে।  ট্রেনের পু-ঝিকঝিক আর মৃদু কম্পনে দুলে দুলে ঘুম এসেও গেল এক সময়।  

হঠাৎ কীসের একটা শব্দে ওর ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। লাইট জ্বালিয়ে চারপাশটা দেখার চেষ্টা করে ভুতুম। বলা যায় না, আজকাল ট্রেনে প্রায়ই নাকি যাত্রীদের জিনিসপত্র চুরি যাচ্ছে। নীচে ঝুঁকে ও মা ও বাবাকে দেখল। দু’জনেই অকাতরে ঘুমোচ্ছেন। তারপর উল্টোদিকের বার্থে নজর যেতেই ও চমকে ওঠে। আরে! সেই বয়স্ক মানুষটি কোথায় গেলেন! তার বদলে সেখানে ওরই বয়েসী একটি মেয়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। মেয়েটি আবার ভূতুমের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে! ভুতুম কিছু বুঝতে না পেরে  জিজ্ঞাসু চোখে মেয়েটির দিকে তাকাল।  মেয়েটি যেন ওর মনের কথা বুঝে বলে উঠল, -তুমি অবাক হলে তো?  ভাবছ আমি কীকরে এখানে এলাম? আগের যাত্রী কোথায় গেলেন? 

--- হ্যা, তিনি কোথায় গেলেন?  ভূতুম জানতে চায়। 

মেয়েটি বলে, -তিনি আগের স্টেশনে নেমে গেছেন। এখন এটা আমার সিট। আসলে তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেই আমি এই বার্থে এসেছি। 

ভুতুমের বিস্ময় এখনও কাটেনি। ও জিজ্ঞাসা করে, -এই অন্ধকারে কীকরে বুঝলে যে আমি এখানে আছি। তা ছাড়া তুমি তো আমাকে চেনও না। 

--- চিনি না, কিন্তু তোমার নাম জানি। ভূতুম। তোমার নামটা শুনেই বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছে হল।  

ভূতুম এখনও বুঝতে পারছে না, নামের সঙ্গে বন্ধুত্বের কী সম্পর্ক?  ও জিজ্ঞাসা করল, -কীকরে নামটা জানলে?  

--- বারে, শুরু থেকেই তো শুনছি তোমার মা তোমাকে এই নামেই ডাকছেন। 

ভূতুমের এমনিতেই এই নামখানা ঘোর অপছন্দ। ও চায় না মেয়েটিও ওকে এই নামেই ডাকুক। তাই ও বলল, আমার কিন্তু একটা ভালো নামও আছে। কৃষ্ণকলি।  

কিন্তু মেয়েটি বলে উঠল, আমার তো ভূতুম নামটাই পছন্দ। আমি তোমাকে ভূতুম বলেই ডাকব। 

ভূতুম আর কী করে? ওরই যখন নাম, মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী। ও একটু ম্লান হেসে বলল, ঠিক আছে, তাই ডেকো। আর তোমার নাম কী? 

--- আমার নাম? আমার নাম অনুভূতি। মেয়েটি বলল।  

--- অনুভূতি! অদ্ভুত নাম তো! ভূতুম অবাক হয়। 

মেয়েটি বলে, -আমাদের নামগুলো এরকমই হয়। আমার নাম অনুভূতি, আমার বাবার নাম বিভূতি, ঠাকুর্দার নাম অভিভূত, তার বাবার নাম পরাভূত,  তার বাবার নাম প্রভূত, তার বাবার নাম...

--- থাক থাক থাক, আর বলতে হবে না। আমি বুঝে গেছি। ভূতুম ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে।  ‘তোমাদের সবার নামের সঙ্গেই একটা করে ‘ভূত’ আছে তাই তো?’   

--- ঠিক বুঝেছ। সেজন্যেই তোমার ভূতুম নামটা আমার পছন্দ। 

শুনে ভূতুম কী বলবে খুঁজে পেল না। ও কেবল হাসল। দেখাদেখি ওর নতুন বন্ধুও হাসল। তারপরেই একটা কাণ্ড ঘটল। মেয়েটি নিজের বার্থ থেকে যেন হাওয়ায় উড়ে ভূতুমের বার্থে চলে এল। 

দেখে ভূতুমের চোখ ছানাবড়া। সাঙ্ঘাতিক অবাক ও! দুই চোখ গোল্লা পাকিয়ে বলে উঠল, -এ কী! তুমি যেন উড়ে এলে!  

--- আরে না না উড়ব কেন?  আমি লাফিয়ে এলাম। অন্ধকারে তুমি ঠিক বুঝতে পারোনি। 

ভূতুম ভাবে, হবে হয়তো, ওর দেখার ভুল। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞাসা  করে, -তুমি কোত্থেকে এসেছ অনুভূতি?

--- আমি এসেছি ভূত-কাল থেকে। তবে আমাদের শহরের নাম ভূতভুবনপুর। বলল সে। 

শুনে ভূতুম রীতিমতো হাঁ। এমন অদ্ভুত জায়গার নাম ও জীবনেও শোনেনি। বিস্ময়টা প্রকাশ করেই ফেলল ও। বলল, -ভূতকাল, ভূতভুবনপুর! আগে কখনও এমন জায়গার নাম শুনিনি! 

--- তোমার শোনার কথাও নয়। আমরা যারা ওখানে থাকি, শুধু তারাই এর নাম জানি। 

--- অদ্ভুত তো! তা তোমার বাবা বুঝি ওখানে চাকরি করেন? 

--- হ্যা, তা বলতে পারো। আমার বাবা একজন ভূতাত্ত্বিক। ভূতল নিয়ে গবেষণা করছেন। 

অনুভূতির কথাগুলো শুনতে বেশ মজা পাচ্ছে ভূতুম। অবাকও হচ্ছে খুব। ওর সব কথাতেই একটা ভূত ভূত গন্ধ আছে। নিজের নাম, বাবা-দাদুর নাম তো বটেই, জায়গার নাম, বাবার কাজের নাম সব কিছুতেই একটা ‘ভূত’ শব্দ আছেই। তবু মেয়েটিকে বেশ ভালো আগছে ওর। অল্প সময়ের মধ্যেই ওর সঙ্গে গল্পে মেতে উঠল ভূতুম। একবার ও জিজ্ঞাসা করল, -তোমার ইস্কুলে যেতে ভালো লাগে অনুভূতি? 

অনুভূতি মাথা দুলিয়ে জানালো, ভালো লাগে। ভূতুম আবার জিজ্ঞাসা করে, -তোমার কোন বিষয় পড়তে সবচেয়ে বেশি ভালোলাগে?  

অনুভূতি বলে, -ইতিহাস। কেন না ওতে ভূতকালের কথা লেখা থাকে। তা ছাড়া ভূগোলও খারাপ লাগে না। ও থেকে ভূতলস্থ সবকিছুর কথা জানা যায়।  

এবারে ভূতুম আর হাসি চাপতে পারল না। সরবে হেসে উঠল।  তারপর বলল, -তোমার দেখছি সবেতেই একটা ‘ভূত’ থাকতে হয়।  ভীষণ অদ্ভুত। 

অনুভূতিও খিকখিক করে হেসে ফেলল। বলল, -‘ভূত’ ছাড়া জীবনে  আর  আছে কী বলো? আজকের দিনটা কালকেই ভূত, মানে অতীত হয়ে যাবে। তা ছাড়া আমার দাদু বলেন, মানুষের সবকিছু পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। আবার প্রভূত কাল পরে সবকিছুর অভ্যুত্থান হয়। আমরাও উদ্ভুত হই।   

ভুতুম অবাক হয়ে অনুভূতির কথাগুলো শোনে। সব কথা ওর বোধগম্য হচ্ছে না।  ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অনুভূতি বলল, তুমি অবাক হচ্ছ ভুতুম? 

ভুতুম বলল, তা একটু হচ্ছি বটে। তবে তোমাকে আমার খুব ভালো লাগছে। 

অনুভূতি খুশি হল শুনে। বলল, -আমারও তোমাকে ভারী ভালো লাগছে। একটু আগে শুধু ভূত ছিলাম, এখন তোমাকে পেয়ে অভিভূত হয়েছি। 

--- কী বললে? ভূত ছিলে মানে? চমকে উঠে বলল ভূতুম। 

--- এই যাঃ, বেফাস বলে ফেলেছি। বলেই জিব কাটল অনুভূতি। তারপর যোগ করল, -আমাদের ভূতপূর্ব মাস্টারমশাই  বলেছিলেন, নিজেদের সম্পর্কে ভূতার্থ কখনও যেন কাউকে না জানাই। আমি ভুলে ভুলে সেটাই করে ফেললাম। 

ঠিক তখনই ভূতুমের ডাইরির দিকে নজর যেতেই অনুভূতি জিজ্ঞাসা করল, -তুমি ডায়েরি লেখো বুঝি? 

ভূতুম মাথা নেড়ে বলল, -হ্যাঁ।

--- তবে ওতে আমার কথা লিখবে তো?

--- নিশ্চয়ই লিখব। ভূতুম হেসে বলে।

--- খুব ভালো। অনেকদিন পরে, যখন ভূতকালের দিকে ফিরে তাকাবে, তখন ডায়েরি দেখে  এই অদ্ভুত ভূতটাকে মনে করবে।

--- তুমি ভূত কেন হবে, তুমিতো বন্ধু। ভূতুম বলল, 

--- বারে, ভূতুমের ভূতকালের বন্ধু অনুভূতি ভূত নাহলে হবে?

এই বলে অনুভূতি আবার হাসতে থাকে। ভুতুমও কিছু না বুঝেই ওর হাসিতে সঙ্গ দিল। অনুভূতির কথাগুলো খুব মজাদার মনে হয়। এখন ভুতুমের নিজের নামটাও ভালো লাগতে শুরু করেছে। 

  এদিকে অনেক রাত হয়েছে। ভুতুমের ঘুম পেয়ে গেছে। ও অনবরত হাই তুলছে। অনুভূতি বলল, ভূতুম চলো এখন ঘুমিয়ে পড়ি। দু’জনেরই ঘুম পেয়েছে। 

--- তাই ভালো। কাল সকালে আবার কথা হবে। ভূতুম বলে। 

এরপর আলো নিভিয়ে দুজনেই যে যার বার্থে শুয়ে পড়ল। 

 

সকালে যখন ঘুম ভাঙল, উল্টোদিকের বার্থে অনুভূতিকে আর দেখতে পেল না ভূতুম। ওরা কি তবে অন্য স্টেশনে নেমে গেছে? কিন্তু তা-ই বা কীকরে হবে? অনুভূতি তো ওকে তেমন কিছু বলেনি কাল। ওদের গন্তব্য এসে গেলে অনুভূতি নিশ্চয়ই  ওকে জানিয়ে যেত। ভুতুমের মা বাবাও কিছু বলতে পারলেন না। উল্টে ওর মা বললেন, -রাতে এখানে কেউ আসেনি। তুমি হয়ত স্বপ্ন দেখছিলে।

ভূতুম যতই বলে, ও স্বপ্ন দেখেনি, অনুভূতিকে ও জেগেই দেখেছে, ওর সঙ্গে অনেক গল্পও করেছে,  মা বিশ্বাসই করছেন না। তাঁর শুধু একই কথা, --রাতে কোনও নতুন যাত্রী এখানে ওঠেনি। ভূতুম কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। 

মনটা বড় খারাপ লাগছে ভূতুমের। খুব আশ্চর্যও লাগছে। ভূতুমের সঙ্গে যে আর কথা হবে না।  নিদেনপক্ষে দেখাও হবে না। এমন যে হবে ভাবতেই পারেনি ও। অল্প সময়ের আলাপেই বড় ভালো লেগে গিয়েছিল মেয়েটিকে। ও থাকলে গল্প করে বেশ কেটে যেত সময়। কিন্তু এখন কিছুই করার নেই। অগত্যা গতরাতের অর্ধসমাপ্ত ডায়েরিটা সম্পূর্ণ করতে, আর ওতে অনুভূতির কথা লিখে রাখতে ভূতুম ডায়েরিটা বের করল। কিন্তু ওটার পৃষ্ঠা ওল্টাতেই ও চমকে উঠল। এক জায়গায় বড়বড় করে ছোট্ট একটা ছড়া লেখা,  

“ভূতুম, তুমি ভীষণ ভালো  

করি সুখ্যাতি। 

অনেক বড় হবে তুমি, 

বলছি অনুভূতি।” 

ছড়াটা পড়ে ভূতুম যারপরনাই হতবাক। তবে একই সঙ্গে নিশ্চিতও হল যে, আগের রাতের ঘটনা নিছক স্বপ্ন ছিল না। অনুভূতি সত্যিই এসেছিল।

Comments

  1. সুব্রত ভট্টাচার্যMay 26, 2022 at 11:13 PM

    নতুন স্বাদের গল্প, বেশ মজার l যাত্রীর সাথে আলোচনাও চমৎকার l ভালো লাগলো l

    ReplyDelete

Post a Comment